'নয়ন সম্মুখে তুমি নাই' by আতিকুল হক চৌধুরী
তিনি আজ নেই। অথচ তিনি একদিন ছিলেন আমাদেরই মাঝে। কথা বলেছেন, কত কিছু লিখেছেন, ঘরে-বাইরে আপনজনদের সঙ্গে মিশেছেন, কারও বিপদাপদের কথা শুনলেই ছুটে গেছেন, গোপনে গোপনে কত জনকে কতভাবে না সাহায্য করেছেন, শিল্পী-সাহিত্যিকদের আসরে বসেছেন, কবিতা উৎসবে কবিতা আবৃত্তি করেছেন, কবিতা
শুনেছেন। কবিতা নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্ন বিলিয়েছেন। সেই মানুষটি আমাদের মাঝ থেকে হঠাৎ করে চলে গেলেন কোথায়? জানি না আমরা কতজন তার কথা স্মরণ করছি, তার অভাব অনুভব করছি, পাঠ করছি তার কবিতা? তাকে নিয়ে কোথাও কি স্মরণসভা হচ্ছে কোনো? তার শেষ শয্যার কাছে দাঁড়িয়ে কেউ কি তার সমাধিতে সমর্পণ করছেন কোনো শ্রদ্ধা বা ভালোবাসার অঞ্জলি?
না, লোকচক্ষুর আড়ালে নিভৃতে যতনে শুধু তারাই পরিবারের ক'জনা তার নিজের ক'টি সন্তান ঘরে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছেন_ ফকির-মিসকিনদের যত্ন সহকারে খাবার পরিবেশন করছেন? একজন মানুষ আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলে এমনি করেই কি আমরা তার সবকিছু এত সহজে ভুলে যাই? মনে কি রাখি না কিছুই? অথচ এই মানুষটিই আমাদের জন্য কত কষ্ট করে, কত পরিশ্রম করে নিজের আরাম-আয়েশ তুচ্ছ করে নিজের হাতে আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখে গেছেন আমাদের মানস লোক উদ্ভাসনার কত না শিল্পিত সৃষ্টি সম্ভার। তিনি এই প্রজন্ম বা আগামী প্রজন্মের জন্য হয়তো নির্মাণ করে যাননি কোনো বসবাসের সুরম্য অট্টালিকা, কিন্তু আমাদের শিল্প ও সাহিত্যের সবুজ আঙিনায় আমাদের মন ও মানসকে তৈরি করার অপরূপ সৃষ্টির ৪৩টি ইমারত তিনি তৈরি করে গেছেন। তিনি কবিতা লিখেছেন, গান রচনা করেছেন, গল্প লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের এক পদস্থ অফিসারের দায়িত্বও পালন করেছেন সুষ্ঠুভাবে। তিনি বড়দের জন্য লিখেছেন, কিশোরদের জন্য লিখেছেন, শিশুদের জন্য লিখেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ ছিলেন। ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী একজন মানুষ, যিনি তার সব সত্তা দিয়ে ভালোবেসেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন। তিনি ধর্মান্ধ ছিলেন না, কিন্তু ধর্ম সচেতন ছিলেন অবশ্যই। তিনি ঘর দেখেছেন, বাহির দেখেছেন। ঘরে-বাইরের এমন সুন্দর যোগসূত্র স্থাপন করার মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণাকে তিনি এক অলৌকিক রোমান্টিক আলোকে উদ্ভাসিত করে গেছেন তার বিশাল সাহিত্যকর্মের মাঝে। নিষ্ঠুর পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতার মাঝেও তিনি থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন অনাবিল মায়া-মমতার কত না উজ্জ্বল প্রদীপ। তার নয়নের মণি সঙ্গীতা, সুমনা ও প্রবাল আজও নিজ নিজ ভুবনে প্রতিভাদীপ্ত, উজ্জ্বল। খালেদা এদিব চৌধুরীর প্রতিটি রচনায় উদ্ভাসিত হয়েছে এক পবিত্র প্রেমের উজ্জ্বল মহিমা, যা মৃত্যুকে পর্যন্ত অপরূপ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। কষ্টের ও বেদনার চাদর গায়ে না জড়ালে কেউ কি কবি হতে পারে? কবিতা লিখতে পারে? পারে কি কোনো লেখক হতে? পারে কি ভালোবাসতে? যন্ত্রণার বাহারি পুষ্পকোরক অন্তরে ধারণ করতে পেরেছিলেন বলেই বোধকরি খালেদা এদিব চৌধুরী জীবনের সব চিত্র-বিচিত্র পথ পার হয়ে সব দুঃখবোধ ও শূন্যতাবোধ অতিক্রম করে একদিকে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে, অপরদিকে ভরা পূর্ণিমার পরতে পরতেও রেখে যেতে পেরেছিলেন 'জীবন-সত্যের' অপরূপ ঝিলিক। তীব্র আঁধারের মাঝেও খালেদা এদিব চৌধুরী খুঁজতে চেয়েছেন রঙিন টুকটুকে একটি দিন। নিষ্প্রাণ নষ্ট পৃথিবী তিনি সাজাতে চেয়েছেন তার ভালোবাসার মানুষ দিয়ে। খালেদা এদিব চৌধুরী নাইবা পেলেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, কিন্তু তার অগণিত ভক্ত-পাঠকের কাছে ভালোবাসার যে অমূল্য পদক তিনি পেয়ে গেছেন তা কি কম মূল্যহীন?
১৯৩৯ সালের ৩ জুলাই তিনি জন্মেছিলেন কুমিল্লা জেলার পরগাছা গ্রামের প্রখ্যাত চৌধুরী পরিবারে আর চলে গেলেন এই ঢাকাতে ২০০৮ সালের ২৮ মে। আজ তার চলে যাওয়ার দিন। চলে যাওয়া কি হারিয়ে যাওয়া? তিনিই তো লিখে গেছেন_
'তুমি চলে গেছ, কী হয়েছে তাতে
স্মৃতি তো উড়ছে বাতাসে।
তোমার চোখের মণি জ্বলে এই চোখের আকাশে, চেয়ে দেখি আজো আছো তো এখানে,
আসলে দূরেই যাওনি; এত যে খুঁজেছ তীব্র দহনে, তবু খুঁজে আর পাওনি'।
আতিকুল হক চৌধুরী : নাট্যকার ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
না, লোকচক্ষুর আড়ালে নিভৃতে যতনে শুধু তারাই পরিবারের ক'জনা তার নিজের ক'টি সন্তান ঘরে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছেন_ ফকির-মিসকিনদের যত্ন সহকারে খাবার পরিবেশন করছেন? একজন মানুষ আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলে এমনি করেই কি আমরা তার সবকিছু এত সহজে ভুলে যাই? মনে কি রাখি না কিছুই? অথচ এই মানুষটিই আমাদের জন্য কত কষ্ট করে, কত পরিশ্রম করে নিজের আরাম-আয়েশ তুচ্ছ করে নিজের হাতে আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখে গেছেন আমাদের মানস লোক উদ্ভাসনার কত না শিল্পিত সৃষ্টি সম্ভার। তিনি এই প্রজন্ম বা আগামী প্রজন্মের জন্য হয়তো নির্মাণ করে যাননি কোনো বসবাসের সুরম্য অট্টালিকা, কিন্তু আমাদের শিল্প ও সাহিত্যের সবুজ আঙিনায় আমাদের মন ও মানসকে তৈরি করার অপরূপ সৃষ্টির ৪৩টি ইমারত তিনি তৈরি করে গেছেন। তিনি কবিতা লিখেছেন, গান রচনা করেছেন, গল্প লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের এক পদস্থ অফিসারের দায়িত্বও পালন করেছেন সুষ্ঠুভাবে। তিনি বড়দের জন্য লিখেছেন, কিশোরদের জন্য লিখেছেন, শিশুদের জন্য লিখেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ ছিলেন। ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী একজন মানুষ, যিনি তার সব সত্তা দিয়ে ভালোবেসেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন। তিনি ধর্মান্ধ ছিলেন না, কিন্তু ধর্ম সচেতন ছিলেন অবশ্যই। তিনি ঘর দেখেছেন, বাহির দেখেছেন। ঘরে-বাইরের এমন সুন্দর যোগসূত্র স্থাপন করার মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণাকে তিনি এক অলৌকিক রোমান্টিক আলোকে উদ্ভাসিত করে গেছেন তার বিশাল সাহিত্যকর্মের মাঝে। নিষ্ঠুর পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতার মাঝেও তিনি থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন অনাবিল মায়া-মমতার কত না উজ্জ্বল প্রদীপ। তার নয়নের মণি সঙ্গীতা, সুমনা ও প্রবাল আজও নিজ নিজ ভুবনে প্রতিভাদীপ্ত, উজ্জ্বল। খালেদা এদিব চৌধুরীর প্রতিটি রচনায় উদ্ভাসিত হয়েছে এক পবিত্র প্রেমের উজ্জ্বল মহিমা, যা মৃত্যুকে পর্যন্ত অপরূপ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। কষ্টের ও বেদনার চাদর গায়ে না জড়ালে কেউ কি কবি হতে পারে? কবিতা লিখতে পারে? পারে কি কোনো লেখক হতে? পারে কি ভালোবাসতে? যন্ত্রণার বাহারি পুষ্পকোরক অন্তরে ধারণ করতে পেরেছিলেন বলেই বোধকরি খালেদা এদিব চৌধুরী জীবনের সব চিত্র-বিচিত্র পথ পার হয়ে সব দুঃখবোধ ও শূন্যতাবোধ অতিক্রম করে একদিকে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে, অপরদিকে ভরা পূর্ণিমার পরতে পরতেও রেখে যেতে পেরেছিলেন 'জীবন-সত্যের' অপরূপ ঝিলিক। তীব্র আঁধারের মাঝেও খালেদা এদিব চৌধুরী খুঁজতে চেয়েছেন রঙিন টুকটুকে একটি দিন। নিষ্প্রাণ নষ্ট পৃথিবী তিনি সাজাতে চেয়েছেন তার ভালোবাসার মানুষ দিয়ে। খালেদা এদিব চৌধুরী নাইবা পেলেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, কিন্তু তার অগণিত ভক্ত-পাঠকের কাছে ভালোবাসার যে অমূল্য পদক তিনি পেয়ে গেছেন তা কি কম মূল্যহীন?
১৯৩৯ সালের ৩ জুলাই তিনি জন্মেছিলেন কুমিল্লা জেলার পরগাছা গ্রামের প্রখ্যাত চৌধুরী পরিবারে আর চলে গেলেন এই ঢাকাতে ২০০৮ সালের ২৮ মে। আজ তার চলে যাওয়ার দিন। চলে যাওয়া কি হারিয়ে যাওয়া? তিনিই তো লিখে গেছেন_
'তুমি চলে গেছ, কী হয়েছে তাতে
স্মৃতি তো উড়ছে বাতাসে।
তোমার চোখের মণি জ্বলে এই চোখের আকাশে, চেয়ে দেখি আজো আছো তো এখানে,
আসলে দূরেই যাওনি; এত যে খুঁজেছ তীব্র দহনে, তবু খুঁজে আর পাওনি'।
আতিকুল হক চৌধুরী : নাট্যকার ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
তিনি নীরবেই থাকবেন আমাদের মনের গভীরে চিরদিন।
ReplyDelete