সমসময়-ডা. জাহিদ হোসেন এ যাত্রা বেঁচে গেলেন কপাল জোরে by আতাউস সামাদ

সব শেষে আমার একটি প্রশ্ন, আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি যদি ডা. জাহিদ হোসেনের মতো সমাজে সুপরিচিত, প্রতিষ্ঠিত ও বহু শুভানুধ্যায়ীর সমর্থনধন্য ব্যক্তি না হয়ে একজন অতি সাধারণ ও অপরিচিত নাগরিক হতেন, তিনি কি আত্মপক্ষ সমর্থন করার মতো সব দলিলপত্র একদিনের মধ্যে সংগ্রহ করতে পারতেন? না, পারতেন না


বাংলাদেশে অতি বিস্ময়কর দুটি ঘটনা ঘটেছে গত সোমবার ঢাকার মহানগর আদালতে। ঘটনা দুটির প্রেক্ষাপট হলো, গত রোববার গোয়েন্দা পুলিশ খ্যাতনামা চিকিৎসক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব, বর্তমানে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাসচিব ও বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনকে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দলের গত রোববার সন্ধ্যায় গ্রেফতার করা। তার অপরাধ হলো, রাজধানীর নাখালপাড়ায় একটি নির্মীয়মাণ হাসপাতাল ভবনের ভিত তৈরির কাজ চলার সময় সেখানে ধস হয় এবং আশপাশের কয়েকটি বাড়ির বড় ধরনের ক্ষতি হয়। এই অপরাধে ডা. জাহিদ হোসেন দোষী হলেন কেন? এই বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা তেজগাঁও থানায় ৭টি ও রাজউক একটি মামলা করে। এরই একটির জের ধরে ডিবি পুলিশ ডা. জাহিদ হোসেনকে তার চেম্বার থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তেজগাঁও থানায় নয়, ক্যান্টনমেন্ট থানায়। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি তদন্তকারীদের বারবার জানান যে, নির্মীয়মাণ হাসপাতালের মালিকানা, ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা কোনো কিছুর সঙ্গে তিনি বা তার পরিবারের কারও কোনো সম্পর্ক নেই। পুলিশ তাকে অভিযোগকারীদের একটি জিডি দেখায় যাতে ওই হাসপাতালটির মালিক হিসেবে 'জাহিদ' নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ ছিল এবং যার নামের পাশে পদবি লেখা ছিল 'ড্যাব মহাসচিব'। ডা. জাহিদ হোসেন তখন পুলিশকে দেখান যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির নামে 'জাহিদ' শব্দটি প্রথমে 'জাহির' লেখা ছিল; কিন্তু পরে অন্তের 'র' অক্ষরটি কেটে সেখানে 'দ' অক্ষরটি বসানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ওই ব্যক্তির নামে অন্য যেসব শব্দ আছে তার কোনোটির সঙ্গেই তার নামের কোনো শব্দের মিল নেই। তৃতীয়ত, হাসপাতালের মালিকদের মধ্যে কেউ কেউ তো পরপর দু'দিন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বক্তব্য দিয়েছেন তাদের কাউকে জিজ্ঞাসা করলেও পুলিশ জানতে পারবে যে, তাদের প্রতিষ্ঠানে তিনি কেউ নন। কিন্তু তবু তদন্তকারী গোয়েন্দা ও পুলিশরা ডা. জাহিদ হোসেনকে বলেন, তিনি তথ্য গোপন করছেন। অতঃপর তারা সারারাত তাকে ক্যান্টনমেন্ট থানার একটি হাজত কক্ষে আটকে রেখে পরদিন সকালে তেজগাঁও থানায় এনে দুপুরে ঢাকা মহানগর আদালতে নিয়ে যান।
সরকার পক্ষ সেখানে মাননীয় মহানগর হাকিম ইসমাইল হোসেনের আদালতে যে দাবি করে বসে তাতে 'সব হতে পারে'র দেশ বাংলাদেশ তো বটেই অপার বিস্ময়ে সারা বিশ্ববাসীর হতভম্ব হয়ে নির্বাক হয়ে যাওয়ার কথা। আদালতে বিজ্ঞ সরকারি উকিল ডা. জাহিদ হোসেনকে চারদিন না পাঁচ দিন না এমনকি দুই সপ্তাহ পর্যন্ত নয়, একেবারে একটানা ৫৬ দিনের জন্য পুলিশের রিমান্ডে দিতে বলেন। এ ব্যাপারে তার যুক্তি ও অঙ্ক একেবারে বোতলজাত পানীয় জলের মতো পরিষ্কার। তিনি বলেন, যেহেতু মোট ৮টি মামলা আছে এর প্রতিটিতে সাত দিন করে আট গুণন সাত যে ৫৬ হয় সেই ৫৬ দিনই ডা. জাহিদ হোসেনকে রিমান্ডে চাই। ওই ক'টা দিন তাকে জেরা করলে তবেই নাকি নাখালপাড়া ধসের কারণ জানা যাবে। আমি লেখার শুরুতে যে 'অতি বিস্ময়কর' দুটি ঘটনা ঘটার কথা বলেছি সরকারি উকিল ও পুলিশের দাবিটি তার মধ্যে প্রথম। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের কোনো আদালতে কোনো অভিযুক্তকে একবারে এত দীর্ঘ সময় রিমান্ডে নির্যাতিত করার দাবি এর আগে কখনও ওঠেনি। এমনকি পাকিস্তানি শাসনের সময় মুসলিম লীগ সরকার বা সেনাশাসক আইয়ুব খানের আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোনো বেসামরিক আদালতে কোনো বিরোধী রাজনীতিককে এত লম্বা সময় রিমান্ডে নিতে চাওয়া হয়েছিল বলে আমার মনে পড়ছে না। দুঃখজনকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে একটা নির্বাচিত সরকারের আমলে আমাদের এই অকল্পনীয় আবদারের কথা শুনতে হলো। তাও আবদারটা একজন শিক্ষক-চিকিৎসককে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করার জন্য। ডা. জাহিদ হোসেন নিশ্চয় খুবই সাহসী মানুষ এবং মহান আল্লাহতায়ালা তাকে অবশ্যই সাহায্য করেছিলেন, না হলে ৫৬ দিন রিমান্ডের দাবি শুনেই যার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ, ভয়ে তার হার্টফেল করার কথা। তবে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, যার দরুন খ্যাতনামা আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া ও তার সহযোগীরা তাদের মক্কেল ডা. জাহিদ হোসেন যে নির্দোষ সে দাবির পক্ষে দলিলপত্র পেশ করার সুযোগ পান।
এই আইনজীবীরা রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ কর্তৃক প্রত্যয়ন করা ওই নির্মাণাধীন হাসপাতালের মালিক কোম্পানিটির মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশনের কপি আদালতে দাখিল করেন। তারা মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখান যে, ওই দলিলে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার, বোর্ড অব ডিরেক্টরস এবং নির্বাহী কমিটির তালিকাগুলোর কোনোটিতে ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের নাম নেই। তারা কোম্পানির প্রকাশ করা একটি স্যুভেনিরের কপি পেশ করেন। এই স্যুভিনিরে কোম্পানির অংশীদার এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নাম ও ছবি ছাপা হয়েছিল। এতেও ডা. জাহিদ হোসেনের নাম বা ছবি ছিল না। এসবের সঙ্গে ডা. জাহিদ হোসেনের আইনজীবীরা রাজউকের কাছে প্রস্তাবিত হাসপাতাল ভবনের নকশা অনুমোদনের দরখাস্তের কপি পেশ করেন। তাতেও ডা. জাহিদ হোসেন অনুপস্থিত। আটটি জিডির মধ্যে সাতটিই ছিল জামিনযোগ্য ধারায়। জামিন অযোগ্য ধারার যে জিডিটি ছিল তাতে শুধু দুই ব্যক্তির নাম ছিল, অন্যরা বা অজ্ঞাত কথাগুলোও ছিল না এবং ওই দুই সন্দেহভাজনের মধ্যে ডা. জাহিদ হোসেনের নাম ছিল না। আদালতে পেশ করা সব দলিলপত্র দেখে এবং সরকার ও বিবাদীদের পক্ষের যুক্তি শুনে মহানগর হাকিম ইসমাইল হোসেন অভিযুক্ত ডা. জাহিদ হোসেনকে সাতটি মামলায় স্থায়ী জামিন এবং অজামিনযোগ্য ধারার মামলাটিতে চার্জশিট দাখিল হওয়া পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন। ডা. জাহিদ হোসেন মহানগর আদালত থেকেই মুক্তি পান।
আমার কাছে সেদিন আদালতে ঘটা দ্বিতীয় 'অতি বিস্ময়কর' ঘটনাটি হচ্ছে, ডা. জাহিদ হোসেন হাজিরার প্রথম দিনই এভাবে জামিনে মুক্ত হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কারও দ্বারা করা মামলায় গ্রেফতার হওয়া কোনো বিরোধী মতাবলম্বী নিম্ন আদালতে প্রথম দিনই জামিনে মুক্তি পান না। রিমান্ড আর হাজতবাস তাদের জন্য কপালের লিখন। আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে এমন ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঘটনা ঘটার সময় তিনি গ্রেফতার অবস্থায় পুলিশের ভ্যানে বসে কোর্টহাজতে নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে যে, আগে অনেককেই এভাবে বিপদ ও যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলছি, এ রকম হচ্ছে বলেই ইদানীং প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মহল ও আইনজীবীদের মধ্যে প্রকাশ্যে অভিযোগ উঠছে যে, সরকারি চাপে দেশের আদালতগুলো ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করছে। ফলে ন্যায়বিচার চাওয়া আর দুরাশা করা সমার্থক।
এখানে উল্লেখ করে রাখি, ডা. জাহিদ হোসেন রাজনৈতিকভাবে বিএনপির পক্ষে সক্রিয়। তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ ও ড্যাব_ এ দুই সংগঠনই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তথা বিএনপির সমর্থক। প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সভাপতি। ডা. জাহিদ হোসেনকে আমি চিনি তিনভাবে_ ১. চিকিৎসক, ২. বিএমএর মহাসচিব হিসেবে ডা. মিলন হত্যা দিবসে মেডিকেল কলেজে অনুষ্ঠিত আলোচনায় অংশ নিতে সেই দিনটির ঘটনাবলির এক প্রতিবেদক হিসেবে তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন এবং ৩. এক বছর আগে সরকার যখন এক বানোয়াট মামলা লাগিয়ে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা জোর করে বন্ধ করে দেয়, পুলিশকে দিয়ে আমার দেশ প্রেস সিল করে দেয় এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে, তখন থেকে তিনি এর প্রতিবাদে সোচ্চার থেকেছেন। তার সংগঠনের পক্ষ মানববন্ধন, সমাবেশ ও আলোচনা সভা করেছে এবং সাংবাদিকরা যেসব প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছেন তাতে যোগ দিয়েছেন। আমাদের পক্ষে অনুমান করা সহজ, কেন বর্তমান সরকার ও তার নির্দেশে পুলিশ কোনো সুযোগ পেলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং রোববার তাই করেছিল।
এদিকে জানতে পারলাম, গত মঙ্গলবার একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ নাখালপাড়ায় নির্মীয়মাণ ধসে যাওয়া হাসপাতাল ভবনে মালিক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আগাম জামিন মঞ্জুর করেছেন। এই জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম ডা. আলী জাহির আল আমিন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, জিডিতে এর নামের 'জাহির' শব্দের 'র' অক্ষরটি কেটে সেই জায়গায় 'দ' অক্ষরটি বসিয়ে ভিন্নমতাবলম্বী পেশাজীবী নেতা ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনকে ফাঁসানো হয়েছিল। কী দুঃখ ও লজ্জার কথা। ডা. জাহিদ হোসেন ও তার স্ত্রী ১/১১'র অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে সাড়ে নয় মাস কারাবাস করেছেন। বর্তমানে আবার সেরকম কিছুর পুনরাবৃত্তি হতে চলেছিল। এখন কেউ যদি বলে, ১/১১'র ভূত এই সরকারের ঘাড়ে ভালোমতেই চেপে আছে, অন্তত মামলা-হামলা ও রিমান্ড যন্ত্রণার বিষয়ে, তারা কি খুব ভুল বলবেন?
সব শেষে আমার একটি প্রশ্ন, আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি যদি ডা. জাহিদ হোসেনের মতো সমাজে সুপরিচিত, প্রতিষ্ঠিত ও বহু শুভানুধ্যায়ীর সমর্থনধন্য ব্যক্তি না হয়ে একজন অতি সাধারণ ও অপরিচিত নাগরিক হতেন, তিনি কি আত্মপক্ষ সমর্থন করার মতো সব দলিলপত্র একদিনের মধ্যে সংগ্রহ করতে পারতেন? না, পারতেন না। সে ক্ষেত্রে তিনি থাকতেন দলীয় স্বার্থে বা হীন ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত কিছু পুলিশ সদস্যের কব্জায়। আমরা সংবিধান সংশোধনের রায় দিচ্ছি, সংসদীয় বিশেষ কমিটি করছি, পক্ষে-বিপক্ষে-মন্তব্যে দেশ সয়লাব করে দিচ্ছি, কিন্তু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কমই করছি। তাই বলে বর্তমান সরকার যদি মনে করে থাকে যে, তারা যা খুশি তাই করে পার পেয়ে যাবে তাহলে ভুল করবে। কারণ, মেয়াদ শেষে হিসাব দেওয়ার দিন কাছিয়ে আসছে। অত্যাচারিত ও নিপীড়িতরা মুখ খুলবেই।

আতাউস সামাদ :সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.