চরাচর-আর্সেনিকের বিষক্রিয়া by আজিজুর রহমান

পানিবাহিত বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে ভূগর্ভের নিরাপদ পানি উত্তোলন ও সরবরাহের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক দাতা ও সাহায্য সংস্থাগুলো আমাদের দেশে নলকূপ স্থাপনে অর্থ ও উপকরণ জোগান দিয়ে আসছে।


দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এ দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ নলকূপের পানি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আকস্মিক আক্রমণকারী এবং মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া পানিবাহিত বিভিন্ন ঘাতক ব্যাধি থেকে নলকূপ আমাদের রক্ষা করলেও এখন সেই নলকূপের 'নিরাপদ' পানির সঙ্গে ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসছে আপাত অদৃশ্য আরেক নীরব ঘাতক আর্সেনিক নামের ভয়ংকর রাসায়নিক বিষ, যে দুঃসংবাদটি জানতে আমাদের চারটি দশক লেগে গেছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আর্সেনিক একটি ভয়ংকর বিষ। পারদের তুলনায় এ বিষ চারগুণ বেশি শক্তিশালী। এ বিষের মারণমাত্রা হচ্ছে ১২৫ মিলিগ্রাম। এ পরিমাণ আর্সেনিক গ্রহণ করার পর ১২ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মানুষের মৃত্যু হতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে, অদ্রবীভূত আর্সেনিকের চেয়ে দ্রবীভূত আর্সেনিক মানবদেহের জন্য বেশি বিপজ্জনক। প্রায় সব পানিতেই কিছু না কিছু আর্সেনিক থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাবার পানিতে মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রতি লিটার পানিতে ০.০৫ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) বা ০.০৫ মিলিগ্রাম। অথচ বাংলাদেশে খাবার পানি হিসেবে যা ব্যবহৃত হয়, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ পানিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি আর্সেনিক রয়েছে। পানি, বাতাস, মাটিসহ প্রকৃতির প্রতিটি মাধ্যমেই কমবেশি আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে। বেশির ভাগ ফলমূল, শাকসবজি, মাছ ও মাংসে সামান্য পরিমাণে আর্সেনিক থাকে। তবে সমুদ্রের পানি ও সামুদ্রিক মাছে বেশ উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক থাকে। আর্সেনিক গ্রহণের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ক্রনিক বিষক্রিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। আর্সেনিকদূষিত পানি দীর্ঘদিন ধরে পান করলে বিষক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মানবদেহ ভয়ংকর আর্সেনিকোসিসগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মানবসমাজের জন্য বেদনাদায়ক ও দুঃসংবাদ হচ্ছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে আজ পর্যন্ত এমন কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি, যা দিয়ে আর্সেনিক বিষাক্রান্ত থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় লাভ করা যেতে পারে। তবে বিষাক্রান্তের প্রাথমিক পর্যায়ে যদি রোগী দূষিত পানি পান বন্ধ করে নিরাপদ পানি পান শুরু করে, তাহলেই পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা আশা করা যায়।
আজিজুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.