আধুনিক স্থাপত্যের পুরোধা মাজহারুল ইসলামের প্রয়াণ
চলে গেলেন বাংলাদেশের স্থাপত্যকলায় আধুনিকতা রূপায়ণের পথিকৃৎ স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যকলার জনক হিসেবে পরিচিত মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের এই কর্মী শনিবার মধ্যরাতে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে রাত ১২টা ৭ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। জীবনের পথ পরিভ্রমণে ৮৯ বছর বয়সে শেষ হয় দেশের আধুনিক স্থাপত্যকলার এই রূপকারের পথচলা। তিনি স্ত্রী হোসনে আরা ইসলাম, দুই ছেলে রফিক মাজহার ইসলাম ও তানভীর ইসলাম তান্না এবং এক মেয়ে ডালিয়া নওশীনসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশের শিল্প-সংস্কৃতি ও নাগরিক সমাজে নেমে আসে শোকের ছায়া। মাজহারুল ইসলামের মৃত্যুতে পৃথক বাণীতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদসহ দেশের সুশীল সমাজ ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
শনিবার রাতে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের মরদেহ ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমাগারে ছিল। রবিবার বেলা ১২টায় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ আনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায়। এখানে ঘণ্টাব্যাপী চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয় মরদেহ। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এখানে বাদ জোহর প্রথম জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গুলশানের নিজ বাসভবনে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর পর বাদ আছর গুলশান আজাদ মসজিদে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা হয়। মাজহারুল ইসলামের পুত্রবধূ তাবাসসুম ইসলাম জানান, সন্ধ্যায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আগামী শুক্রবার কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে। মাজহারুল ইসলামের ছোট ছেলে তানভীর ইসলাম তান্না বলেন, বাবা বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে গত ৩১ মে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। এর পর থেকে তিনি একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার মধ্যরাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চারুকলায় শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ রবিবার বেলা বারোটায় চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শুরু হয় তাঁর শেষ শ্রদ্ধানুষ্ঠান। তাঁর মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানান কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এবি তাজুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। সাংস্কৃতিক ও শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান কামাল লোহানী, শিল্পী হাশেম খান, আবুল বারক্ আলভী, জামাল আহমেদ, ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান, মনিরুজ্জামান, শিশির ভট্টাচার্য, রবিউল হুসাইনসহ অনেকে। এ ছাড়াও ঢাকা ক্লাব, ছায়ানট, চারুকলা ইনস্টিটিউট, গণঐক্য কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়। দেশের আধুনিক স্থাপত্যকলার এই প্রাণপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘স্থপতি মাজহারুল ইসলাম বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন আমাদের অগ্রদূত। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের একজন মানুষ ছিলেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাপারেও বঙ্গবন্ধু তাঁর পরামর্শ নিতেন। তাঁর চলে যাওয়া রাষ্ট্রের একটি অপূরণীয় ক্ষতি।’
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, ‘তিন দশকের সাহসী সঙ্গী মাজহারুল ইসলামকে আজ হারালাম। তাঁকে দেশের স্থাপত্যশিল্পের গুরু বললে ভুল হয় না। তিনি শুধু একজন স্থপতি নন, সমাজ বিনির্মাণে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। তার শূন্যস্থান কখনও পূর্ণ হবে না। তিনি আগেও আমাদের পথ দেখিয়েছেন, মৃত্যুর পরও পথ দেখাবেন।’
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘তার চলে যাওয়াতে বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পে একটি যুগের অবসান হলো। সারা বিশ্বে এ দেশের স্থাপত্যশিল্পকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আজ যেখানে তাঁর মরদেহ আনা হয়েছে, তারও স্থপতি ছিলেন তিনি। আজকে যাঁরা বড় স্থপতি তাঁদের জন্য অনুসরণীয় মাজহারুল ইসলাম। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই তিনি শিক্ষক ছিলেন।’
মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘মাজহারুল ইসলাম ছিলেন জাতির এক অন্যতম পথপ্রদর্শক। তাঁর চলে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়।’
জীবনপঞ্জি ॥ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ছিলেন ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের প্রথম সভাপতি। স্থাপত্যকলার বাইরেও একজন সমাজসচেতন নাগরিক হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সক্রিয় ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল স্থাপত্য নকশা, জাতীয় গণগ্রন্থাগার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ও লাইব্রেরী ভবন, রাঙ্গামাটি শহর পরিকল্পনাসহ দেশের অধিকাংশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নকশাবিদ তিনি।
ব্রিটিশ ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে নানার বাড়িতে ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মাজহারুল ইসলাম। সে সময় বাবা ওমদাতুল ইসলাম ছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজের অঙ্কের শিক্ষক। কৃষ্ণনগর কলেজ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর বাবার বদলির সুবাদে রাজশাহীতে যান। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজ থেকে যথাক্রমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঐ কলেজ থেকেই পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতক পাস করেন। এর পর শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে প্রকৌশল বিদ্যা পড়া শেষ করেন ১৯৪৬ সালে। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে সরকারী চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৫০ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যের পাঠ শেষে আড়াই বছর পর দেশে ফেরেন। দেশে ফিরে একনাগাড়ে ছয় মাসের পরিশ্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট ও লাইব্রেরী ভবনের স্থাপত্য নকশা করেন।
এরপর ১৯৫৬ সালে বৃত্তি নিয়ে তিনি ট্রপিক্যাল আর্কিটেকচার পড়তে লন্ডনের এ এ স্কুল অব আর্কিটেকচারে যান। ১৯৬০ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে পল রুডল্ফের অধীনে মাস্টার্স করেন। সেখান থেকে ১৯৬১ সালের শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কনস্ট্রাকশন, বিল্ডিং এ্যান্ড ইরিগেশন বিভাগে। মতের মিল না হওয়ায় ১৯৬৪ সালে সরকারী চাকরী ছেড়ে প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে ‘বাস্তুকলাবিদ’ নামে একটি স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়Ñ বুয়েটে স্থাপত্য অনুষদ চালু করার ক্ষেত্রেও তিনি রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। এখানে তিনি খ-কালীন শিক্ষকতাও করেন।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জীবন দর্শন ছিল একইসঙ্গে একজন বাঙালী ও একজন শাশ্বত বিশ্বমানব হয়ে ওঠা। এই দর্শন থেকেই বাংলাদেশের স্থাপত্যকলার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন তৈরির চেষ্টা করে গেছেন আমৃত্যু। তিনি জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা তৈরির দায়িত্ব পেলেও নিজ আগ্রহেই বিশ্বখ্যাত স্থপতি ও তাঁর শিক্ষক লুই কানকে নকশা করার আহ্বান জানান। শুধু লুই কানই নন, তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশে ঘুরে গেছেন স্ট্যানলি টাইগারম্যান ও পল রুডলফের মতো বিশ্বখ্যাত স্থপতিরা।
মাজহারুল ইসলামের নকশায় নির্মিত উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছেÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট, লাইব্রেরী ভবন, ঢাকার খিলগাঁও রেলওয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প, নতুন রাঙ্গামাটি শহর পরিকল্পনা, আজিমপুরে চতুথ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য আবাসন প্রকল্প, ঢাকার বিসিএসআইআর লাইব্রেরী ভবন, নিপা ভবন, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, জীবন বীমা ভবন; বিদেশী স্থপতি স্ট্যানলি টাইগারম্যানকে সাথে নিয়ে রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিলেট ও বরিশালের জন্য পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ঢাকার সড়ক গবেষণা পরীক্ষাগার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্লান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন, রূপপুরে আণবিক শক্তি কমিশনের আবাসন প্রকল্প, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্লান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন, জয়পুরহাট কয়লা ও সিমেন্ট প্রকল্প, জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভ ভবন, ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংক অফিস ভবন, ২০ তলা ‘গার্ডেন সিটি’ প্রকল্প ইত্যাদি।
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম নিজ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৯), আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের জাতীয় সম্মেলনে সম্মানিত ফেলোশিপ অর্জন (১৯৯৯), বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রথম স্বর্ণ পদক অর্জন (১৯৯৩), ভারতের জে কে সিমেন্ট আয়োজিত স্থাপত্যশিল্পে শ্রেষ্ঠ অবদানের জন্য ‘গ্র্যান্ডমাস্টার এ্যাওয়ার্ড’সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন।
শনিবার রাতে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের মরদেহ ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমাগারে ছিল। রবিবার বেলা ১২টায় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ আনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায়। এখানে ঘণ্টাব্যাপী চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয় মরদেহ। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এখানে বাদ জোহর প্রথম জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গুলশানের নিজ বাসভবনে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর পর বাদ আছর গুলশান আজাদ মসজিদে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা হয়। মাজহারুল ইসলামের পুত্রবধূ তাবাসসুম ইসলাম জানান, সন্ধ্যায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আগামী শুক্রবার কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে। মাজহারুল ইসলামের ছোট ছেলে তানভীর ইসলাম তান্না বলেন, বাবা বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে গত ৩১ মে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। এর পর থেকে তিনি একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার মধ্যরাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চারুকলায় শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ রবিবার বেলা বারোটায় চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শুরু হয় তাঁর শেষ শ্রদ্ধানুষ্ঠান। তাঁর মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানান কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) এবি তাজুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। সাংস্কৃতিক ও শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান কামাল লোহানী, শিল্পী হাশেম খান, আবুল বারক্ আলভী, জামাল আহমেদ, ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান, মনিরুজ্জামান, শিশির ভট্টাচার্য, রবিউল হুসাইনসহ অনেকে। এ ছাড়াও ঢাকা ক্লাব, ছায়ানট, চারুকলা ইনস্টিটিউট, গণঐক্য কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়। দেশের আধুনিক স্থাপত্যকলার এই প্রাণপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘স্থপতি মাজহারুল ইসলাম বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন আমাদের অগ্রদূত। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের একজন মানুষ ছিলেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাপারেও বঙ্গবন্ধু তাঁর পরামর্শ নিতেন। তাঁর চলে যাওয়া রাষ্ট্রের একটি অপূরণীয় ক্ষতি।’
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, ‘তিন দশকের সাহসী সঙ্গী মাজহারুল ইসলামকে আজ হারালাম। তাঁকে দেশের স্থাপত্যশিল্পের গুরু বললে ভুল হয় না। তিনি শুধু একজন স্থপতি নন, সমাজ বিনির্মাণে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। তার শূন্যস্থান কখনও পূর্ণ হবে না। তিনি আগেও আমাদের পথ দেখিয়েছেন, মৃত্যুর পরও পথ দেখাবেন।’
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘তার চলে যাওয়াতে বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পে একটি যুগের অবসান হলো। সারা বিশ্বে এ দেশের স্থাপত্যশিল্পকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আজ যেখানে তাঁর মরদেহ আনা হয়েছে, তারও স্থপতি ছিলেন তিনি। আজকে যাঁরা বড় স্থপতি তাঁদের জন্য অনুসরণীয় মাজহারুল ইসলাম। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই তিনি শিক্ষক ছিলেন।’
মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘মাজহারুল ইসলাম ছিলেন জাতির এক অন্যতম পথপ্রদর্শক। তাঁর চলে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়।’
জীবনপঞ্জি ॥ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ছিলেন ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের প্রথম সভাপতি। স্থাপত্যকলার বাইরেও একজন সমাজসচেতন নাগরিক হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সক্রিয় ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল স্থাপত্য নকশা, জাতীয় গণগ্রন্থাগার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ও লাইব্রেরী ভবন, রাঙ্গামাটি শহর পরিকল্পনাসহ দেশের অধিকাংশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নকশাবিদ তিনি।
ব্রিটিশ ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে নানার বাড়িতে ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মাজহারুল ইসলাম। সে সময় বাবা ওমদাতুল ইসলাম ছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজের অঙ্কের শিক্ষক। কৃষ্ণনগর কলেজ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর বাবার বদলির সুবাদে রাজশাহীতে যান। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজ থেকে যথাক্রমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঐ কলেজ থেকেই পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতক পাস করেন। এর পর শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে প্রকৌশল বিদ্যা পড়া শেষ করেন ১৯৪৬ সালে। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে সরকারী চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৫০ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যের পাঠ শেষে আড়াই বছর পর দেশে ফেরেন। দেশে ফিরে একনাগাড়ে ছয় মাসের পরিশ্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট ও লাইব্রেরী ভবনের স্থাপত্য নকশা করেন।
এরপর ১৯৫৬ সালে বৃত্তি নিয়ে তিনি ট্রপিক্যাল আর্কিটেকচার পড়তে লন্ডনের এ এ স্কুল অব আর্কিটেকচারে যান। ১৯৬০ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে পল রুডল্ফের অধীনে মাস্টার্স করেন। সেখান থেকে ১৯৬১ সালের শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কনস্ট্রাকশন, বিল্ডিং এ্যান্ড ইরিগেশন বিভাগে। মতের মিল না হওয়ায় ১৯৬৪ সালে সরকারী চাকরী ছেড়ে প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে ‘বাস্তুকলাবিদ’ নামে একটি স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়Ñ বুয়েটে স্থাপত্য অনুষদ চালু করার ক্ষেত্রেও তিনি রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। এখানে তিনি খ-কালীন শিক্ষকতাও করেন।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জীবন দর্শন ছিল একইসঙ্গে একজন বাঙালী ও একজন শাশ্বত বিশ্বমানব হয়ে ওঠা। এই দর্শন থেকেই বাংলাদেশের স্থাপত্যকলার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন তৈরির চেষ্টা করে গেছেন আমৃত্যু। তিনি জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা তৈরির দায়িত্ব পেলেও নিজ আগ্রহেই বিশ্বখ্যাত স্থপতি ও তাঁর শিক্ষক লুই কানকে নকশা করার আহ্বান জানান। শুধু লুই কানই নন, তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশে ঘুরে গেছেন স্ট্যানলি টাইগারম্যান ও পল রুডলফের মতো বিশ্বখ্যাত স্থপতিরা।
মাজহারুল ইসলামের নকশায় নির্মিত উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছেÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট, লাইব্রেরী ভবন, ঢাকার খিলগাঁও রেলওয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প, নতুন রাঙ্গামাটি শহর পরিকল্পনা, আজিমপুরে চতুথ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য আবাসন প্রকল্প, ঢাকার বিসিএসআইআর লাইব্রেরী ভবন, নিপা ভবন, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, জীবন বীমা ভবন; বিদেশী স্থপতি স্ট্যানলি টাইগারম্যানকে সাথে নিয়ে রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিলেট ও বরিশালের জন্য পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ঢাকার সড়ক গবেষণা পরীক্ষাগার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্লান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন, রূপপুরে আণবিক শক্তি কমিশনের আবাসন প্রকল্প, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্লান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন, জয়পুরহাট কয়লা ও সিমেন্ট প্রকল্প, জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় আর্কাইভ ভবন, ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংক অফিস ভবন, ২০ তলা ‘গার্ডেন সিটি’ প্রকল্প ইত্যাদি।
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম নিজ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৯), আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের জাতীয় সম্মেলনে সম্মানিত ফেলোশিপ অর্জন (১৯৯৯), বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রথম স্বর্ণ পদক অর্জন (১৯৯৩), ভারতের জে কে সিমেন্ট আয়োজিত স্থাপত্যশিল্পে শ্রেষ্ঠ অবদানের জন্য ‘গ্র্যান্ডমাস্টার এ্যাওয়ার্ড’সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন।
No comments