বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বন্ধ ঘোষণার পর উত্তাল বুয়েট
শিক্ষকদের আন্দোলনে এই প্রথম শিক্ষার্থীরা যোগ দেওয়ায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। গত মঙ্গলবার কর্তৃপক্ষ অনেকটা আকস্মিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করলেও ছাত্র-শিক্ষকেরা ভিন্ন মাত্রার আন্দোলন শুরু করেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে উপাচার্য গতকাল বুধবার রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভা
ডাকেন। এ সময় উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য আচার্যের কাছে আবেদন করার সিদ্ধান্ত হয়।
উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকেরা যেহেতু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন মেনে নেননি, সে ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনে মত দিয়েছে। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চলবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উপাচার্য বা সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়টি সিন্ডিকেটের হাতে নয়। তিনি নিজে পদত্যাগ করবেন না বলেও জানান।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গতকাল শ্রেণীকক্ষের বদলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। প্রশাসনের ওপর অনাস্থা এনে পদত্যাগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ২৪ অধ্যাপক।
বুয়েটের উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাকার্যক্রম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। গতকাল শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ছিল তাঁদের লেখাপড়া বিঘ্ন হওয়ার বিষয়টি। একাধিক শিক্ষার্থী জানালেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করে বিদেশে চলে যান। ওই সব দেশে মার্চ ও সেপ্টেম্বরে সেশন থাকে। যে অবস্থা তৈরি হয়েছে মার্চের সেশন ধরা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানালেন, আগামী ডিসেম্বরে তাঁদের পরীক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু সেই সম্ভাবনা আর নেই।
শিক্ষকদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়াও গতকাল প্রকাশ্যে যোগ দিয়েছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একাংশ। সব মিলিয়ে অনির্ধারিত বন্ধের প্রথম দিন ক্যাম্পাস ছিল উত্তাল। প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রায় দিনভর চলেছে বক্তৃতা, সংগীত ও আলোচনা।
উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের ওপর ক্ষোভ যে কারণে: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপ্রীতিকর অবস্থার মুখে ঢাকায় চলে এসেছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম। বুয়েটে ফিরে ২০১০ সালে তিনি উপাচার্য পদে দায়িত্ব নেন। সরকার সমর্থক হওয়ায় এবং একটি বিশেষ জেলায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে তিনি আন্দোলনের মুখে উপাচার্য পদে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষকদের বড় অভিযোগ হচ্ছে, উপাচার্য পদে তিনি থাকলেও নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ান সহ-উপাচার্য। এ কারণে উপাচার্যের চেয়েও শিক্ষকদের বেশি ক্ষোভ সহ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে। আন্দোলনের প্রথম ভাগে বুয়েট শিক্ষকদের সংকেত ছিল, সহ-উপাচার্যকে অপসারণ করলে তাঁরা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াবেন। কিন্তু গতকাল থেকে শুরু হওয়া ভিন্ন মাত্রার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বললেন, উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য দুজনকে অপসারণ ছাড়া এই আন্দোলন থামবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য পদে ২০০৯ সালে প্রথম নিয়োগ পান এম হাবিবুর রহমান। তিনি বুয়েটে সরকার-সমর্থক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল ৫৯তম। বুয়েট শিক্ষকদের দাবি ছিল, এত ছোট একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য পদের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এত পেছনে থাকা একজন অধ্যাপককে সামনে টেনে আনার বিষয়টি কেউ সমর্থন করেননি।
এত দিন বুয়েট শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। গতকাল দেখা গেল ওই ব্যানারে পদত্যাগের জায়গায় অপসারণ লেখা হয়েছে।
বুয়েটের বর্তমান উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘন করে ভূতাপেক্ষ নিয়োগ দেওয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ বুয়েট শাখার সভাপতি ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার কামাল উদ্দীনকে রেজিস্ট্রার করার উদ্যোগ, ছাত্রলীগের এক নেতার বিষয় নিবন্ধন ও ফল পরিবর্তনে বিশেষ সুযোগ দেওয়া, কর্মচারী নিয়োগে পছন্দের কমিটি গঠন করে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া, প্রশাসনের বিভিন্ন পদে দলীয়করণসহ ১৬টি অভিযোগ তুলেছে শিক্ষক সমিতি। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গত ৭ এপ্রিল থেকে টানা ২৮ দিন কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকেরা। প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে কর্মবিরতি স্থগিত করেন তাঁরা। এরপর গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। সম্প্রতি ওই কমিটির প্রতিবেদনে শিক্ষক সমিতির অভিযোগগুলো ঠিক নয় বলে মত দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বুয়েট প্রশাসনের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো সঠিক ছিল বলেও মত দেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
‘আমরা তদন্ত চাইনি। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই উপাচার্য পছন্দের লোক দিয়ে তদন্ত করিয়েছেন। সেটা আমরা মানব কেন?’ বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের প্রশ্ন এটি।
মুজিবুর রহমান বলেন, তার পরও যখন তদন্ত কমিটি হয়, তখন শিক্ষক সমিতি যাঁদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছিল, তাঁদের নেওয়া হয়নি। ফলে এটি প্রহসনের তদন্তে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বুয়েটের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকার শুরু থেকেই সেখানকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে আসছে, যাতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি না হয়।’ মন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি। প্রশাসনিক ও শিক্ষকদের কারণে শিক্ষার্থীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান শিক্ষামন্ত্রী।
শিক্ষক সমিতির সভা, কর্মসূচি ও পদত্যাগ: বুয়েট বন্ধ ঘোষণার পর গতকাল সকালে সাধারণ সভায় বসে বুয়েট শিক্ষক সমিতি। সমিতির সহসভাপতি মাকসুদ হেলালী বলেন, কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই উপাচার্যের বুয়েট বন্ধের ঘোষণা অবৈধ। সভা শেষে দুপুর পৌনে ১২টায় পুরকৌশল ভবন থেকে মৌন মিছিল বের হয়। এ সময় ভবনের সামনে জড়ো হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী করতালির মাধ্যমে শিক্ষকদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। শিক্ষকদের মৌন মিছিলে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীরা এ সময় ভূতাপেক্ষ নিয়োগের নামে নিয়মবহির্ভূত নিয়োগ ও পদোন্নতি বন্ধের দাবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করেন। এ ছাড়া ‘উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যকে অপসারণ করে বুয়েটকে রক্ষা করুন’ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করেন তাঁরা।
মুজিবুর রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী আমরা ক্লাসে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। উপরন্তু অভিযোগ তদন্তে গঠিত প্রতিবেদনে উপাচার্যের মতামতই তুলে ধরা হয়েছে। এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দুপুর থেকেই পদত্যাগপত্রে সই করা শুরু করেন বিভিন্ন একাডেমিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা। সন্ধ্যার মধ্যেই পাঁচজন ডিন, ১৭ জন বিভাগীয় প্রধানের মধ্যে ১৫ জন এবং তিনটি ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদত্যাগপত্রে সই করেন।
কর্মসূচিস্থলে কথা হয় বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিমের সঙ্গে। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ছিলেন। এ সংকটের সমাধান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়া বিকল্প কিছু দেখছেন না। তিনি বলেন, ‘উনাদের শোধরানোর অনেক সময় দিয়েছেন শিক্ষকেরা। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বাঁচাতে আর কোনো বিকল্প তাঁদের সামনে নেই।’
ছাত্রলীগের প্রচারপত্র: শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে বুয়েটের ছাত্রাবাসগুলোতে প্রচারপত্র বিলি করেছে ছাত্রলীগ। গত মঙ্গলবার রাতে বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের প্যাডে প্রচারপত্র বিলি করা হয়। সেখানে লেখা রয়েছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির বুয়েট ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা প্রণয়ন করেছে। এই অবস্থায় যদি কোনো ছাত্রের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে সরকারবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে ছাত্রলীগ কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রসঙ্গত, নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় বুয়েট ছাত্রলীগের কমিটি সম্প্রতি বিলুপ্ত করা হয়েছে। গতকালও ছাত্রলীগের কিছু কর্মী কর্মসূচির আশপাশে ঘোরাফেরা করেন বলে আন্দোলনরত শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন।
উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকেরা যেহেতু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন মেনে নেননি, সে ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনে মত দিয়েছে। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা চলবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উপাচার্য বা সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়টি সিন্ডিকেটের হাতে নয়। তিনি নিজে পদত্যাগ করবেন না বলেও জানান।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গতকাল শ্রেণীকক্ষের বদলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। প্রশাসনের ওপর অনাস্থা এনে পদত্যাগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ২৪ অধ্যাপক।
বুয়েটের উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাকার্যক্রম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। গতকাল শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ছিল তাঁদের লেখাপড়া বিঘ্ন হওয়ার বিষয়টি। একাধিক শিক্ষার্থী জানালেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করে বিদেশে চলে যান। ওই সব দেশে মার্চ ও সেপ্টেম্বরে সেশন থাকে। যে অবস্থা তৈরি হয়েছে মার্চের সেশন ধরা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানালেন, আগামী ডিসেম্বরে তাঁদের পরীক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু সেই সম্ভাবনা আর নেই।
শিক্ষকদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়াও গতকাল প্রকাশ্যে যোগ দিয়েছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একাংশ। সব মিলিয়ে অনির্ধারিত বন্ধের প্রথম দিন ক্যাম্পাস ছিল উত্তাল। প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রায় দিনভর চলেছে বক্তৃতা, সংগীত ও আলোচনা।
উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের ওপর ক্ষোভ যে কারণে: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপ্রীতিকর অবস্থার মুখে ঢাকায় চলে এসেছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম। বুয়েটে ফিরে ২০১০ সালে তিনি উপাচার্য পদে দায়িত্ব নেন। সরকার সমর্থক হওয়ায় এবং একটি বিশেষ জেলায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে তিনি আন্দোলনের মুখে উপাচার্য পদে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষকদের বড় অভিযোগ হচ্ছে, উপাচার্য পদে তিনি থাকলেও নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ান সহ-উপাচার্য। এ কারণে উপাচার্যের চেয়েও শিক্ষকদের বেশি ক্ষোভ সহ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে। আন্দোলনের প্রথম ভাগে বুয়েট শিক্ষকদের সংকেত ছিল, সহ-উপাচার্যকে অপসারণ করলে তাঁরা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াবেন। কিন্তু গতকাল থেকে শুরু হওয়া ভিন্ন মাত্রার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বললেন, উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য দুজনকে অপসারণ ছাড়া এই আন্দোলন থামবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য পদে ২০০৯ সালে প্রথম নিয়োগ পান এম হাবিবুর রহমান। তিনি বুয়েটে সরকার-সমর্থক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল ৫৯তম। বুয়েট শিক্ষকদের দাবি ছিল, এত ছোট একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য পদের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এত পেছনে থাকা একজন অধ্যাপককে সামনে টেনে আনার বিষয়টি কেউ সমর্থন করেননি।
এত দিন বুয়েট শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। গতকাল দেখা গেল ওই ব্যানারে পদত্যাগের জায়গায় অপসারণ লেখা হয়েছে।
বুয়েটের বর্তমান উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘন করে ভূতাপেক্ষ নিয়োগ দেওয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ বুয়েট শাখার সভাপতি ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার কামাল উদ্দীনকে রেজিস্ট্রার করার উদ্যোগ, ছাত্রলীগের এক নেতার বিষয় নিবন্ধন ও ফল পরিবর্তনে বিশেষ সুযোগ দেওয়া, কর্মচারী নিয়োগে পছন্দের কমিটি গঠন করে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া, প্রশাসনের বিভিন্ন পদে দলীয়করণসহ ১৬টি অভিযোগ তুলেছে শিক্ষক সমিতি। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গত ৭ এপ্রিল থেকে টানা ২৮ দিন কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকেরা। প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে কর্মবিরতি স্থগিত করেন তাঁরা। এরপর গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। সম্প্রতি ওই কমিটির প্রতিবেদনে শিক্ষক সমিতির অভিযোগগুলো ঠিক নয় বলে মত দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বুয়েট প্রশাসনের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো সঠিক ছিল বলেও মত দেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
‘আমরা তদন্ত চাইনি। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই উপাচার্য পছন্দের লোক দিয়ে তদন্ত করিয়েছেন। সেটা আমরা মানব কেন?’ বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের প্রশ্ন এটি।
মুজিবুর রহমান বলেন, তার পরও যখন তদন্ত কমিটি হয়, তখন শিক্ষক সমিতি যাঁদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছিল, তাঁদের নেওয়া হয়নি। ফলে এটি প্রহসনের তদন্তে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বুয়েটের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকার শুরু থেকেই সেখানকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে আসছে, যাতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি না হয়।’ মন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি। প্রশাসনিক ও শিক্ষকদের কারণে শিক্ষার্থীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান শিক্ষামন্ত্রী।
শিক্ষক সমিতির সভা, কর্মসূচি ও পদত্যাগ: বুয়েট বন্ধ ঘোষণার পর গতকাল সকালে সাধারণ সভায় বসে বুয়েট শিক্ষক সমিতি। সমিতির সহসভাপতি মাকসুদ হেলালী বলেন, কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই উপাচার্যের বুয়েট বন্ধের ঘোষণা অবৈধ। সভা শেষে দুপুর পৌনে ১২টায় পুরকৌশল ভবন থেকে মৌন মিছিল বের হয়। এ সময় ভবনের সামনে জড়ো হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী করতালির মাধ্যমে শিক্ষকদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। শিক্ষকদের মৌন মিছিলে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীরা এ সময় ভূতাপেক্ষ নিয়োগের নামে নিয়মবহির্ভূত নিয়োগ ও পদোন্নতি বন্ধের দাবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করেন। এ ছাড়া ‘উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যকে অপসারণ করে বুয়েটকে রক্ষা করুন’ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করেন তাঁরা।
মুজিবুর রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী আমরা ক্লাসে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি। উপরন্তু অভিযোগ তদন্তে গঠিত প্রতিবেদনে উপাচার্যের মতামতই তুলে ধরা হয়েছে। এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দুপুর থেকেই পদত্যাগপত্রে সই করা শুরু করেন বিভিন্ন একাডেমিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা। সন্ধ্যার মধ্যেই পাঁচজন ডিন, ১৭ জন বিভাগীয় প্রধানের মধ্যে ১৫ জন এবং তিনটি ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদত্যাগপত্রে সই করেন।
কর্মসূচিস্থলে কথা হয় বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিমের সঙ্গে। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ছিলেন। এ সংকটের সমাধান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়া বিকল্প কিছু দেখছেন না। তিনি বলেন, ‘উনাদের শোধরানোর অনেক সময় দিয়েছেন শিক্ষকেরা। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বাঁচাতে আর কোনো বিকল্প তাঁদের সামনে নেই।’
ছাত্রলীগের প্রচারপত্র: শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে বুয়েটের ছাত্রাবাসগুলোতে প্রচারপত্র বিলি করেছে ছাত্রলীগ। গত মঙ্গলবার রাতে বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের প্যাডে প্রচারপত্র বিলি করা হয়। সেখানে লেখা রয়েছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির বুয়েট ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা প্রণয়ন করেছে। এই অবস্থায় যদি কোনো ছাত্রের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে সরকারবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে ছাত্রলীগ কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রসঙ্গত, নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় বুয়েট ছাত্রলীগের কমিটি সম্প্রতি বিলুপ্ত করা হয়েছে। গতকালও ছাত্রলীগের কিছু কর্মী কর্মসূচির আশপাশে ঘোরাফেরা করেন বলে আন্দোলনরত শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন।
No comments