মহাসংকটে বুয়েট-ডিন-চেয়ারম্যানসহ ২৪ জন শিক্ষকের একযোগে পদত্যাগ, অনড় উপাচার্য
মহাসংকটে পড়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। গতকাল বুধবার বিকেলে একযোগে পদত্যাগ করেছেন বুয়েটের তিনটি ইনস্টিটিউটের পরিচালক, বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগের চেয়ারম্যানরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৪ জন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সমর্থনে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। গতকালই তাঁরা পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন।
আরেকজন বিভাগীয় চেয়ারম্যান ক্যাম্পাসে না থাকলেও পদত্যাগের ব্যাপারে তাঁর সম্মতির কথা জানিয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার রাতে শিক্ষকদের আন্দোলনের মধ্যেই হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজা ও ঈদ উপলক্ষে ৪৪ দিনের ছুটি ঘোষণা করেন উপাচার্য ড. এস এম নজরুল ইসলাম।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের জরুরি সভা শেষে গতকাল রাত ১১টায় পদত্যাগ করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বুয়েট উপাচার্য ড. এস এম নজরুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পদত্যাগের বিষয়টি সিন্ডিকেটের হাতে নয়।' তবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে উপাচার্য বলেছেন, রাষ্ট্রপতি চাইলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণার পর একযোগে পদত্যাগের ঘটনাটি ঘটল। তবে হঠাৎ করে এই ছুটি ঘোষণার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, আন্দোলনের জের ধরে বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটতে পারে- এ আশঙ্কায় আগেভাগেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর এই বন্ধ ঘোষণার পর লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। একই সঙ্গে বুয়েট কর্তৃপক্ষের ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণাকে অনৈতিক ও অবৈধ বলেও দাবি করেছেন তাঁরা। গতকাল বুয়েটের কাউন্সিল ভবনের সামনে সমাবেশ করে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনে বুয়েটের শিক্ষক সমিতি গত ৭ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের দাবি বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস দিলে শিক্ষক সমিতি তাদের আন্দোলন এক মাসের জন্য স্থগিত করে। দাবি পূরণ না হওয়ায় গত ৭ জুলাই থেকে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করছিলেন শিক্ষকরা।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- কারো সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই বুয়েট কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। এতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেত বলেও তিনি মনে করেন। মন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতিতে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করা হবে।
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সব দাবিই পূরণ করা হয়েছে। এর পরও তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানান। মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, শিক্ষকদের এসব বিষয় নিয়ে সরকারের কোনো বিভাগই হস্তক্ষেপ করতে চায় না।
বুয়েটের উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, 'হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলবাদী কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জোর করে আন্দোলন করতে বাধ্য করেন। এমনিতেই আমাদের রমজানে ছুটি থাকে। উত্তেজনা বিরাজ করায় ছুটি এগিয়ে আনা হয়েছে।' সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি তো সরে যেতে চাই। কিন্তু মিথ্যা কোনো অভিযোগের দায়ভার নিয়ে আমি পদত্যাগ করব না।'
যাঁরা পদত্যাগ করেছেন : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আতাউর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে একযোগে পদত্যাগ করেছেন বুয়েটের বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগের চেয়ারম্যানরা। রেজিস্ট্রার ড. আবু সিদ্দিকের কাছে ২৪ জন পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৫ জন শীর্ষ কর্মকর্তাই আন্দোলনের অংশ হিসেবে পদত্যাগ করতে সম্মত হয়েছেন। ২৪ জন এরই মধ্যে পদত্যাগপত্রে সই করেছেন বলে জানান শিক্ষক সমিতির সভাপতি। এই ২৪ জনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৭টি বিভাগের ১৬টির চেয়ারম্যান, তিনটি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও পাঁচটি অনুষদের ডিন রয়েছেন। শিক্ষক সমিতির এক নেতা জানান, রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শাকিলা রহমান ক্যাম্পাসে না থাকায় সই করতে পারেননি।
পদত্যাগকারীরা হলেন- ডিন ড. মো. জাকারিয়া, ড. রেফায়েতউল্লাহ, ড. সত্যপ্রসাদ মজুমদার, ড. খালেদা রশিদ ও ড. মমিনুল হক। চেয়ারম্যানরা হলেন- ড. উম্মে কুলসুম, ড. মুজিবুর রহমান, ড. এহেসান, ড. রফিকুল ইসলাম, ড. আবদুল আজিম, ড. লতিফুল হক, ড. প্রাণ কানাই সাহা, ড. জেবুন নাসরিন, ড. শাকিল আক্তার, ড. মুরসিকুল আলম, ড. মোহর আলী, ড. ম. তামিম, ড. মোস্তাক হোসেন, ড. ইজাজ হোসেন, ড. ইলিয়াস ও ড. ফখরুল ইসলাম। তিনটি ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা হলেন- ড. মনসুর রহমান, ড. কামাল উদ্দিন ও ড. লুৎফুল কবীর। পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান ড. ম তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে গতকাল রেজিস্ট্রার বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি।'
শিক্ষার্থীদের একাত্মতা প্রকাশ : অবস্থান ধর্মঘটে অংশ নেওয়া যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মেহরাব আকতার সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা অত কিছু বুঝি না। আমরা চাই, একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা চালু থাকুক, যাতে আমাদের সেশনজটে পড়তে না হয়।'
শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতি, কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের নেতৃত্বে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে একটি মৌন মিছিল বের করেন শিক্ষকরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী করতালির মাধ্যমে তাঁদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভসংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড। মিছিলের আগে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত একটি লিফলেট বিতরণ করা হয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। মিছিলটি বুয়েটের প্রশাসনিক ভবন হয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে কাউন্সিল ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানে তাঁরা সমাবেশ করেন।
সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, 'সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে বুয়েট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই উপাচার্য একক সিদ্ধান্ত নিয়ে আবারও তাঁর স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ দিয়েছেন।' তিনি আরো বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী আমরা ক্লাসে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। বরং অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে উপাচার্যের মতামতই তুলে ধরা হয়েছে।' তিনি প্রশাসনিক ভবনের সামনে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান ধর্মঘটের আহ্বান জানান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা লাগাতার ধর্মঘট দেওয়ার আহ্বান জানান। পরে তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট ঘোষণা করেন।
ছাত্রলীগের প্রচারপত্র : এদিকে বিভিন্ন হলের কক্ষে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের প্যাডে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে- নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাওহীদ ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির বুয়েট ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা প্রণয়ন করেছে। এ অবস্থায় যদি কোনো ছাত্রের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে সরকারবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে ছাত্রলীগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
অন্যদিকে ছাত্রলীগের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বুয়েট শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ড. আতাউর রহমান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রলীগের প্রচারপত্রের মাধ্যমে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জামায়াত-শিবিরপন্থী ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে, যা কোনোভাবেই সঠিক নয়।
অনড় বুয়েট উপাচার্য : এদিকে, গতকাল বুধবার রাতে এক জরুরি সভায় উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে বুয়েট সিন্ডিকেট। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সিন্ডিকেট সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কোরাম সংকটের কারণে সে সভা শুরু হতে সোয়া ৯টা বেজে যায়। রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে সিন্ডিকেটের জরুরি সভা শেষ হয়।
সভা শেষে উপাচার্য নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সিন্ডিকেট সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো, অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে একটি জুডিশিয়াল তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। দ্বিতীয়টি, শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সর্বশেষটি হলো, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সেটা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।' উপাচার্য বলেন, 'বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ প্রমাণিত হলে পদত্যাগ করব। তার আগে নয়।' তিনি বলেন, শিক্ষকরা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য আবুল কাসেমকে প্রধান করে গঠিত কমিটির তদন্ত মেনে নেননি, তাই বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য আচার্যের কাছে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চলবে।' তবে রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, 'আমার পদত্যাগ করার এখতিয়ার নেই। রাষ্ট্রপতি আমাকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি চাইলে আমি পদত্যাগ করব।'
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের জরুরি সভা শেষে গতকাল রাত ১১টায় পদত্যাগ করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বুয়েট উপাচার্য ড. এস এম নজরুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পদত্যাগের বিষয়টি সিন্ডিকেটের হাতে নয়।' তবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে উপাচার্য বলেছেন, রাষ্ট্রপতি চাইলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণার পর একযোগে পদত্যাগের ঘটনাটি ঘটল। তবে হঠাৎ করে এই ছুটি ঘোষণার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, আন্দোলনের জের ধরে বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটতে পারে- এ আশঙ্কায় আগেভাগেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর এই বন্ধ ঘোষণার পর লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। একই সঙ্গে বুয়েট কর্তৃপক্ষের ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণাকে অনৈতিক ও অবৈধ বলেও দাবি করেছেন তাঁরা। গতকাল বুয়েটের কাউন্সিল ভবনের সামনে সমাবেশ করে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনে বুয়েটের শিক্ষক সমিতি গত ৭ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের দাবি বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস দিলে শিক্ষক সমিতি তাদের আন্দোলন এক মাসের জন্য স্থগিত করে। দাবি পূরণ না হওয়ায় গত ৭ জুলাই থেকে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করছিলেন শিক্ষকরা।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- কারো সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই বুয়েট কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। এতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেত বলেও তিনি মনে করেন। মন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতিতে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করা হবে।
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সব দাবিই পূরণ করা হয়েছে। এর পরও তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানান। মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, শিক্ষকদের এসব বিষয় নিয়ে সরকারের কোনো বিভাগই হস্তক্ষেপ করতে চায় না।
বুয়েটের উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, 'হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলবাদী কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জোর করে আন্দোলন করতে বাধ্য করেন। এমনিতেই আমাদের রমজানে ছুটি থাকে। উত্তেজনা বিরাজ করায় ছুটি এগিয়ে আনা হয়েছে।' সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি তো সরে যেতে চাই। কিন্তু মিথ্যা কোনো অভিযোগের দায়ভার নিয়ে আমি পদত্যাগ করব না।'
যাঁরা পদত্যাগ করেছেন : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আতাউর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে একযোগে পদত্যাগ করেছেন বুয়েটের বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগের চেয়ারম্যানরা। রেজিস্ট্রার ড. আবু সিদ্দিকের কাছে ২৪ জন পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৫ জন শীর্ষ কর্মকর্তাই আন্দোলনের অংশ হিসেবে পদত্যাগ করতে সম্মত হয়েছেন। ২৪ জন এরই মধ্যে পদত্যাগপত্রে সই করেছেন বলে জানান শিক্ষক সমিতির সভাপতি। এই ২৪ জনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৭টি বিভাগের ১৬টির চেয়ারম্যান, তিনটি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও পাঁচটি অনুষদের ডিন রয়েছেন। শিক্ষক সমিতির এক নেতা জানান, রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শাকিলা রহমান ক্যাম্পাসে না থাকায় সই করতে পারেননি।
পদত্যাগকারীরা হলেন- ডিন ড. মো. জাকারিয়া, ড. রেফায়েতউল্লাহ, ড. সত্যপ্রসাদ মজুমদার, ড. খালেদা রশিদ ও ড. মমিনুল হক। চেয়ারম্যানরা হলেন- ড. উম্মে কুলসুম, ড. মুজিবুর রহমান, ড. এহেসান, ড. রফিকুল ইসলাম, ড. আবদুল আজিম, ড. লতিফুল হক, ড. প্রাণ কানাই সাহা, ড. জেবুন নাসরিন, ড. শাকিল আক্তার, ড. মুরসিকুল আলম, ড. মোহর আলী, ড. ম. তামিম, ড. মোস্তাক হোসেন, ড. ইজাজ হোসেন, ড. ইলিয়াস ও ড. ফখরুল ইসলাম। তিনটি ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা হলেন- ড. মনসুর রহমান, ড. কামাল উদ্দিন ও ড. লুৎফুল কবীর। পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান ড. ম তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে গতকাল রেজিস্ট্রার বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি।'
শিক্ষার্থীদের একাত্মতা প্রকাশ : অবস্থান ধর্মঘটে অংশ নেওয়া যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মেহরাব আকতার সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা অত কিছু বুঝি না। আমরা চাই, একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা চালু থাকুক, যাতে আমাদের সেশনজটে পড়তে না হয়।'
শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতি, কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের নেতৃত্বে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে একটি মৌন মিছিল বের করেন শিক্ষকরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী করতালির মাধ্যমে তাঁদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভসংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড। মিছিলের আগে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত একটি লিফলেট বিতরণ করা হয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। মিছিলটি বুয়েটের প্রশাসনিক ভবন হয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে কাউন্সিল ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানে তাঁরা সমাবেশ করেন।
সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, 'সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে বুয়েট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই উপাচার্য একক সিদ্ধান্ত নিয়ে আবারও তাঁর স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ দিয়েছেন।' তিনি আরো বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী আমরা ক্লাসে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। বরং অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে উপাচার্যের মতামতই তুলে ধরা হয়েছে।' তিনি প্রশাসনিক ভবনের সামনে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান ধর্মঘটের আহ্বান জানান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা লাগাতার ধর্মঘট দেওয়ার আহ্বান জানান। পরে তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট ঘোষণা করেন।
ছাত্রলীগের প্রচারপত্র : এদিকে বিভিন্ন হলের কক্ষে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের প্যাডে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে- নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাওহীদ ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির বুয়েট ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা প্রণয়ন করেছে। এ অবস্থায় যদি কোনো ছাত্রের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে সরকারবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে ছাত্রলীগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
অন্যদিকে ছাত্রলীগের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বুয়েট শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ড. আতাউর রহমান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রলীগের প্রচারপত্রের মাধ্যমে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জামায়াত-শিবিরপন্থী ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে, যা কোনোভাবেই সঠিক নয়।
অনড় বুয়েট উপাচার্য : এদিকে, গতকাল বুধবার রাতে এক জরুরি সভায় উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে বুয়েট সিন্ডিকেট। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সিন্ডিকেট সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কোরাম সংকটের কারণে সে সভা শুরু হতে সোয়া ৯টা বেজে যায়। রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে সিন্ডিকেটের জরুরি সভা শেষ হয়।
সভা শেষে উপাচার্য নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সিন্ডিকেট সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো, অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে একটি জুডিশিয়াল তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। দ্বিতীয়টি, শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সর্বশেষটি হলো, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সেটা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।' উপাচার্য বলেন, 'বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ প্রমাণিত হলে পদত্যাগ করব। তার আগে নয়।' তিনি বলেন, শিক্ষকরা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য আবুল কাসেমকে প্রধান করে গঠিত কমিটির তদন্ত মেনে নেননি, তাই বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য আচার্যের কাছে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চলবে।' তবে রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, 'আমার পদত্যাগ করার এখতিয়ার নেই। রাষ্ট্রপতি আমাকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি চাইলে আমি পদত্যাগ করব।'
No comments