পশ্চিমবঙ্গ-পরাজয় বামফ্রন্টের, বামপন্থার নয় by সুভাষ সাহা
অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূমি অধিকার, কর্মের অধিকার, এমনকি সামাজিক কতক দাবি এখন শাশ্বত দাবিতে পরিণত হওয়ায় সেগুলোকে অবজ্ঞা করা ভারতের কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভবত সহজ হবে না। আসলে বামপন্থা এখন ভারতের জনমানসে গভীর ছাপ ফেলেছে।
তাই রাজ্য ক্ষমতা হারানো বা জাতীয় পার্লামেন্টে সংখ্যাশক্তি হ্রাস পাওয়া নিয়ে ভারতে বামপন্থি আন্দোলনের প্রভাবকে বিচার করা যাবে না
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের একটানা ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটতে দেখে আমাদের দেশের অনেক বামপন্থি নেতাকর্মীকে হতাশা প্রকাশ করতে দেখেছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ও বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশটির টুকরো হয়ে যাওয়া দেখেও তখন অনেক বামপন্থি নেতাকর্মী ভেঙে পড়েছিলেন।
কিন্তু ভারতে বামপন্থি পিছু হটতে দেখা যায়নি। বরং তারা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে লিবারেল মিডিয়ার উদ্দেশ্যমূলক অব্যাহত আক্রমণ, বুদ্ধিবৃত্তিক ঘূর্ণিঝড় ও বাস্তব প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সদা চেষ্টা করেছেন। এটাকে পুঁজিবাদের নিউ লিবারেল পলিসির অব্যাহত গতিতে সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবল ঢেউয়ের মুখেও অবিচলভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য সাহস ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে।
এবারও পশ্চিমবঙ্গে যখন ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনকে সেখানকার জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করল, তখনও সেখানকার কমিউনিস্ট ও বাম নামে সমধিক পরিচিত দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জনগণের রায় মেনে নিয়ে নতুন করে উজ্জীবিত হতে দেখা যাচ্ছে। তবে ভারতের এক শ্রেণীর নিউ লিবারেল নীতি-সমর্থক মিডিয়াকে বামফ্রন্টের এই পরাজয়কে ভারতে বামপন্থিদের বিরাট বিপর্যয় এবং ভবিষ্যতে বামধারা ভারতের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকবে কি-না এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা শুরু করেছে। মিডিয়ার এহেন প্রচারণায় অনেকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে, অনেক বামপন্থি কর্মী-সমর্থক হতোদ্যম হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এতে ভারতের বামপন্থি আন্দোলনে সামান্য চিড় ধরানো যাবে বলে মনে হয় না। এদের শক্তিটা জনচেতনার গভীরে।
শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয় ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থিরা যে ধরনের কার্যকর ভূমিকা সুদীর্ঘকাল পালন করে আসছে তা পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাশক্তি দ্বারা কখনোই নিরূপিত হয়নি। অধিকাংশ সময় জনগণের সংঘশক্তি, অধিকারবোধ, প্রচলিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষুব্ধ মনোভাব, জাত-পাতের ভেদজ্ঞান মুছে দিয়ে প্রগতিশীল জাতীয় বোধে উজ্জীবিত হওয়া, সর্বোপরি ক্রমাগত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে উপলব্ধি ও সেটার হিস্যা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হওয়া এবং সামাজিক সাম্যের চেতনাবোধ একটি সমগ্র বামপন্থি চেতনার জন্ম দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর গরিবি হটাও আন্দোলন ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এবং সমাজের প্রান্তিক জনগণ ও নৃজাতিগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কর্মসূচি গ্রহণ বামপন্থারই প্রকাশ। আর তৎকালীন সময়ে সিপিআইর সঙ্গে কংগ্রেসের সখ্য অথবা বামপন্থিদের অব্যাহতভাবে সাধারণ মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ এ ধরনের কর্মসূচি গ্রহণে ইন্দিরা গান্ধীকে উৎসাহিত করে থাকবে। গুজরালের স্বল্পকালীন প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে বা ভিপি সিংয়ের সরকারের আমলে বামফ্রন্টের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক কেন্দ্রীয় স্তরে বিভিন্ন জনহিতকর কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারগুলোকে উৎসাহিত করে থাকবে। সর্বশেষ মনমোহনের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের প্রথম মেয়াদে বামফ্রন্টের সঙ্গে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারই আওতায় কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে কতগুলো নীতি নির্দিষ্ট করা হয়েছিল।
বস্তুত সে সময় গৃহীত নীতিগুলোতে বামপন্থার ছাপ ছিল স্পষ্ট। যেমন বামফ্রন্ট ঢালাও বিরাষ্ট্রীয়করণের বিরোধী ছিল। তারা প্রচণ্ডভাবে মনমোহন সরকারের ঢালাও বিরাষ্ট্রীয়করণ চেষ্টার গতি অনেকটা শ্লথ করে দিতে পেরেছিল। আন্তর্জাতিক অর্থলগি্নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অব্যাহত চাপের মুখেও ভারতের ব্যাংক ও বীমা সেক্টরকে সে কারণে বিদেশি লগি্নর জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়নি। এসব কারণেই ২০০৮-০৯ সালে বিশ্বমন্দায় ভারতের অর্থনীতিতে তেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। বামপন্থিরা বরাবরই খাদ্যমূল্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধী ছিল। তারা প্রবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে এসব ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধিকে সে সময় অনেকটা প্রতিরোধ করতে পেরেছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য ছিল গরিব ও প্রান্তিক স্তরে থাকা মানুষদের কল্যাণ। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে পুরোপুরি বেসরকারিকরণে বিরোধী ছিল তারা। তাদেরই চাপে সে সময় এ ক্ষেত্রেও মনমোহন সিংকে পিছু হটতে হয়েছিল। শিল্পের জন্য কৃষিজমিকে বরাদ্দ না দেওয়া এবং জমির মালিকদের মতামত ছাড়া জমি অধিগ্রহণ না করা, পাহাড়ে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসা আদিবাসী ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সম্পত্তির মালিকানা প্রদান বামপন্থিদেরই দাবি। তারা নানাভাবেই গরিব চাষিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর সেগুলোকে পুরোপুরি অস্বীকার করে প্রথম ইউপিএ সরকার একপাও ফেলতে পারেনি। গ্রামীণ জনগণ যে এখন ১০০ দিনের চাকরির গ্যারান্টি সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে সেটাও প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় বামপন্থিদের সঙ্গে জোটের ফসল। তারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের রক্ষার জন্য বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানিকে এ ব্যবসায় ভারতে স্বাগত জানানোর বিরুদ্ধে ছিল। বস্তুত তাদের চাপের কারণেই ভারতের লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী বহুজাতিক রিটেইল হাউসগুলোর আগ্রাসন থেকে তখন রক্ষা পায়। নারী অধিকারের ক্ষেত্রে বামেদের অবদান সুদূরপ্রসারী। তাদেরই চাপাচাপিতে পার্লামেন্টের ৩০ শতাংশ আসন মহিলাদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করার বিষয়টি এখন সর্বজনীনতা পেয়েছে। আর কংগ্রেস এসব দাবি ও কর্মসূচিকে এক প্রকার মেনে নেওয়ার পর এখন তাদের পক্ষেও এসব কর্মসূচি থেকে সরে আসা মুশকিল। তাই কেবল পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় বামফ্রন্ট ক্ষমতা হারিয়েছে বলে ভারতে বামপন্থার দফারফা হয়ে যাবে বলে যারা মনে করেন, তারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূমি অধিকার, কর্মের অধিকার, এমনকি সামাজিক কতক দাবি এখন শাশ্বত দাবিতে পরিণত হওয়ায় সেগুলোকে অবজ্ঞা করা ভারতের কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভবত সহজ হবে না। আসলে বামপন্থা এখন ভারতের জনমানসে গভীর ছাপ ফেলেছে। তাই রাজ্য ক্ষমতা হারানো বা জাতীয় পার্লামেন্টে সংখ্যাশক্তি হ্রাস পাওয়া নিয়ে ভারতে বামপন্থি আন্দোলনের প্রভাবকে বিচার করা যাবে না।
পশ্চিমবঙ্গে মমতার উত্থানও বামপন্থার প্রতি রাজ্যটির মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের কারণেই। এখানকার বামপন্থিরা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতায় আসার পর ভূমি সংস্কারে হাত দিয়েছিল। তারা এটা কিন্তু দলের ক্যাডারদের মাধ্যমে করতে যায়নি। স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই ভূমি বণ্টনের কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল। এর ফলে ভূমি ব্যবস্থায় আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান হয়েছিল। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে তারাই প্রথম ভারতে গ্রামীণ জনগণকে ক্ষমতার স্বাদ দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পঞ্চায়েতের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান নিশ্চিত করেছিল বাম সরকারই। মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসা সেবা নিয়ে যাওয়া, সবার জন্য শিক্ষার অধিকার, ক্ষদ্র ও মাঝারি ব্যবসাকে রক্ষা করা ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা গ্রামকে সনাতনী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল। তাছাড়া নানা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, যা তাদের কাছ থেকে এনজিও এবং বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা শিখেছে, তা গ্রামীণ ও শহরের নিম্নআয়ের মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। এজন্য এই বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের ভোটব্যাংকে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতিতে উজ্জীবিত শহুরে মধ্যবিত্তের প্রতি বামফ্রন্ট তেমন নজর দেয়নি। ফলে এদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বামফ্রন্টের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। গত কয়েকটি নির্বাচনে বামপন্থিদের কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরগুলোতে আসন ও ভোটপ্রাপ্তি হার কমে যাওয়া সেই সাক্ষ্যই দেয়।
এদিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার বাতিকে বামপন্থিরা তাদেরই গৃহীত কর্মসূচিবিরোধী কর্মকাণ্ডে হাত লাগায়। যেমন শিল্পের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ না করা ও কৃষকের সম্মতি ব্যতিরেকে জমি অধিগ্রহণ না করার নীতিকে তারা জলাঞ্জলি দেয়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে সে কারণেই কৃষকদের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল তাদের। আর এরই ফায়দা তুলেছেন মমতা। তিনি বামপন্থিদের অস্ত্রেই তাদের ঘায়েল করলেন। বামপন্থি অনুসৃত নীতি গ্রহণ করলেন মমতা আর বামফ্রন্ট হয়ে গেল তার বিরোধী। এভাবে একের পর এক বামফ্রন্ট ঘোষিত নীতিই হয়ে দাঁড়াল মমতার নীতি। মমতার নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। মমতা বামফ্রন্টকেই বানিয়ে দিলেন তথাকথিত বামপন্থি আর নিজে হয়ে উঠলেন প্রকৃত বামপন্থি। তদুপরি বামফ্রন্ট সরকারে ও বামেদের সর্বস্তরের নেতৃত্বে উচ্চবর্ণের বাবুদের প্রাধান্যও নিম্নবর্ণের কর্মী-সমর্থক এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। তাই বামপন্থা পশ্চিমবঙ্গে পরাজিত হয়ে কার্যত ভারত থেকেই উঠে যাবে বলে যারা প্রচার করছেন, তারা আসলে চোখে ঠুলি এঁটে আছেন। বরং বামপন্থা থেকে সরে গিয়ে কিছুটা সুবিধাবাদী লাইন নেওয়ার কারণেই বামপন্থিদের ওপর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সমর্থন তুলে নিয়েছে বলা যায়।
তবে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় বামপন্থিদের পরাজয়ের ফলে রাজ্যস্তরে বামপন্থিদের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেলেও জাতীয় স্তরে তা মোটেই কমবে না। তদুপরি সমাজ প্রগতির জন্যও বামপন্থার প্রয়োজন। মৌলবাদ বলুন, নাগরিক অধিকার বলুন, অর্থনৈতিক মুক্তি, সম্পদের সুষম বণ্টন, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে আনা, নারী-শিশু ও অনগ্রসর শ্রেণীর অধিকার বলুন, সবক্ষেত্রেই বামপন্থা প্রভাবদায়ী শক্তি জোগায়। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের মতো আমাদের এখানকার বামপন্থিরা তাদের বাম আদর্শই ভুলতে বসেছে। সে কারণেই তারা নানা ইস্যুতে জোরালো অবস্থান নিতে পারে না বা নিলেও তা অনেকটা লোক দেখানো। এখানকার বামপন্থিদের বিভিন্ন ইস্যুতে অবস্থান সামাজিক, নাগরিক সংগঠন ও অধিকার সংক্রান্ত এনজিওর চাইতেও দুর্বল। এ কারণেই আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে আপস করে ক্ষমতায় টিকে থাকার সাহস দেখাতে পারে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের একটানা ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটতে দেখে আমাদের দেশের অনেক বামপন্থি নেতাকর্মীকে হতাশা প্রকাশ করতে দেখেছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ও বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশটির টুকরো হয়ে যাওয়া দেখেও তখন অনেক বামপন্থি নেতাকর্মী ভেঙে পড়েছিলেন।
কিন্তু ভারতে বামপন্থি পিছু হটতে দেখা যায়নি। বরং তারা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে লিবারেল মিডিয়ার উদ্দেশ্যমূলক অব্যাহত আক্রমণ, বুদ্ধিবৃত্তিক ঘূর্ণিঝড় ও বাস্তব প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সদা চেষ্টা করেছেন। এটাকে পুঁজিবাদের নিউ লিবারেল পলিসির অব্যাহত গতিতে সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবল ঢেউয়ের মুখেও অবিচলভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য সাহস ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে।
এবারও পশ্চিমবঙ্গে যখন ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনকে সেখানকার জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করল, তখনও সেখানকার কমিউনিস্ট ও বাম নামে সমধিক পরিচিত দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জনগণের রায় মেনে নিয়ে নতুন করে উজ্জীবিত হতে দেখা যাচ্ছে। তবে ভারতের এক শ্রেণীর নিউ লিবারেল নীতি-সমর্থক মিডিয়াকে বামফ্রন্টের এই পরাজয়কে ভারতে বামপন্থিদের বিরাট বিপর্যয় এবং ভবিষ্যতে বামধারা ভারতের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকবে কি-না এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা শুরু করেছে। মিডিয়ার এহেন প্রচারণায় অনেকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে, অনেক বামপন্থি কর্মী-সমর্থক হতোদ্যম হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এতে ভারতের বামপন্থি আন্দোলনে সামান্য চিড় ধরানো যাবে বলে মনে হয় না। এদের শক্তিটা জনচেতনার গভীরে।
শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয় ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থিরা যে ধরনের কার্যকর ভূমিকা সুদীর্ঘকাল পালন করে আসছে তা পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাশক্তি দ্বারা কখনোই নিরূপিত হয়নি। অধিকাংশ সময় জনগণের সংঘশক্তি, অধিকারবোধ, প্রচলিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষুব্ধ মনোভাব, জাত-পাতের ভেদজ্ঞান মুছে দিয়ে প্রগতিশীল জাতীয় বোধে উজ্জীবিত হওয়া, সর্বোপরি ক্রমাগত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে উপলব্ধি ও সেটার হিস্যা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হওয়া এবং সামাজিক সাম্যের চেতনাবোধ একটি সমগ্র বামপন্থি চেতনার জন্ম দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর গরিবি হটাও আন্দোলন ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এবং সমাজের প্রান্তিক জনগণ ও নৃজাতিগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কর্মসূচি গ্রহণ বামপন্থারই প্রকাশ। আর তৎকালীন সময়ে সিপিআইর সঙ্গে কংগ্রেসের সখ্য অথবা বামপন্থিদের অব্যাহতভাবে সাধারণ মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ এ ধরনের কর্মসূচি গ্রহণে ইন্দিরা গান্ধীকে উৎসাহিত করে থাকবে। গুজরালের স্বল্পকালীন প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে বা ভিপি সিংয়ের সরকারের আমলে বামফ্রন্টের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক কেন্দ্রীয় স্তরে বিভিন্ন জনহিতকর কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারগুলোকে উৎসাহিত করে থাকবে। সর্বশেষ মনমোহনের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের প্রথম মেয়াদে বামফ্রন্টের সঙ্গে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারই আওতায় কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে কতগুলো নীতি নির্দিষ্ট করা হয়েছিল।
বস্তুত সে সময় গৃহীত নীতিগুলোতে বামপন্থার ছাপ ছিল স্পষ্ট। যেমন বামফ্রন্ট ঢালাও বিরাষ্ট্রীয়করণের বিরোধী ছিল। তারা প্রচণ্ডভাবে মনমোহন সরকারের ঢালাও বিরাষ্ট্রীয়করণ চেষ্টার গতি অনেকটা শ্লথ করে দিতে পেরেছিল। আন্তর্জাতিক অর্থলগি্নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অব্যাহত চাপের মুখেও ভারতের ব্যাংক ও বীমা সেক্টরকে সে কারণে বিদেশি লগি্নর জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়নি। এসব কারণেই ২০০৮-০৯ সালে বিশ্বমন্দায় ভারতের অর্থনীতিতে তেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। বামপন্থিরা বরাবরই খাদ্যমূল্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধী ছিল। তারা প্রবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে এসব ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধিকে সে সময় অনেকটা প্রতিরোধ করতে পেরেছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য ছিল গরিব ও প্রান্তিক স্তরে থাকা মানুষদের কল্যাণ। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে পুরোপুরি বেসরকারিকরণে বিরোধী ছিল তারা। তাদেরই চাপে সে সময় এ ক্ষেত্রেও মনমোহন সিংকে পিছু হটতে হয়েছিল। শিল্পের জন্য কৃষিজমিকে বরাদ্দ না দেওয়া এবং জমির মালিকদের মতামত ছাড়া জমি অধিগ্রহণ না করা, পাহাড়ে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসা আদিবাসী ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সম্পত্তির মালিকানা প্রদান বামপন্থিদেরই দাবি। তারা নানাভাবেই গরিব চাষিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর সেগুলোকে পুরোপুরি অস্বীকার করে প্রথম ইউপিএ সরকার একপাও ফেলতে পারেনি। গ্রামীণ জনগণ যে এখন ১০০ দিনের চাকরির গ্যারান্টি সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে সেটাও প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় বামপন্থিদের সঙ্গে জোটের ফসল। তারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের রক্ষার জন্য বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানিকে এ ব্যবসায় ভারতে স্বাগত জানানোর বিরুদ্ধে ছিল। বস্তুত তাদের চাপের কারণেই ভারতের লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী বহুজাতিক রিটেইল হাউসগুলোর আগ্রাসন থেকে তখন রক্ষা পায়। নারী অধিকারের ক্ষেত্রে বামেদের অবদান সুদূরপ্রসারী। তাদেরই চাপাচাপিতে পার্লামেন্টের ৩০ শতাংশ আসন মহিলাদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করার বিষয়টি এখন সর্বজনীনতা পেয়েছে। আর কংগ্রেস এসব দাবি ও কর্মসূচিকে এক প্রকার মেনে নেওয়ার পর এখন তাদের পক্ষেও এসব কর্মসূচি থেকে সরে আসা মুশকিল। তাই কেবল পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় বামফ্রন্ট ক্ষমতা হারিয়েছে বলে ভারতে বামপন্থার দফারফা হয়ে যাবে বলে যারা মনে করেন, তারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূমি অধিকার, কর্মের অধিকার, এমনকি সামাজিক কতক দাবি এখন শাশ্বত দাবিতে পরিণত হওয়ায় সেগুলোকে অবজ্ঞা করা ভারতের কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভবত সহজ হবে না। আসলে বামপন্থা এখন ভারতের জনমানসে গভীর ছাপ ফেলেছে। তাই রাজ্য ক্ষমতা হারানো বা জাতীয় পার্লামেন্টে সংখ্যাশক্তি হ্রাস পাওয়া নিয়ে ভারতে বামপন্থি আন্দোলনের প্রভাবকে বিচার করা যাবে না।
পশ্চিমবঙ্গে মমতার উত্থানও বামপন্থার প্রতি রাজ্যটির মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের কারণেই। এখানকার বামপন্থিরা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতায় আসার পর ভূমি সংস্কারে হাত দিয়েছিল। তারা এটা কিন্তু দলের ক্যাডারদের মাধ্যমে করতে যায়নি। স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই ভূমি বণ্টনের কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল। এর ফলে ভূমি ব্যবস্থায় আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান হয়েছিল। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে তারাই প্রথম ভারতে গ্রামীণ জনগণকে ক্ষমতার স্বাদ দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পঞ্চায়েতের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান নিশ্চিত করেছিল বাম সরকারই। মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসা সেবা নিয়ে যাওয়া, সবার জন্য শিক্ষার অধিকার, ক্ষদ্র ও মাঝারি ব্যবসাকে রক্ষা করা ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা গ্রামকে সনাতনী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল। তাছাড়া নানা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, যা তাদের কাছ থেকে এনজিও এবং বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা শিখেছে, তা গ্রামীণ ও শহরের নিম্নআয়ের মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। এজন্য এই বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের ভোটব্যাংকে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতিতে উজ্জীবিত শহুরে মধ্যবিত্তের প্রতি বামফ্রন্ট তেমন নজর দেয়নি। ফলে এদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বামফ্রন্টের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। গত কয়েকটি নির্বাচনে বামপন্থিদের কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরগুলোতে আসন ও ভোটপ্রাপ্তি হার কমে যাওয়া সেই সাক্ষ্যই দেয়।
এদিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার বাতিকে বামপন্থিরা তাদেরই গৃহীত কর্মসূচিবিরোধী কর্মকাণ্ডে হাত লাগায়। যেমন শিল্পের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ না করা ও কৃষকের সম্মতি ব্যতিরেকে জমি অধিগ্রহণ না করার নীতিকে তারা জলাঞ্জলি দেয়। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে সে কারণেই কৃষকদের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল তাদের। আর এরই ফায়দা তুলেছেন মমতা। তিনি বামপন্থিদের অস্ত্রেই তাদের ঘায়েল করলেন। বামপন্থি অনুসৃত নীতি গ্রহণ করলেন মমতা আর বামফ্রন্ট হয়ে গেল তার বিরোধী। এভাবে একের পর এক বামফ্রন্ট ঘোষিত নীতিই হয়ে দাঁড়াল মমতার নীতি। মমতার নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। মমতা বামফ্রন্টকেই বানিয়ে দিলেন তথাকথিত বামপন্থি আর নিজে হয়ে উঠলেন প্রকৃত বামপন্থি। তদুপরি বামফ্রন্ট সরকারে ও বামেদের সর্বস্তরের নেতৃত্বে উচ্চবর্ণের বাবুদের প্রাধান্যও নিম্নবর্ণের কর্মী-সমর্থক এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। তাই বামপন্থা পশ্চিমবঙ্গে পরাজিত হয়ে কার্যত ভারত থেকেই উঠে যাবে বলে যারা প্রচার করছেন, তারা আসলে চোখে ঠুলি এঁটে আছেন। বরং বামপন্থা থেকে সরে গিয়ে কিছুটা সুবিধাবাদী লাইন নেওয়ার কারণেই বামপন্থিদের ওপর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সমর্থন তুলে নিয়েছে বলা যায়।
তবে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় বামপন্থিদের পরাজয়ের ফলে রাজ্যস্তরে বামপন্থিদের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেলেও জাতীয় স্তরে তা মোটেই কমবে না। তদুপরি সমাজ প্রগতির জন্যও বামপন্থার প্রয়োজন। মৌলবাদ বলুন, নাগরিক অধিকার বলুন, অর্থনৈতিক মুক্তি, সম্পদের সুষম বণ্টন, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে আনা, নারী-শিশু ও অনগ্রসর শ্রেণীর অধিকার বলুন, সবক্ষেত্রেই বামপন্থা প্রভাবদায়ী শক্তি জোগায়। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের মতো আমাদের এখানকার বামপন্থিরা তাদের বাম আদর্শই ভুলতে বসেছে। সে কারণেই তারা নানা ইস্যুতে জোরালো অবস্থান নিতে পারে না বা নিলেও তা অনেকটা লোক দেখানো। এখানকার বামপন্থিদের বিভিন্ন ইস্যুতে অবস্থান সামাজিক, নাগরিক সংগঠন ও অধিকার সংক্রান্ত এনজিওর চাইতেও দুর্বল। এ কারণেই আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে আপস করে ক্ষমতায় টিকে থাকার সাহস দেখাতে পারে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
No comments