নারী উন্নয়ন নীতি-কথায় বড়, কাজের কি? by ম. ইনামুল হক

বাংলাদেশের জন্য একটি যুগোপযোগী নারীনীতি প্রণয়ন করতে হলে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে, যা বর্তমানে প্রচলিত কোনো ধর্ম বা সমাজ বা রাষ্ট্র তা করছে না। রাষ্ট্র যখন সে ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছে তখন এ লক্ষ্যেই সবটুক নীতি প্রণীত হওয়া দরকার


বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ আমলে প্রথম জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করে। কোনো কোনো বিশেষ মহলের আপত্তির মুখে ২০০৪ সালে বিএনপি আমলে তা সংশোধন করা হয়েছিল। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার তা সংশোধন করে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরছে।
বাংলাদেশে নারীনীতি নিয়ে দুই শ্রেণীর লোকজনের অতি উৎসাহ দেখা যায়; যারা নারী-পুরুষের সমানাধিকার বিষয়ে জোরেশোরে কথা বলেন এবং পিতা ও মাতার সম্পত্তির ওপর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকার চান; অন্যরা যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে বলেন, নারীরা পুরুষের অর্ধেক মর্যাদাসম্পন্ন তাই সমানাধিকারের প্রশ্নই ওঠে না। এদের উভয়েরই কথায় কিছুটা অসম্পূর্ণতা থাকে, কিন্তু তাদের জঙ্গি মনোভাব পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে দেয়, নারীর যথাযথ মর্যাদা প্রদান বা উন্নয়ন বিষয়টি পিছিয়েই পড়ে।
আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে যদিও মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবুও এই দেশ শুধু মুসলমানের দেশ নয়, এখানে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করে। তাই সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও বিবাহের বেলায় জাতীয় নারীনীতি সবার জন্য প্রযোজ্য হবে কিনা এবং সবার ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির ওপর আঘাত করবে কিনা তা বিবেচনায় আনতে হবে। জাতীয় নারীনীতি ২০১১ সেভাবে মোটেই প্রণীত হয়নি তাই এই নীতি বাংলাদেশের জাতীয় নারীনীতি বলে গণ্য করা যায় না।
বাংলাদেশের পরিবারগুলোর পরিচালনা ঐতিহ্যগতভাবে মাতৃতান্ত্রিক হলেও সম্পত্তি ও বিবাহের বেলায় মুসলমান, হিন্দু বাঙালি ও ত্রিপুরা জাতি পুরুষতান্ত্রিক; খ্রিস্টানদের সাঁওতাল, ওঁরাও ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী পুরুষতান্ত্রিক; বৌদ্ধ চাকমা, মারমা পুরুষতান্ত্রিক; কিন্তু খ্রিস্টান গারো এবং খাসিয়ারা মাতৃতান্ত্রিক। মুসলমান সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বেলায় নারীরা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক পেলেও (নানারকম সামাজিক বাধার কারণে সবসময় পায় না) গারো ও খাসিয়া বাদে অন্য কোনো সমাজে নারীরা কিছুই পায় না।
বাংলাদেশের জন্য একটি যুগোপযোগী নারীনীতি প্রণয়ন করতে হলে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে, যা বর্তমানে প্রচলিত কোনো ধর্ম বা সমাজ বা রাষ্ট্র তা করছে না। রাষ্ট্র যখন সে ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছে তখন এ লক্ষ্যেই সবটুক নীতি প্রণীত হওয়া দরকার। এই নিরাপত্তার বেলায়, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান ও আইনের নিরাপত্তা অন্তর্ভুক্ত; যা সংবিধানে সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রযোজ্য বলে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে অবশ্যই নিশ্চিত করা দরকার।
বাংলাদেশের নারীনীতি নিয়ে ইসলামী ধর্ম ব্যবসায়ীরা মূলত যে বিষয়টির ওপর শঙ্কা পোষণ করে তা হলো নারী ও পুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকার। ইসলামী আইনে পিতার বর্তমানে পুত্রের মৃত্যু হলে ওই পুত্রের ঔরসজাত শিশুসন্তানরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। যদিও পবিত্র কোরআনে এতিম শিশুদের সম্পত্তি ও হক মেরে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রচুর সাবধানবাণী উচ্চারিত আছে, বাংলাদেশের সমাজে ওই হক আদায় করা কঠিন ব্যাপার। ইসলামী আইনে মৃত পিতার সম্পত্তির ওপর সবল সচ্ছল সন্তান আর পঙ্গু হতদরিদ্র পুত্রসন্তানের দাবি সমান করা আছে, যা বিবেকসম্মত হতে পারে না। ক্লীবদের বেলায় কোনো বিধানই নেই। তবে সম্পত্তির যথাযথ বিতরণের জন্য পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৮০ নং আয়াতে একটি সহজ সমাধান দেওয়া আছে, যেখানে বলা হয়েছে, 'যারা মৃত্যু আসন্ন বোধ করবে তাদের জন্য তাদের সম্পত্তি নিকটজনদের মাঝে ওছিয়তনামার মাধ্যমে বিলি করে দেওয়ার বিধান রয়েছে।' বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশের সব সমাজে মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির 'উইল' বা ইচ্ছা প্রযোজ্য করার বিধান আছে।
আমাদের দেশের মানুষরা মৃত্যুর পূর্বে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে দিতে চান না, কারণ তারা তাদের বার্ধক্যের অসহায় সময়ে ছেলেমেয়েদের কাছে যত্ন পাবেন কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দিহান থাকেন। বাস্তব ক্ষেত্রে এ ধরনের নিদারুণ পরিণতি অহরহ দেখা যায়ও বটে। যেখানে বৃদ্ধ পিতামাতা ও সন্তানদের সম্পর্ক অবিশ্বাসের সেখানে তাদের অবর্তমানে তাদের সম্পত্তি নিয়ে সন্তানদের মধ্যে অবিচার ও রেষারেষি হওয়াটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তি যদি তার কন্যাসন্তান বা কোনো দুর্বল সন্তানের প্রতি দায়িত্ববান হন তাহলে তিনি তার মৃত্যুপূর্ববর্তী সময়েই ওছিয়তনামা করে তাকে প্রয়োজনীয় সম্পত্তি দিয়ে যেতে পারেন। তাই বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে এবং অন্যান্য সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়ে ব্যক্তির মৃত্যুপূর্ববর্তী ইচ্ছা পোষণের গুরুত্বকে বড় করে আনতে হবে এবং এ ব্যবস্থাকে উৎসাহ দিয়ে জনপ্রিয় করতে হবে। তবে যদি কেউ ইচ্ছা পোষণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করেন সে ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান কিংবা নারী-পুরুষ সমানাধিকারের বিধান সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার নিশ্চয়তা দেবে না।
বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত সামাজিক নিপীড়নের কারণে নারী ও শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে এবং তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইসলামী আইনে যৌতুক নারীর প্রাপ্য হলেও পুরুষ এটা দখল করেছে যার বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজরা সোচ্চার নয়। বাংলাদেশের ফতোয়াবাজদের কাছে যৌতুক একটি আকর্ষণীয় বিষয় বলেই মনে হয়। তাই কাবিননামার ধারাগুলোতে যৌতুক মাফ বা অনাদায়ী থাকা, তালাকের অধিকার নারী-পুরুষ উভয়েরই থাকা ইত্যাদি বিষয়ে কিছু কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে এবং প্রয়োজন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য একইভাবে প্রযোজ্য একটি পারিবারিক আইন। তবে রাষ্ট্র যতদিন ব্যক্তির মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের দায়িত্ব না নেবে, যতদিন কল্যাণকর রাষ্ট্র না হবে, ততদিন সমাজে বৈষম্য থাকবে, প্রতারণা চলবে এবং ধর্মের নামে বা প্রচলিত আইনের নামে দুর্বলের ওপর সমাজের দুর্বৃত্ত ও সম্পদশালীরাই শেষমেশ জয়ী হবে।

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : সাবেক মহাপরিচালক পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.