রিপোর্টারের ডায়েরি
অভাবী সন্তানদের স্কুলে একদিন ১২ জুন, মঙ্গলবার। সকালে প্রাত্যহিক কাজ শেষে ঠিক ৯টায় বাসা থেকে বেরিয়ে একটি রিক্সায় রওনা হলাম বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ শহর সংযোগ সড়কের যমুনাপারের ভাঙনকবলিত রামগতির পথে।
ওপেন হার্ট সার্জারির সাড়ে তিন মাস পর বিশেষ কোন রিপোর্টের জন্য এই প্রথম শহরের বাইরে যাচ্ছি। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বারডেম হাসপাতালের ইব্রাহিম কার্ডিয়াক ইউনিটে আমার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। সিরাজগঞ্জের মাটি ও মানুষের প্রিয় সন্তান অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাতের তত্ত্বাবধানে হার্টের বাইপাস অপারেশন করা হয়। মোটরসাইকেল চালানো পুরোপুরি নিষেধ। তাই রিক্সায় রওনা হয়ে অনেকটা নিজের অক্ষমতায় মনে মনে হার মানার যন্ত্রণা নিয়ে পথ চলেছি। মাত্র ৪ মাস আগেও অর্থাৎ জানুয়ারি মাসেও দুরন্ত বালকের মতো ছুটে চলেছি মাঠে মাঠে দিনের পর দিন। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি খবরের পেছনের খবর সংগ্রহের জন্য। তখন মোটরসাইকেল ছিল নিত্যসঙ্গী। অথচ এখন আমি পরাস্ত এক মানুষ। তবে মনের জোর প্রবল। তাই যন্ত্রণা থাকলেও হার মানতে নেই। রিক্সায় যেতে যেতে নিজের অজান্তেই এসব কথা মনের আয়নায় প্রতিচ্ছবির মতো ভেসে ওঠে। সে আরও অনেক দীর্ঘ ইতিহাস। থাক, এসব কথা নিতান্তই ব্যক্তিগত।
সিরাজগঞ্জ শহর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর সংযোগ সড়কপথ দিয়ে মাত্র ৫ কিলোমিটার পথ এগুলোই পূর্ব রামগাতি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মল্লিকা- ছানাউল্লাহ আনছারী উচ্চ বিদ্যালয়। যমুনার উথাল-পাথাল ঢেউয়ে নদী ভাঙ্গা মানুষরা এই পূর্ব রামগাতিতে বসতি গড়েছে। রামগাতিতে যখন পৌঁছলাম তখন ঠিক সকাল ১০টা। একঝাঁক শিশু-কিশোর স্কুল ড্রেস পরে তাদের বিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে কোরআন থেকে তেলাওয়াত, শপথ বাক্য পাঠ এবং জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন শেষে যে যার ক্লাসে ফিরছে। এটি তাদের প্রতিদিনের রুটিন। জানালেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতিকুল ইসলাম।
বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপারে যমুনার তীরে আধুনিক নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত অভাবগ্রস্ত অবহেলিত পরিবারের সন্তানরা এ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কোরআন থেকে তেলাওয়াত, শপথ বাক্য পাঠ এবং জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার শিক্ষা দেয়া হয়। মল্লিকা-ছানাউল্লাহ আনছারী নামের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশুরা অদম্য উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পড়ালেখা করছে। প্রকৃতির প্রতিকূলতার সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা অভাবগ্রস্ত পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া অলীক বিলাস বা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হলেও তা এখন সম্ভব হয়ে উঠেছে। তারা বইপুস্তক, শিক্ষা উপকরণ, এমনকি পোশাক বিনামূল্যে পেয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক এবং উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে অভাবের তাড়নায় ঝরে পড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। পারিবারিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘আনছারী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান এ শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা দিচ্ছে।
২০০৪ সালে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে এর গোড়াপত্তন করা হয়। পায়ে পায়ে এগিয়ে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক স্তরের এসএসসি পরীক্ষা দেবার সুযোগ পায় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত এ শিক্ষার্থীরা শতকরা ৯০ ভাগ উত্তীর্ণ হয়ে নিজেরা আলোকিত হয়েছে এবং পরিবারকেও আলোকিত করেছে। এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার আগে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে ঝরে পড়ত। দূর-বহুদূরে উচ্চ বিদ্যালয়ে যাবার খুব ইচ্ছা হতো না কিংবা আর্থিক দুরবস্থায়, যাতায়াতের সমস্যায় পড়ালেখার পাঠ চুকে যেত। অনেকেই আবার অশিক্ষার কারণে বাল্য বিয়ের পিঁড়িতে বসে অল্প বয়সে সংসারের ঘানি টানতে শুরু করত। এমনই এক পরিস্থিতিতে ২০০৪ সালে সিরাজগঞ্জের মাটি ও মানুষের প্রিয় সন্তান অধ্যাপক এমএইচ মিল্লাত প্রবাসে বসে যমুনাপারের এ অভাবগ্রস্ত এলাকায় ঝরে পড়া শিশুদের পড়ালেখার সুবিধা দিতে প্রথমে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় চালু করেন। তাঁর মরহুম পিতা ছানাউল্লাহ আনছারীর নামানুসারে পারিবারিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আনছারি ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এ বিদ্যালয় পরিচালিত হয়ে আসছে। পরবর্তীতে এটি উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক এমএইচ মিল্লাত জনকণ্ঠকে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানান, যমুনাপারের সুবিধাবঞ্চিত অবহেলিত শিশুদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে এ প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ পারিবারিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আনছারী ফাউন্ডেশন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছে। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পোশাক, শিক্ষা উপকরণ এবং শিক্ষকসহ স্টাফ বেতন আনছারী ফাউন্ডেশন থেকে প্রদান করা হয়। শাবাশ বীর বাঙালী, শাবাশ। এমন মহতী উদ্যোগে শামিল হতে আরও কোন মহৎ ব্যক্তি এগিয়ে আসবেন, সমাজকে আলোকিত করবেন এমন প্রত্যাশা সিরাজগঞ্জবাসীর।
প্রায় আধাবেলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোরদের মধ্যে সময় কাটিয়ে আবারও রিক্সায় ফিরে এলাম শহরে, নিজের অফিসে। আসার পথে মনের মধ্যে উদয় হলো অধ্যাপক হাবিবে মিল্লাতের সিরাজগঞ্জের মানবসম্পদকে কাজে লাগানোর নানা উদ্যোগের কথা।
বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ
ব্রাজিলের অর্থনৈতিক উন্নতি
১৯ জুন, মঙ্গলবার। দুবাই থেকে সকাল সাড়ে ৭টায় আমাদের নিয়ে উড়োজাহাজ রওনা হলো। দীর্ঘ জার্নি। তাই উড়োজাহাজটিও বেশ বড়। যাত্রীও বোঝাই। বিমানে ওঠার সময় পরিচয় হলো পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান বিএসএসের সাংবাদিক কামরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলের সঙ্গে। সে ঢাকার কলাস্টিকার ছাত্র। যুব প্রতিনিধি হিসাবে রিও যাচ্ছে। পরিচয়পর্বের পর তাকে বললাম, তোমার মা এক সময় আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে শিক্ষা সাগর পাতা দেখতেন। সে সঙ্গে সঙ্গেই তার মাকে মোবাইলে ফোন করল। তার মা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। কুশল বিনিময়ের পর বললেন, ছেলে একা যাচ্ছে, ফলে খুব টেনশনে আছেন। বললাম, আমরা সঙ্গে আছি। কোন চিন্তা করবেন না। তিনি আমার কথায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন।
বিমানে ওঠার সময় এক চীনা ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলো। ভেবেছিলাম তিনিও রিও সম্মেলনে যাচ্ছেন। তিনি জানালেন, তিনি ব্যবসার কাজে রিও যাচ্ছেন। চীনারা এখন ব্রাজিলের সঙ্গে ব্যবসায় ঝুঁকছে। আমাদেরও ওখানে একটি বড় বাজার আছে। বিশেষ করে আমাদের তৈরি পোশাকের একটি সম্ভাবনাময় বাজার রয়েছে ব্রাজিলে। সেটাকে আমরা খুব একটা কাজে লাগাতে পারছি না। তবে আমাদের তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধি দল লাতিন আমেরিকার দেশগুলো সফর করেছে। ফলে ওখানে আস্তে আস্তে আমাদের তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ছে।
রিওতে যাওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে ব্রাজিলের অর্থনীতি। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে ইকোনমিক ও বিজনেস রিপোর্টিং করার কারণে চারটি দেশ আমার দেখার খুব ইচ্ছে। এ দেশগুলো হলো ব্রাজিল, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এ দেশগুলো এখন বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ। তারা নিজেরাও একটি জোট গঠন করেছে, যা বিআইসিএস (বিকস) নামে পরিচিত। কিভাবে তারা উন্নতি করছে এটা দেখার একটি কৌতূহল আছে। এছাড়া ব্রাজিল দেখার আরও একটি উদ্দেশ্য হলো এটি ফুটবলের দেশ। দেশটির ছেলেদের ধ্যানজ্ঞান সবই ফুটবল নিয়ে। পেলের মতো কিংবদন্তি ফুটবলার জন্ম নিয়েছে এ দেশটিতে।
ব্রাজিলের অর্থনীতি দেখে বেশ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। যেমন দেশ, অর্থনীতির আকারও তেমন। দেশটির আয়তন প্রায় ৮৫ লাখ ১১ হাজার ৯৬৫ বর্গকিলোমিটার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সামান্য ছোট। অবশ্য ম্যাপে দেখলে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বড়। আর এর অর্থনীতির (জিডিপি) আকার হচ্ছে দুই দশমিক ৫০ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ১২ হাজার মার্কিন ডলারেরও বেশি। প্রতিবছর বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণই হচ্ছে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্বিগুণ। অর্থাৎ আমাদের রিজার্ভের দ্বিগুণ অর্থ তারা প্রতিবছর বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হিসাবেই পায়। ফলে মুদ্রা রিয়েইজও খুব শক্তিশালী। এক ডলারের বিনিময়ে মাত্র দুই রিয়েইজ পাওয়া যায়। চিন্তা করুন বাংলাদেশের মুদ্রার সঙ্গে কি অবস্থা দাঁড়ায়। ব্রাজিলের এক টাকা সমান বাংলাদেশের ৪০ টাকা। অর্থাৎ ব্রাজিলে তাদের মুদ্রায় কোন কিছু কিনতে গেলে তাকে ৪০ দিয়ে গুণ করতে হয়। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাও শক্তিশালী হচ্ছে।
উন্নত দেশগুলোর মতো ব্রাজিলের অর্থনীতিতেও সেবা খাতের দাপট বেশি। জিডিপির ৬৬ শতাংশই আয় এ সেবা খাত থেকে। অর্থাৎ সে দেশে সব সেবাই অর্থের বিনিময়ে নিতে হয়। এ কারণেই দেশটিতে সবকিছুই ব্যয়বহুল।
সেবা খাতের পরেই শিল্প খাতের অবস্থান। শিল্প খাত থেকে আসে জিডিপির ২৮ শতাংশ। এরপরেই প্রাকৃতিক সম্পদের অবস্থান। প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে আয় হয় মোট জিডিপির ১৪ শতাংশ। জিডিপিতে সবার নিচে কৃষি খাতের অবস্থান। এ খাত থেকে আসে মাত্র ছয় শতাংশ। যদিও ব্রাজিল হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সয়াবিন, কফি ও আখ উৎপাদনকারী দেশ। এর মধ্যে আখ, কফি, গ্রীষ্মম-লীয় ফল ও হিমায়িত কমলার জুস তৈরিতে ব্রাজিল বর্তমানে বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গবাদিপশুর মাংসও ব্রাজিলেই হয়। আর সয়াবিন উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ব্রাজিলের অবস্থান।
বর্তমানে ব্রাজিল থেকে সয়াবিন তেল আসে আমাদের দেশে। এক সময় প্রচুর চিনি আমদানি হতো।
ব্রাজিলের শিল্পের মধ্যে অন্যতম হলো স্টিল, বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ, কেমিক্যালস, পেট্রোকেমিক্যালস, মেশিনারি, গাড়ি, গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রভৃতি। ব্রাজিলের নিজস্ব লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল, ইউরেনিয়াম, তেল, কাঠ ও এ্যালুমিনিয়াম খনি আছে। তাদের কাঠের বড় উৎস হলো বিশ্বের বৃহত্তম নাতিশীতোষ্ণ রেইনফরেস্ট আমাজান বন। ব্রাজিল এখন শিল্পের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মিস রওসেফের অর্থনৈতিক নীতিই হচ্ছে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন। আর দেশটির দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের নিয়ামক হচ্ছে রফতানি। ব্রাজিল তার পণ্যের রফতানি বাড়াতে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করছে। এজন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্যে যাচ্ছে। উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে ও আর্জেন্টিনাকে নিয়ে ব্রাজিলের একটি বাণিজ্যিক জোট আছে। এটি মূলত একটি কাস্টমস ইউনিয়ন। স্প্যানিশ ভাষায় যাকে ‘মার্কোসোল’ বলা হয়। এ জোট একের পর এক দেশ ও অর্থনৈতিক ব্লকের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা ইসরাইল ও মিসরের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। দেশটি এখন মেক্সিকো, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ম্ক্তুবাণিজ্য চুক্তির আলোচনা করছে। চীনের সঙ্গেও তারা বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছে। অথচ আমরা সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গেই মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে এক কদম আগাচ্ছি তো, সাত কদম পিছাচ্ছি। এত ভাবাভাবি করলে উন্নতি করা যায় না। সারা দুনিয়া এখন মুক্তবাণিজ্যের দিকে ছুটছে। আর আমরা ঘরে বসে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছি। বাস যখন ছেড়ে চলে যাবে, তখন হয়ত আমরা জেগে উঠব। এমন করে আমরা উন্নয়নের অনেক বাসই মিস করেছি।
ব্রাজিলের অর্থনীতি সারাবিশ্বকে সবচেয়ে বেশি তাক লাগিয়েছে ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়। বৈশ্বিক মন্দায় যখন সব দেশ নাজুক অবস্থায়, তখন ব্রাজিলের অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থায় থেকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশটি ২০১০ সালেও সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এত বড় অর্থনীতি নিয়ে এত উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়। সেই কারণেই ব্রাজিলের অর্থনীতি আঞ্চলিক শক্তি থেকে বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ব্রাজিলের অর্থনীতি বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম অর্থনীতি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই তারা পঞ্চম অবস্থানে চলে আসবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলার অর্থনৈতিক নেতৃত্ব। তাঁর অর্থনৈতিক নেতৃত্বের কারণে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে। বেকারত্বের হার একেবারেই নিম্নপর্যায়ে নেমে এসেছে। এই প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের সিংহভাগ মানুষ মধ্যবিত্তের আওতায় চলে এসেছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে গিয়ে ব্রাজিলের প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডিলমা রওসেফও তাঁর পূর্বসূরির অর্থনৈতিক নীতিই অনুসরণ করে চলেছেন।
আমাদের মতো ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কম। এ কারণে তারা বিদেশী বিনিয়োগের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে নানা সুবিধা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বিনোদনের নানা পশ্চিমা সুযোগ। সেক্স ফ্রি দেশ হওয়ায় এ সুযোগগুলো তারা বেশি দিতে পারছে বলে লাতিন আমেরিকার মধ্যে ব্রাজিলে বিদেশী বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। আর বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল এবং ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিককে কেন্দ্র করে সে দেশটিতে এখন প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে।
-কাওসার রহমান
সিরাজগঞ্জ শহর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর সংযোগ সড়কপথ দিয়ে মাত্র ৫ কিলোমিটার পথ এগুলোই পূর্ব রামগাতি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মল্লিকা- ছানাউল্লাহ আনছারী উচ্চ বিদ্যালয়। যমুনার উথাল-পাথাল ঢেউয়ে নদী ভাঙ্গা মানুষরা এই পূর্ব রামগাতিতে বসতি গড়েছে। রামগাতিতে যখন পৌঁছলাম তখন ঠিক সকাল ১০টা। একঝাঁক শিশু-কিশোর স্কুল ড্রেস পরে তাদের বিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে কোরআন থেকে তেলাওয়াত, শপথ বাক্য পাঠ এবং জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন শেষে যে যার ক্লাসে ফিরছে। এটি তাদের প্রতিদিনের রুটিন। জানালেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতিকুল ইসলাম।
বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপারে যমুনার তীরে আধুনিক নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত অভাবগ্রস্ত অবহেলিত পরিবারের সন্তানরা এ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কোরআন থেকে তেলাওয়াত, শপথ বাক্য পাঠ এবং জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার শিক্ষা দেয়া হয়। মল্লিকা-ছানাউল্লাহ আনছারী নামের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশুরা অদম্য উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পড়ালেখা করছে। প্রকৃতির প্রতিকূলতার সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা অভাবগ্রস্ত পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া অলীক বিলাস বা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হলেও তা এখন সম্ভব হয়ে উঠেছে। তারা বইপুস্তক, শিক্ষা উপকরণ, এমনকি পোশাক বিনামূল্যে পেয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক এবং উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে অভাবের তাড়নায় ঝরে পড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। পারিবারিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘আনছারী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান এ শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা দিচ্ছে।
২০০৪ সালে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে এর গোড়াপত্তন করা হয়। পায়ে পায়ে এগিয়ে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক স্তরের এসএসসি পরীক্ষা দেবার সুযোগ পায় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত এ শিক্ষার্থীরা শতকরা ৯০ ভাগ উত্তীর্ণ হয়ে নিজেরা আলোকিত হয়েছে এবং পরিবারকেও আলোকিত করেছে। এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার আগে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে ঝরে পড়ত। দূর-বহুদূরে উচ্চ বিদ্যালয়ে যাবার খুব ইচ্ছা হতো না কিংবা আর্থিক দুরবস্থায়, যাতায়াতের সমস্যায় পড়ালেখার পাঠ চুকে যেত। অনেকেই আবার অশিক্ষার কারণে বাল্য বিয়ের পিঁড়িতে বসে অল্প বয়সে সংসারের ঘানি টানতে শুরু করত। এমনই এক পরিস্থিতিতে ২০০৪ সালে সিরাজগঞ্জের মাটি ও মানুষের প্রিয় সন্তান অধ্যাপক এমএইচ মিল্লাত প্রবাসে বসে যমুনাপারের এ অভাবগ্রস্ত এলাকায় ঝরে পড়া শিশুদের পড়ালেখার সুবিধা দিতে প্রথমে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় চালু করেন। তাঁর মরহুম পিতা ছানাউল্লাহ আনছারীর নামানুসারে পারিবারিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আনছারি ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এ বিদ্যালয় পরিচালিত হয়ে আসছে। পরবর্তীতে এটি উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক এমএইচ মিল্লাত জনকণ্ঠকে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানান, যমুনাপারের সুবিধাবঞ্চিত অবহেলিত শিশুদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে এ প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ পারিবারিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আনছারী ফাউন্ডেশন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছে। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পোশাক, শিক্ষা উপকরণ এবং শিক্ষকসহ স্টাফ বেতন আনছারী ফাউন্ডেশন থেকে প্রদান করা হয়। শাবাশ বীর বাঙালী, শাবাশ। এমন মহতী উদ্যোগে শামিল হতে আরও কোন মহৎ ব্যক্তি এগিয়ে আসবেন, সমাজকে আলোকিত করবেন এমন প্রত্যাশা সিরাজগঞ্জবাসীর।
প্রায় আধাবেলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোরদের মধ্যে সময় কাটিয়ে আবারও রিক্সায় ফিরে এলাম শহরে, নিজের অফিসে। আসার পথে মনের মধ্যে উদয় হলো অধ্যাপক হাবিবে মিল্লাতের সিরাজগঞ্জের মানবসম্পদকে কাজে লাগানোর নানা উদ্যোগের কথা।
বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ
ব্রাজিলের অর্থনৈতিক উন্নতি
১৯ জুন, মঙ্গলবার। দুবাই থেকে সকাল সাড়ে ৭টায় আমাদের নিয়ে উড়োজাহাজ রওনা হলো। দীর্ঘ জার্নি। তাই উড়োজাহাজটিও বেশ বড়। যাত্রীও বোঝাই। বিমানে ওঠার সময় পরিচয় হলো পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান বিএসএসের সাংবাদিক কামরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলের সঙ্গে। সে ঢাকার কলাস্টিকার ছাত্র। যুব প্রতিনিধি হিসাবে রিও যাচ্ছে। পরিচয়পর্বের পর তাকে বললাম, তোমার মা এক সময় আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে শিক্ষা সাগর পাতা দেখতেন। সে সঙ্গে সঙ্গেই তার মাকে মোবাইলে ফোন করল। তার মা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। কুশল বিনিময়ের পর বললেন, ছেলে একা যাচ্ছে, ফলে খুব টেনশনে আছেন। বললাম, আমরা সঙ্গে আছি। কোন চিন্তা করবেন না। তিনি আমার কথায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন।
বিমানে ওঠার সময় এক চীনা ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলো। ভেবেছিলাম তিনিও রিও সম্মেলনে যাচ্ছেন। তিনি জানালেন, তিনি ব্যবসার কাজে রিও যাচ্ছেন। চীনারা এখন ব্রাজিলের সঙ্গে ব্যবসায় ঝুঁকছে। আমাদেরও ওখানে একটি বড় বাজার আছে। বিশেষ করে আমাদের তৈরি পোশাকের একটি সম্ভাবনাময় বাজার রয়েছে ব্রাজিলে। সেটাকে আমরা খুব একটা কাজে লাগাতে পারছি না। তবে আমাদের তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধি দল লাতিন আমেরিকার দেশগুলো সফর করেছে। ফলে ওখানে আস্তে আস্তে আমাদের তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ছে।
রিওতে যাওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে ব্রাজিলের অর্থনীতি। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে ইকোনমিক ও বিজনেস রিপোর্টিং করার কারণে চারটি দেশ আমার দেখার খুব ইচ্ছে। এ দেশগুলো হলো ব্রাজিল, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এ দেশগুলো এখন বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ। তারা নিজেরাও একটি জোট গঠন করেছে, যা বিআইসিএস (বিকস) নামে পরিচিত। কিভাবে তারা উন্নতি করছে এটা দেখার একটি কৌতূহল আছে। এছাড়া ব্রাজিল দেখার আরও একটি উদ্দেশ্য হলো এটি ফুটবলের দেশ। দেশটির ছেলেদের ধ্যানজ্ঞান সবই ফুটবল নিয়ে। পেলের মতো কিংবদন্তি ফুটবলার জন্ম নিয়েছে এ দেশটিতে।
ব্রাজিলের অর্থনীতি দেখে বেশ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। যেমন দেশ, অর্থনীতির আকারও তেমন। দেশটির আয়তন প্রায় ৮৫ লাখ ১১ হাজার ৯৬৫ বর্গকিলোমিটার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সামান্য ছোট। অবশ্য ম্যাপে দেখলে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বড়। আর এর অর্থনীতির (জিডিপি) আকার হচ্ছে দুই দশমিক ৫০ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ১২ হাজার মার্কিন ডলারেরও বেশি। প্রতিবছর বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণই হচ্ছে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্বিগুণ। অর্থাৎ আমাদের রিজার্ভের দ্বিগুণ অর্থ তারা প্রতিবছর বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হিসাবেই পায়। ফলে মুদ্রা রিয়েইজও খুব শক্তিশালী। এক ডলারের বিনিময়ে মাত্র দুই রিয়েইজ পাওয়া যায়। চিন্তা করুন বাংলাদেশের মুদ্রার সঙ্গে কি অবস্থা দাঁড়ায়। ব্রাজিলের এক টাকা সমান বাংলাদেশের ৪০ টাকা। অর্থাৎ ব্রাজিলে তাদের মুদ্রায় কোন কিছু কিনতে গেলে তাকে ৪০ দিয়ে গুণ করতে হয়। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাও শক্তিশালী হচ্ছে।
উন্নত দেশগুলোর মতো ব্রাজিলের অর্থনীতিতেও সেবা খাতের দাপট বেশি। জিডিপির ৬৬ শতাংশই আয় এ সেবা খাত থেকে। অর্থাৎ সে দেশে সব সেবাই অর্থের বিনিময়ে নিতে হয়। এ কারণেই দেশটিতে সবকিছুই ব্যয়বহুল।
সেবা খাতের পরেই শিল্প খাতের অবস্থান। শিল্প খাত থেকে আসে জিডিপির ২৮ শতাংশ। এরপরেই প্রাকৃতিক সম্পদের অবস্থান। প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে আয় হয় মোট জিডিপির ১৪ শতাংশ। জিডিপিতে সবার নিচে কৃষি খাতের অবস্থান। এ খাত থেকে আসে মাত্র ছয় শতাংশ। যদিও ব্রাজিল হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সয়াবিন, কফি ও আখ উৎপাদনকারী দেশ। এর মধ্যে আখ, কফি, গ্রীষ্মম-লীয় ফল ও হিমায়িত কমলার জুস তৈরিতে ব্রাজিল বর্তমানে বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গবাদিপশুর মাংসও ব্রাজিলেই হয়। আর সয়াবিন উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ব্রাজিলের অবস্থান।
বর্তমানে ব্রাজিল থেকে সয়াবিন তেল আসে আমাদের দেশে। এক সময় প্রচুর চিনি আমদানি হতো।
ব্রাজিলের শিল্পের মধ্যে অন্যতম হলো স্টিল, বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ, কেমিক্যালস, পেট্রোকেমিক্যালস, মেশিনারি, গাড়ি, গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রভৃতি। ব্রাজিলের নিজস্ব লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল, ইউরেনিয়াম, তেল, কাঠ ও এ্যালুমিনিয়াম খনি আছে। তাদের কাঠের বড় উৎস হলো বিশ্বের বৃহত্তম নাতিশীতোষ্ণ রেইনফরেস্ট আমাজান বন। ব্রাজিল এখন শিল্পের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মিস রওসেফের অর্থনৈতিক নীতিই হচ্ছে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন। আর দেশটির দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের নিয়ামক হচ্ছে রফতানি। ব্রাজিল তার পণ্যের রফতানি বাড়াতে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করছে। এজন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্যে যাচ্ছে। উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে ও আর্জেন্টিনাকে নিয়ে ব্রাজিলের একটি বাণিজ্যিক জোট আছে। এটি মূলত একটি কাস্টমস ইউনিয়ন। স্প্যানিশ ভাষায় যাকে ‘মার্কোসোল’ বলা হয়। এ জোট একের পর এক দেশ ও অর্থনৈতিক ব্লকের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা ইসরাইল ও মিসরের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। দেশটি এখন মেক্সিকো, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ম্ক্তুবাণিজ্য চুক্তির আলোচনা করছে। চীনের সঙ্গেও তারা বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছে। অথচ আমরা সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গেই মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে এক কদম আগাচ্ছি তো, সাত কদম পিছাচ্ছি। এত ভাবাভাবি করলে উন্নতি করা যায় না। সারা দুনিয়া এখন মুক্তবাণিজ্যের দিকে ছুটছে। আর আমরা ঘরে বসে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছি। বাস যখন ছেড়ে চলে যাবে, তখন হয়ত আমরা জেগে উঠব। এমন করে আমরা উন্নয়নের অনেক বাসই মিস করেছি।
ব্রাজিলের অর্থনীতি সারাবিশ্বকে সবচেয়ে বেশি তাক লাগিয়েছে ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়। বৈশ্বিক মন্দায় যখন সব দেশ নাজুক অবস্থায়, তখন ব্রাজিলের অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থায় থেকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশটি ২০১০ সালেও সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এত বড় অর্থনীতি নিয়ে এত উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়। সেই কারণেই ব্রাজিলের অর্থনীতি আঞ্চলিক শক্তি থেকে বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ব্রাজিলের অর্থনীতি বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম অর্থনীতি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই তারা পঞ্চম অবস্থানে চলে আসবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলার অর্থনৈতিক নেতৃত্ব। তাঁর অর্থনৈতিক নেতৃত্বের কারণে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে। বেকারত্বের হার একেবারেই নিম্নপর্যায়ে নেমে এসেছে। এই প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের সিংহভাগ মানুষ মধ্যবিত্তের আওতায় চলে এসেছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে গিয়ে ব্রাজিলের প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডিলমা রওসেফও তাঁর পূর্বসূরির অর্থনৈতিক নীতিই অনুসরণ করে চলেছেন।
আমাদের মতো ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কম। এ কারণে তারা বিদেশী বিনিয়োগের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে নানা সুবিধা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বিনোদনের নানা পশ্চিমা সুযোগ। সেক্স ফ্রি দেশ হওয়ায় এ সুযোগগুলো তারা বেশি দিতে পারছে বলে লাতিন আমেরিকার মধ্যে ব্রাজিলে বিদেশী বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। আর বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল এবং ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিককে কেন্দ্র করে সে দেশটিতে এখন প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে।
-কাওসার রহমান
No comments