লড়াইয়ের নতুন ময়দান by শেখ রোকন

যারা মনে করেন, পরিবেশ আন্দোলন মানে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় পাতায় দোয়েলের হারানো শীষ নিয়ে হাহাকার করা, দামি ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে বন্য ঘাসফুলের খোঁজে বেরিয়ে পড়া কিংবা ভাতঘুম সেরে বিকেলে নগরের কেন্দ্রস্থলে নদী রক্ষার দাবিতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দু'দণ্ড দাঁড়ানো; তাদের জন্য দুঃসংবাদ। প্রকৃতি সুরক্ষা তৎপরতার চরিত্র,


ধরন ও ময়দান যে আর আগের মতো শৌখিন থাকছে না, তার সর্বশেষ নজির হলেন হোসে ক্লদিও রিবেইরো দ্য সিলভা ও তার স্ত্রী মারিয়া দো স্পাইরিতো সান্তো। আমাজোন চিরহরিৎ (রেইন ফরেস্ট) বনাঞ্চলে অবৈধ উজাড়িকরণ ও দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার এ দম্পতি গত সোমবার রাতে বা মঙ্গলবার সকালে ব্রাজিলের পারা রাজ্যের মারাবা শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে তাদের বাড়ির কাছে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। গত ছয় মাস ধরে অজ্ঞাত ফোন থেকে 'পরিবেশ নিয়ে বাড়াবাড়ি' না করার জন্য নানা হুমকি দেওয়া হচ্ছিল তাদের। দ্য সিলভা প্রকাশ্যেই কয়েকবার আশঙ্কা ব্যক্ত করছিলেন, তিনি যে কোনো দিন নিহত বা নিখোঁজ হতে পারেন। পুলিশি সুরক্ষাও চেয়েছিলেন। না পেলেও কিন্তু দমেননি। গত নভেম্বরে এক সভায় বলেছেন, 'মানুষ হিসেবে আমি নিশ্চয়ই মৃত্যুভয়ে ভীত; কিন্তু ভয় আমার কণ্ঠ রোধ করতে পারবে না।' শেষদিন পর্যন্ত তিনি আমাজোন রক্ষায় সোচ্চার ছিলেন।
কেবল দ্য সিলভা নন, চলতি দশকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পরিবেশ আন্দোলনকারীরা হুমকি ও হামলার শিকার হচ্ছেন। গত বছর জুলাইয়ে গুজরাট হাইকোর্টের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়েছিলেন ওই রাজ্যের খ্যাতিমান পরিবেশকর্মী অমিত জেঠভা। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে এল সালভেদরে দু'জন পরিবেশকর্মী নিহত হয়েছিলেন। তাদের 'অপরাধ' তারা বনাঞ্চলে খনি বসানোর বিরোধিতা করেছিলেন। বস্তুত গত কয়েক বছরে পরিবেশকর্মীদের জন্য পরিস্থিতি ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
পরিবেশ বিষয়ে সাংবাদিকতা, লেখালেখি বা ব্লগিং করেন_ এমন ব্যক্তিদের জন্যও পরিস্থিতি ক্রমেই বিরূপ হয়ে উঠছে। রিপোর্টার্স সানস ফ্রন্টিয়ার্সের সাম্প্রতিক দুটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন উজাড়িকরণ, দূষণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং এ বিষয়ে সাংবাদিকতা অনেক দেশেই ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ওই প্রতিবেদনে এমন ১৩ জন পরিবেশ সাংবাদিক ও ব্লগারের কথা বলা হয়েছে, যারা পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি জনসমক্ষে উন্মোচিত করতে গিয়ে নিখোঁজ বা নিহত, হামলায় গুরুতর আহত, কারাবন্দি বা হুমকির মুখে পড়েছেন। ২০১০ সালে বুলগেরিয়ার রিপোর্টার মারিয়া কিকোলায়েভাকে এসিড ছুড়ে মারা হয়েছিল। রিপোর্টার্স সানস ফ্রন্টিয়ার্স পরিবেশ সাংবাদিকতাকে আখ্যা দিয়েছে 'লড়াইয়ের নতুন ময়দান' হিসেবে।
বলাবাহুল্য, লড়াইয়ের সাম্প্রতিক ময়দান বাংলাদেশে আরও আগেই বিস্তৃত হয়েছে। আমাদের মধুপুর গড়ের পীরেন স্লানের হত্যাকাণ্ড কিংবা ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে বিরোধিতা করতে গিয়ে নিহত হওয়ার ঘটনাকেও পরিবেশবিরোধী সহিংসতা থেকে আলাদা করে দেখার অবকাশ আছে কি? আমদানি করা জাহাজভাঙা শিল্প থেকে যে বর্জ্য-বিষের বিপদ তার বিরোধিতা করতে গিয়েও কিছু মৃত্যু হুমকি আসছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি পরিবেশকর্মীদের ও সাংবাদিকদের ওপর নানামুখী চাপও ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কেউ কেউ যেভাবে পরিবেশবাদীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন, একশ্রেণীর সংবাদপত্রে যেভাবে পরিবেশবাদীদের নিয়ে কুৎসা রটনা চলছে, এগুলো তারই অংশ। পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গে মানুষ ও প্রকৃতি ধ্বংসকারী পক্ষের বিরোধ যত স্পষ্ট হচ্ছে, লড়াইয়ের নতুন ময়দান তত তপ্ত হয়ে উঠছে।
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.