ইরানের আমেরিকান ট্রানজিট by ড. আহমদ আনিসুর রহমান

১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরান সরকারের বৈরী সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। বর্তমানেও প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের পারস্পরিক হুমকি-ধমকিতে ওই রকম বৈরী ভাব প্রতীয়মান। দেখে-শুনে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র এই বুঝি ইরান আক্রমণ করে সব তছনছ করে দিল, এই বুঝি আক্রমণ করল।


ইরানের কথাবার্তায় মনে হয়, তাবৎ বিশ্বের তথাকথিত মার্কিনবিরোধী জাতিগুলোর নেতৃত্ব যেন তারই হাতে। কিন্তু সবার অলক্ষে সম্প্রতি এমন একটি ছোট্ট ঘটনা ঘটেছে, যা এমন বড় একটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গভীরতর বিশেষজ্ঞসুলভ বিশ্লেষকদের অনেক আগে থেকেই জানা ছিল, এখন সর্বসাধারণেরও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিষয়টি হলো, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরকার চিরায়ত মৌলিক এমন এক আত্মীয়তার সম্পর্ক, যা কিছু ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শগত ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উৎস থেকে উৎসারিত। এই চিরায়ত গভীরতর সম্পর্ক এমনই শক্ত যে তুলনামূলক সাময়িক অগভীর সংঘাত বা সংঘাতমূলক কথাবার্তা সত্ত্বেও উভয়ের কারো কোনো মৌলিক স্বার্থের প্রশ্ন উপস্থিত হলে, তারা ওইসব ভুলে পরস্পরের সহায়তা করবে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের আপাতদৃষ্টে সংঘাত অনেকটা দুই প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমসিক্ত মান-অভিমানের (lover�s quarrel) মতো, যাঁরা ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের গভীরতা এবং ঐতিহাসিক উৎসগুলোর ব্যাপারে গভীরতর জ্ঞান রাখেন না, তাঁদের কাছে এই কথাটি অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটেছে, তার দিকে দৃকপাত করলে এ বিষয়ে তাঁদের পুনর্বিবেচনার দরকার মনে হতে পারে। ঘটনাটি হলো, আফগানিস্তানে যুদ্ধরত মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর রসদ আনা-নেয়ার জন্য আরব সাগর পর্যন্ত একটি 'ট্রানজিটের' যুক্তরাষ্ট্রের যখন খুবই দরকার এবং ওইরূপ 'ট্রানজিটের' স্বাভাবিক পথ যে পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠ মিত্র সেই পাকিস্তানও যখন সেই ট্রানজিট দিতে রাজি হয়নি, তখন তাবৎ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু হিসেবে পরিচিত সেই ইরানই আগে বেড়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান থেকে আরব সাগর পর্যন্ত ওই 'ট্রানজিট' দিয়ে পুরো এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্বার্থ রক্ষায় একমাত্র সহায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়। মার্কিনিরা যেভাবে বলে, A friend in need is a friend indeed- দরকারের সময়কার বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। লাইলী-মজনুর ঝগড়াঝাটি যতই থাক, জানের খতরার সময় একে অন্যের 'জানের জান'।
ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের এই গভীর মৌলিক আত্মীয়তার সম্পর্ক ইরানের জন্মসূত্রে। আজকের ইরানের জন্ম প্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রধান প্রতিবন্ধক ও প্রতিপক্ষ, ইস্তাম্বুলকেন্দ্রিক 'খেলাফত'-ব্যবস্থার সর্বনাশের কেন্দ্র হিসেবে ব্রিটিশদের সহায়তায় ওই 'খেলাফতের' পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তের পারস্য প্রদেশের ইস্পাহানে জনৈক 'শাহ আব্বাসের' অধীনে প্রতিষ্ঠিত বিদ্রোহী শিয়া 'রাজ্য' হিসেবে। শুরু থেকেই এই তথাকথিত 'ইরান' মধ্যপ্রাচ্যে উসমানি 'খেলাফত' ও ভারতবর্ষে মোগল 'সুলতানাত'-এর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি ও ষড়যন্ত্রের আখড়াই শুধু নয়, ওই দুই মহাসাম্রাজ্যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের স্বার্থের কার্যক্রমের স্থানীয় সূচনাক্ষেত্র (Launching pad) হিসেবে কার্যকর থাকে। সেকালে পাশ্চাত্যে মধ্যপ্রাচ্যকে 'সেমিটিক' ও মোগল সাম্রাজ্যকে 'মঙ্গোল' সভ্যতার এবং ইউরোপকে আর্য সভ্যতার ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হতো বলে, পাশ্চাত্য স্বার্থের স্থানীয় ষড়যন্ত্রকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই নতুন রাজ্যকে তার প্রাচীন ও ঐতিহ্যগর্বদীপ্ত নাম, পারস্য বা ফারিসের পরিবর্তে নতুন নাম, 'ইরান'- আক্ষরিক অর্থে 'আর্যরাজ্য' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সে থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকাল পর্যন্ত এই তথাকথিত 'ইরান' দক্ষিণ মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দোসর ও প্রধান ঘাঁটি হিসেবে কার্যকর থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্রিটিশ 'সিংহ' অসুস্থ শেয়ালের মতো হয়ে পড়লে তার জায়গা নেয় ব্রিটিশ সভ্যতারই নবজন্মরূপ সবল যুক্তরাষ্ট্র। এখন থেকে এই তথাকথিত ইরান ১৯৭৯ সালের বিপ্লব পর্যন্ত প্রকাশ্যেই বিশ্ব শাসনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারী যুক্তরাষ্ট্রের আত্মার আত্মীয় হিসেবে সুখে-দুঃখে একসঙ্গে থেকে স্থানীয় সব সংঘাতে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করে। এই কাজে শাহ আব্বাসের উত্তরাধিকারী হিসেবে রেজা শাহ পাহলভি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৯ সালে ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে ওই রেজা শাহ পাহলভি উৎখাত হলে, সাধারণ দর্শকরা সংঘাতের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে ইরানের যেই বন্ধুত্বের জোরে তাঁর গদি টিকে ছিল, সেই ইরান-মার্কিন সম্পর্কেরও অবসান হয়েছে বলে মনে করে। ইরানের যেই উদারনৈতিক ধর্মীয় নেতা ও ধর্মপ্রিয় উদারনৈতিক দার্শনিক- খোমেনি, শরিয়তি, বাজরগনি, আবুল হাসনিদের নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, তাঁদের কেউ কেউ মার্কিন প্রভাববলয় থেকে ইরানকে বের করে আনার জন্য আগ্রহী হলে, তার ফলে যে ব্যাপক সাময়িক মার্কিনবিরোধী গণ-আন্দোলন দেখা দেয়, তার কারণেও অনেকে মনে করতে শুরু করেন যে ইরান-মার্কিন সম্পর্ক বুঝি ইরানের মার্কিন প্রভাবের প্রধান সুবিধাভোগী শাহের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ইরান-মার্কিন সুগভীর আত্মিক সম্পর্কও ছিন্ন হয়েছে। ওই মার্কিনবিরোধী গণ-আন্দোলন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার ফলে একপর্যায়ে তার জের হিসেবে উচ্ছৃঙ্খল ইরানি কিছু যুবক দ্বারা মার্কিন দূতাবাস দখল করে মার্কিন কূটনীতিকদের জিম্মি করে নেওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্রও সেই সুবাদে নতুন ইরানি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য নানারূপ বৈরী পদক্ষেপ নিলে সাধারণ দর্শকদের ওই ধারণা আরো পোক্ত হয়। কিন্তু দীর্ঘকালীন ইতিহাসের ধারায় তা ছিল অত্যন্ত সাময়িক এক বিষয়। তা কেটে গেলেই আসলে পুরনো ইঙ্গ-ইরানি সম্পর্কেরই উত্তরসূরি মার্কিন-ইরান সম্পর্ক তার মৌলিক একাত্মতায় প্রবহমান থাকে। তবে প্রকাশ্যে ওই সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ায় যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল, তার নানাবিধ সুবিধা বজায় রাখার জন্য, প্রকাশ্যে ওই ধারণাটিই বজায় রাখার মতো নানা কর্মকাণ্ড উভয় পক্ষ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে আরব সাগর পর্যন্ত ট্রানজিটের মতো সেখানে মার্কিন স্বার্থের জীবন-মরণের সমস্যা দেখা দিলে ঠিকই দুই পক্ষের পারস্পরিক সহায়তা দেখা যায়। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের আগ্রাসী যুদ্ধে যখন ইরানের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা দেখা দিয়েছিল- তখনো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইরানের আরেক প্রধান 'শত্রু' বলে পরিচিত ইসরায়েল ইরানকে অস্ত্র সরবরাহ করে তার প্রাণ রক্ষা করে।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ইরান সহায়তা করতে চাইলে- তা যদি প্রকৃতই হয় সন্ত্রাসবাদের প্রতিপক্ষে, তাহলে তা তো ভালো কথা, তাকে এত রেখেঢেকে করার দরকার কী? সেটা অবশ্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইরানের নিজের ভূমিকার জন্যও দরকারি।
সে দরকার আর যেসব মৌলিক উৎস থেকে ইরান-মার্কিন সম্পর্ক গভীরতর পর্যায়ে এমনই মৌলিক ও সুদৃঢ় ইরানের জন্ম থেকেই, তার বিশ্লেষণ অন্য কোনো প্রবন্ধে করব।

লেখক : হার্ভার্ড ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব শিক্ষক। প্রফেসর ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.