একেক সময় একেকটি বিষয় প্রাধান্য পাচ্ছে by ওয়াহিদ নবি
বিলেতে এখন ছয়টি বাংলা টিভি চ্যানেল। আমরা খবর শুনতে পাই নিয়মিত। সব চ্যানেলেই টক শো হয়। দেশেও হয়, এখানেও হয়। আমরা বিজ্ঞজনদের মতামত ও বিশ্লেষণ শুনতে পাই। তবে টক শো দেখে মনে হয়, বিভিন্ন চ্যানেলের নিয়মিত কিছু বিশ্লেষক আছেন এবং তাঁরা কী বলবেন তা আমরা আন্দাজ করে নিতে পারি।
এ ছাড়া টেলিফোনের মাধ্যমে আত্মীয়-বন্ধুদের কাছ থেকেও দেশের খবর পাই।
এমনিভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে খবর শুনে মনে হয়, একটা বিশেষ সংবাদ বেশ কিছুদিন ধরে প্রাধান্য লাভ করে। খবরের প্রধান অংশজুড়ে থাকে সেই খবরটি। টক শোতে সবাই সেই বিষয়টিই আলোচনা করেন। আত্মীয়-বন্ধুরাও সেই বিষয়টি আমাদের বলেন। বর্তমান সময়ের কথা যদি ধরি তবে বলতে হয় যে পদ্মা সেতুর বিষয়টি এখন সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। অবশ্য আলোচিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মনে হয়, এ ছাড়া আর কিছু ঘটছে না দেশে। মনে হয় বন্যা না হলে পদ্মা সেতুর কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত।
প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছু শোনার পর আমরা কি জানছি? বিশেষ জনেরা অবশ্য বিশেষ বিশেষ খবর জানেন; কিন্তু তাঁরা আমাদের বলছেন না। আমরা ইতরজনেরা যা শুনছি, তাতে দিশাহারা না হয়ে পারছি না।
বিদেশি মন্ত্রীরা এলেন। আমরা দলে দলে ছুটলাম নালিশের ঝুড়ি নিয়ে। প্রধান খবর হয়ে রইল বিষয়টি কিছুদিন ধরে। যাঁরা ছুটলেন তাঁরা অবশ্য আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি হস্তক্ষেপ নিয়ে মাঝেমধ্যেই কথাবার্তা বলেন। বিদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউনূস সাহেবের ব্যাপারে চাপ দিলেন। বিদেশি মন্ত্রীরা ভূরি ভূরি উপদেশ দিলেন আলাপ-আলোচনা ইত্যাদি ব্যাপারে। তাঁরা অবশ্য ইরাক বা আফগানিস্তানের সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেননি। ডি ব্রাউনের লেখা 'বেরি মাই হার্ট ইন উন্ডেড নি' পড়লে বোঝা যায়, আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানরা আমেরিকার বর্তমান সরকারের পূর্বপুরুষদের হাতে কী আচরণ পেয়েছিল।
সাগর-রুনি নির্মমভাবে খুন হলেন নিজেদের ফ্ল্যাটে। তখন মনে হয়েছিল খুনি সহজেই ধরা পড়বে। ঢাকার ফ্ল্যাটগুলোর প্রবেশপথ একটিই হয়ে থাকে সাধারণত। কাজেই মনে হয়েছিল দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই খুনির সন্ধান পাওয়া যাবে। হয়তো সেটা ভেবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন যে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে ধরার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন; কিন্তু আজও খুনি ধরা পড়েনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠেকে শিখলেন যে রাজনীতিবিদদের কৌশলী হতে হয় কথাবার্তায়। খুনি ধরার ব্যর্থতার নৈরাশ্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে এমন কথা বেরিয়ে গেল যাতে করে সবাই বুঝতে পারল তিনি প্রচণ্ড চাপের ভেতর আছেন। জনৈক পুলিশ কর্তার মুখের হাসি নিয়ে লেখালেখি হলো অনেক। খুনি ধরার দায়িত্ব পুলিশের হাত থেকে র্যাবের হাতে গেল। এখনো খুনি ধরা পড়েনি। সাংবাদিক হত্যা এর আগেও হয়েছে। এবার সাংবাদিকরা একতাবদ্ধ আন্দোলন করছেন। এটা তাঁদের চালিয়ে যেতে হবে। আমরা আরো দেখলাম বিষয়টিকে রাজনীতিকরণের অপচেষ্টা। অনেক কিছু আলোচনা হয়েছে, শুধু একটি বিষয় ছাড়া আর তা হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীসহ আমাদের সবার অযোগ্যতার কথা। স্বভাবতই প্রশিক্ষণের কথা আমরা আলোচনা করি না।
ঢাকার অভিজাত এলাকা থেকে 'গুম' হলেন বিরোধী দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। এখনো তাঁর হদিস মেলেনি। লেখালেখি ও কথাবার্তা হয়েছে অনেক। পারস্পরিক দোষারোপ হয়েছে। হরতাল হয়েছে। নিহত হয়েছেন পাঁচজন। সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছে যেমনটি হয়েছে সব হরতালে। দলীয় রাজনীতির রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। একটি টক শোতে দেখলাম, একজন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক এই বলে আক্ষেপ করলেন যে ইলিয়াস আলীর গুম হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করার সভায় বিরোধী দলের নেত্রীকে বেশ হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছিল এবং তিনি অনবরত কী যেন চিবুচ্ছিলেন।
ইকোনমিস্ট পত্রিকার প্রবন্ধ দুটি নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। সরকারের ব্যর্থতার তালিকা এত দীর্ঘ যে তারা ভারত সরকারকে আহ্বান করল বাংলাদেশের দিকে নজর দিতে। জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগল কি? সরকারের ব্যর্থতায় আমরা এতই ক্ষুব্ধ যে আমাদের এসব চিন্তা করার সময় কোথায়? কিন্তু যেটি মোটেই আলোচনা হলো না তা হচ্ছে বিরোধী দল সম্পর্কে দুটি মন্তব্য। ইকোনমিস্ট লিখেছিল, "বর্তমান বিরোধী দলের নেত্রী ক্ষমতায় থাকার সময় 'ভয়ংকর চৌর্যতন্ত্র' (Brutal Kleptocracy) সৃষ্টি করেছিলেন।" ইকোনমিস্ট আরো লিখেছিল যে প্রণব মুখার্জি দেখা করতে গেলে বিরোধী দলের নেত্রী ভারতকে 'বন্ধু' বলে অভিহিত করেন । ভারত বিরোধিতা আমাদের বিরোধী দলের একটি প্রধান নীতি। উঠতে বসতে তাঁরা ভারতের নিন্দা করেন। বিরোধী দলের নৈতিকতা কি প্রশ্নবিদ্ধ হয় না এমন সব আচরণে?
সমস্যা আসে। সমস্যা যায়। একটি সমস্যা এলে আগেরটির কথা ভুলে যাই। ইলিয়াস সমস্যা এলে কিবরিয়া সমস্যা ভুলে যাই। এমনকি ২০০১ সালের কথাও ভুলে যাই। সমস্যার এসব শোভাযাত্রার হট্টগোলে আমাদের গোচরেই আসে না যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কী হচ্ছে? কোর্টের সওয়াল-জবাবগুলোর বর্ণনা কিছু পত্রিকায় বেরোচ্ছে, কিন্তু ওগুলো নীরব। সরব সমস্যার পর্যালোচনায় আমরা এত ব্যস্ত যে ওগুলোর দিকে দৃষ্টিপাতে আমাদের মন সায় দেয় না। শুধু শোকার্ত পরিজনরা চোখ মোছেন। আর যদি উত্তেজক সমস্যাগুলো একটি চলে গেলে আর একটি আনা যায় এবং সেগুলোকে যদি বহুল আলোচিত করা যায় তবে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় তারা হবে প্রত্যাখ্যাত। ক্ষমতায় আসবে যারা যুদ্ধাপরাধ বিস্মৃতির অন্ধকারে ফেলে দিতে চায় তারা। ব্যস, তবে আর কী? সব ঝামেলা শেষ।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী মনোচিকিৎসক
এমনিভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে খবর শুনে মনে হয়, একটা বিশেষ সংবাদ বেশ কিছুদিন ধরে প্রাধান্য লাভ করে। খবরের প্রধান অংশজুড়ে থাকে সেই খবরটি। টক শোতে সবাই সেই বিষয়টিই আলোচনা করেন। আত্মীয়-বন্ধুরাও সেই বিষয়টি আমাদের বলেন। বর্তমান সময়ের কথা যদি ধরি তবে বলতে হয় যে পদ্মা সেতুর বিষয়টি এখন সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। অবশ্য আলোচিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মনে হয়, এ ছাড়া আর কিছু ঘটছে না দেশে। মনে হয় বন্যা না হলে পদ্মা সেতুর কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত।
প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছু শোনার পর আমরা কি জানছি? বিশেষ জনেরা অবশ্য বিশেষ বিশেষ খবর জানেন; কিন্তু তাঁরা আমাদের বলছেন না। আমরা ইতরজনেরা যা শুনছি, তাতে দিশাহারা না হয়ে পারছি না।
বিদেশি মন্ত্রীরা এলেন। আমরা দলে দলে ছুটলাম নালিশের ঝুড়ি নিয়ে। প্রধান খবর হয়ে রইল বিষয়টি কিছুদিন ধরে। যাঁরা ছুটলেন তাঁরা অবশ্য আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি হস্তক্ষেপ নিয়ে মাঝেমধ্যেই কথাবার্তা বলেন। বিদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউনূস সাহেবের ব্যাপারে চাপ দিলেন। বিদেশি মন্ত্রীরা ভূরি ভূরি উপদেশ দিলেন আলাপ-আলোচনা ইত্যাদি ব্যাপারে। তাঁরা অবশ্য ইরাক বা আফগানিস্তানের সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেননি। ডি ব্রাউনের লেখা 'বেরি মাই হার্ট ইন উন্ডেড নি' পড়লে বোঝা যায়, আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানরা আমেরিকার বর্তমান সরকারের পূর্বপুরুষদের হাতে কী আচরণ পেয়েছিল।
সাগর-রুনি নির্মমভাবে খুন হলেন নিজেদের ফ্ল্যাটে। তখন মনে হয়েছিল খুনি সহজেই ধরা পড়বে। ঢাকার ফ্ল্যাটগুলোর প্রবেশপথ একটিই হয়ে থাকে সাধারণত। কাজেই মনে হয়েছিল দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই খুনির সন্ধান পাওয়া যাবে। হয়তো সেটা ভেবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন যে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে ধরার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন; কিন্তু আজও খুনি ধরা পড়েনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠেকে শিখলেন যে রাজনীতিবিদদের কৌশলী হতে হয় কথাবার্তায়। খুনি ধরার ব্যর্থতার নৈরাশ্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে এমন কথা বেরিয়ে গেল যাতে করে সবাই বুঝতে পারল তিনি প্রচণ্ড চাপের ভেতর আছেন। জনৈক পুলিশ কর্তার মুখের হাসি নিয়ে লেখালেখি হলো অনেক। খুনি ধরার দায়িত্ব পুলিশের হাত থেকে র্যাবের হাতে গেল। এখনো খুনি ধরা পড়েনি। সাংবাদিক হত্যা এর আগেও হয়েছে। এবার সাংবাদিকরা একতাবদ্ধ আন্দোলন করছেন। এটা তাঁদের চালিয়ে যেতে হবে। আমরা আরো দেখলাম বিষয়টিকে রাজনীতিকরণের অপচেষ্টা। অনেক কিছু আলোচনা হয়েছে, শুধু একটি বিষয় ছাড়া আর তা হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীসহ আমাদের সবার অযোগ্যতার কথা। স্বভাবতই প্রশিক্ষণের কথা আমরা আলোচনা করি না।
ঢাকার অভিজাত এলাকা থেকে 'গুম' হলেন বিরোধী দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। এখনো তাঁর হদিস মেলেনি। লেখালেখি ও কথাবার্তা হয়েছে অনেক। পারস্পরিক দোষারোপ হয়েছে। হরতাল হয়েছে। নিহত হয়েছেন পাঁচজন। সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছে যেমনটি হয়েছে সব হরতালে। দলীয় রাজনীতির রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। একটি টক শোতে দেখলাম, একজন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক এই বলে আক্ষেপ করলেন যে ইলিয়াস আলীর গুম হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করার সভায় বিরোধী দলের নেত্রীকে বেশ হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছিল এবং তিনি অনবরত কী যেন চিবুচ্ছিলেন।
ইকোনমিস্ট পত্রিকার প্রবন্ধ দুটি নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। সরকারের ব্যর্থতার তালিকা এত দীর্ঘ যে তারা ভারত সরকারকে আহ্বান করল বাংলাদেশের দিকে নজর দিতে। জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগল কি? সরকারের ব্যর্থতায় আমরা এতই ক্ষুব্ধ যে আমাদের এসব চিন্তা করার সময় কোথায়? কিন্তু যেটি মোটেই আলোচনা হলো না তা হচ্ছে বিরোধী দল সম্পর্কে দুটি মন্তব্য। ইকোনমিস্ট লিখেছিল, "বর্তমান বিরোধী দলের নেত্রী ক্ষমতায় থাকার সময় 'ভয়ংকর চৌর্যতন্ত্র' (Brutal Kleptocracy) সৃষ্টি করেছিলেন।" ইকোনমিস্ট আরো লিখেছিল যে প্রণব মুখার্জি দেখা করতে গেলে বিরোধী দলের নেত্রী ভারতকে 'বন্ধু' বলে অভিহিত করেন । ভারত বিরোধিতা আমাদের বিরোধী দলের একটি প্রধান নীতি। উঠতে বসতে তাঁরা ভারতের নিন্দা করেন। বিরোধী দলের নৈতিকতা কি প্রশ্নবিদ্ধ হয় না এমন সব আচরণে?
সমস্যা আসে। সমস্যা যায়। একটি সমস্যা এলে আগেরটির কথা ভুলে যাই। ইলিয়াস সমস্যা এলে কিবরিয়া সমস্যা ভুলে যাই। এমনকি ২০০১ সালের কথাও ভুলে যাই। সমস্যার এসব শোভাযাত্রার হট্টগোলে আমাদের গোচরেই আসে না যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কী হচ্ছে? কোর্টের সওয়াল-জবাবগুলোর বর্ণনা কিছু পত্রিকায় বেরোচ্ছে, কিন্তু ওগুলো নীরব। সরব সমস্যার পর্যালোচনায় আমরা এত ব্যস্ত যে ওগুলোর দিকে দৃষ্টিপাতে আমাদের মন সায় দেয় না। শুধু শোকার্ত পরিজনরা চোখ মোছেন। আর যদি উত্তেজক সমস্যাগুলো একটি চলে গেলে আর একটি আনা যায় এবং সেগুলোকে যদি বহুল আলোচিত করা যায় তবে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় তারা হবে প্রত্যাখ্যাত। ক্ষমতায় আসবে যারা যুদ্ধাপরাধ বিস্মৃতির অন্ধকারে ফেলে দিতে চায় তারা। ব্যস, তবে আর কী? সব ঝামেলা শেষ।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী মনোচিকিৎসক
No comments