রইছউদ্দিনের তিন তারের সংসার by মামুনুর রশিদ

পাবনার রইছউদ্দিন। রইছ উদ্দিনের হাত পা মাথা চোখ সবই আছে, কিন্তু সেগুলোর সব ঠিকঠাক মতো কাজ করে না। চোখ দুটি দিয়ে ভালো একটা দেখতে পারেন না, দুই বাহুতে কাজ করার মতো শক্তি নেই, পা দুটিও তেমন সবল না। কেবল সবল তার কণ্ঠনালি আর দুই হাতের প্রান্তভাগে অবস্থিত আঙুলগুলো, আর এগুলো থেকে বের হওয়া শব্দমালা


তৈরি করে সুমধুর সঙ্গীতের, যাতেই তার একমাত্র ভরসা। এই সঙ্গীতকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য কাঠের দোতারার উপরে তিন তার বেঁধে নিয়ে তাতে তোলা হয় সুমধুর সুর। তবে এই দোতারা ঠিক অন্যান্য দোতারা থেকে একটু আলাদা। এর তারগুলো গ্রামদেশে আঙিনায় সবজি বাগানে বেড়া দেওয়ার জন্য যে সুতার জাল বোনে, সেই সুতা দিয়ে তৈরি। তারের পরিবর্তে এই সুতা বেঁধে নিজের পছন্দমতো কাল্পনিক ঘাট তৈরি করে নিয়েছে দোতারার উপরে। তার কেনার মতো অর্থ তো নেই, কিংবা খুব সহজে ছিঁড়ে যাওয়ার ভাবনা নেই, সেজন্য এই সহজ ব্যবস্থা। কাঠের টুকরো ঘষে ঘষে চোখা করে বাজানোর জন্য একটা পিক তৈরি করে নিয়েছে। সঙ্গে নিজের ভরাট গলা মিলিয়ে এক সুমধুর সঙ্গীতের মাধ্যমে পথচারীদের আনন্দ দেন রইছউদ্দিন। রাস্তা কিংবা ফুটপাত নয়, রইছউদ্দিনের উপার্জন মেলে নদীবক্ষ থেকে।
পদ্মাপ্রমত্তা তরঙ্গিনীকে শুষ্ক মরুতে যেথায় শুধু ধু-ধু বালুরাশি জমায়েত করে রেখেছে, পাকশীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আর লালন শাহ্ সেতুর নিচে শুকিয়ে বালুচর পড়ে গেছে। সেই বালুচরে বিনোদনের জন্য ঘুরে বেড়ায় তরুণ-তরুণীসহ নানান বয়সের লোকজন। তাদের লক্ষ্য রেখেই তিন তারে সুর তোলেন রইছউদ্দিন, সঙ্গে দরদ মেশানো কণ্ঠ দিয়ে বের হয় ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, লালন, হাছনসহ আবহমান গ্রামবাংলার সুপরিচিত এবং সুমধুর সেই গানগুলো। বিমুগ্ধ শ্রোতারা ভালোবেসে পল্গাস্টিকের ব্যাগের ওপর যা দিয়ে যায়, তাতেই রইছউদ্দিন বেঁচে থাকেন তার পুরো পরিবার নিয়ে। যেখানে পদ্মাপ্রমত্তা উত্তাল তরঙ্গিনী একরাশ বালুকা বয়ে সঞ্চিত করে গেছে, সেই বালুকাময় পদ্মার বুকের ওপর ভর করেই অর্থ উপার্জন করেন রইছউদ্দিন। এই পদ্মার বুক ছাড়াও রইছউদ্দিন জীবিকার জন্য বেছে নেন ঈশ্বরদী বাজার কিংবা আশপাশের কোনো হাটবাজারের বটতলা_ সেখানকার মানুষজনকে সঙ্গীতের সুরে বিমুগ্ধ করে কিছু উপার্জন আসে। দোতারা ছাড়াও রইছউদ্দিন হারমোনিয়াম বাজাতে পারেন, কিন্তু নিজের উপার্জনে তো আর হারমোনিয়াম কেনার স্বপ্ন দেখতে পারেন না। গ্রাম-গঞ্জের শ্রোতারা যতই গান ভালোবেসে দু'চার টাকা ভিক্ষা দিক, হারমোনিয়াম কিনে দেওয়ার সাধ্যও হয়তোবা কারও নেই, কিংবা সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। রইছউদ্দিনের গ্রামের নাম লক্ষ্মীকুণ্ডা, পাবনার ঈশ্বরদী থানার অন্তর্গত এই গ্রামেই রইছউদ্দিনের সঙ্গীত জীবনের হাতেখড়ি। রইছউদ্দিন দুই সন্তানের জনক, স্ত্রী সংসার দেখাশোনা করা ছাড়া আর কিছু করেন না। ছেলে দুটি ছোট। আর কিছুদিন পরে লেখাপড়ার খরচের পাশাপাশি কাপড়-চোপড়, তেল, সাবান, সোডা ইত্যাদির খরচও বাড়বে, তাদের জন্য উপার্জন বাড়াতে হবে। উপার্জন না বাড়লে এগুলো কুলাবেন কীভাবে রইছউদ্দিন? কিন্তু কী করে উপার্জন বাড়াবেন অপূর্ণাঙ্গ শরীর নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকা রইছউদ্দিন? এই ভাবনায় মাঝে মধ্যে রাতে তার ঘুম আসে না স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন দুটি চোখে। কখনও কখনও তার ভাবনায় চলে আসে অতীতের স্মৃতি কিংবা ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্নমাখা জীবন। ভাবেন একদিন হয়তো তার সন্তানরা লেখাপড়া শিখে বড় হবে, সংসারের অভাব মেটাবে। লোকে তখন তাদের দেখে বলবে, দেখ দেখ দোতারাবাদক রইছউদ্দিনের কষ্টের সংসারে সোনার টুকরো জন্ম নিয়েছে। কিন্তু সেই সুদিন কি আসবে রইছউদ্দিনের? সত্যিই কি সেই সোনালি স্বপ্নের দেখা মিলবে?
mamunurrashidju@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.