শ্রদ্ধাঞ্জলি-আমার আম্মা

দীর্ঘ এক মাস ২৪ দিন কী অপরিসীম লড়াই করে আমার আম্মা ২০১০ সালে ১৭ অক্টোবর রোববার ভোররাত চারটা ১৫ মিনিটে চলে গেলেন। এই ৫৪ দিনে আম্মাকে দুবার আইসিইউতে এবং দুবার সিসিইউতে নেওয়া হয়। তৃতীয়বার যখন আইসিইউ থেকে কেবিনে নিয়ে আসা হলো, তখন আম্মা বুঝে গেছেন, তাঁর আশা নেই। প্রচণ্ড রোগযন্ত্রণার সঙ্গে মনের শক্তি হারিয়ে ফেললেন। এবারে কেবিনে আট দিন ছিলেন। তেমন কথাবার্তা বলেননি। শুধু মাঝেমধ্যে বলেছেন, প্রচণ্ড কষ্ট।


জিজ্ঞাসা করেছি, আম্মা, কোথায় কষ্ট হচ্ছে? কোনো উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে একেবারে চুপ হয়ে গেছেন। আমার ছোট বোন সেলিনাকে বলেছিলেন, একবার বাসায় যেতে চান। না, আম্মার বাসায় যাওয়া হয়নি। আমরা অক্ষম সন্তানেরা বাসায় নিয়ে যেতে পারিনি।
১৫ অক্টোবর শুক্রবার বিকেলে আম্মার অবস্থা আবার খারাপ হলো। আম্মাকে নিয়ে যাওয়া হলো আইসিইউতে। ১৬ তারিখ শনিবার রাত ১০টায় আইসিইউ থেকে চিকিৎসক ডাকলেন। আমি ছিলাম, ছুটে গেলাম। আমাকে বসতে বললেন এবং কঠিন সত্য কথাটি বললেন, ‘আম্মার অবস্থা সংকটাপন্ন, রাতে কী হয় বলা যায় না।’ কেবিনে ফিরে এলাম। মিশু আর সেলিনাকে সঙ্গে রাখলাম। রাত দুইটায় আবার ডাক এল। চিকিৎসক জানালেন, আর দুই ঘণ্টা আম্মা আছেন। আমরা তিন ভাইবোন কেবিনে বসে প্রহর গুনছি। সময় বয়ে যায়, ধীরে অতি ধীরে। ভোর চারটায় ডাক এল, আমরা ছুটে গেলাম। আম্মা ঠান্ডা হয়ে গেছেন কিন্তু প্রাণ আছে। ঠিক চারটা ১৫ মিনিটে মনিটরের সব দাগ সোজা হয়ে গেল। চিকিৎসক বললেন, ‘যন্ত্রপাতি খুলে দিচ্ছি।’ তখন বুঝলাম, আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, শেষ আশ্রয় সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেলেন।
আমার আম্মা মীর্জা আজিজা ইদরিস একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। জীবনের প্রারম্ভে আম্মা জলপাইগুড়ি ও কলকাতায় ২৪ বছর কাটিয়েছেন। নানি জমিরননেসা এবং নানা মৌলভি আজিমউদ্দিন আহমদের ছয় সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন আমার আম্মা। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ায় ভাইয়েরা আম্মাকে বড় আদরে মানুষ করেছেন। আম্মাকে কোনো রকম কষ্ট কখনো করতে হয়নি।
অত্যন্ত সচ্ছল পরিবারের একজন সদস্য হওয়া সত্ত্বেও কখনো পার্থিব কোনো কিছুর প্রতি আম্মার ছিল না আসক্তি। আমার আব্বা প্রখ্যাত সাংবাদিক সাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিস একজন নীতিমান, মুক্তবুদ্ধি এবং আদর্শবান মানুষ ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ৯২ক ধারা জারি হলো। আব্বা সরকারি চাকরি করবেন না। চাকরি ছেড়ে দিলেন। তিনি ছিলেন পাবলিসিটি অ্যাসিসট্যান্ট ডাইরেক্টর। আমরা থাকতাম আজিমপুর কলোনিতে। নিশ্চিত আশ্রয়। ছেড়ে দিতে হলো। এসে উঠলাম ৩৩ নম্বর গোপীবাগ তৃতীয় লেনে। যে বাড়িতে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই। বাড়ির অন্যান্য অবকাঠামো আধুনিক নয়। অবাক বিস্ময়ে ভাবি, মাত্র ২৮ বছরের একজন ছয়-ছয়টি সন্তান নিয়ে আমার আব্বার আদর্শকে পরম শ্রদ্ধায় অনিশ্চিত জীবনে কত তৃপ্তিতে সংসার নামের চাকাটাকে সচল রাখতে লড়াই করেছেন। এখন ভাবি, কোথায় পেয়েছিলেন আম্মা এমন শক্তি। হ্যাঁ, আম্মার মাঝে ছিল এমন এক হার না-মানার শক্তি—যে শক্তির বলে আম্মা সব প্রতিকূলতা জয় করে আমাদের ছয় ভাইবোনকে যেমন বড় করেছেন, তেমনি জীবনবোধ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে শিখিয়েছেন, কর্মে ও কথায় এক হতে হয়।
আজ পরিণত বয়সে এসে ভাবি, আম্মা কী করে পেরেছেন ওই অল্প বয়সে এত স্বল্প অর্থে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, আব্বার বন্ধুবান্ধব, আমাদের ভাইবোনদের বন্ধুবান্ধব—সবাইকে আপন করে কাউকে আশ্রয় দেওয়া, কাউকে আপ্যায়ন করা, প্রয়োজনে সাহায্য করার কাজটি সুচারুভাবে করতে। আমার আব্বা বরাবর খবরের কাগজে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই প্রজন্মের সাংবাদিকেরা ভাবতেই পারবেন না, কত কম সম্মানী ছিল ওই সময়। সীমিত অর্থে আম্মাকে দেখেছি, কী বিশাল মনের বৈভবে জীবন চালাতেন। কত মানুষ আসত আমাদের বাড়িতে। খড়ির চুলায় রান্না করতেন আম্মা। রান্নাঘর থেকে যখন বের হতেন, ফরসা টুকটুকে আমার আম্মা লাল টকটকে হয়ে যেতেন। মুখে কোনো বিরক্তির ছাপ নেই।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এ দেশে যত গণ-আন্দোলন হয়েছে, প্রতিটি আন্দোলনে আম্মা ছিলেন প্রথম সারিতে। হূদয়ের কতখানি অঙ্গীকার থাকলে এমনভাবে বাইরে-ভেতরে কাজ করতে পারেন। জীবনাচরণে আম্মা ছিলেন সহজ-সরল। কিন্তু জীবনবোধে ছিলেন ঐশ্বর্যময়ী। কখনো আম্মাকে দেখিনি, তিনি পরিপাটি নন। অতি সাধারণ শাড়ি কড়া ইস্তিরিতে পরতেন। সেই সঙ্গে আমাদেরও নিজ হাতে জামা সেলাই করে কয়লার ইস্তিরিতে ইস্তিরি করে পরাতেন।
আম্মার মাঝে কোনো রকম সংস্কার কখনো দেখিনি। ছেলেসন্তান এবং মেয়েসন্তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য কখনো করেননি। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ছিল আম্মার জীবনবোধ। আমাদের এক উজ্জ্বল পরিবেশে, সুসংগঠিত নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে বড় করেছেন। এখন ভাবি, আম্মা কী করে পেরেছেন। আম্মা যেমন ঘর সামলিয়েছেন, তেমনি সমাজের কাজ করেছেন। পাড়ায় কোনো বাচ্চার অসুখ হাসপাতালে যেতে হবে, কার প্রসবব্যথা উঠেছে, কী করতে হবে—আম্মাকে জানালেই ঘর-সংসার সব ফেলে ছুটলেন সেখানে। মনে পড়ে, মধ্য ষাটের দশকে প্রচণ্ড ঝড় হয়। আমাদের বাড়ির কাছে একটা বস্তি ছিল, ঝড়ে উড়ে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে শিশুরা বিপর্যন্ত। ঝড় থামার সঙ্গে সঙ্গে আম্মা চাল-ডাল বাড়িতে যা ছিল এবং ছোট ভাইবোনদের কাপড় নিয়ে একাই ছুটে গেলেন সেখানে। আম্মার ব্রতই ছিল ‘সবারে বাস রে ভালো নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে’। মনে পড়ে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় বাড়িতে মেয়ের বিয়ের কাজ। বাড়িভরা লোক। খবর শুনলেন মতিউর শহীদ হয়েছে। সবকিছু উপেক্ষা করে আম্মা ছুটলেন সেখানে। সব কাজ সমাধা করে তবেই বাড়ি ফিরলেন। আবার মেয়ের বিয়ের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করলেন। আম্মাকে মৃত্যুর সঙ্গেও লড়াই করতে হয়েছে। শেষের দিকে আম্মার শারীরিক যন্ত্রণা কোনোভাবেই উপশম করা যায়নি। একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার শীর্ষে পৌঁছেও আমরা কত অসহায়, এতটুকু আরাম দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশাল হূদয়ের আম্মা আমার, তুমি কোন অনন্তলোকে আছ। তোমাকে ছাড়া আমরা সেকেন্ড, মিনিট, দিন, মাস এবং এক বছর পার করে দিলাম। তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি। ক্ষমা করো।
কাজী মদিনা

No comments

Powered by Blogger.