সাক্ষাৎকার-মধ্যপ্রাচ্যে অনেক দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে by আশফাকুর রহমান
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অজয় দাশগুপ্ত মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে যে গণজোয়ার চলছে তার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং শ্রমবাজারে কীভাবে ও কতটা পড়বে এবং তা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাব্য পথগুলো কী কী_ মেট্রোপলিটন চেম্বার এ ধরনের একটি আলোচনার আয়োজন করেছিল ১৬ মে।
চীন, জার্মানি ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং লন্ডন, তেহরান, স্টকহোম ও মস্কোর মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেছেন আশফাকুর রহমান। মেট্রোপলিটন চেম্বারে ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের পরিচালক মামুন রশীদের আলোচ্য বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী ও তথ্যমূলক নিবন্ধের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ঘটনাপ্রবাহের ওপর বাংলাদেশের গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। বিশেষ নজর রাখতে হবে সৌদি আরব, মিসর ও ইরানের ওপর। এ মন্তব্যের সূত্র ধরেই ২১ মে দুপুরে সেন্টার ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্সের গুলশান অফিসে কথা হয় তার সঙ্গে। কেন তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেন?
সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে
আশফাকুর রহমান বলেন, তিউনিসিয়া ও মিসরে গণবিক্ষোভের ফলে বহু বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। লিবিয়া, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান প্রভৃতি দেশে চলছে প্রচণ্ড আলোড়ন। সৌদি আরবের শাসকরা জনগণকে কার্যত ঘুষ দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু কতদিন তা সম্ভব হবে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সেখানের পরিবর্তনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি জানেন, ওই অঞ্চলের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আমি বলব, বিশ্বের অনেক দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে আরব বিশ্বে। তাদের তেলসম্পদ এর বড় কারণ। বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের অসংখ্য দক্ষ-অদক্ষ কর্মী সেখানে কাজ করে। তাদের রাজনৈতিক গতিবিধির ওপর আমাদের মনোযোগ থাকতেই হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বারের আলোচনার সূত্রপাত করে মামুন রশীদ জানান, ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৬ লাখ মানুষ কাজ নিয়ে গিয়েছে। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ সেখানে এখনও কাজ করছে। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখান থেকে বাংলাদেশি কর্মীরা বৈধপথেই দেশে পাঠিয়েছে এক হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। আগের বছর পাঠিয়েছিল ২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সৌদি আরবে বাংলাদেশের যত কর্মী রয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও তা বেশি। লিবিয়া সংকটের কারণে সেখান থেকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষকে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ হিমশিম খেয়েছে। সৌদি আরবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অবস্থা কী দাঁড়াবে?
আশফাকুর রহমান বলেন, সৌদি আরবে রয়েছে রাজতন্ত্র। মধ্যপ্রাচ্যের মূল সমস্যা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে ঘিরে। মিসরের সঙ্গে রয়েছে তাদের সীমান্ত। সৌদি আরব নিজেকে এ সমস্যার সঙ্গে ততটা যুক্ত করেনি। সৌদি বাদশা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতি নমনীয়। ইরানের ধর্মীয় নেতা খোমেনি সৌদি বাদশাহকে বলতেন গভর্নর অব হেজাজ। ব্রিটিশরা তাদের বাদশাহ বানিয়েছে। বাংলাদেশের এ দেশটির ওপর নির্ভরতার অন্যতম কারণ হলো ২৫-২৬ লাখ কর্মীর সেখানে অবস্থান। তারা খুব কম সুবিধা নিয়ে সেখানে কাজ করে। ধর্ম নয়, বরং অর্থনীতিই তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত রচনা করে দিয়েছে। তবুও তেলের বড় রিজার্ভের কারণে সৌদি আরব বিশ্বের তেলের দর নির্ধারণেও ভূমিকা রাখে।
আশফাকুর রহমান বলেন, সৌদি বাদশাহরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ব্রিটিশরা যখন বর্তমান শাসক পরিবারকে ক্ষমতায় বসায় তখন তারা রক্ষণশীল ওহাবি মতের অনুসারীদের সঙ্গে আপস করে। ইসলামে রাজতন্ত্র থাকার কথা নয়। সৌদি আরবে বহাল তবিয়তে তা রয়েছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ জেগে উঠতে শুরু করেছে। তার প্রভাব সৌদি আরবে পড়বেই। আমি মনে করি, ওই দেশটিতে গণতন্ত্র জয়যুক্ত হলে তা মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কেন এ জনবিস্ফোরণ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনগণ মনে হয় ঘুমিয়েছিল। বাদশাহ পরিবার কিংবা কয়েক দশক ধরে ক্ষমতাসীন নেতা এবং তাদের আত্মীয়-পরিজন যা বলত সেটিই সবাই মেনে নিত। হঠাৎ কেন এ জনবিস্ফোরণ?
এমন প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির প্রতি গভীর মনোযোগ রেখে চলা আশফাকুর রহমান বলেন, সেখানে মধ্যবিত্তদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েও চাকরি মেলে না। বুদ্ধিজীবীরা বৈরী। তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ নেই। শাসকশ্রেণীর মধ্যেও দেখা দিয়েছে বিভেদ। সর্বোপরি মিসর, তিউনিসিয়ার মতো কয়েকটি দেশে পড়েছে দ্রব্যমূল্যের কশাঘাত। কায়রোতে গত জানুয়ারিতে পুলিশের নিষ্ঠুরতার শিকার হয় এক শিক্ষিত তরুণ খালিদ সাইদ। এ ঘটনা ফেসবুকে চলে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সর্বত্র বার্তা ছড়িয়ে পড়ে, 'আমরা সবাই খালিদ সাইদ।' আগে এ ধরনের জনরোষ নিয়ন্ত্রণ কিংবা তার প্রকাশ বন্ধ রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি এখন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
কী ঘটছে জানতে হবে, বুঝতে হবে
বর্তমান বাদশাহ পরিবর্তনের প্রয়োজন বুঝতে পারছেন। প্রিন্সদের মধ্যে কেউ কেউ উদার মনোভাব পোষণ করেন। কিন্তু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সেখানের কট্টরপন্থি ওহাবিরা। তাদের এ মনোভাবের কারণে সংঘাত অনিবার্য। সেখানে অস্থিরতা দেখা দিলে আমরা ২৫ লাখ মানুষকে ফেরত আনতে পারব না। কিন্তু আমরা যা পারি তা হচ্ছে সেখানের পরিস্থিতির ওপর তীক্ষষ্ট নজর রাখা। যদি পরিবর্তন ঘটে তাহলে কি নতুন শাসকরা বিদেশিদের ফেরত পাঠাবে? এখন তারা বিদেশ থেকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী নিচ্ছে। অথচ তাদের দেশেও এ ধরনের দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে। শুধু সৌদি আরব, মিসর বা লিবিয়া নয়_ প্রতিটি দেশের প্রতিই আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। প্রতিটি দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। এ কারণে আমাদের সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র দফতরের উচিত হবে, ওইসব দেশে সেরা কূটনীতিকদের পাঠানো। এমন কর্মী নির্বাচিত করতে হবে যাদের ভূমণ্ডলীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। কেবল রুটিন কাজ করলে চলবে না। সরকারি ও বিরোধী_ সবার সঙ্গেই যোগাযোগ বাড়াতে হবে। লিবিয়ায় বিরোধীদের সঙ্গে কতটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু তারা ক্ষমতায় এসে যদি বলে, বাংলাদেশ গাদ্দাফিকে সমর্থন দিয়েছে, এ কারণে তাদের যেসব মানুষ দেশে চলে গেছে তাদের আর ফেরত নেওয়া হবে না, তাহলে? ইরানে আয়াতুল্লাহরা খুব ক্ষমতাশালী। সেখানের রাষ্ট্রপতি ও অন্য মন্ত্রীদের প্রতিটি কাজ গার্ডিয়ান কাউন্সিল দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ জন্য আমাদের কূটনীতিকদের কাজ হচ্ছে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিধির বাইরেও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখা। ইরান এক সময় বিপ্লব রফতানির পথ নিয়েছিল। কিন্তু লেবাননে তা ব্যর্থ হলে এ চিন্তা এখন তেমন জোরালো নেই। তবে তারা পারমাণবিক প্রযুক্তি আয়ত্তে আনার প্রশ্নে অনড়। আবার এটিও লক্ষণীয়, তাদের খুব বেশি বল্পুব্দ দেশ নেই। পাশের দুই পড়শি রাশিয়া ও আজারবাইজানের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তো পহেলা নম্বরের দুশমন। পাকিস্তান ও ভারতে পাইপলাইনে গ্যাস রফতানি করে এ বিচ্ছিন্নতা তারা কাটাতে চাইছে। তেল সম্পদের বাইরেও অন্য পণ্য উৎপাদনেও তারা সচেষ্ট। গণতন্ত্রও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আমাদের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক তেমন গভীর নয়। কিন্তু বৈরিতার ইস্যুও নেই। ইরানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাড়ানোর একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। ফার্সি এক সময় এ ভূখণ্ডে রাজভাষা ছিল। বাংলা ভাষায় প্রচুর শব্দ নেওয়া হয়েছে ফার্সি থেকে। সেখানে দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদী ও ফেরদৌসীসহ অনেক মনীষীর নাম ও কাজ সম্পর্কে বাংলাদেশের অনেকেই অবহিত জেনে তারা বিস্মিত হতো। এ সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে।
কোন পথে যাবে?
মিসরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে শিগগিরই। হোসনি মোবারক-পরবর্তী মিসরের ক্ষমতায় কারা আসছে? এ প্রশ্নে আশফাকুর রহমান বলেন, তিউনিসিয়া ও মিসরের দুরবস্থার জন্য সেনাবাহিনীর দায় কম নয়। তারা একই শাসককে যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় রেখেছে। ইসরায়েলেরও পছন্দের মানুষ ছিল তারা। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় বিস্তর। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল চাইছে তাদের পছন্দের লোকজন আর্মির মদদে ক্ষমতায় আসুক। এটি হলে বিপ্লবের সুফল তার স্রষ্টা তরুণ প্রজন্মের ঘরে উঠবে না। তাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।
সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে
মধ্যপ্রাচ্য আমাদের জন্য মাথাব্যথার কারণ। আবার সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে_ এমন মত কেন? এ প্রশ্নে আশফাকুর রহমান বলেন, সৌদি আরবসহ অনেক দেশের হাতে বিনিয়োগের মতো প্রচুর অর্থ রয়েছে। তাদের বিনিয়োগের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। কিন্তু উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার অভাব স্পষ্ট। সামনের দিনগুলোতে তা প্রকট হতে পারে। এ কারণে তাদের বিনিয়োগের জন্য নতুন ক্ষেত্র খুঁজতে হবে। বাংলাদেশ তাদের পছন্দের গন্তব্য হতে পারে। তবে এ জন্য দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা আকৃষ্ট হয়।
আমরা খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ নই। কিন্তু আতিথেয়তা, সময়ানুবর্তিতা, কর্মদক্ষতা_ এসব দিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি। আমাদের বেসরকারি খাত ভালো করছে। কৃষকরা অসাধ্য সাধন করে চলেছেন। আরব দেশগুলোর নেতৃত্ব ও জনগণের কাছে আমাদের এ সম্ভাবনা তুলে ধরতে হবে। সিঙ্গাপুরে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আশফাকুর রহমান বলেন, তারা প্রথমে সমুদ্রবন্দর বড় করেছে। তারপর নজর দিয়েছে বিমানবন্দরকে আরও বড় করার প্রতি। ইন্দোনেশিয়া তাদের খাবার পানির উৎস। এ কারণে সেখানের সঙ্গে জাহাজ চলাচলের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। বিদেশিরা তাদের দেশে গেলে বিনামূল্যে চকোলেট দিয়েছে। এ থেকে তারা বার্তা দিয়েছে_ 'মিষ্টিমুখ হলো, এখন আমাদের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলো।' আমাদের দেশ বাংলাদেশ অবশ্যই সিঙ্গাপুরের চেয়ে অনেক ধরনের সম্পদে এগিয়ে। আমরা নিশ্চয়ই আরও অনেক সমৃদ্ধ হতে পারব।
সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে
আশফাকুর রহমান বলেন, তিউনিসিয়া ও মিসরে গণবিক্ষোভের ফলে বহু বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। লিবিয়া, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান প্রভৃতি দেশে চলছে প্রচণ্ড আলোড়ন। সৌদি আরবের শাসকরা জনগণকে কার্যত ঘুষ দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু কতদিন তা সম্ভব হবে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সেখানের পরিবর্তনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি জানেন, ওই অঞ্চলের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আমি বলব, বিশ্বের অনেক দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে আরব বিশ্বে। তাদের তেলসম্পদ এর বড় কারণ। বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের অসংখ্য দক্ষ-অদক্ষ কর্মী সেখানে কাজ করে। তাদের রাজনৈতিক গতিবিধির ওপর আমাদের মনোযোগ থাকতেই হবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বারের আলোচনার সূত্রপাত করে মামুন রশীদ জানান, ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৬ লাখ মানুষ কাজ নিয়ে গিয়েছে। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ সেখানে এখনও কাজ করছে। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখান থেকে বাংলাদেশি কর্মীরা বৈধপথেই দেশে পাঠিয়েছে এক হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। আগের বছর পাঠিয়েছিল ২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সৌদি আরবে বাংলাদেশের যত কর্মী রয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও তা বেশি। লিবিয়া সংকটের কারণে সেখান থেকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষকে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ হিমশিম খেয়েছে। সৌদি আরবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অবস্থা কী দাঁড়াবে?
আশফাকুর রহমান বলেন, সৌদি আরবে রয়েছে রাজতন্ত্র। মধ্যপ্রাচ্যের মূল সমস্যা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে ঘিরে। মিসরের সঙ্গে রয়েছে তাদের সীমান্ত। সৌদি আরব নিজেকে এ সমস্যার সঙ্গে ততটা যুক্ত করেনি। সৌদি বাদশা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতি নমনীয়। ইরানের ধর্মীয় নেতা খোমেনি সৌদি বাদশাহকে বলতেন গভর্নর অব হেজাজ। ব্রিটিশরা তাদের বাদশাহ বানিয়েছে। বাংলাদেশের এ দেশটির ওপর নির্ভরতার অন্যতম কারণ হলো ২৫-২৬ লাখ কর্মীর সেখানে অবস্থান। তারা খুব কম সুবিধা নিয়ে সেখানে কাজ করে। ধর্ম নয়, বরং অর্থনীতিই তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত রচনা করে দিয়েছে। তবুও তেলের বড় রিজার্ভের কারণে সৌদি আরব বিশ্বের তেলের দর নির্ধারণেও ভূমিকা রাখে।
আশফাকুর রহমান বলেন, সৌদি বাদশাহরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ব্রিটিশরা যখন বর্তমান শাসক পরিবারকে ক্ষমতায় বসায় তখন তারা রক্ষণশীল ওহাবি মতের অনুসারীদের সঙ্গে আপস করে। ইসলামে রাজতন্ত্র থাকার কথা নয়। সৌদি আরবে বহাল তবিয়তে তা রয়েছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ জেগে উঠতে শুরু করেছে। তার প্রভাব সৌদি আরবে পড়বেই। আমি মনে করি, ওই দেশটিতে গণতন্ত্র জয়যুক্ত হলে তা মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কেন এ জনবিস্ফোরণ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনগণ মনে হয় ঘুমিয়েছিল। বাদশাহ পরিবার কিংবা কয়েক দশক ধরে ক্ষমতাসীন নেতা এবং তাদের আত্মীয়-পরিজন যা বলত সেটিই সবাই মেনে নিত। হঠাৎ কেন এ জনবিস্ফোরণ?
এমন প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির প্রতি গভীর মনোযোগ রেখে চলা আশফাকুর রহমান বলেন, সেখানে মধ্যবিত্তদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েও চাকরি মেলে না। বুদ্ধিজীবীরা বৈরী। তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ নেই। শাসকশ্রেণীর মধ্যেও দেখা দিয়েছে বিভেদ। সর্বোপরি মিসর, তিউনিসিয়ার মতো কয়েকটি দেশে পড়েছে দ্রব্যমূল্যের কশাঘাত। কায়রোতে গত জানুয়ারিতে পুলিশের নিষ্ঠুরতার শিকার হয় এক শিক্ষিত তরুণ খালিদ সাইদ। এ ঘটনা ফেসবুকে চলে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সর্বত্র বার্তা ছড়িয়ে পড়ে, 'আমরা সবাই খালিদ সাইদ।' আগে এ ধরনের জনরোষ নিয়ন্ত্রণ কিংবা তার প্রকাশ বন্ধ রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি এখন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
কী ঘটছে জানতে হবে, বুঝতে হবে
বর্তমান বাদশাহ পরিবর্তনের প্রয়োজন বুঝতে পারছেন। প্রিন্সদের মধ্যে কেউ কেউ উদার মনোভাব পোষণ করেন। কিন্তু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সেখানের কট্টরপন্থি ওহাবিরা। তাদের এ মনোভাবের কারণে সংঘাত অনিবার্য। সেখানে অস্থিরতা দেখা দিলে আমরা ২৫ লাখ মানুষকে ফেরত আনতে পারব না। কিন্তু আমরা যা পারি তা হচ্ছে সেখানের পরিস্থিতির ওপর তীক্ষষ্ট নজর রাখা। যদি পরিবর্তন ঘটে তাহলে কি নতুন শাসকরা বিদেশিদের ফেরত পাঠাবে? এখন তারা বিদেশ থেকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী নিচ্ছে। অথচ তাদের দেশেও এ ধরনের দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে। শুধু সৌদি আরব, মিসর বা লিবিয়া নয়_ প্রতিটি দেশের প্রতিই আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। প্রতিটি দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। এ কারণে আমাদের সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র দফতরের উচিত হবে, ওইসব দেশে সেরা কূটনীতিকদের পাঠানো। এমন কর্মী নির্বাচিত করতে হবে যাদের ভূমণ্ডলীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। কেবল রুটিন কাজ করলে চলবে না। সরকারি ও বিরোধী_ সবার সঙ্গেই যোগাযোগ বাড়াতে হবে। লিবিয়ায় বিরোধীদের সঙ্গে কতটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু তারা ক্ষমতায় এসে যদি বলে, বাংলাদেশ গাদ্দাফিকে সমর্থন দিয়েছে, এ কারণে তাদের যেসব মানুষ দেশে চলে গেছে তাদের আর ফেরত নেওয়া হবে না, তাহলে? ইরানে আয়াতুল্লাহরা খুব ক্ষমতাশালী। সেখানের রাষ্ট্রপতি ও অন্য মন্ত্রীদের প্রতিটি কাজ গার্ডিয়ান কাউন্সিল দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ জন্য আমাদের কূটনীতিকদের কাজ হচ্ছে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিধির বাইরেও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখা। ইরান এক সময় বিপ্লব রফতানির পথ নিয়েছিল। কিন্তু লেবাননে তা ব্যর্থ হলে এ চিন্তা এখন তেমন জোরালো নেই। তবে তারা পারমাণবিক প্রযুক্তি আয়ত্তে আনার প্রশ্নে অনড়। আবার এটিও লক্ষণীয়, তাদের খুব বেশি বল্পুব্দ দেশ নেই। পাশের দুই পড়শি রাশিয়া ও আজারবাইজানের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তো পহেলা নম্বরের দুশমন। পাকিস্তান ও ভারতে পাইপলাইনে গ্যাস রফতানি করে এ বিচ্ছিন্নতা তারা কাটাতে চাইছে। তেল সম্পদের বাইরেও অন্য পণ্য উৎপাদনেও তারা সচেষ্ট। গণতন্ত্রও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আমাদের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক তেমন গভীর নয়। কিন্তু বৈরিতার ইস্যুও নেই। ইরানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাড়ানোর একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। ফার্সি এক সময় এ ভূখণ্ডে রাজভাষা ছিল। বাংলা ভাষায় প্রচুর শব্দ নেওয়া হয়েছে ফার্সি থেকে। সেখানে দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদী ও ফেরদৌসীসহ অনেক মনীষীর নাম ও কাজ সম্পর্কে বাংলাদেশের অনেকেই অবহিত জেনে তারা বিস্মিত হতো। এ সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে।
কোন পথে যাবে?
মিসরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে শিগগিরই। হোসনি মোবারক-পরবর্তী মিসরের ক্ষমতায় কারা আসছে? এ প্রশ্নে আশফাকুর রহমান বলেন, তিউনিসিয়া ও মিসরের দুরবস্থার জন্য সেনাবাহিনীর দায় কম নয়। তারা একই শাসককে যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় রেখেছে। ইসরায়েলেরও পছন্দের মানুষ ছিল তারা। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় বিস্তর। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল চাইছে তাদের পছন্দের লোকজন আর্মির মদদে ক্ষমতায় আসুক। এটি হলে বিপ্লবের সুফল তার স্রষ্টা তরুণ প্রজন্মের ঘরে উঠবে না। তাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।
সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে
মধ্যপ্রাচ্য আমাদের জন্য মাথাব্যথার কারণ। আবার সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে_ এমন মত কেন? এ প্রশ্নে আশফাকুর রহমান বলেন, সৌদি আরবসহ অনেক দেশের হাতে বিনিয়োগের মতো প্রচুর অর্থ রয়েছে। তাদের বিনিয়োগের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। কিন্তু উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার অভাব স্পষ্ট। সামনের দিনগুলোতে তা প্রকট হতে পারে। এ কারণে তাদের বিনিয়োগের জন্য নতুন ক্ষেত্র খুঁজতে হবে। বাংলাদেশ তাদের পছন্দের গন্তব্য হতে পারে। তবে এ জন্য দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা আকৃষ্ট হয়।
আমরা খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ নই। কিন্তু আতিথেয়তা, সময়ানুবর্তিতা, কর্মদক্ষতা_ এসব দিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি। আমাদের বেসরকারি খাত ভালো করছে। কৃষকরা অসাধ্য সাধন করে চলেছেন। আরব দেশগুলোর নেতৃত্ব ও জনগণের কাছে আমাদের এ সম্ভাবনা তুলে ধরতে হবে। সিঙ্গাপুরে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আশফাকুর রহমান বলেন, তারা প্রথমে সমুদ্রবন্দর বড় করেছে। তারপর নজর দিয়েছে বিমানবন্দরকে আরও বড় করার প্রতি। ইন্দোনেশিয়া তাদের খাবার পানির উৎস। এ কারণে সেখানের সঙ্গে জাহাজ চলাচলের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। বিদেশিরা তাদের দেশে গেলে বিনামূল্যে চকোলেট দিয়েছে। এ থেকে তারা বার্তা দিয়েছে_ 'মিষ্টিমুখ হলো, এখন আমাদের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলো।' আমাদের দেশ বাংলাদেশ অবশ্যই সিঙ্গাপুরের চেয়ে অনেক ধরনের সম্পদে এগিয়ে। আমরা নিশ্চয়ই আরও অনেক সমৃদ্ধ হতে পারব।
No comments