তৃতীয় গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটবে? by গাজীউল হাসান খান
বাংলাদেশের বর্তমান দ্বিদলীয় রাজনীতির জটিল ঘুরপাকে প্রশ্ন উঠেছে একটি তৃতীয় গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান নিয়ে। পাশাপাশি সে শক্তির বিভিন্ন রাজনৈতিক নীতি, কৌশল ও গঠনপ্রক্রিয়া নিয়েও যথেষ্ট ইতিবাচক ও নেতিবাচক আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে, যা আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
তবে এ কথা সত্য, এতে একদিকে যেমন নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোও বিভিন্ন আত্মসমালোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ পাবে। তাতে নূ্যনতম কোনো প্রতিহিংসায় জ্বলে ওঠার কারণ নেই। কথায় আছে, 'শত ফুল ফুটতে দাও, শত চিন্তা বিকাশলাভ করুক।'
বিশ্বের যেকোনো দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি বা মতামত প্রায়ই প্রাধান্য পেতে দেখা যায়, সেখানে মুক্তবুদ্ধি অথবা নাগরিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যান-ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এর সবচেয়ে বড় বাধা হলো কায়েমি স্বার্থ। এখানে নেতৃত্বের প্রভাব-প্রতিপত্তি, আধিপত্য ও বিশেষ করে শ্রেণীচরিত্রের বিষয়গুলোই স্বভাবত বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ফলে অনেক পুরনো গণতান্ত্রিক দল কিংবা ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী সংগঠনের মধ্যেও দেখা দেয় মুখ্য নেতা-নেত্রীদের প্রতি কর্মীদের এক ধরনের অন্ধ আনুগত্য, তোষামোদি ও চাটুকারবৃত্তি। তখন সংগঠনের ভেতরে আন্তদলীয় শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা এবং অধিকন্তু গণতান্ত্রিক চর্চা কিংবা মূল্যবোধের পরিবর্তে একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সে অবস্থায় দেশ, জাতি কিংবা জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতই মুখ্য হয়ে ওঠে। অনেক প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীর মতে, আমাদের দেশে এখন অনেকটা সে অবস্থাই বিরাজ করছে। অর্থাৎ প্রধান দুটি দলের হাতে দেশের মানুষ রাজনীতিগতভাবে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে। দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে মুখ্য নেতা-নেত্রীদের কায়েমি স্বার্থ থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারছে না, এমনকি তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের অন্য শরিকরাও নয়। ফলে ওয়ান-ইলেভেনের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক মানসিকতা ও পরিস্থিতির অবসান ঘটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সে কারণেই ক্রমে আরো অধিকতর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সম্মুখীন হচ্ছে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ।
প্রশ্ন উঠেছে দেশে তৃতীয় গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান কিংবা গণতান্ত্রিক ধারার আবির্ভাব প্রসঙ্গে। সূচনায় সেটি একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল না হয়ে একটি নিরপেক্ষ নাগরিক কমিটিভিত্তিক আন্দোলনও হতে পারে। জাতীয় পর্যায়ে না হোক প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পর্যায়ে সে উল্লিখিত নাগরিক কমিটির পতাকাতলে সৎ, যোগ্য ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিসচেতন মানুষের সমাবেশ ঘটাতে কোনো অসুবিধা নেই। এটিকে অনেকে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পূর্বাবস্থা বা প্রস্তুতি পর্ব বলেও উল্লেখ করতে পারেন। তবে এ ধরনের সমাবেশ দলগত রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও সুস্পষ্ট সাংগঠনিক ঘোষণাপত্র এবং বলিষ্ঠ কর্মসূচির অভাবে খুব তাড়াতাড়িই ওপরে উল্লিখিত বড় বড় দলের খপ্পরে পড়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। তখন দেখা যাবে, কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষের কঠোর পরিশ্রমের ফসল গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি রাতারাতি তছনছ করে দিয়েছে। সে কারণেই একটি আদর্শনিষ্ঠ সংগঠিত দল বা পার্টি ছাড়া কোনো সূদূরপ্রসারী জাতীয়ভিত্তিক আর্থ-রাজনৈতিক কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। এ আপাদমস্তক দুর্নীতি ও সামাজিক অনাচারের দেশে পদ-পদবি এবং অর্থের কাছে সব কিছুই অতি সহজে বেচাকেনা হয়ে যায়। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ দেশে যারা বিভিন্ন দলের সার্বক্ষণিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের অনেকেরই জীবিকা নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট কোনো পেশাগত সংগতি নেই। রাজনীতিই তাদের একমাত্র পেশা। সুতরাং এ দেশ থেকে সামাজিক অনাচার, বিশেষ করে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ। দুর্নীতি যে এ দেশের সর্বস্তরে একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে গেছে তা বিভিন্ন অফিস বা প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক গোলাগুলি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে বিশ্বব্যাংকের লবি পর্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে। সুতরাং এখানে স্থানীয় সরকার কিংবা বৃহত্তরভাবে জাতীয় পর্যায়ে একটি সত্যনিষ্ঠ দিকনির্দেশনামূলক রাজনীতির সূচনা করা কোনো মতেই সহজ হবে না। তাই বলে বর্তমান অবস্থাকে কী এভাবেই চলতে দেওয়া যাবে? এ প্রশ্ন আজ এ দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে দানা বেঁধে উঠেছে। বড় বড় রাজনৈতিক দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীকে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ দেশ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদের নিমিত্তে তাদের কারোরই কোনো বিপ্লবাত্মক ঘোষণা বা কর্মসূচি নেই। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) একটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, সরকার এ কমিশনকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে। প্রকৃত অর্থে দুর্নীতি দমনকল্পে এর তেমন কোনো স্বাধীনতা নেই। একটা সঠিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ে যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা আবশ্যক, তা বাংলাদেশে কোথায় আছে? সেগুলো থাকলে দেশে উন্নয়ন যা হচ্ছে তা আরো বহুগুণ বেশি হতে পারত।
ওয়ান-ইলেভেন পরবর্র্তী বাংলাদেশে আপামর জনসাধারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বোধোদয় এবং পরিবর্তন আশা করেছিল সে জাগ্রত মূল্যবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, সুবিচার ও আইনের শাসনের প্রতি তোয়াক্কা কোথায়? এ অবস্থায় তরুণ রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্না 'তৃতীয় শক্তি' প্রসঙ্গে যে নাগরিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেছেন তা মোটেও অপ্রাসঙ্গিক বা অযৌক্তিক নয়। যেকোনো গণতন্ত্রমনা দেশপ্রেমিক মানুষই এ ধরনের ভাবনা-চিন্তা কিংবা উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাবে। কারণ পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল না হলেও সে ধরনের নাগরিক ঐক্যের কমিটি দেশের বড় দুটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে। গোড়া থেকে সাবধানতা অবলম্বন করলে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সৎ, আদর্শবান ও যোগ্য প্রার্থী খুঁজে বের করা কিংবা মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন পেশাজীবী ও দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে এ ধরনের সংগঠন অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এদের সংগঠিত কার্যকলাপ জাতীয় নির্বাচনকালেও মনোনয়ন বাণিজ্য রোধসহ সঠিকভাবে রাজনীতি পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। তা ছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে জনমত গঠনেও এরা কাজ করতে সক্ষম হবে। যা এ দেশের সাংঘর্ষিক রাজনীতি ও তার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে জনগণকে বাঁচাতে পারে। সে ধারায় সুচিন্তিতভাবে অগ্রসর হতে পারলে পর্যায়ক্রমে সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান পাওয়া এবং তৃতীয় একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলাও দুঃসাধ্য হবে বলে মনে হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে প্রশ্নাতীত সততা, কঠোর নিষ্ঠা ও লোভ-লালসা সংবরণ। প্রয়োজন হবে অসামান্য ত্যাগ-তিতিক্ষার। যদি কেউ মনে করে থাকেন তাঁরা এ দেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংগঠনের চেহারা পাল্টে দেবেন তবে তাঁদের কাছে এর বিকল্প আর কী আছে? এ দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বড় কোনো বিবাদ নেই। বিবাদ-বিসংবাদ সৃষ্টি করছে একটি কায়েমি স্বার্থবাদী মহল। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও প্রচলিত মূল্যবোধের তেমন কোনো মূল্য তাঁদের কাছে নেই। জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে অনৈক্য সৃষ্টি এবং দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ বাধিয়ে দুর্নীতি, লুটপাট ও অরাজকতা জারি রাখাই হচ্ছে তাঁদের রাজনীতির মূলমন্ত্র।
দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি বুঝে থাকে যে কী কারণে দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এবং কিছু বিবেকবান মানুষ দেশে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির (সাংবিধানিক) উত্থান চাইছেন, তাহলে সেখানে তারা প্রকৃত অর্থে ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তের কোনো গন্ধ খুঁজে পাবে না। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে, দলীয় নেতা-নেত্রীদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের বাইরেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে আজ দেশে যে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে তা অবিলম্বে নিরসন করা না হলে দেশ এক চরম নৈরাজ্য ও সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট আগামী সংসদ নির্বাচন একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের জন্য দাবি জানিয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার তা মেনে না নিলে রোজার ঈদের পর তারা সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। আর ক্ষমতাসীনরা বলছে তেমন আন্দোলনে গেলে বিরোধী জোটকে রাজপথে ঠেকানো হবে। তা ছাড়া তারা এখনো বলছেন দলীয় সরকারের অধীনেই দেশে নির্বাচন হতে হবে। বাজারে এখনো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বহাল তবিয়তেই বজায় রয়েছে। সাধারণ মানুষ তাদের আয় দিয়ে কোনো মতেই সংসার চালাতে পারছে না। তার ওপর ঘোষণা এসেছে আরেক দফা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির। বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, গুম ও রাহাজানির এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। তদুপরি বিভিন্ন সরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠানে চলছে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন কাজকর্ম নিয়ে দুর্নীতি ও সংঘর্ষ। সাধারণ মানুষ মনে করে, এ অবস্থায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলেও রাতারাতি কাঁচাবাজার থেকে শেয়ারবাজার, সাধারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু এবং বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। তা ওপর কারো কারো ধারণা, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দলবাজি ও দুর্নীতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। কারণ সরকার পতনের দাবি ছাড়া দুর্নীতি দমনসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অনাচার রোধকল্পে তাদের কাছ থেকে এখনো তেমন কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। সুতরাং একে অপরের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল ছাড়া অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পরিবর্তনের আভাস জাতি এখনো পায়নি। অথচ জনগণ, ব্যবসায়ী মহল, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এবং এমনকি জ্ঞানান্বেষী ছাত্র সমাজ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে শুনতে চায় একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের কথা, সত্যিকার গণতন্ত্র চর্চা ও পরমতসহিষ্ণুতার আশ্বাস এবং দুর্নীতিমুক্ত এক রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা, যেখানে মানুষ এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে। বাংলাদেশের একটি বুদ্ধিজীবী অংশ আরো মনে করে, ওই দুটি বড় দল দিয়ে জনগণের সে আশা-আকাঙ্ক্ষার আর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন এমন এক বন্ধনমুক্ত তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি, যারা তাদের একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী এক অগ্রসরমান বুদ্ধিদীপ্ত ও শিল্পসমৃদ্ধ অথচ সংস্কৃতি ও সভ্যতাভিমানী দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ উপহার দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত ও সক্ষম। অন্যান্যের মধ্যে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা শুধু সংবিধানে নয়, বাস্তবেও খুঁজে পাওয়া যাবে। সবার জন্য কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা হবে। হবে মাথা গোঁজার ঠাঁই। নয়া সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী শোষণ-শাসন এবং গোষ্ঠীবিশেষের লাগামহীন লুটপাট ও দুর্নীতির হাত থেকে মানুষ মুক্তি পাবে। আজকের আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কি তার জন্য প্রস্তুত?
গণমাধ্যমের বিশ্লেষকদের মতে, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে জনগণ তাদের প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছে, তবে এখনো তাদের বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক, প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা কিংবা তরুণ আইনজ্ঞ আসিফ নজরুলসহ অনেকের মতে, দেশের জনগণ ওই রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে। সে কারণেই হয়তো দেশের সর্বত্র আজ একটি গঠনশীল তৃতীয় গণতান্ত্রিক শক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা শোনা যাচ্ছে। এভাবেই আলোচনা ও সমালোচনার ভিত্তিতে কোনো ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি হয়ে থাকে। সে অবস্থায় যোগ্য নেতৃত্ব পেলে অনেক কিছুই অবিশ্বাস্যভাবে বাস্তবে রূপলাভ করতে পারে। আবার নেতৃত্বের অযোগ্যতা ও খামখেয়ালীপনা কিংবা কায়েমি স্বার্থ বা লোভ-লালসার কারণে অনেক সম্ভাবনাময় ব্যাপারও হারিয়ে যেতে পারে ব্যর্থতার অতল গহ্বরে। এ বিষয়টি থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দলই শিক্ষা নিতে পারে। রাজনৈতিক এবং বিশেষ করে জনগণের বিভিন্ন স্বার্থের ব্যাপারে আন্তরিক হলে তাদের আচার-আচরণ, দোষ-ত্রুটি এবং দলীয় জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডকে শোধরাতে পারে। পরিবর্তন আনতে পারে দলীয় নেতৃত্ব এবং সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনায়। নতুবা শুধু বড় বড় নেতার নামের দোহাই দিয়ে নিজেদের শেষ রক্ষা হবে না। নতুন শক্তি যুগের দাবিতেই নিজস্ব স্থান করে নেবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কিংবা জাতির ইতিহাসে। সেখানে কোনো চক্রান্ত কিংবা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ হালে পানি পাবে না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com
বিশ্বের যেকোনো দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি বা মতামত প্রায়ই প্রাধান্য পেতে দেখা যায়, সেখানে মুক্তবুদ্ধি অথবা নাগরিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যান-ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এর সবচেয়ে বড় বাধা হলো কায়েমি স্বার্থ। এখানে নেতৃত্বের প্রভাব-প্রতিপত্তি, আধিপত্য ও বিশেষ করে শ্রেণীচরিত্রের বিষয়গুলোই স্বভাবত বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ফলে অনেক পুরনো গণতান্ত্রিক দল কিংবা ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী সংগঠনের মধ্যেও দেখা দেয় মুখ্য নেতা-নেত্রীদের প্রতি কর্মীদের এক ধরনের অন্ধ আনুগত্য, তোষামোদি ও চাটুকারবৃত্তি। তখন সংগঠনের ভেতরে আন্তদলীয় শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা এবং অধিকন্তু গণতান্ত্রিক চর্চা কিংবা মূল্যবোধের পরিবর্তে একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সে অবস্থায় দেশ, জাতি কিংবা জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতই মুখ্য হয়ে ওঠে। অনেক প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীর মতে, আমাদের দেশে এখন অনেকটা সে অবস্থাই বিরাজ করছে। অর্থাৎ প্রধান দুটি দলের হাতে দেশের মানুষ রাজনীতিগতভাবে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে। দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে মুখ্য নেতা-নেত্রীদের কায়েমি স্বার্থ থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারছে না, এমনকি তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের অন্য শরিকরাও নয়। ফলে ওয়ান-ইলেভেনের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক মানসিকতা ও পরিস্থিতির অবসান ঘটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সে কারণেই ক্রমে আরো অধিকতর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সম্মুখীন হচ্ছে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ।
প্রশ্ন উঠেছে দেশে তৃতীয় গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান কিংবা গণতান্ত্রিক ধারার আবির্ভাব প্রসঙ্গে। সূচনায় সেটি একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল না হয়ে একটি নিরপেক্ষ নাগরিক কমিটিভিত্তিক আন্দোলনও হতে পারে। জাতীয় পর্যায়ে না হোক প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পর্যায়ে সে উল্লিখিত নাগরিক কমিটির পতাকাতলে সৎ, যোগ্য ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিসচেতন মানুষের সমাবেশ ঘটাতে কোনো অসুবিধা নেই। এটিকে অনেকে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পূর্বাবস্থা বা প্রস্তুতি পর্ব বলেও উল্লেখ করতে পারেন। তবে এ ধরনের সমাবেশ দলগত রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও সুস্পষ্ট সাংগঠনিক ঘোষণাপত্র এবং বলিষ্ঠ কর্মসূচির অভাবে খুব তাড়াতাড়িই ওপরে উল্লিখিত বড় বড় দলের খপ্পরে পড়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। তখন দেখা যাবে, কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষের কঠোর পরিশ্রমের ফসল গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি রাতারাতি তছনছ করে দিয়েছে। সে কারণেই একটি আদর্শনিষ্ঠ সংগঠিত দল বা পার্টি ছাড়া কোনো সূদূরপ্রসারী জাতীয়ভিত্তিক আর্থ-রাজনৈতিক কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। এ আপাদমস্তক দুর্নীতি ও সামাজিক অনাচারের দেশে পদ-পদবি এবং অর্থের কাছে সব কিছুই অতি সহজে বেচাকেনা হয়ে যায়। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ দেশে যারা বিভিন্ন দলের সার্বক্ষণিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের অনেকেরই জীবিকা নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট কোনো পেশাগত সংগতি নেই। রাজনীতিই তাদের একমাত্র পেশা। সুতরাং এ দেশ থেকে সামাজিক অনাচার, বিশেষ করে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ। দুর্নীতি যে এ দেশের সর্বস্তরে একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে গেছে তা বিভিন্ন অফিস বা প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক গোলাগুলি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে বিশ্বব্যাংকের লবি পর্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে। সুতরাং এখানে স্থানীয় সরকার কিংবা বৃহত্তরভাবে জাতীয় পর্যায়ে একটি সত্যনিষ্ঠ দিকনির্দেশনামূলক রাজনীতির সূচনা করা কোনো মতেই সহজ হবে না। তাই বলে বর্তমান অবস্থাকে কী এভাবেই চলতে দেওয়া যাবে? এ প্রশ্ন আজ এ দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে দানা বেঁধে উঠেছে। বড় বড় রাজনৈতিক দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীকে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ দেশ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদের নিমিত্তে তাদের কারোরই কোনো বিপ্লবাত্মক ঘোষণা বা কর্মসূচি নেই। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) একটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, সরকার এ কমিশনকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে। প্রকৃত অর্থে দুর্নীতি দমনকল্পে এর তেমন কোনো স্বাধীনতা নেই। একটা সঠিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ে যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা আবশ্যক, তা বাংলাদেশে কোথায় আছে? সেগুলো থাকলে দেশে উন্নয়ন যা হচ্ছে তা আরো বহুগুণ বেশি হতে পারত।
ওয়ান-ইলেভেন পরবর্র্তী বাংলাদেশে আপামর জনসাধারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বোধোদয় এবং পরিবর্তন আশা করেছিল সে জাগ্রত মূল্যবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, সুবিচার ও আইনের শাসনের প্রতি তোয়াক্কা কোথায়? এ অবস্থায় তরুণ রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্না 'তৃতীয় শক্তি' প্রসঙ্গে যে নাগরিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেছেন তা মোটেও অপ্রাসঙ্গিক বা অযৌক্তিক নয়। যেকোনো গণতন্ত্রমনা দেশপ্রেমিক মানুষই এ ধরনের ভাবনা-চিন্তা কিংবা উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাবে। কারণ পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দল না হলেও সে ধরনের নাগরিক ঐক্যের কমিটি দেশের বড় দুটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে। গোড়া থেকে সাবধানতা অবলম্বন করলে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সৎ, আদর্শবান ও যোগ্য প্রার্থী খুঁজে বের করা কিংবা মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন পেশাজীবী ও দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে এ ধরনের সংগঠন অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এদের সংগঠিত কার্যকলাপ জাতীয় নির্বাচনকালেও মনোনয়ন বাণিজ্য রোধসহ সঠিকভাবে রাজনীতি পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। তা ছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে জনমত গঠনেও এরা কাজ করতে সক্ষম হবে। যা এ দেশের সাংঘর্ষিক রাজনীতি ও তার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে জনগণকে বাঁচাতে পারে। সে ধারায় সুচিন্তিতভাবে অগ্রসর হতে পারলে পর্যায়ক্রমে সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান পাওয়া এবং তৃতীয় একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলাও দুঃসাধ্য হবে বলে মনে হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে প্রশ্নাতীত সততা, কঠোর নিষ্ঠা ও লোভ-লালসা সংবরণ। প্রয়োজন হবে অসামান্য ত্যাগ-তিতিক্ষার। যদি কেউ মনে করে থাকেন তাঁরা এ দেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংগঠনের চেহারা পাল্টে দেবেন তবে তাঁদের কাছে এর বিকল্প আর কী আছে? এ দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বড় কোনো বিবাদ নেই। বিবাদ-বিসংবাদ সৃষ্টি করছে একটি কায়েমি স্বার্থবাদী মহল। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও প্রচলিত মূল্যবোধের তেমন কোনো মূল্য তাঁদের কাছে নেই। জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে অনৈক্য সৃষ্টি এবং দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ বাধিয়ে দুর্নীতি, লুটপাট ও অরাজকতা জারি রাখাই হচ্ছে তাঁদের রাজনীতির মূলমন্ত্র।
দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি বুঝে থাকে যে কী কারণে দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এবং কিছু বিবেকবান মানুষ দেশে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির (সাংবিধানিক) উত্থান চাইছেন, তাহলে সেখানে তারা প্রকৃত অর্থে ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তের কোনো গন্ধ খুঁজে পাবে না। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে, দলীয় নেতা-নেত্রীদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের বাইরেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে আজ দেশে যে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে তা অবিলম্বে নিরসন করা না হলে দেশ এক চরম নৈরাজ্য ও সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট আগামী সংসদ নির্বাচন একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের জন্য দাবি জানিয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার তা মেনে না নিলে রোজার ঈদের পর তারা সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। আর ক্ষমতাসীনরা বলছে তেমন আন্দোলনে গেলে বিরোধী জোটকে রাজপথে ঠেকানো হবে। তা ছাড়া তারা এখনো বলছেন দলীয় সরকারের অধীনেই দেশে নির্বাচন হতে হবে। বাজারে এখনো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বহাল তবিয়তেই বজায় রয়েছে। সাধারণ মানুষ তাদের আয় দিয়ে কোনো মতেই সংসার চালাতে পারছে না। তার ওপর ঘোষণা এসেছে আরেক দফা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির। বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, গুম ও রাহাজানির এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। তদুপরি বিভিন্ন সরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠানে চলছে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন কাজকর্ম নিয়ে দুর্নীতি ও সংঘর্ষ। সাধারণ মানুষ মনে করে, এ অবস্থায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলেও রাতারাতি কাঁচাবাজার থেকে শেয়ারবাজার, সাধারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু এবং বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। তা ওপর কারো কারো ধারণা, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দলবাজি ও দুর্নীতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। কারণ সরকার পতনের দাবি ছাড়া দুর্নীতি দমনসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অনাচার রোধকল্পে তাদের কাছ থেকে এখনো তেমন কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। সুতরাং একে অপরের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল ছাড়া অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পরিবর্তনের আভাস জাতি এখনো পায়নি। অথচ জনগণ, ব্যবসায়ী মহল, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এবং এমনকি জ্ঞানান্বেষী ছাত্র সমাজ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে শুনতে চায় একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের কথা, সত্যিকার গণতন্ত্র চর্চা ও পরমতসহিষ্ণুতার আশ্বাস এবং দুর্নীতিমুক্ত এক রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা, যেখানে মানুষ এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে। বাংলাদেশের একটি বুদ্ধিজীবী অংশ আরো মনে করে, ওই দুটি বড় দল দিয়ে জনগণের সে আশা-আকাঙ্ক্ষার আর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন এমন এক বন্ধনমুক্ত তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি, যারা তাদের একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী এক অগ্রসরমান বুদ্ধিদীপ্ত ও শিল্পসমৃদ্ধ অথচ সংস্কৃতি ও সভ্যতাভিমানী দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ উপহার দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত ও সক্ষম। অন্যান্যের মধ্যে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা শুধু সংবিধানে নয়, বাস্তবেও খুঁজে পাওয়া যাবে। সবার জন্য কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা হবে। হবে মাথা গোঁজার ঠাঁই। নয়া সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী শোষণ-শাসন এবং গোষ্ঠীবিশেষের লাগামহীন লুটপাট ও দুর্নীতির হাত থেকে মানুষ মুক্তি পাবে। আজকের আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কি তার জন্য প্রস্তুত?
গণমাধ্যমের বিশ্লেষকদের মতে, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে জনগণ তাদের প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছে, তবে এখনো তাদের বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক, প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা কিংবা তরুণ আইনজ্ঞ আসিফ নজরুলসহ অনেকের মতে, দেশের জনগণ ওই রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে। সে কারণেই হয়তো দেশের সর্বত্র আজ একটি গঠনশীল তৃতীয় গণতান্ত্রিক শক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা শোনা যাচ্ছে। এভাবেই আলোচনা ও সমালোচনার ভিত্তিতে কোনো ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি হয়ে থাকে। সে অবস্থায় যোগ্য নেতৃত্ব পেলে অনেক কিছুই অবিশ্বাস্যভাবে বাস্তবে রূপলাভ করতে পারে। আবার নেতৃত্বের অযোগ্যতা ও খামখেয়ালীপনা কিংবা কায়েমি স্বার্থ বা লোভ-লালসার কারণে অনেক সম্ভাবনাময় ব্যাপারও হারিয়ে যেতে পারে ব্যর্থতার অতল গহ্বরে। এ বিষয়টি থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দলই শিক্ষা নিতে পারে। রাজনৈতিক এবং বিশেষ করে জনগণের বিভিন্ন স্বার্থের ব্যাপারে আন্তরিক হলে তাদের আচার-আচরণ, দোষ-ত্রুটি এবং দলীয় জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডকে শোধরাতে পারে। পরিবর্তন আনতে পারে দলীয় নেতৃত্ব এবং সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনায়। নতুবা শুধু বড় বড় নেতার নামের দোহাই দিয়ে নিজেদের শেষ রক্ষা হবে না। নতুন শক্তি যুগের দাবিতেই নিজস্ব স্থান করে নেবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কিংবা জাতির ইতিহাসে। সেখানে কোনো চক্রান্ত কিংবা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ হালে পানি পাবে না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com
No comments