সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ : কিছু প্রস্তাব by মো. রেযাউল করিম

চট্টগ্রামের মিরসরাই ট্র্যাজেডির এক বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল (১১ জুলাই)। সেখানকার কান্নার রোল এখনো থামেনি। গত বছরের এই দিনে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুলগামী ৪৩ শিক্ষার্থী অকালে ঝরে গেছে। এমনি আরো অনেক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত করে। এটা কি আমাদের নিয়তি?


প্রতিবছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ থেকে ১৫ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটলেও তা প্রতিকারে কার্যত কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপকতা ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তি এবং তার পরিবারের আর্থিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষয়ক্ষতির বাস্তব চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরারও কোনো ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ এবং সড়কপথে জনগণের জানমাল রক্ষা ও নিরাপদে চলাচল নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার আশু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সাম্প্রতিককালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহীর সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর পর দেশের সব প্রচারমাধ্যম, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ ও সংগঠন সড়ক দুর্ঘটনারোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ ও জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে মোটরযান আইনটি দ্রুত যুগোপযোগী করার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। ২০১০ সালের ১০-২২ অক্টোবর বেলজিয়ামের হাসেল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিএলআইআর স্কলারশিপে সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক একটি উচ্চতর প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়। ওই প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ-পরবর্তী ইউরোপের কয়েকটি দেশে সড়ক নিরাপত্তার চিত্র প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতা সমন্বয় করে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে সংশ্লিষ্ট সবার সুবিবেচনার জন্য এখানে কিছু প্রস্তাব পেশ করা হলো।
আইন অমান্যকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখে মোটরযান আইনটির (১৯৮৩) ওপর চলমান হালনাগাদের কাজ একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করে এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সচেতনতা কার্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির নিজের এবং পরিবারের অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কী ধরনের বিপর্যয় ঘটে, তা প্রচারের ওপর একটি জোর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। টেলিভিশন নাটক-নাটিকা, বিজ্ঞাপন, টক শো ইত্যাদির মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা বার্তা জনগণের কাছে পেঁৗছানো যায়। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারীদের (যেমন শিশু, যুবক বয়সী চালক, মোটর সাইকেলচালক, নেশাগ্রস্ত অবস্থার গাড়িচালক প্রমুখের) উপযোগী সড়ক নিরাপত্তা সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে পাঠ্য পুস্তকে বয়সোপযোগী পাঠ্যক্রম; যেমন প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কারিকুলামে বয়সভিত্তিক সড়ক নিরাপত্তা পাঠ্যসূচি আকারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সড়ক নিরাপত্তা শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে পার্লামেন্টে আইন পাস করেছে। এসব বিষয়ে ওয়েবসাইটে গবেষণালব্ধ দেশি-বিদেশি প্রচুর প্রতিবেদন ও নির্দেশিকা সহজলভ্য। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কেই এ ব্যাপারে সক্রিয় হতে হবে। পেশাদার ও অপেশাদার চালকদের জন্য নিরাপদে গাড়ি চালনার ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গাড়িচালকদের দক্ষতা-যাচাই পরীক্ষার মাধ্যমে ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স (দেশের যেকোনো স্থানে স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে পরখযোগ্য) প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস প্রদানের লক্ষ্যে যোগ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
ছোট সড়ক থেকে বড় সড়ক ও মহাসড়কের যেখান-সেখান দিয়ে অবাধে প্রবেশপথ ও টি-জাংকশন সুবিধা বন্ধ করলে দুর্ঘটনা ও যানজট হ্রাস পাবে। সড়ক ও মহাসড়ক এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে চালকসহ সব সড়ক ব্যবহারকারী তার দৃষ্টিসীমার মধ্যকার সড়ক সুবিধা, ঝুঁকি ও করণীয় সম্পর্কে সহজেই ধারণা পেতে পারে (সেল্‌ফ এক্সপ্লেইনিং সড়ক) এবং বিপজ্জনক মুহূর্তে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ ছাড়া দেশের সব সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থান, ঝুঁকির কারণ এবং তা নিরাময়ের উপায়ের ওপর নিরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মোটরযানের গতি নিয়ন্ত্রণে ও মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে প্রকৌশলগত বিভিন্ন সুবিধা; যেমন গাড়ির ধরন এবং গতিভেদে পৃথক সড়ক ও লেন সম্ভব হলে গার্ডরেল ও রোড ডিভাইডারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
উন্নত দেশের মতো সব মোটরযানকে একটি অভিন্ন নেটওয়ার্কে (জিপিএস) আনাসহ আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ট্রাফিক সিগন্যাল এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কম জনবল ও অর্থ ব্যয় করে মোটরযান নিয়ন্ত্রণ এবং সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসসহ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যাবে। এ কাজে বেসরকারি মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ককে কাজে লাগানো যেতে পারে।
নগর ও মহানগরীর সব পথচারীবান্ধব ফুটপাতের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ফুটপাতে নির্মীয়মাণ দালানকোঠার ইট, বালি, সিমেন্ট- এসব নির্মাণসামগ্রী স্তূপাকারে রেখে কিংবা ফুটপাত ভাঙাচুরা থাকলে তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফুটপাতকে মুক্ত রাখতে হবে। ফুটপাত থেকে ভাসমান হকারদের পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরের পদক্ষেপ নিতে হবে। পথচারী পারাপার সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সেগুলোর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও তা অমান্যকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে আর্থিক জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। অবৈধ পার্কিং এবং সড়ক ও ফুটপাতে অবৈধ দখল এবং মালামাল রাখা বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায়, তার প্রায় ৫০-৫৫ শতাংশ পথচারী। সঠিক নিয়ম মেনে হাঁটলে (যেমন ফুটপাতবিহীন সড়কের ডান পাশ দিয়ে) ও নিরাপদে পারাপার (সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে, প্রথমে ডান দিক দেখে পরে বাঁ দিক দেখে এরপর গাড়ির শব্দ শুনে এবং সর্বশেষবার দুই দিক দেখতে দেখতে রাস্তা সোজাসুজি পার হওয়া) হলে এসব দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ প্রয়োজন না পড়লে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে গাড়িতে না ওঠা, গাড়ির বাম্পারের ওপর না বসা, ছাদে না চড়া, চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা না বলা, চলন্ত গাড়িতে ওঠানামা না করা ইত্যাদি সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। উন্নত দেশের মতো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার পর দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জনবল নিশ্চিত করতে হবে। সড়কবিধি অনুসরণকারী ও অধিকতর ভালো সেবা প্রদানকারী পরিবহন সংস্থাকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন নগর ও মহানগরীর কোন কোন অংশ কোন কোন মাসে হর্নমুক্ত, তা বছরের শুরুতেই জনসাধারণসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার এবং তা কার্যকর করার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া যায়। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা এমনিতেই হ্রাস পাবে। সড়ক দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তথ্যসহ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিআরটিএ-র রোড সেফটি সেলে প্রয়োজনীয় জনবল, অর্থ ও লজিস্টিক সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সেলের মাধ্যমে কিংবা মালিক, শ্রমিক এবং মোটরযান ব্যবহারকারীদের অভিযোগ ও পরামর্শ গ্রহণ এবং তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
জনবান্ধব সড়ক পরিবহনব্যবস্থার অন্যতম নিয়ামক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআরটিএকে একটি কার্যকর ও গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিআরটিএর রোড সেফটি সেলটি কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে। সড়ক নিরাপত্তায় জনসচেতনতা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিআরটিএকে প্রয়োজনীয় জনবল, অর্থ ও লজিস্টিক সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার (গবেষণা), টিআইবি

No comments

Powered by Blogger.