অরণ্যে রোদন-বাতাসে এত রোদন কেন? by আনিসুল হক
শীতের শেষটা এমন বিষাদ বয়ে আনল! ভালোই ছিলাম আইভরি কোস্টে। ওখানে জাতিসংঘের মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা খুব ভালো করছেন। তাঁদের মনোবল উঁচু, শৃঙ্খলার মান খুব ভালো, পেশাদারি দক্ষতায় তাঁরা জয় করে নিয়েছেন সবার অন্তর। প্রশংসিত হয়েছেন জাতিসংঘের কাছে। সমাদৃত হয়েছেন স্থানীয় মানুষের কাছে।
তাঁদের মানবিক গুণাবলি, সেবামূলক কাজ আইভরিয়ানদের চিত্ত জয় করে নিয়েছে। আমাদের অনেক আইভরিয়ান বলেছেন, ‘বাংলা গুড’। অন্য একটা-দুটো দেশের নাম নিয়ে তাঁরা আমাদের বলেছেন, ‘ওরা ভালো নয়। বাংলা ভালো।’ ‘রূপসী বাংলা’ নামের গ্রাম দেখলে, স্থানীয় মানুষকে বাংলায় অবিরল কথা বলতে দেখলে কোন বাঙালির না ভালো লাগবে!
আইভরি কোস্ট থেকে ঢাকা এসে সোজা চলে গেলাম দিল্লি। ফ্রিডম’স মাদার নাম নিয়ে মা উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ বেরোল নয়াদিল্লির পালিম্পসেস্ট প্রকাশনী থেকে। একটা প্রকাশনা উৎসব হলো। কারান সিংয়ের মতো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন আমাদের হাই কমিশনারসহ গণ্যমান্য অতিথিরা। প্রকাশনা উৎসবে কেউ কোনো বই সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলেন না, প্রশংসা করাটাই রেওয়াজ, এই বই নিয়েও তাই হবে, সেটা খুব অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু, হঠাৎ করে, দিল্লির আইআইসির সুদৃশ্য ক্যাফেতে বসে ভাবনা চলে আসে, আমি এখানে কেন? এই যে এঁরা আতিথেয়তা করছেন, ঔপন্যাসিক-সাংবাদিক ভাস্কর রায় নিজে উদ্যোগী হয়ে বইটা অনুবাদ করালেন, প্রকাশ করলেন, কেন? তিনি আমার কে? হঠাৎ করে ঢাকায় দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে, তাঁকে বইটা দিয়েছিলাম, কতজনকেই তো বই দিই। তিনি পড়লেন এবং যেন ব্রত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, এই বই বাংলা ভাষার বাইরের লোকদেরও পড়াতেই হবে। ব্যস, এখন আমি দিল্লিতে। লোদি গার্ডেনের শোভা দেখছি। পৃথিবীতে অনাত্মীয়, প্রায় অপরিচিত মানুষের কাছে এমন সব ভালোবাসা পেয়েছি যে কেমন আশ্চর্য লাগে সব কিছু। কিছু তো করিনি, বাংলায় কতগুলো বাক্য রচনা করা ছাড়া। তারই সূত্র ধরে এইখানে আসা।
কিন্তু ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় অনড় যানজটের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে মনটা কী রকম যেন দমে যেতে লাগল। দিল্লি এত সুন্দর! ওদের বিমানবন্দর এত ঝকঝকে! রাস্তায় যানজট নেই, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল নানা কিছু করে ওরা সব মসৃণ করে দিয়েছে। অটোরিকশাওয়ালারা মিটারে চলছে, একটা টাকা অতিরিক্ত দাবি করল না। ঢাকা দিল্লির মতো না হোক, অন্তত কলকাতার মতো তো হতে পারে। কলকাতাতেও এখন যানজট নেই, যেই যায়, সেই মুগ্ধ হয়। ঢাকা শহরটা যে চলছে না, স্থবির হয়ে আছে, এটা কি আমাদের কর্তারা জানেন? আর এই সমস্যার সমাধান যে টোটকা পদ্ধতিতে হবে না, একটা সমন্বিত পরিকল্পনা লাগবে, সেই কথাটা উপলব্ধিতে আনার মতো কেউ কি আছেন? হঠাৎ করে একটা ফ্লাইওভার, একটা ফুটওভার ব্রিজ করলে পরে দেখা গেল সেটা সমন্বিত কোনো প্রকল্পের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেটা তখন ভাঙতে হবে। পাঁচ বছর পর ঢাকা শহরে মানুষ থাকতে পারবে, নাকি এটা একটা পরিত্যক্ত নগরে পরিণত হবে?
দিল্লি থেকে ফিরে ধাতস্থ হইনি। রাতের খবরে শুনি, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু আর নাই। অরুন্ধতী রায়ের গড অফ স্মল থিংস বইয়ে একটা কথা আছে—ভায়াব্ল ডায়াব্ল এজ। আমরা এখন মৃত্যুর বয়স ছুঁয়ে ফেলেছি। টিংকু ভাইয়ের ব্রেন টিউমার হয়েছিল। বছর দুয়েক আগে জেনেছিলাম। তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন সিঙ্গাপুরে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। অপারেশন ভালো হয়েছিল, তিনি সেরে উঠবেন বলেই জানতাম। কিন্তু শেষতক বাঁচলেন না। একদিন ফেসবুকে লিখলেন, ‘এই, আমার ছেলে তোর ভক্ত, ওকে বন্ধু করে নে।’ সে আদেশ আমি মান্য করেছিলাম।
জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু একটা সময়ে আমাদের কাছে নায়ক ছিলেন। আমি যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন তিনি পড়েন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তিনি আর মোজাম্মেল বাবু মিলে বের করেছিলেন শিল্প-সাহিত্যের কাগজ স্পর্শ। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নামধাম, সাক্ষাৎকার পড়ার সুযোগ হয়েছিল ওই স্পর্শ নামের কাগজের মাধ্যমেই। টিংকু ভাই ছোটগল্প লিখতেন, আমার কবিতা খুব পছন্দ করতেন, বিশেষ করে এই লাইনটা: ‘আসলে আয়ুর চেয়ে বড় সাধ তার আকাশ দেখার।’ আমাদের বন্ধু কবি হুমায়ূন রেজার সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, ‘রেজা, তুই এই লাইনটা খুব ভালো লিখেছিস।’ রেজা কাঁচুমাচু হয়ে বলত, ‘টিংকু ভাই, ওটা মিটুন ভাইয়ের লেখা।’ টিংকু ভাইয়ের খুব প্রিয় ছিল বুদ্ধদেব গুহর মাধুকরী। আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘সবাই মাধুকরী পড়বি।’ নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে আমরা ভীষণভাবে যুক্ত ছিলাম। আমার মনে আছে, এরশাদ সরকারের শেষ দিনগুলো, জরুরি অবস্থা, কারফিউ। শুক্রবারে সবাই গেছি বায়তুল মোকাররম মসজিদে, নামাজ শেষে কারফিউ ভেঙে মিছিল বের করা হবে। আমরা মিছিল নিয়ে কাকরাইলের দিকে আসছি। কাকরাইল মোড়ে পুলিশ গুলি আর টিয়ারগ্যাস ছুড়তে শুরু করল। বিজয়নগরের একটা কানাগলির ভেতরে পালাচ্ছি, টিংকু ভাই চিৎকার করে বলছেন, ‘মিটুন মিটুন, ওটা কানাগলি। পানি নে। শার্ট ভেজা।’ আমার পাশে সাংবাদিক আমিনুর রশীদ, ফজলুল বারী, আমান উদ দৌলা, আনিস আলমগীর, কুদ্দুস আফ্রাদ, ফজলুর রহমান, দীপু হাসান। আমরা বের করছি সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের বুলেটিন। এরশাদের নিযুক্ত সন্ত্রাসীরা মাইক্রোবাসে করে অস্ত্র নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করল। টিংকু ভাই খালি হাতে সেই গুলির ভেতর দিয়ে ছাত্রদের নিয়ে সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করতে ছুটলেন, সেদিনই তিনি বীর হয়ে গেলেন।
কিন্তু সেইসব আগুন-তাতানো দিন কোথায় ফুরিয়ে গেল। সেই ছাত্রনেতারাই বা কে কোথায় ছড়িয়ে পড়লেন। আমরা, সাংবাদিক- লেখকেরা এখন বিভিন্ন কাগজে বিভিন্ন টেলিভিশনে সক্রিয়। কার সঙ্গেই বা কার দেখা হয়। টিংকু ভাইয়ের প্রিয় ছিল ওই লাইন, ‘আসলে আয়ুর চেয়ে বড় সাধ তার আকাশ দেখার।’ তিনিও, আকাশ দেখবেন বলে জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেলেন।
সেই শোক কাটতে না কাটতেই সাগর সরওয়ার আর মেহেরুন রুনির এমন বিয়োগান্তক মৃত্যুর খবর। আমরা তখন ভোরের কাগজে। ‘মেলা’ নামের একটা ক্রোড়পত্র বের করব। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম—তরুণ লেখক চাই। তখন যাঁরা এসেছিলেন, তুষার আবদুল্লাহ, আবু সুফিয়ান, সুপন রায়—তাঁদেরই সঙ্গে বা একটু পরে এসেছিলেন সাগর সরওয়ার। ‘মেলা’ পাতায় লেখা দিয়েই তাঁর সাংবাদিকতা শুরু। মেহেরুন রুনিও এসেছিলেন ওই ‘মেলা’ পাতায় লিখবেন বলেই। আমাদের দুই প্রদায়ক একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করেন। তারপর সাগর চলে গেলেন প্রথমে সংবাদে। তারপর ইত্তেফাকে। দূর থেকে তাঁদের সাফল্য দেখি। ভালো লাগে। কিন্তু সকালবেলা টেলিভিশনের পর্দার নিচে তাঁদের দুজনের খুন হওয়ার খবর দেখে সারা ভুবন আঁধার হয়ে এল।
বাংলাদেশের মানুষ আমরা এত নিষ্ঠুর কেন?
বন্ধু ছিল তারা। একই রুমে থাকত। একই ছাত্রসংগঠন করে। পরে তাদের দুটো আলাদা গ্রুপ হয়ে গেল। তারপর এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে হত্যা করল স্রেফ পিটিয়ে। আমরা ছিনতাইকারীদের ধরে যেভাবে গণপিটুনি দিই, কিংবা হরতালের আগে বাসে যেভাবে আগুন দিয়ে মানুষ মারা হয়, তা থেকে মনে হয়, আমরা সভ্য হইনি। হাটহাজারীর ঘটনাও তারই প্রমাণ। এসব ঘটনায় এমন অসহায় লাগে। মনে হয়, কার উদ্দেশে কী লিখছি। কারা আমাদের লেখা পড়েন? আমরা কবে মানবিক হয়ে উঠব? কবে আমরা সভ্য হব?
সবকিছু মিলে খুব হতাশ, খুব অবসন্ন, খুব বিষণ্ন হয়ে পড়েছি। রোদনভরা এ বসন্ত—এমন করুণ বসন্ত সত্যি কখনো আর এসেছিল কি! জানি না আরও কত খারাপ সময় আমাদের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে।
আইভরি কোস্টে রাস্তায় মানুষ জীবন্ত মানুষের গায়ে আগুন দিচ্ছে, এই ভিডিও ফুটেজ দেখেছি। ওখানে একটা নির্বাচন হয়েছিল। বাগবো আর ওয়াত্তারা দুজনই নিজেকে সেই নির্বাচনে বিজয়ী বলে ঘোষণা করেছিলেন, দুজনেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তারপর দুই দলে শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। দুঃস্বপ্নের মতো ওই দৃশ্য সারাক্ষণ আমাকে তাড়িয়ে ফেরে—আমরাও ওই রকম দিন ডেকে আনছি না তো?
মৌসুমী ভৌমিকের গানে একটা লাইন আছে না, ‘কাকে বলি আজ মৃত্যু থামাও?’ কাকে বলব, আমাদের মৃত্যু থামান। আমাদের পতন থামান। ‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে’, নাজিম হিকমতের এই লাইনও যে আর ভরসা জোগাতে পারে না। তবুও ওখানেই আশা রাখতে হবে। মানুষই আমাদের ভরসার নাম। মানুষই আমাদের উদ্ধার করবে এই সমূহ বিনাশের থাবা থেকে।
স্টপ প্রেস: এই লেখাটা শেষ করে মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সাতট মিস্ড কল। তারপর সেই খবর শোনা: হুমায়ূন ফরীদি আর নেই। মাত্র ৬০ বছর। ভায়াব্ল ডায়াব্ল এজ। এখন ফরীদি ভাইয়ের ধানমণ্ডির বাসা থেকে ফিরছি। ফেরা কি যায়? খামারবাড়ির সামনে গাড়িতে এক ঘণ্টা বসে থাকলাম। গাড়ি নড়ছে না। ঢাকা চলছে না। প্রিয়তম পাতাগুলো ঝরে যাচ্ছে, প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ফোনের ভাণ্ডার থেকে আরো একটা নাম মুছতে হবে? চন্দ্রগ্রস্ত মানুষটা এইভাবে চলে গেল! পুরোপুরি শিল্পীর জীবন ছিল তাঁর, চলে যাওয়াটাও হলো শিল্পীরই মতোন। বিদায়, ফরীদি ভাই!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আইভরি কোস্ট থেকে ঢাকা এসে সোজা চলে গেলাম দিল্লি। ফ্রিডম’স মাদার নাম নিয়ে মা উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ বেরোল নয়াদিল্লির পালিম্পসেস্ট প্রকাশনী থেকে। একটা প্রকাশনা উৎসব হলো। কারান সিংয়ের মতো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন আমাদের হাই কমিশনারসহ গণ্যমান্য অতিথিরা। প্রকাশনা উৎসবে কেউ কোনো বই সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলেন না, প্রশংসা করাটাই রেওয়াজ, এই বই নিয়েও তাই হবে, সেটা খুব অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু, হঠাৎ করে, দিল্লির আইআইসির সুদৃশ্য ক্যাফেতে বসে ভাবনা চলে আসে, আমি এখানে কেন? এই যে এঁরা আতিথেয়তা করছেন, ঔপন্যাসিক-সাংবাদিক ভাস্কর রায় নিজে উদ্যোগী হয়ে বইটা অনুবাদ করালেন, প্রকাশ করলেন, কেন? তিনি আমার কে? হঠাৎ করে ঢাকায় দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে, তাঁকে বইটা দিয়েছিলাম, কতজনকেই তো বই দিই। তিনি পড়লেন এবং যেন ব্রত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, এই বই বাংলা ভাষার বাইরের লোকদেরও পড়াতেই হবে। ব্যস, এখন আমি দিল্লিতে। লোদি গার্ডেনের শোভা দেখছি। পৃথিবীতে অনাত্মীয়, প্রায় অপরিচিত মানুষের কাছে এমন সব ভালোবাসা পেয়েছি যে কেমন আশ্চর্য লাগে সব কিছু। কিছু তো করিনি, বাংলায় কতগুলো বাক্য রচনা করা ছাড়া। তারই সূত্র ধরে এইখানে আসা।
কিন্তু ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় অনড় যানজটের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে মনটা কী রকম যেন দমে যেতে লাগল। দিল্লি এত সুন্দর! ওদের বিমানবন্দর এত ঝকঝকে! রাস্তায় যানজট নেই, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল নানা কিছু করে ওরা সব মসৃণ করে দিয়েছে। অটোরিকশাওয়ালারা মিটারে চলছে, একটা টাকা অতিরিক্ত দাবি করল না। ঢাকা দিল্লির মতো না হোক, অন্তত কলকাতার মতো তো হতে পারে। কলকাতাতেও এখন যানজট নেই, যেই যায়, সেই মুগ্ধ হয়। ঢাকা শহরটা যে চলছে না, স্থবির হয়ে আছে, এটা কি আমাদের কর্তারা জানেন? আর এই সমস্যার সমাধান যে টোটকা পদ্ধতিতে হবে না, একটা সমন্বিত পরিকল্পনা লাগবে, সেই কথাটা উপলব্ধিতে আনার মতো কেউ কি আছেন? হঠাৎ করে একটা ফ্লাইওভার, একটা ফুটওভার ব্রিজ করলে পরে দেখা গেল সেটা সমন্বিত কোনো প্রকল্পের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেটা তখন ভাঙতে হবে। পাঁচ বছর পর ঢাকা শহরে মানুষ থাকতে পারবে, নাকি এটা একটা পরিত্যক্ত নগরে পরিণত হবে?
দিল্লি থেকে ফিরে ধাতস্থ হইনি। রাতের খবরে শুনি, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু আর নাই। অরুন্ধতী রায়ের গড অফ স্মল থিংস বইয়ে একটা কথা আছে—ভায়াব্ল ডায়াব্ল এজ। আমরা এখন মৃত্যুর বয়স ছুঁয়ে ফেলেছি। টিংকু ভাইয়ের ব্রেন টিউমার হয়েছিল। বছর দুয়েক আগে জেনেছিলাম। তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন সিঙ্গাপুরে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। অপারেশন ভালো হয়েছিল, তিনি সেরে উঠবেন বলেই জানতাম। কিন্তু শেষতক বাঁচলেন না। একদিন ফেসবুকে লিখলেন, ‘এই, আমার ছেলে তোর ভক্ত, ওকে বন্ধু করে নে।’ সে আদেশ আমি মান্য করেছিলাম।
জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু একটা সময়ে আমাদের কাছে নায়ক ছিলেন। আমি যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন তিনি পড়েন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তিনি আর মোজাম্মেল বাবু মিলে বের করেছিলেন শিল্প-সাহিত্যের কাগজ স্পর্শ। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নামধাম, সাক্ষাৎকার পড়ার সুযোগ হয়েছিল ওই স্পর্শ নামের কাগজের মাধ্যমেই। টিংকু ভাই ছোটগল্প লিখতেন, আমার কবিতা খুব পছন্দ করতেন, বিশেষ করে এই লাইনটা: ‘আসলে আয়ুর চেয়ে বড় সাধ তার আকাশ দেখার।’ আমাদের বন্ধু কবি হুমায়ূন রেজার সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, ‘রেজা, তুই এই লাইনটা খুব ভালো লিখেছিস।’ রেজা কাঁচুমাচু হয়ে বলত, ‘টিংকু ভাই, ওটা মিটুন ভাইয়ের লেখা।’ টিংকু ভাইয়ের খুব প্রিয় ছিল বুদ্ধদেব গুহর মাধুকরী। আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘সবাই মাধুকরী পড়বি।’ নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে আমরা ভীষণভাবে যুক্ত ছিলাম। আমার মনে আছে, এরশাদ সরকারের শেষ দিনগুলো, জরুরি অবস্থা, কারফিউ। শুক্রবারে সবাই গেছি বায়তুল মোকাররম মসজিদে, নামাজ শেষে কারফিউ ভেঙে মিছিল বের করা হবে। আমরা মিছিল নিয়ে কাকরাইলের দিকে আসছি। কাকরাইল মোড়ে পুলিশ গুলি আর টিয়ারগ্যাস ছুড়তে শুরু করল। বিজয়নগরের একটা কানাগলির ভেতরে পালাচ্ছি, টিংকু ভাই চিৎকার করে বলছেন, ‘মিটুন মিটুন, ওটা কানাগলি। পানি নে। শার্ট ভেজা।’ আমার পাশে সাংবাদিক আমিনুর রশীদ, ফজলুল বারী, আমান উদ দৌলা, আনিস আলমগীর, কুদ্দুস আফ্রাদ, ফজলুর রহমান, দীপু হাসান। আমরা বের করছি সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের বুলেটিন। এরশাদের নিযুক্ত সন্ত্রাসীরা মাইক্রোবাসে করে অস্ত্র নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করল। টিংকু ভাই খালি হাতে সেই গুলির ভেতর দিয়ে ছাত্রদের নিয়ে সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করতে ছুটলেন, সেদিনই তিনি বীর হয়ে গেলেন।
কিন্তু সেইসব আগুন-তাতানো দিন কোথায় ফুরিয়ে গেল। সেই ছাত্রনেতারাই বা কে কোথায় ছড়িয়ে পড়লেন। আমরা, সাংবাদিক- লেখকেরা এখন বিভিন্ন কাগজে বিভিন্ন টেলিভিশনে সক্রিয়। কার সঙ্গেই বা কার দেখা হয়। টিংকু ভাইয়ের প্রিয় ছিল ওই লাইন, ‘আসলে আয়ুর চেয়ে বড় সাধ তার আকাশ দেখার।’ তিনিও, আকাশ দেখবেন বলে জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেলেন।
সেই শোক কাটতে না কাটতেই সাগর সরওয়ার আর মেহেরুন রুনির এমন বিয়োগান্তক মৃত্যুর খবর। আমরা তখন ভোরের কাগজে। ‘মেলা’ নামের একটা ক্রোড়পত্র বের করব। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম—তরুণ লেখক চাই। তখন যাঁরা এসেছিলেন, তুষার আবদুল্লাহ, আবু সুফিয়ান, সুপন রায়—তাঁদেরই সঙ্গে বা একটু পরে এসেছিলেন সাগর সরওয়ার। ‘মেলা’ পাতায় লেখা দিয়েই তাঁর সাংবাদিকতা শুরু। মেহেরুন রুনিও এসেছিলেন ওই ‘মেলা’ পাতায় লিখবেন বলেই। আমাদের দুই প্রদায়ক একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করেন। তারপর সাগর চলে গেলেন প্রথমে সংবাদে। তারপর ইত্তেফাকে। দূর থেকে তাঁদের সাফল্য দেখি। ভালো লাগে। কিন্তু সকালবেলা টেলিভিশনের পর্দার নিচে তাঁদের দুজনের খুন হওয়ার খবর দেখে সারা ভুবন আঁধার হয়ে এল।
বাংলাদেশের মানুষ আমরা এত নিষ্ঠুর কেন?
বন্ধু ছিল তারা। একই রুমে থাকত। একই ছাত্রসংগঠন করে। পরে তাদের দুটো আলাদা গ্রুপ হয়ে গেল। তারপর এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে হত্যা করল স্রেফ পিটিয়ে। আমরা ছিনতাইকারীদের ধরে যেভাবে গণপিটুনি দিই, কিংবা হরতালের আগে বাসে যেভাবে আগুন দিয়ে মানুষ মারা হয়, তা থেকে মনে হয়, আমরা সভ্য হইনি। হাটহাজারীর ঘটনাও তারই প্রমাণ। এসব ঘটনায় এমন অসহায় লাগে। মনে হয়, কার উদ্দেশে কী লিখছি। কারা আমাদের লেখা পড়েন? আমরা কবে মানবিক হয়ে উঠব? কবে আমরা সভ্য হব?
সবকিছু মিলে খুব হতাশ, খুব অবসন্ন, খুব বিষণ্ন হয়ে পড়েছি। রোদনভরা এ বসন্ত—এমন করুণ বসন্ত সত্যি কখনো আর এসেছিল কি! জানি না আরও কত খারাপ সময় আমাদের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে।
আইভরি কোস্টে রাস্তায় মানুষ জীবন্ত মানুষের গায়ে আগুন দিচ্ছে, এই ভিডিও ফুটেজ দেখেছি। ওখানে একটা নির্বাচন হয়েছিল। বাগবো আর ওয়াত্তারা দুজনই নিজেকে সেই নির্বাচনে বিজয়ী বলে ঘোষণা করেছিলেন, দুজনেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তারপর দুই দলে শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। দুঃস্বপ্নের মতো ওই দৃশ্য সারাক্ষণ আমাকে তাড়িয়ে ফেরে—আমরাও ওই রকম দিন ডেকে আনছি না তো?
মৌসুমী ভৌমিকের গানে একটা লাইন আছে না, ‘কাকে বলি আজ মৃত্যু থামাও?’ কাকে বলব, আমাদের মৃত্যু থামান। আমাদের পতন থামান। ‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে’, নাজিম হিকমতের এই লাইনও যে আর ভরসা জোগাতে পারে না। তবুও ওখানেই আশা রাখতে হবে। মানুষই আমাদের ভরসার নাম। মানুষই আমাদের উদ্ধার করবে এই সমূহ বিনাশের থাবা থেকে।
স্টপ প্রেস: এই লেখাটা শেষ করে মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সাতট মিস্ড কল। তারপর সেই খবর শোনা: হুমায়ূন ফরীদি আর নেই। মাত্র ৬০ বছর। ভায়াব্ল ডায়াব্ল এজ। এখন ফরীদি ভাইয়ের ধানমণ্ডির বাসা থেকে ফিরছি। ফেরা কি যায়? খামারবাড়ির সামনে গাড়িতে এক ঘণ্টা বসে থাকলাম। গাড়ি নড়ছে না। ঢাকা চলছে না। প্রিয়তম পাতাগুলো ঝরে যাচ্ছে, প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ফোনের ভাণ্ডার থেকে আরো একটা নাম মুছতে হবে? চন্দ্রগ্রস্ত মানুষটা এইভাবে চলে গেল! পুরোপুরি শিল্পীর জীবন ছিল তাঁর, চলে যাওয়াটাও হলো শিল্পীরই মতোন। বিদায়, ফরীদি ভাই!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments