নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হোক by নাজনীন তৌহিদ

আজ থেকে ৩০ বছর আগে এক অজপাড়াগাঁয়ে বসে আমার মা যখন শেষবারের মতো 'মা' হন, তখন আমি ৮-৯ বছরের শিশু। সে বয়সের অনেক কথাই আমার মনে নেই। তবে তখনকার কোনো এক রাতের মাঝভাগে আমার মায়ের চিৎকার, কষ্টের আহাজারি আমার শিশুমনে আজীবনের জন্য গেঁথে গেল।


সে গভীর ঘুটঘুটে রাতে ছোটাছুটি করে ধাত্রী দাইমাকে খুঁজে আনলাম। একটি ফুটফুটে মেয়ে শিশুর জন্ম দিলেন আমার মা। আর এ নিয়ে আমার মায়ের পাঁচটি সন্তান পূর্ণ হলো। দাই চলে গেলেন। নবজাতককে নিয়ে আমার দাদিও ঘুমিয়ে পড়লেন। জেগে রইলাম আমি একা, আমার মৃতপ্রায় মাকে নিয়ে। অতটুকুন বয়সে আমার মায়ের কী কষ্ট আমি বুঝিনি। আমি পাগলের মতো ছুটছিলাম আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে। কখনও হারিকেনের তাপে কাপড় সেঁকে তা দিই, কখনও লবণের পুঁটলি বেঁধে চুলার তাওয়ায় গরম করে সেঁক দিই। কতটা সময়_ রাত পার হয়েছিল মনে নেই। শিশুমনের আকুতি বুঝি বিধাতা ফেরাতে পারলেন না। আমার মাকে তিনি আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন অবশেষে।
এরপর বড় হওয়ার পর থেকে স্বপ্ন ছিল একজন ডাক্তার হবো। প্রসূতি বিশেষজ্ঞ হয়ে আমার মায়ের মতো হাজার মায়ের কষ্ট দূর করব। কিন্তু সব আশা কি পূরণ হওয়ার? আমি ডাক্তার হতে পারিনি, তবে আমি কিছু একটা হয়েছি, যা সব নারীর মধ্যে লুকিয়ে থাকে। আমি একজন 'মা' হয়েছি। আর মা হয়েছি বলেই আমি অন্য মায়ের কষ্ট বুঝি।
আজ ২৮ মে, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় 'হাসপাতালে প্রসব করান, মা ও শিশুকে বাঁচান'। গণসচেতনতা গড়তে আমারও আকাঙ্ক্ষা, তবে হাসপাতালে কতজন মা নিরাপদে 'মা' হচ্ছেন_ সে ব্যাপারে আমরা কতটা সচেতন?
আমার মা গাঁয়ে বসে 'মা' হয়েছেন, তাই চিকিৎসাসেবা পাননি। আধুনিক সুযোগ-সুবিধারও তখন অভাব ছিল। কিন্তু আমি যখন এ রাজধানী শহরে বসে মা হলাম, হাতের নাগালে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেলাম, তখনইবা কতটা নিরাপদভাবে 'মা' হতে পারলাম! এই শহরের একটি উন্নতমানের সরকারি হাসপাতালে প্রথম মা হই। শিশু জন্মগ্রহণের দিনক্ষণ সব পূর্ণ হওয়ার পরও শিশুটি জন্ম নিচ্ছিল না। সঠিক সময়ের ১০ দিন পার হলে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ভর্তির আনুষঙ্গিক কাজ পূরণ করতে করতে অফিস ছুটির সময় হয়ে গেল। এত এত রোগী দেখে ডাক্তারের মেজাজ তখন বিগড়ে ছিল। সবার সঙ্গে তিনি যে বিশ্রী ব্যবহার করছিলেন, তাতেই আমি ভয়ে মুষড়ে পড়লাম। পরক্ষণেই আমার চেকআপের পালা। তিনি কাগজপত্রে কোনো রকম চোখ বুলিয়েই ফিঙ্গার ওপেন চেকিং শুরু করলেন। আমি ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারিনি, প্রথমবার যারা মা হন তাদের বোঝারও কথা নয়। লজ্জা-ভয় সব মিলিয়ে তার কাজে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে পারিনি বলে দ্বিতীয়বার চেষ্টা না করে কাগজে আমার সম্পর্কে অসন্তোষজনক রিপোর্ট দিলেন। অথচ তিনি তো জানলেনই না আমি নরমাল ডেলিভারি দিতে সক্ষম কি-না। এরপর ডাক্তার চলে গেলেন, নার্সরা আমাকে নরমাল ডেলিভারির জন্য কৃত্রিমভাবে লেবার পেইন তুললেন। সারারাত প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম।
শিশু যদি ডাক্তারের অবহেলায়, হাসপাতালের অবহেলায় জন্মগ্রহণ করে তবে তার দায়দায়িত্ব কার? সারাজীবন সে শিশুটির পরিবার মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব দিক থেকে ক্ষতির মাশুল দিতে থাকে। একটি শিশু কি দেশের সম্পদ নয়? দেশ কি একটি শিশুর মধ্যে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন বোনে না? তবে কেন এত অবহেলা? এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাসেবার পথ সুগম হয়েছে। আধুনিক হয়েছে। দক্ষ চিকিৎসক বেড়েছে। তবুও খুঁজে দেখুন, সেবার মান কতটা উন্নত হয়েছে? চিকিৎসা পেশা শুধু অর্থ রোজগার করার জন্য নয়। এ পেশা মানবসেবার পেশা। তাই এ পেশায় যারা আসতে আগ্রহী তাদেরই আসা উচিত। এ জন্য তাদের অবশ্যই দক্ষ ও সহিষ্ণু হতে হবে অন্য সবার চেয়ে বেশি।
গ্রামগঞ্জে চিকিৎসার যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। গ্রামে কিংবা শহরে অনেক অসচ্ছল পরিবার ডাক্তারের ফি দিতে অপারগ বলে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করায় না। অনেক মা চিকিৎসা ব্যয়, হাসপাতালের ব্যয় কিংবা অনর্থক অপারেশনের জন্য বাড়তি টাকা গুনতে হবে বলে হাসপাতালে আসেন না এসব কি আমাদের কাম্য? আমরা মায়েরা নিরাপদ মাতৃত্ব চাই। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানার হাসপাতাল কিংবা সেবাদান কেন্দ্র_ সবখানে একজন মা যেন মূল্যায়ন পান, সঠিক সেবা পান_ এই হোক আমাদের স্লোগান। আর সে সঙ্গে দূর করতে হবে বাল্যবিবাহ। অল্প বয়সে মা হওয়া রোধ, নারী শিক্ষা, পরিবারের সহযোগিতা, সহমর্মিতা, মেয়েশিশুর প্রতি অধিক যত্নবান হওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রও যথেষ্ট গুরুত্বের দাবিদার বলে সবার আরও সচেতন হয়ে ওঠা প্রয়োজন। সর্বোপরি একজন মাকে পরিবার থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে গর্ভকালীন ও প্রসবোত্তর সেবাদানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সচেষ্ট হলেই আজকের দিনটির সঠিক মূল্যায়ন হবে। একজন মা হিসেবে নিরাপদ মাতৃত্ব চাওয়া আমাদের অধিকার বলে দাবি রাখি।
nazneentowhid@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.