হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-বাংলাদেশ কি সার্কাসের তাঁবু হয়ে গেল? by আবদুল মান্নান
বেশ কিছুদিন ধরে কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও বিদেশি দূত তাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটা সার্কাসের তাঁবুর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। তবে তারা যা বলে, তা যে সব সময় অসত্য, তা-ও নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, তারা যেভাবে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে এসে তাদের বক্তব্য পেশ করে, তাতে এ কথা মনে হওয়ার যথেষ্ট
কারণ আছে যে তাদের অনেকেই বাংলাদেশকে এখনো একটা উপনিবেশ মনে করে। আর দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যম সজ্ঞানে তাদের বক্তব্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলছে, ‘ওরা যা বলছে তা ঠিক।’ যেটি বলছে না তা হচ্ছে, এই ঠিক কথাটি এমনভাবে বলার অধিকার ওদের নেই, আমাদের আছে। তা আমাদের দেশের সমালোচকেরা বলবেন, সরকারের ওপর নিজের অবস্থান পরিবর্তন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করবেন।
পত্রপত্রিকায় আবার কেউ যদি এসব প্রসঙ্গে যুক্তিনির্ভর কোনো (বিদেশিদের অযাচিত বক্তৃতা-বিবৃতি প্রসঙ্গে) মন্তব্য প্রতিবেদন লেখেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণীর পাঠক আছেন, যাঁরা তাঁকে সরকারের দালাল বলে তুলাধোনা করেন। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতে পদ্মা সেতু নিয়ে আমার একটা উপসম্পাদকীয় ছাপা হলো। বলার চেষ্টা করেছিলাম, বিশ্বব্যাংক অর্থ না দিলেও এই সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে তাদের সাবেক কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছিলাম। আর যায় কোথায়? প্রায় ২৩০টি মন্তব্য। দু-একটি বাদ দিলে সবাই মোটামুটি এই উপসংহারে পৌঁছেছে, আমার মতো আওয়ামী লীগের দালাল বাংলাদেশে দ্বিতীয়জন নেই। দু-একজন আবার উপদেশ দিয়ে জানাল, এসব দালালি ছেড়ে তাদের খুব পছন্দের দু-একজন বিশ্লেষকের বা কলাম লেখকের মতো ‘বস্তুনিষ্ঠ’ লেখা লিখি। কেউ কেউ আবার প্রথম আলোরও তুমুল সমালোচনা করেছে, আমার মতো একজন নালায়েকের লেখা ছাপানোর জন্য। তাদের উদ্দেশে বলি, আমি আওয়ামী লীগের সমর্থক বটে, তবে স্তাবক বা দলকানা নই। ভালো কাজের প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হই না, আবার মন্দ কাজের সমালোচনা করতেও পিছপা হই না। আমার অনেক লেখায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও সমালোচনা করেছি। আমি সব সময় ‘আমার সমালোচক, আমার বন্ধু’ এই নীতিতে বিশ্বাস করি। যাক সে সব কথা। এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিরেক্টর ব্র্যাড অ্যাডামস তাঁর কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য, ঢাকায় বসে তাঁরা বাংলাদেশের মানবাধিকার-বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন। এটি তাঁদের প্রকাশ করার কথা ছিল দুই মাস আগে। অজ্ঞাত কারণে তা তাঁরা করলেন দুই মাস পর। কথা উঠতে পারে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করার চার দিনের মাথায় কেন তাঁরা ঢাকায় এসে এই রিপোর্ট প্রকাশ করলেন? তবে এই প্রশ্ন করলে কোনো কোনো পাঠক বলতে পারেন, সবকিছুতেই আমাদের বা আমার সন্দেহ বাতিক। ধরে নিলাম বিষয়টা কাকতালীয়।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে প্রতিবেদনটি যুগপৎ ঢাকা ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশ করেছে, সেটির শিরোনাম ছিল, ‘ভয় আমাকে কখনো ছাড়ে না’ (The Fear Never Leaves Me)। ৫৭ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে মূলত প্রাধান্য পেয়েছে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিলখানায় সংঘটিত ভয়াবহ বিডিআর বিদ্রোহ, যে বিদ্রোহটি ঘটেছিল মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসেরও কম সময়ে এবং সেই বিদ্রোহে ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় এমন একটি ঘটনা অন্য কোনো দেশে ঘটলে সে দেশের সরকার পতনেরও সম্ভাবনা ছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে যে বিষয়টি তুলে আনার চেষ্টা হয়েছে তা হচ্ছে, ‘এই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বিডিআরের যে সব সদস্যকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, হেফাজতে থাকাকালীন তাঁদের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন, অত্যাচার চালানো হচ্ছে এবং এর ফলে তাঁদের অনেককেই মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’
এই নির্যাতন ও মৃত্যুর জন্য তারা সরাসরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র্যাবকে দায়ী করেছে এবং নজিরবিহীনভাবে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, এই বাহিনী যেন ভেঙে দেওয়া হয়। বর্তমানে বিডিআর ও বেসামরিক আদালতে বিদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত ছয় হাজারের মতো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, এ ধরনের গণবিচার বন্ধ করতে হবে, কারণ, এতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ন্যায্য বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। মনে রাখতে হবে, তারা এ কথাগুলো বলছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের রাজধানীতে এসে, যে কাজটি তারা কখনো সৌদি আরব, ইরান, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, ভারত অথবা চীনে গিয়ে করতে পারত না।
র্যাব বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগ বহু পুরোনো। বাংলাদেশের প্রতিটি মানবাধিকার সংস্থাই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে, তা বন্ধ করতে দাবি তুলেছে। আমাদের উচ্চ আদালত এ রকম একাধিক ঘটনার বিরুদ্ধে সুয়োমোটো রুল জারি করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবছরই তাদের রিপোর্টে বিষয়টি উল্লেখ করেছে। কিন্তু একেবারে বাড়িতে বয়ে এসে কোনো একটি সরকারি সংস্থাকে বন্ধ করার দাবি করা অথবা একটি ভয়াবহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের চলমান বিচারকে মাঝপথে স্থগিত করার দাবি চরম ঔদ্ধত্যের শামিল বলে মনে না করার কি কোনো যৌক্তিক কারণ আছে? বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়মিত গুলি করে মানুষ হত্যা করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে তারা দিল্লিতে গিয়ে বলুক তো, তোমাদের বিএসএফের কার্যক্রম বন্ধ করে দাও। না, তারা তা করতে পারবে না। তাদের নিজ দেশের বিরুদ্ধে বহুদিনের অভিযোগ, সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো বন্দীর কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করতে চাইলে এবং তা নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করার জন্য ওই ব্যক্তিকে ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে এই পদ্ধতিতে স্বীকারোক্তি আদায় করা বেআইনি। এ কাজটি করতে তারা আউটসোর্স করেছিল পোল্যান্ড, মিসর, জর্ডান, মরক্কো, সিরিয়া, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান আর সৌদি আরবে। ব্যবস্থাটা ছিল এ রকম, প্লেন ভর্তি করে বন্দীদের (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুয়ানতানামো বে কারাগার থেকে) সে সব দেশে পাঠিয়ে তাদের নির্যাতনবিশারদদের হাতে তুলে দেওয়া হতো, তারা নির্যাতনের প্রয়োজনীয় কলাকৌশল (ওয়াটার বোর্ডিং অন্যতম) ব্যবহার করে বন্দীর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে তারপর তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠাত। এই ব্যবস্থা যে ছিল, তা স্বয়ং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র স্বীকার করেছেন। পোল্যান্ডের বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পোল্যান্ডকে বহিষ্কার করার হুমকি দেয়। এরপর তা বন্ধ হয়। মিসরের হোসনি মোবারকের পতন হলে সেখানে তা আপাতত বন্ধ আছে। সিরিয়ার অবস্থাও টালমাটাল। বাকিরা এ কাজ প্রয়োজনে করতে মোটেও কুণ্ঠিত নয়। কাজটি তারা মোটা অর্থের বিনিময়ে করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ক্ষমতা থাকলে এসব ব্যাপারে কথা বলুক না রিয়াদ, আম্মান বা ওয়াশিংটনে বসে।
বাংলাদেশে কেন, আধুনিক বিশ্বের কোথাও বিডিআর বিদ্রোহের মতো এমন ঘটনা গত ১০০ বছরে শান্তিকালীন সময়ে ঘটেনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গণবিচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে অপরাধের বিচার হচ্ছে, তা ছিল একটি জঘন্য গণ-অপরাধ (Collective Crime)। এমন একটি অপরাধের বিচার যদি আলাদাভাবে করতে হয়, তা হলে এটি শেষ হতে ১৬-২০ বছর লেগে যেতে পারে। তখন তা হবে বিচারের নামে কালক্ষেপণের নামান্তর এবং একধরনের প্রহসন। যে আদালতে বিচার হচ্ছে, সে সম্পর্কেও এ সংস্থার আপত্তি আছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সরকার যেকোনো স্থানকে আদালত ঘোষণা করতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারকার্য পরিচালনার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আদালত বসানো হয়েছিল। সিভিল আদালতে যাঁরা বিচারকাজ পরিচালনা করছেন, তাঁরা সবাই জেলা জজ পদমর্যাদার। বিবাদী পক্ষকে নিজ পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। বিডিআর আদালতে বিচার তাদের আইনেই হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর চেয়ে আইনের আশ্রয়ের সুযোগ আর কী হতে পারে? আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কোনো সদস্য কখনো কোনো আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য সেখানে যাননি। এমনটা চলতে থাকলে পরেরবার হয়তো এসে তারা বলবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করা হোক। কারণ, তারা সুযোগ পেলেই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। অথবা সব আদালত বন্ধ করে দেওয়া হোক, কেননা তাঁরা ঠিকমতো বিচারকাজ চালাতে পারছেন না। তবে যে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বা হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু হওয়া নিয়ে কথা উঠেছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, যা আগে উল্লেখ করেছি। সরকারের উচিত হবে নিজেদের স্বার্থেই ‘এ রকম কোনো ঘটনা কখনো ঘটেনি’ এ কথা না বলে, সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা।
এই যে র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেনকে আসামি করে সম্প্রতি আরেকটি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ, তার কী হবে? এখানেও মামলার বাদী র্যাব। পুলিশ ও র্যাবের এহেন অমানবিক আচরণ দেখে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, এই দুটি সংস্থার কোনো কোনো সদস্য সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য যত রকমের পদ্ধতি আছে, তার সব কটি ব্যবহার করছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, তাঁরা পরের সরকারের জন্য কাজ করছেন। এমন মন্তব্য আমাদের দেশের মানুষ করতে পারে, তবে তা কোনো কারণেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিয়ে দেশে দেশে অনেক বিতর্ক আছে। একসময় তারা গাদ্দাফি সরকারকে সহায়তা করেছিল কিংবা সৌদি আরবের নাগরিকদের কাছ থেকে এই সংস্থা নিয়মিত অর্থ সাহায্য নেয়, এমন অভিযোগ করা হয়। ভেনেজুয়েলা সে দেশে থেকে তাদের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেছে। গবেষণাকার্য পরিচালনার জন্য তারা যেভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে, তার পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে বলে যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের অনেক নামকরা গবেষক মনে করেন। বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে জামায়াতের নিয়োগ পাওয়া লবিস্টদের বিদেশে বসে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো এক কথা, আর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থা একেবারে আমাদের বাড়িতে এসে অযাচিত উপদেশ দেওয়া অন্য কথা। বুঝতে হবে আমাদের—পররাষ্ট্রনীতিতে কোথাও বড় ধরনের গলদ আছে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পত্রপত্রিকায় আবার কেউ যদি এসব প্রসঙ্গে যুক্তিনির্ভর কোনো (বিদেশিদের অযাচিত বক্তৃতা-বিবৃতি প্রসঙ্গে) মন্তব্য প্রতিবেদন লেখেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণীর পাঠক আছেন, যাঁরা তাঁকে সরকারের দালাল বলে তুলাধোনা করেন। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতে পদ্মা সেতু নিয়ে আমার একটা উপসম্পাদকীয় ছাপা হলো। বলার চেষ্টা করেছিলাম, বিশ্বব্যাংক অর্থ না দিলেও এই সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে তাদের সাবেক কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছিলাম। আর যায় কোথায়? প্রায় ২৩০টি মন্তব্য। দু-একটি বাদ দিলে সবাই মোটামুটি এই উপসংহারে পৌঁছেছে, আমার মতো আওয়ামী লীগের দালাল বাংলাদেশে দ্বিতীয়জন নেই। দু-একজন আবার উপদেশ দিয়ে জানাল, এসব দালালি ছেড়ে তাদের খুব পছন্দের দু-একজন বিশ্লেষকের বা কলাম লেখকের মতো ‘বস্তুনিষ্ঠ’ লেখা লিখি। কেউ কেউ আবার প্রথম আলোরও তুমুল সমালোচনা করেছে, আমার মতো একজন নালায়েকের লেখা ছাপানোর জন্য। তাদের উদ্দেশে বলি, আমি আওয়ামী লীগের সমর্থক বটে, তবে স্তাবক বা দলকানা নই। ভালো কাজের প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হই না, আবার মন্দ কাজের সমালোচনা করতেও পিছপা হই না। আমার অনেক লেখায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও সমালোচনা করেছি। আমি সব সময় ‘আমার সমালোচক, আমার বন্ধু’ এই নীতিতে বিশ্বাস করি। যাক সে সব কথা। এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিরেক্টর ব্র্যাড অ্যাডামস তাঁর কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য, ঢাকায় বসে তাঁরা বাংলাদেশের মানবাধিকার-বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন। এটি তাঁদের প্রকাশ করার কথা ছিল দুই মাস আগে। অজ্ঞাত কারণে তা তাঁরা করলেন দুই মাস পর। কথা উঠতে পারে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করার চার দিনের মাথায় কেন তাঁরা ঢাকায় এসে এই রিপোর্ট প্রকাশ করলেন? তবে এই প্রশ্ন করলে কোনো কোনো পাঠক বলতে পারেন, সবকিছুতেই আমাদের বা আমার সন্দেহ বাতিক। ধরে নিলাম বিষয়টা কাকতালীয়।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে প্রতিবেদনটি যুগপৎ ঢাকা ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশ করেছে, সেটির শিরোনাম ছিল, ‘ভয় আমাকে কখনো ছাড়ে না’ (The Fear Never Leaves Me)। ৫৭ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে মূলত প্রাধান্য পেয়েছে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিলখানায় সংঘটিত ভয়াবহ বিডিআর বিদ্রোহ, যে বিদ্রোহটি ঘটেছিল মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসেরও কম সময়ে এবং সেই বিদ্রোহে ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় এমন একটি ঘটনা অন্য কোনো দেশে ঘটলে সে দেশের সরকার পতনেরও সম্ভাবনা ছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে যে বিষয়টি তুলে আনার চেষ্টা হয়েছে তা হচ্ছে, ‘এই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বিডিআরের যে সব সদস্যকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, হেফাজতে থাকাকালীন তাঁদের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন, অত্যাচার চালানো হচ্ছে এবং এর ফলে তাঁদের অনেককেই মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’
এই নির্যাতন ও মৃত্যুর জন্য তারা সরাসরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র্যাবকে দায়ী করেছে এবং নজিরবিহীনভাবে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, এই বাহিনী যেন ভেঙে দেওয়া হয়। বর্তমানে বিডিআর ও বেসামরিক আদালতে বিদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত ছয় হাজারের মতো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, এ ধরনের গণবিচার বন্ধ করতে হবে, কারণ, এতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ন্যায্য বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। মনে রাখতে হবে, তারা এ কথাগুলো বলছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের রাজধানীতে এসে, যে কাজটি তারা কখনো সৌদি আরব, ইরান, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, ভারত অথবা চীনে গিয়ে করতে পারত না।
র্যাব বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগ বহু পুরোনো। বাংলাদেশের প্রতিটি মানবাধিকার সংস্থাই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে, তা বন্ধ করতে দাবি তুলেছে। আমাদের উচ্চ আদালত এ রকম একাধিক ঘটনার বিরুদ্ধে সুয়োমোটো রুল জারি করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবছরই তাদের রিপোর্টে বিষয়টি উল্লেখ করেছে। কিন্তু একেবারে বাড়িতে বয়ে এসে কোনো একটি সরকারি সংস্থাকে বন্ধ করার দাবি করা অথবা একটি ভয়াবহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের চলমান বিচারকে মাঝপথে স্থগিত করার দাবি চরম ঔদ্ধত্যের শামিল বলে মনে না করার কি কোনো যৌক্তিক কারণ আছে? বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়মিত গুলি করে মানুষ হত্যা করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে তারা দিল্লিতে গিয়ে বলুক তো, তোমাদের বিএসএফের কার্যক্রম বন্ধ করে দাও। না, তারা তা করতে পারবে না। তাদের নিজ দেশের বিরুদ্ধে বহুদিনের অভিযোগ, সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো বন্দীর কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করতে চাইলে এবং তা নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করার জন্য ওই ব্যক্তিকে ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে এই পদ্ধতিতে স্বীকারোক্তি আদায় করা বেআইনি। এ কাজটি করতে তারা আউটসোর্স করেছিল পোল্যান্ড, মিসর, জর্ডান, মরক্কো, সিরিয়া, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান আর সৌদি আরবে। ব্যবস্থাটা ছিল এ রকম, প্লেন ভর্তি করে বন্দীদের (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুয়ানতানামো বে কারাগার থেকে) সে সব দেশে পাঠিয়ে তাদের নির্যাতনবিশারদদের হাতে তুলে দেওয়া হতো, তারা নির্যাতনের প্রয়োজনীয় কলাকৌশল (ওয়াটার বোর্ডিং অন্যতম) ব্যবহার করে বন্দীর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে তারপর তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠাত। এই ব্যবস্থা যে ছিল, তা স্বয়ং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র স্বীকার করেছেন। পোল্যান্ডের বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পোল্যান্ডকে বহিষ্কার করার হুমকি দেয়। এরপর তা বন্ধ হয়। মিসরের হোসনি মোবারকের পতন হলে সেখানে তা আপাতত বন্ধ আছে। সিরিয়ার অবস্থাও টালমাটাল। বাকিরা এ কাজ প্রয়োজনে করতে মোটেও কুণ্ঠিত নয়। কাজটি তারা মোটা অর্থের বিনিময়ে করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ক্ষমতা থাকলে এসব ব্যাপারে কথা বলুক না রিয়াদ, আম্মান বা ওয়াশিংটনে বসে।
বাংলাদেশে কেন, আধুনিক বিশ্বের কোথাও বিডিআর বিদ্রোহের মতো এমন ঘটনা গত ১০০ বছরে শান্তিকালীন সময়ে ঘটেনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গণবিচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে অপরাধের বিচার হচ্ছে, তা ছিল একটি জঘন্য গণ-অপরাধ (Collective Crime)। এমন একটি অপরাধের বিচার যদি আলাদাভাবে করতে হয়, তা হলে এটি শেষ হতে ১৬-২০ বছর লেগে যেতে পারে। তখন তা হবে বিচারের নামে কালক্ষেপণের নামান্তর এবং একধরনের প্রহসন। যে আদালতে বিচার হচ্ছে, সে সম্পর্কেও এ সংস্থার আপত্তি আছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সরকার যেকোনো স্থানকে আদালত ঘোষণা করতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারকার্য পরিচালনার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আদালত বসানো হয়েছিল। সিভিল আদালতে যাঁরা বিচারকাজ পরিচালনা করছেন, তাঁরা সবাই জেলা জজ পদমর্যাদার। বিবাদী পক্ষকে নিজ পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। বিডিআর আদালতে বিচার তাদের আইনেই হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর চেয়ে আইনের আশ্রয়ের সুযোগ আর কী হতে পারে? আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কোনো সদস্য কখনো কোনো আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য সেখানে যাননি। এমনটা চলতে থাকলে পরেরবার হয়তো এসে তারা বলবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করা হোক। কারণ, তারা সুযোগ পেলেই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। অথবা সব আদালত বন্ধ করে দেওয়া হোক, কেননা তাঁরা ঠিকমতো বিচারকাজ চালাতে পারছেন না। তবে যে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বা হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু হওয়া নিয়ে কথা উঠেছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, যা আগে উল্লেখ করেছি। সরকারের উচিত হবে নিজেদের স্বার্থেই ‘এ রকম কোনো ঘটনা কখনো ঘটেনি’ এ কথা না বলে, সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা।
এই যে র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেনকে আসামি করে সম্প্রতি আরেকটি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ, তার কী হবে? এখানেও মামলার বাদী র্যাব। পুলিশ ও র্যাবের এহেন অমানবিক আচরণ দেখে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, এই দুটি সংস্থার কোনো কোনো সদস্য সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য যত রকমের পদ্ধতি আছে, তার সব কটি ব্যবহার করছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, তাঁরা পরের সরকারের জন্য কাজ করছেন। এমন মন্তব্য আমাদের দেশের মানুষ করতে পারে, তবে তা কোনো কারণেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিয়ে দেশে দেশে অনেক বিতর্ক আছে। একসময় তারা গাদ্দাফি সরকারকে সহায়তা করেছিল কিংবা সৌদি আরবের নাগরিকদের কাছ থেকে এই সংস্থা নিয়মিত অর্থ সাহায্য নেয়, এমন অভিযোগ করা হয়। ভেনেজুয়েলা সে দেশে থেকে তাদের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেছে। গবেষণাকার্য পরিচালনার জন্য তারা যেভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে, তার পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে বলে যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের অনেক নামকরা গবেষক মনে করেন। বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে জামায়াতের নিয়োগ পাওয়া লবিস্টদের বিদেশে বসে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো এক কথা, আর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থা একেবারে আমাদের বাড়িতে এসে অযাচিত উপদেশ দেওয়া অন্য কথা। বুঝতে হবে আমাদের—পররাষ্ট্রনীতিতে কোথাও বড় ধরনের গলদ আছে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments