সাদাকালো-পদ্মা সেতু চুক্তি বাতিল মর্যাদা রক্ষার চ্যালেঞ্জ by আহমদ রফিক
পদ্মা সেতুর বিশ্বব্যাংক ঋণ নিয়ে এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক মহলে মহা তোলপাড়। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায়ই সব মহলে প্রতিক্রিয়া। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির ধুম- সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে। আজকেও দেখছি তার রেশ।
চলবে মনে হয় আরো কিছুদিন- অন্তত সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে কিছু একটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত।
অর্থনীতিবিদ নই, স্থপতি-প্রকৌশলী- কোনোটাই নই। তবু বিষয়টা রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক বলে এবং সংগত কিছু বক্তব্য থাকার কারণে এ লেখা। বিশেষ করে আরো এ জন্য যে বিশ্বব্যাংকের পদক্ষেপ ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া- এ দুই কারণের আপাত-সংঘাতের মধ্য দিয়ে ভিন্ন এক সম্ভাবনা উঁকি দিতে শুরু করেছে, যার স্বচ্ছ ব্যবহার ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। অবশ্যই এর পূর্বশর্ত অর্থ ব্যবহারে স্বচ্ছতা। আমার মূল বক্তব্য ওই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে, যদিও আলোচনায় আসবে বহু উচ্চারিত কিছু কথা।
প্রথমেই বলে রাখি, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও আরো অনেকের মতো আমি দেশের উন্নয়নে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক নির্ভরতার বিরোধী, তবে অন্ধভাবে নয়। তাই চোখ-কান খোলা রেখে পদ্মা সেতুর ঋণ নিয়ে এক পক্ষের অভিযোগ অন্য পক্ষের তা উড়িয়ে দেওয়ার অভ্যন্তরীণ কারণগুলো খতিয়ে দেখতে চাই। এবং তা যেমন দলীয় স্বার্থের অন্ধ সমর্থনে নয়, তেমনি নয় সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা গ্রহণ করে।
দশক কয়েক আগেরকার কথা। তখন শিল্পব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে বিদেশি ঋণ এবং ঋণ ব্যবহারে জাতীয় স্বার্থের ভালো-মন্দ নিয়ে হিসাব-নিকাশে আগ্রহী ছিলাম। ফলে কিছু তথ্যও জানার অবকাশ ছিল। তখনো দুর্নীতি ছিল, তবে তা এতটা ব্যাপক ও বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি। তখনো হিসাব-নিকাশে দেখা গেছে, বিদেশি ঋণের আয়-ব্যয়ে দেশের পক্ষে নেতিবাচক দিকটাই বড়। যা নিই, অবশেষ বিচারে তার চেয়ে অনেক বেশি দিই। তাই শেষ হিসাবে জমাখরচের খাতাটা ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়ায়।
এর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ এ বিষয়ে এ পর্যন্ত একাধিক জন কাগজে লিখেছেন। যেমন পদ্মা সেতুর ঋণ প্রসঙ্গে, তেমনি অন্য ঋণ প্রসঙ্গে এর আগেও। অর্থাৎ ঋণদাতার নানা শর্ত, পরামর্শদাতা নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আর শর্তবহির্ভূত দ্বিপাক্ষিক লাভালাভ মিলে কমবেশি সব ঋণনির্ভর প্রকল্প দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থবিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লাটা ভারী। এ ধরনের কথাই দশক কয় আগে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরিচালিত সংস্থার ঋণ গ্রহণের বিপক্ষে লিখেছিলাম। এবং তা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বিবেচনায়।
এই ধারায় আজকালও লেখা হচ্ছে। হচ্ছে পক্ষে-বিপক্ষে। তবে এসব লেখা নিয়ে উচ্চস্তরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মাথা ঘামান বলে মনে হয় না। ঘামালে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ভালো-মন্দের দিকগুলো বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতেন। এখন আমাদের বড় সমস্যা হলো- এ দেশের রাজনীতি পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ও তাদের অর্থনীতিনির্ভর। ক্ষমতায় থাকা-না থাকা অনেকাংশে নির্ভর করে পরাক্রান্ত শক্তির ইচ্ছার ওপর। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র, ভোটের রাজনীতি, জনতার ম্যান্ডেট- কোনো কিছুই কাজে আসে না। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্র সব কিছু ভেস্তে দেয়। এমনটাই দেখে আসছি পঞ্চাশের দশক থেকে রাজনীতির পালাবদলে। এ বিষয়ে দ্বিতীয় সমস্যা দুর্নীতি।
পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি ভণ্ডুলবিষয়ক অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ প্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে যে বাস্তব তথ্যের হিসাব-নিকাশ না করে এ সম্বন্ধে যে যার তরিকা অনুযায়ী লিখছেন। সে হিসেবে কেউ বিশ্বব্যাংকের পক্ষে, কেউ সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে। একটা উদাহরণ দিই। যেমন- রাজনৈতিকভাবে সরকারবিরোধী বলে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির বয়ানে সরকারের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ। যেন বিশ্বব্যাংক ধোয়া তুলসীপাতা। যেহেতু ওইসব সংস্থা থেকে নিয়মিত ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তাই তাদের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ তোলার অধিকার নেই।
অদ্ভুত সব যুক্তি! অর্থাৎ পদ্মা সেতু-বিষয়ক সমস্যাটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বদেশি স্বার্থবিষয়ক হিসাব-নিকাশ হয়ে উঠেছে গৌণ। তাই অযোগ্য চীনা কম্পানির কাজ পাওয়া না-পাওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি লেখায় উঠে আসে না। অন্যদিকে সরকার পক্ষের এমন যুক্তিও ধোপে টেকে না যে অর্থ লেনদেনই যেখানে হয়নি, সেখানে দুর্নীতি হবে কিভাবে? এটা যে কুযুক্তি, আসিফ নজরুলের লেখায় তা অপরাধবিষয়ক আইনি বিধান উল্লেখ করে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ কমিশনের নামে ঘুষ চাওয়া অপরাধ।
এমন সব বাদ-প্রতিবাদ, পক্ষে-বিপক্ষের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আসল কথা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। সত্য ঘটনা বা তথ্য চাপের মুখে বলা যায় উপেক্ষিত।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ বা বিশ্লেষকদের লেখার ধারা নিজ নিজ রাজনৈতিক ঘরানার বাইরে যুক্তিগ্রাহ্য ও নিরপেক্ষ হওয়া উচিত, যা ওইসব বিশেষ ক্ষেত্রে হচ্ছে না। তবে পদ্মা সেতু নিয়ে এত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে যে তার মধ্যে কিছু আলোচনা যুক্তিনির্ভর ও দলনিরপেক্ষ। যেমন- অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর তথ্যভিত্তিক বক্তব্য।
আর তারই ভিত্তিতে অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম ঘটনার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছেন। তাতে দেখা যায়, গলার কাঁটা পূর্বোক্ত যোগ্যতাহীন চীনা কম্পানি, যাদের কাজ পাইয়ে দিতে বিশ্বব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন। এবং এতটাই ছিলেন যে সে ব্যর্থতায় আধপাকা ঘুঁটি কেচে গেল। এই কেচে যাওয়ার পেছনে রয়েছে মন্ত্রীর ঘুঁটি, যেটিকে কেচিয়ে দিল বিশ্বব্যাংক। সে জন্যই কি সরকার জোরগলায় চীনা কম্পানির বিষয়টা শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে বলতে পারেনি?
অর্থাৎ ঘাপলা উভয় পক্ষে? আর সে জন্যই তা সমাধানের বাইরে চলে গেছে (পয়েন্ট অব নো রিটার্ন)। সম্ভবত নিজেদের দুর্বলতার (সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারার) কারণে সরকার বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারেনি। কী হয়েছে না হয়েছে সে বিষয়ে জনগণ এখনো অন্ধকারে। এ অবস্থায় অপমানিত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সরকার একাধিক ব্যবস্থা নিতে পারে। যেমন- সব ঘটনার বিবরণ ও ব্যাখ্যা দিয়ে নিজ ভূমিকা স্পষ্ট করে শ্বেতপত্র প্রকাশ। তাতে বিরোধী পক্ষই (বিশ্বব্যাংক) নয় শুধু, স্থানীয় বিরোধী দলেরও মুখ বন্ধ হবে।
দ্বিতীয়ত, কারো কারো দাবি অনুযায়ী নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনার পূর্বাপর তথ্যনির্ভর বিবরণ প্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে মানুষ শুনছে, পড়ছে; কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সম্বন্ধে সঠিক জানে না- কোথায় দুর্নীতি, কাদের দুর্নীতি, কিভাবে দুর্নীতি। রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বিষয়টা স্পষ্ট করতে পারতেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর বিপরীতার্থক কথাবার্তায় বরং জটিলতা বেড়েছে বই কমেনি। তবে ৩ জুলাই সংবাদপত্রে প্রকাশিত অর্থমন্ত্রীর বিবৃতিতে ঘটনা অনেকটা স্পষ্ট হলেও সব ধোয়াশা দূর হয়নি। অপর পক্ষের বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ এ সম্বন্ধে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি। কাজেই বিষয়টা অস্পষ্টতায় ঝুলে আছে।
তবে এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক যে তিনটা শর্ত দিয়েছিল, তা এত কঠিন ছিল না যে পূরণ করা যাবে না। যা করা হয়েছে তা অনেকটা গোঁজামিল দেওয়ার মতো। পদ্মা সেতুর গুরুত্ব ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন বিবেচনায় বিষয়টা আরো গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করলে দেশের ও সরকারের জন্য ভালো হতো। নিরপেক্ষ তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের পর বরং সরকার বিশ্বব্যাংকের ঋণগ্রহণ খারিজ করে দিলে তাতে সাপও মরত, লাঠিও ভাঙত না। যাঁরা বিশ্বব্যাংকের হাতে বাংলাদেশের অপমানের কথা বলে দীর্ঘ কলাম লেখেন, তাঁদের স্বদেশীয় দুর্নীতির বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিত।
জানি না, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কী ভেবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তবে আমার বিশ্বাস, কষ্টকর হলেও এবং কৃচ্ছ্রসাধন করে হলেও আত্মনির্ভরশীলতার পথই উন্নয়নশীল দেশের জন্য সঠিক পথ। দেশে সাদা-কালো অর্থসম্পদ নেহাৎ কম নেই। যা আছে তা দিয়ে কয়েকটা পদ্মা সেতু তৈরি করা যায়।
এ কথাও মিথ্যা নয় যে বিশ্বব্যাংকের টাকার ফাঁদে পা দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দুর্বল দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বনাশ ঘটে গেছে। পদ্মা সেতুর ঋণপ্রস্তাব বাতিল করে বিশ্বব্যাংক যদি আমাদের রাষ্ট্রীয় আত্মমর্যাদায় আঘাত করে থাকে, সেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক, যদি আমরা আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় স্বনির্ভরতার কঠিন পথ বেছে নিতে পারি।
শুধু বেছে নেওয়া নয়, বরং কঠিন সংকল্পবদ্ধ হতে পারি এই বলে যে এখন থেকে আর আত্মঘাতী ঋণ নয়। নিজের সামর্থ্যে-শক্তিতে কষ্টকর যাত্রায় নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নতি করতে হবে। লক্ষ করার বিষয় যে ইতিমধ্যে দেশের কয়েকটি সংস্থা থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে যে সাড়া মিলেছে, তার আদর্শগত গুরুত্ব কম নয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দল-নির্বিশেষে ব্যক্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার জন্য ঘোষণায় ভালো সাড়া মিলতে পারে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, এটা সুখবর।
কিন্তু সে ক্ষেত্রে বড় শর্ত হবে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশের পক্ষে নিশ্চয়তা। তা না হলে স্থানীয় সাদা পুঁজি উৎসাহিত হবে না। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সরে এসে নিজেরাই যদি কালো লেনদেনে জড়িয়ে পড়ি, তাহলে স্বনির্ভর দেশ গড়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। স্থানীয় মেধা ও অর্থের জন্য তা হবে অপমানজনক। একটা চ্যালেঞ্জ যথাযথভাবে পূরণ করে আমরা কি অন্তত একবার জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় জবাব দিতে পারি না? ব্যক্তিস্বার্থ কি সেখানে এতটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
অর্থনীতিবিদ নই, স্থপতি-প্রকৌশলী- কোনোটাই নই। তবু বিষয়টা রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক বলে এবং সংগত কিছু বক্তব্য থাকার কারণে এ লেখা। বিশেষ করে আরো এ জন্য যে বিশ্বব্যাংকের পদক্ষেপ ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া- এ দুই কারণের আপাত-সংঘাতের মধ্য দিয়ে ভিন্ন এক সম্ভাবনা উঁকি দিতে শুরু করেছে, যার স্বচ্ছ ব্যবহার ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। অবশ্যই এর পূর্বশর্ত অর্থ ব্যবহারে স্বচ্ছতা। আমার মূল বক্তব্য ওই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে, যদিও আলোচনায় আসবে বহু উচ্চারিত কিছু কথা।
প্রথমেই বলে রাখি, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও আরো অনেকের মতো আমি দেশের উন্নয়নে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক নির্ভরতার বিরোধী, তবে অন্ধভাবে নয়। তাই চোখ-কান খোলা রেখে পদ্মা সেতুর ঋণ নিয়ে এক পক্ষের অভিযোগ অন্য পক্ষের তা উড়িয়ে দেওয়ার অভ্যন্তরীণ কারণগুলো খতিয়ে দেখতে চাই। এবং তা যেমন দলীয় স্বার্থের অন্ধ সমর্থনে নয়, তেমনি নয় সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা গ্রহণ করে।
দশক কয়েক আগেরকার কথা। তখন শিল্পব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে বিদেশি ঋণ এবং ঋণ ব্যবহারে জাতীয় স্বার্থের ভালো-মন্দ নিয়ে হিসাব-নিকাশে আগ্রহী ছিলাম। ফলে কিছু তথ্যও জানার অবকাশ ছিল। তখনো দুর্নীতি ছিল, তবে তা এতটা ব্যাপক ও বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি। তখনো হিসাব-নিকাশে দেখা গেছে, বিদেশি ঋণের আয়-ব্যয়ে দেশের পক্ষে নেতিবাচক দিকটাই বড়। যা নিই, অবশেষ বিচারে তার চেয়ে অনেক বেশি দিই। তাই শেষ হিসাবে জমাখরচের খাতাটা ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়ায়।
এর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ এ বিষয়ে এ পর্যন্ত একাধিক জন কাগজে লিখেছেন। যেমন পদ্মা সেতুর ঋণ প্রসঙ্গে, তেমনি অন্য ঋণ প্রসঙ্গে এর আগেও। অর্থাৎ ঋণদাতার নানা শর্ত, পরামর্শদাতা নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আর শর্তবহির্ভূত দ্বিপাক্ষিক লাভালাভ মিলে কমবেশি সব ঋণনির্ভর প্রকল্প দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থবিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লাটা ভারী। এ ধরনের কথাই দশক কয় আগে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরিচালিত সংস্থার ঋণ গ্রহণের বিপক্ষে লিখেছিলাম। এবং তা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বিবেচনায়।
এই ধারায় আজকালও লেখা হচ্ছে। হচ্ছে পক্ষে-বিপক্ষে। তবে এসব লেখা নিয়ে উচ্চস্তরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মাথা ঘামান বলে মনে হয় না। ঘামালে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ভালো-মন্দের দিকগুলো বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতেন। এখন আমাদের বড় সমস্যা হলো- এ দেশের রাজনীতি পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ও তাদের অর্থনীতিনির্ভর। ক্ষমতায় থাকা-না থাকা অনেকাংশে নির্ভর করে পরাক্রান্ত শক্তির ইচ্ছার ওপর। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র, ভোটের রাজনীতি, জনতার ম্যান্ডেট- কোনো কিছুই কাজে আসে না। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্র সব কিছু ভেস্তে দেয়। এমনটাই দেখে আসছি পঞ্চাশের দশক থেকে রাজনীতির পালাবদলে। এ বিষয়ে দ্বিতীয় সমস্যা দুর্নীতি।
পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি ভণ্ডুলবিষয়ক অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ প্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে যে বাস্তব তথ্যের হিসাব-নিকাশ না করে এ সম্বন্ধে যে যার তরিকা অনুযায়ী লিখছেন। সে হিসেবে কেউ বিশ্বব্যাংকের পক্ষে, কেউ সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে। একটা উদাহরণ দিই। যেমন- রাজনৈতিকভাবে সরকারবিরোধী বলে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির বয়ানে সরকারের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ। যেন বিশ্বব্যাংক ধোয়া তুলসীপাতা। যেহেতু ওইসব সংস্থা থেকে নিয়মিত ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তাই তাদের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ তোলার অধিকার নেই।
অদ্ভুত সব যুক্তি! অর্থাৎ পদ্মা সেতু-বিষয়ক সমস্যাটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বদেশি স্বার্থবিষয়ক হিসাব-নিকাশ হয়ে উঠেছে গৌণ। তাই অযোগ্য চীনা কম্পানির কাজ পাওয়া না-পাওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি লেখায় উঠে আসে না। অন্যদিকে সরকার পক্ষের এমন যুক্তিও ধোপে টেকে না যে অর্থ লেনদেনই যেখানে হয়নি, সেখানে দুর্নীতি হবে কিভাবে? এটা যে কুযুক্তি, আসিফ নজরুলের লেখায় তা অপরাধবিষয়ক আইনি বিধান উল্লেখ করে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ কমিশনের নামে ঘুষ চাওয়া অপরাধ।
এমন সব বাদ-প্রতিবাদ, পক্ষে-বিপক্ষের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আসল কথা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। সত্য ঘটনা বা তথ্য চাপের মুখে বলা যায় উপেক্ষিত।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বিশেষজ্ঞ বা বিশ্লেষকদের লেখার ধারা নিজ নিজ রাজনৈতিক ঘরানার বাইরে যুক্তিগ্রাহ্য ও নিরপেক্ষ হওয়া উচিত, যা ওইসব বিশেষ ক্ষেত্রে হচ্ছে না। তবে পদ্মা সেতু নিয়ে এত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে যে তার মধ্যে কিছু আলোচনা যুক্তিনির্ভর ও দলনিরপেক্ষ। যেমন- অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর তথ্যভিত্তিক বক্তব্য।
আর তারই ভিত্তিতে অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম ঘটনার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছেন। তাতে দেখা যায়, গলার কাঁটা পূর্বোক্ত যোগ্যতাহীন চীনা কম্পানি, যাদের কাজ পাইয়ে দিতে বিশ্বব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন। এবং এতটাই ছিলেন যে সে ব্যর্থতায় আধপাকা ঘুঁটি কেচে গেল। এই কেচে যাওয়ার পেছনে রয়েছে মন্ত্রীর ঘুঁটি, যেটিকে কেচিয়ে দিল বিশ্বব্যাংক। সে জন্যই কি সরকার জোরগলায় চীনা কম্পানির বিষয়টা শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে বলতে পারেনি?
অর্থাৎ ঘাপলা উভয় পক্ষে? আর সে জন্যই তা সমাধানের বাইরে চলে গেছে (পয়েন্ট অব নো রিটার্ন)। সম্ভবত নিজেদের দুর্বলতার (সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারার) কারণে সরকার বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারেনি। কী হয়েছে না হয়েছে সে বিষয়ে জনগণ এখনো অন্ধকারে। এ অবস্থায় অপমানিত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সরকার একাধিক ব্যবস্থা নিতে পারে। যেমন- সব ঘটনার বিবরণ ও ব্যাখ্যা দিয়ে নিজ ভূমিকা স্পষ্ট করে শ্বেতপত্র প্রকাশ। তাতে বিরোধী পক্ষই (বিশ্বব্যাংক) নয় শুধু, স্থানীয় বিরোধী দলেরও মুখ বন্ধ হবে।
দ্বিতীয়ত, কারো কারো দাবি অনুযায়ী নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনার পূর্বাপর তথ্যনির্ভর বিবরণ প্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে মানুষ শুনছে, পড়ছে; কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সম্বন্ধে সঠিক জানে না- কোথায় দুর্নীতি, কাদের দুর্নীতি, কিভাবে দুর্নীতি। রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বিষয়টা স্পষ্ট করতে পারতেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর বিপরীতার্থক কথাবার্তায় বরং জটিলতা বেড়েছে বই কমেনি। তবে ৩ জুলাই সংবাদপত্রে প্রকাশিত অর্থমন্ত্রীর বিবৃতিতে ঘটনা অনেকটা স্পষ্ট হলেও সব ধোয়াশা দূর হয়নি। অপর পক্ষের বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ এ সম্বন্ধে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি। কাজেই বিষয়টা অস্পষ্টতায় ঝুলে আছে।
তবে এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক যে তিনটা শর্ত দিয়েছিল, তা এত কঠিন ছিল না যে পূরণ করা যাবে না। যা করা হয়েছে তা অনেকটা গোঁজামিল দেওয়ার মতো। পদ্মা সেতুর গুরুত্ব ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন বিবেচনায় বিষয়টা আরো গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করলে দেশের ও সরকারের জন্য ভালো হতো। নিরপেক্ষ তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের পর বরং সরকার বিশ্বব্যাংকের ঋণগ্রহণ খারিজ করে দিলে তাতে সাপও মরত, লাঠিও ভাঙত না। যাঁরা বিশ্বব্যাংকের হাতে বাংলাদেশের অপমানের কথা বলে দীর্ঘ কলাম লেখেন, তাঁদের স্বদেশীয় দুর্নীতির বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিত।
জানি না, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কী ভেবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তবে আমার বিশ্বাস, কষ্টকর হলেও এবং কৃচ্ছ্রসাধন করে হলেও আত্মনির্ভরশীলতার পথই উন্নয়নশীল দেশের জন্য সঠিক পথ। দেশে সাদা-কালো অর্থসম্পদ নেহাৎ কম নেই। যা আছে তা দিয়ে কয়েকটা পদ্মা সেতু তৈরি করা যায়।
এ কথাও মিথ্যা নয় যে বিশ্বব্যাংকের টাকার ফাঁদে পা দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দুর্বল দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বনাশ ঘটে গেছে। পদ্মা সেতুর ঋণপ্রস্তাব বাতিল করে বিশ্বব্যাংক যদি আমাদের রাষ্ট্রীয় আত্মমর্যাদায় আঘাত করে থাকে, সেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক, যদি আমরা আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় স্বনির্ভরতার কঠিন পথ বেছে নিতে পারি।
শুধু বেছে নেওয়া নয়, বরং কঠিন সংকল্পবদ্ধ হতে পারি এই বলে যে এখন থেকে আর আত্মঘাতী ঋণ নয়। নিজের সামর্থ্যে-শক্তিতে কষ্টকর যাত্রায় নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নতি করতে হবে। লক্ষ করার বিষয় যে ইতিমধ্যে দেশের কয়েকটি সংস্থা থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে যে সাড়া মিলেছে, তার আদর্শগত গুরুত্ব কম নয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দল-নির্বিশেষে ব্যক্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার জন্য ঘোষণায় ভালো সাড়া মিলতে পারে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, এটা সুখবর।
কিন্তু সে ক্ষেত্রে বড় শর্ত হবে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশের পক্ষে নিশ্চয়তা। তা না হলে স্থানীয় সাদা পুঁজি উৎসাহিত হবে না। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সরে এসে নিজেরাই যদি কালো লেনদেনে জড়িয়ে পড়ি, তাহলে স্বনির্ভর দেশ গড়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। স্থানীয় মেধা ও অর্থের জন্য তা হবে অপমানজনক। একটা চ্যালেঞ্জ যথাযথভাবে পূরণ করে আমরা কি অন্তত একবার জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় জবাব দিতে পারি না? ব্যক্তিস্বার্থ কি সেখানে এতটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
No comments