সরল গরল-মেট্রোরেলে বন্দুকের ছায়া by মিজানুর রহমান খান
মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি বহু আগে থেকেই আলগা থাকা সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক আরও আলগাই করবে। আমজনতার সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়াবে। ঐতিহাসিক ও দীর্ঘ সামরিক শাসনে পর্যুদস্ত বাংলাদেশের মানুষের মনে উর্দিধারীরা এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক জায়গা করে নিতে পারেনি। তবে এ থেকে উত্তরণে নির্বাচিত সরকারগুলো যে আদৌ কাজের কাজ করেছে, তা কিন্তু বলা যাবে না। তারাও তাদের দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করে নেয়।
চূড়ান্ত বিচারে মানিকে মানিক চেনে। শুধু সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক থেকে যায় অচেনা, যা আমাদের জাতি গঠনে খুবই দরকারি।
উইকিলিকস সূত্রে জানছি যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিকে বলেছিলেন, ‘আপনারা সামরিক বাহিনীকে একটু বোঝান, যাতে তারা নির্বাচিত সরকারকে সহযোগিতা করে।’
আমাদের কাছে এর অর্থ নেতিবাচক। কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের এমন দৈন্য থাকার কথা নয়। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস না রেখে ফন্দিফিকিরে টিকে থাকতে চায়, তাদের পক্ষেই এমনটা বলা সম্ভব। আর আমরা বারবার সে রকম নির্বাচিত সরকারের ফাঁদে পড়ে খাবি খাচ্ছি।
উইকিলিকস আমাদের আরও ধারণা দিচ্ছে, দুই নেত্রী ক্ষমতা ধরে না রাখতে পারলে সামরিক বাহিনীই তাদের ভরসাস্থল। এ রকম একটা অবস্থায় বিবিসি-বর্ণিত বাংলাদেশ মিলিটারির ‘কমসে কম ৫০০ মিলিয়ন ডলারের’ ফৌজি সাম্রাজ্য ফুলেফেঁপে ওঠার কাহিনি শুনে আমরা বিস্মিত হই না। তেজগাঁওয়ে বিমানবন্দরের নামে জমি ধরে রাখাও ওই ফৌজি সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে।
প্ল্যানার্স টাওয়ারের গোলটেবিলে অংশ নেওয়া বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক গ্রুপ ক্যাপ্টেন বলেছেন, তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দর রাখার ব্যাপারে পরিকল্পনাবিদেরা যেসব যুক্তি দিচ্ছেন, তা অস্বীকার করা যায় না। তবে ওই বিমানবন্দর আমাদের বিমানবাহিনীর লাগবেই। এঁরা আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই জমিদার, যিনি বলছেন, ‘বুঝেছ উপেন, ওটা দিতে হবে।’
জাপানের ওকিনাওয়া শহরে যখন মার্কিন ঘাঁটি বসেছিল, তখন শহরটি ঘনবসতিপূর্ণ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে শহর বড় হওয়ার পথে ওই সামরিক ঘাঁটির অপসারণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এ রিপোর্ট দেখেছি, সম্প্রতি বারাক ওবামার সঙ্গে জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হয়। তখন তিনি ওকিনাওয়া ঘাঁটি অপসারণের প্রসঙ্গ তুললে ওবামা অত্যন্ত বিরক্ত হন। তাঁর সেই বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ছিল এমন অভাবনীয় যে জাপানি কর্মকর্তারা বৈঠকের নোট নিতে ভুলে গিয়েছিলেন। ওকিনাওয়া আর ঢাকার মানুষের মধ্যে কোনো তফাত দেখি না। তাঁরা সেই সব যুক্তিতেই আন্দোলন করছেন, যা আমরা নগরের হূৎপিণ্ডে থাকা তেজগাঁও বিমানবন্দর অপসারণের জন্য করছি। জাপানিরা একটি শক্তিশালী দখলদার বাহিনীর পাল্লায় পড়েছে। আর আমরা পড়েছি তাদের পাল্লায়, যারা এ পর্যন্ত শুধু নিজ দেশ জয়েই বিক্রম দেখিয়েছে।
মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসির পাঠানো বার্তায় দেখি, জরুরি অবস্থায় একটি ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠার ধারণা তৈরি হয়েছিল। ডিজিএফআই সব রাজনৈতিক দলের রাজনীতিকদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল যে এ ধরনের সরকারে তাদের যোগ দিতে হবে। এতে তাদের বাধ্য করারও ইঙ্গিত রয়েছে গীতা পাসির বার্তায়। একটি গুজবও নাকি ছিল যে ডিজিএফআই ক্ষুদ্র দলগুলো দিয়ে একটি ন্যাশনাল ফ্রন্ট তৈরি করবে। তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং নতুন সরকারে তাদের হয়ে প্রক্সি দেবে। এটা গুজব। কিন্তু গুজবের একটি মহিমা হচ্ছে, যা একেবারেই অসম্ভব, সত্যের ধারেকাছেও নেই, তা কিন্তু গুজব হিসেবেও ডানা মেলে না। কিছুদিন আগে রাশেদ খান মেনন ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তাদের ভূমিকার বিষয়ে একটা বিরূপতা বিভিন্ন মহলে সংগত কারণেই রয়েছে। ডিজিএফআই ও আইএসপিআরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজে যে ধরনের আস্থা অর্জন করার কথা, সেটা গড়ে উঠছে না।
ডিজিএফআই পাকিস্তানি আইএসআইয়ের আদলে তৈরি বলে শেখ হাসিনার একটি বইয়ে উল্লেখ ছিল। আইএসআই বানিয়ে ছারখার হওয়া পাকিস্তান সংস্থাটির রাজনৈতিক সেল বন্ধ করল। শুনে আমরা লিখলাম, তাহলে এখানেও বন্ধ হোক। শেখ হাসিনা দুই দফায় সাত বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী। আজ পর্যন্ত আরেকটি বই লিখে তিনি জাতিকে জানালেন না যে ডিজিএফআইয়ের গণতন্ত্রায়ণে তিনি এ পর্যন্ত কী কী করেছেন।
আমাদের সন্দেহ অনৈতিক ফৌজি বাণিজ্যের সম্প্রসারণটা সামরিক শাসনের চেয়ে নির্বাচিত আমলেই ঘটেছে। জমকালো হোটেল, সুউচ্চ টাওয়ার, ব্যাংক, পেট্রলপাম্প—কোথায় তারা নেই।
মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্ত কুমার রায় প্রশাসনের অন্দরমহল: বাংলাদেশ শীর্ষক বইয়ে যে চিত্র বহু আগে এঁকেছিলেন, তা থেকে আমরা কি বেশি দূরে বেরিয়ে আসতে পেরেছি? তাঁরা লিখেছিলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে নির্লজ্জভাবে ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সের অদলবদল করে এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বেতন অনেক বাড়িয়ে সামরিক শাসকেরা বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসকে হেয় করেছে। এ ব্যবস্থায় একজন মেজর জেনারেল একজন সচিবের সমকক্ষ।’
জনপ্রশাসনে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অব্যাহত। মহাজোট সরকারের আড়াই বছরে বেসামরিক প্রশাসনে ১৭৮ জন সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা ইতিহাসের নতুন রেকর্ড। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় এ সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৮২।
কেন এমন ঘটছে। মাপকাঠি কী, মেধা না কোটা? কতিপয় ক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টতই লক্ষ করি একটা কোটারি অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদপ্তর একটি বেসামরিক সংস্থা। নিতান্ত কোটারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামরিক বাহিনী এর নেতৃত্ব করায়ত্ত করেছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদটি সেনাতন্ত্রের আরেকটি নমুনা। সেখানে বেসামরিক কথাটি নিজেই নিজকে ঠাট্টা করছে। কারণ, ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রথম পাঁচ চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন। পরবর্তী ১৬ জনের ১৪ জনই কর্মরত এয়ার কমোডর ও দুই গ্রুপ ক্যাপ্টেন। একটিবারের জন্যও এখানে কোনো উর্দিহীন প্রাণী ঢুকতে পারেনি।
একটা অস্বস্তিকর বিষয় হচ্ছে, প্রতিরক্ষা বিভাগের বিষয়ে কোনো সমালোচনামূলক কিছু বলতে গেলেই অনেক সময় জুজুর ভয় দেখানো হয়। ‘জাতীয় নিরাপত্তা’, জাতীয় স্বার্থ ও দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। দেশপ্রেমিক শব্দটি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর ভূষণ।
প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়েই চলেছে। কেন বাড়ে, তার সদুত্তর নেই। আগামী ১০-২০ বছরে আমাদের সামরিক বাহিনীর কোনো বিভাগে কত লোকবল বাড়বে এবং তাদের ক্যান্টনমেন্ট ও বাসস্থান কোথায় কী হবে, সেই চিত্র জনগণের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। তবে সামরিক বাহিনী যত সহজে সাইনবোর্ড লাগিয়ে জমি দখলে রাখতে পারে, তত সহজে বেসামরিক কোনো বান্দা পারে না। কেরানীগঞ্জে বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলে সেনাবাহিনীর নতুন সাইনবোর্ড পড়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদেরা হতভম্ব।
২২ তলা র্যাংগস ভবন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান এখন একটি নতুন রাস্তা হয়েছে। নতুন একটি রাস্তা পাওয়ায় জনগণ র্যাংগস ভবনটি ভেঙে ফেলার প্রতি তেমন সহানুভূতিসম্পন্ন হতে পারেনি। ৭০০ কোটি টাকার একটি সম্পদকে আমরা জাতীয় সম্পদ হিসেবে দেখতে পারিনি। কিন্তু এর আড়ালে রয়েছে মূলত পুরোনো বিমানবন্দর। আজ মেট্রোরেল রুটের সঙ্গে আপসই একমাত্র বিবেচ্য নয়। র্যাংগসের মতো উচ্চ কোনো ভবনই আর হতে দেওয়া হবে না ওই এলাকায়। তবে যদি ফৌজি সাম্রাজ্যের স্বার্থে ট্রাস্ট ব্যাংকের মতো কোনো উচ্চ ইমারত করতে হয়, তাহলে সমস্যা নেই। আইনও সে জন্য তাদের মনের মতো করে লেখা। পাকিস্তানের বিধি পড়ে যে কেউ বুঝবেন, রানওয়ে থেকে কত দূরে কী উচ্চতায় ভবন করা যাবে। বাংলাদেশে বোঝার উপায় নেই। এটা নির্ধারণের চূড়ান্ত এখতিয়ার ওই চেয়ারম্যানের।
র্যাংগসের জমিতে যদি জনস্বার্থে রাস্তা তৈরি করাই লক্ষ্য থাকত, তাহলে সেখানে একতলা ভবন নির্মাণেরও অনুমোদন দেওয়ার কথা নয়। তাদের একমাত্র মাথাব্যথা ছিল এরশাদ যে তেজগাঁও বিমানবন্দরকে সরকারিভাবে পরিত্যক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাকে বাস্তবায়িত হতে না দেওয়া। সে কারণে তারা ছয়তলা পর্যন্ত র্যাংগস ভবন নির্মাণ মেনে নেয়। শুধু বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে তেজগাঁওয়ে তথাকথিত পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর ধরে নিয়ে র্যাংগসের ছয়তলার অতিরিক্ত তলাগুলো ভাঙার রায় আসে। শুনানি হয়েছিল জরুরি অবস্থায় যখন সেনা দাপট মধ্যগগনে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একটি হলফনামায় বলেছিলেন, পাঁচ বছর পার হলো বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের কোনো খবরই ছিল না। এখন তারা তড়িঘড়ি করে শুনানি করতে চাইছে। সত্যি সেখানে নাটকীয়তা ছিল। আপিল বিভাগের রায়টি আইনের চেয়ে অনুমানের ওপর বেশি দাঁড়িয়ে। আপিল বিভাগ ধরে নিয়েছেন, ওখানে একটি বিমানবন্দর আছে।
শুনেছি পুরোনো বিমানবন্দরের জমিতে বিমানবাহিনীর জন্য একটি হাউজিং প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল। সেটি আর কখনো হবে না, সেটা তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। তেজগাঁও বিমানবন্দর পরিত্যক্ত হয়েছে। কুর্মিটোলাও (বর্তমান শাহজালাল) একদিন হবে, যদিও সেটা তারা শুরু থেকেই ব্যবহার করে আসছে। দুটোর দূরত্ব মাত্র সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এখন বিমান সদর আমাদের ঘুম পাড়ানি গান শোনাচ্ছে। তারা বলছে, তেজগাঁওয়ে বিমানবন্দর না থাকলে দেশের মধ্যাঞ্চলের নিরাপত্তা লাটে উঠবে। বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একাধিক দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা বলেছেন, এটা একেবারেই ভিত্তিহীন।
এটুকু আমজনতাও বুঝবে, সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে একটি বড় বিমানবন্দর থাকতে এ রকম কথা বলা কত উদ্ভট। তাই এটা যে বন্দুকের নলের জোরে ঘটছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কের উন্নতি চাইলে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রস্তাব অনুযায়ী এটি হোক উন্মুক্ত স্থান। বিমানবাহিনী এই সিদ্ধান্ত নিলে সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কের বিরাট উন্নতি ঘটবে। অন্যথায় আমাদের মনে পড়বে ফৌজি বাণিজ্যের কথা। যেখানে একজন হোটেল ব্যবসায়ী বিবিসিকে বলেন, ঢাকার জমির আকাশচুম্বী দাম। সেই জমি বিনে পয়সায় পেয়ে তারা হোটেল ব্যবসা করলে আমরা তো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারি না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
উইকিলিকস সূত্রে জানছি যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিকে বলেছিলেন, ‘আপনারা সামরিক বাহিনীকে একটু বোঝান, যাতে তারা নির্বাচিত সরকারকে সহযোগিতা করে।’
আমাদের কাছে এর অর্থ নেতিবাচক। কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের এমন দৈন্য থাকার কথা নয়। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস না রেখে ফন্দিফিকিরে টিকে থাকতে চায়, তাদের পক্ষেই এমনটা বলা সম্ভব। আর আমরা বারবার সে রকম নির্বাচিত সরকারের ফাঁদে পড়ে খাবি খাচ্ছি।
উইকিলিকস আমাদের আরও ধারণা দিচ্ছে, দুই নেত্রী ক্ষমতা ধরে না রাখতে পারলে সামরিক বাহিনীই তাদের ভরসাস্থল। এ রকম একটা অবস্থায় বিবিসি-বর্ণিত বাংলাদেশ মিলিটারির ‘কমসে কম ৫০০ মিলিয়ন ডলারের’ ফৌজি সাম্রাজ্য ফুলেফেঁপে ওঠার কাহিনি শুনে আমরা বিস্মিত হই না। তেজগাঁওয়ে বিমানবন্দরের নামে জমি ধরে রাখাও ওই ফৌজি সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে।
প্ল্যানার্স টাওয়ারের গোলটেবিলে অংশ নেওয়া বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক গ্রুপ ক্যাপ্টেন বলেছেন, তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দর রাখার ব্যাপারে পরিকল্পনাবিদেরা যেসব যুক্তি দিচ্ছেন, তা অস্বীকার করা যায় না। তবে ওই বিমানবন্দর আমাদের বিমানবাহিনীর লাগবেই। এঁরা আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই জমিদার, যিনি বলছেন, ‘বুঝেছ উপেন, ওটা দিতে হবে।’
জাপানের ওকিনাওয়া শহরে যখন মার্কিন ঘাঁটি বসেছিল, তখন শহরটি ঘনবসতিপূর্ণ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে শহর বড় হওয়ার পথে ওই সামরিক ঘাঁটির অপসারণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এ রিপোর্ট দেখেছি, সম্প্রতি বারাক ওবামার সঙ্গে জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হয়। তখন তিনি ওকিনাওয়া ঘাঁটি অপসারণের প্রসঙ্গ তুললে ওবামা অত্যন্ত বিরক্ত হন। তাঁর সেই বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ছিল এমন অভাবনীয় যে জাপানি কর্মকর্তারা বৈঠকের নোট নিতে ভুলে গিয়েছিলেন। ওকিনাওয়া আর ঢাকার মানুষের মধ্যে কোনো তফাত দেখি না। তাঁরা সেই সব যুক্তিতেই আন্দোলন করছেন, যা আমরা নগরের হূৎপিণ্ডে থাকা তেজগাঁও বিমানবন্দর অপসারণের জন্য করছি। জাপানিরা একটি শক্তিশালী দখলদার বাহিনীর পাল্লায় পড়েছে। আর আমরা পড়েছি তাদের পাল্লায়, যারা এ পর্যন্ত শুধু নিজ দেশ জয়েই বিক্রম দেখিয়েছে।
মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসির পাঠানো বার্তায় দেখি, জরুরি অবস্থায় একটি ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠার ধারণা তৈরি হয়েছিল। ডিজিএফআই সব রাজনৈতিক দলের রাজনীতিকদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল যে এ ধরনের সরকারে তাদের যোগ দিতে হবে। এতে তাদের বাধ্য করারও ইঙ্গিত রয়েছে গীতা পাসির বার্তায়। একটি গুজবও নাকি ছিল যে ডিজিএফআই ক্ষুদ্র দলগুলো দিয়ে একটি ন্যাশনাল ফ্রন্ট তৈরি করবে। তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং নতুন সরকারে তাদের হয়ে প্রক্সি দেবে। এটা গুজব। কিন্তু গুজবের একটি মহিমা হচ্ছে, যা একেবারেই অসম্ভব, সত্যের ধারেকাছেও নেই, তা কিন্তু গুজব হিসেবেও ডানা মেলে না। কিছুদিন আগে রাশেদ খান মেনন ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তাদের ভূমিকার বিষয়ে একটা বিরূপতা বিভিন্ন মহলে সংগত কারণেই রয়েছে। ডিজিএফআই ও আইএসপিআরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজে যে ধরনের আস্থা অর্জন করার কথা, সেটা গড়ে উঠছে না।
ডিজিএফআই পাকিস্তানি আইএসআইয়ের আদলে তৈরি বলে শেখ হাসিনার একটি বইয়ে উল্লেখ ছিল। আইএসআই বানিয়ে ছারখার হওয়া পাকিস্তান সংস্থাটির রাজনৈতিক সেল বন্ধ করল। শুনে আমরা লিখলাম, তাহলে এখানেও বন্ধ হোক। শেখ হাসিনা দুই দফায় সাত বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী। আজ পর্যন্ত আরেকটি বই লিখে তিনি জাতিকে জানালেন না যে ডিজিএফআইয়ের গণতন্ত্রায়ণে তিনি এ পর্যন্ত কী কী করেছেন।
আমাদের সন্দেহ অনৈতিক ফৌজি বাণিজ্যের সম্প্রসারণটা সামরিক শাসনের চেয়ে নির্বাচিত আমলেই ঘটেছে। জমকালো হোটেল, সুউচ্চ টাওয়ার, ব্যাংক, পেট্রলপাম্প—কোথায় তারা নেই।
মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্ত কুমার রায় প্রশাসনের অন্দরমহল: বাংলাদেশ শীর্ষক বইয়ে যে চিত্র বহু আগে এঁকেছিলেন, তা থেকে আমরা কি বেশি দূরে বেরিয়ে আসতে পেরেছি? তাঁরা লিখেছিলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে নির্লজ্জভাবে ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সের অদলবদল করে এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বেতন অনেক বাড়িয়ে সামরিক শাসকেরা বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসকে হেয় করেছে। এ ব্যবস্থায় একজন মেজর জেনারেল একজন সচিবের সমকক্ষ।’
জনপ্রশাসনে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অব্যাহত। মহাজোট সরকারের আড়াই বছরে বেসামরিক প্রশাসনে ১৭৮ জন সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা ইতিহাসের নতুন রেকর্ড। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় এ সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৮২।
কেন এমন ঘটছে। মাপকাঠি কী, মেধা না কোটা? কতিপয় ক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টতই লক্ষ করি একটা কোটারি অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদপ্তর একটি বেসামরিক সংস্থা। নিতান্ত কোটারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামরিক বাহিনী এর নেতৃত্ব করায়ত্ত করেছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদটি সেনাতন্ত্রের আরেকটি নমুনা। সেখানে বেসামরিক কথাটি নিজেই নিজকে ঠাট্টা করছে। কারণ, ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রথম পাঁচ চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন। পরবর্তী ১৬ জনের ১৪ জনই কর্মরত এয়ার কমোডর ও দুই গ্রুপ ক্যাপ্টেন। একটিবারের জন্যও এখানে কোনো উর্দিহীন প্রাণী ঢুকতে পারেনি।
একটা অস্বস্তিকর বিষয় হচ্ছে, প্রতিরক্ষা বিভাগের বিষয়ে কোনো সমালোচনামূলক কিছু বলতে গেলেই অনেক সময় জুজুর ভয় দেখানো হয়। ‘জাতীয় নিরাপত্তা’, জাতীয় স্বার্থ ও দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। দেশপ্রেমিক শব্দটি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর ভূষণ।
প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়েই চলেছে। কেন বাড়ে, তার সদুত্তর নেই। আগামী ১০-২০ বছরে আমাদের সামরিক বাহিনীর কোনো বিভাগে কত লোকবল বাড়বে এবং তাদের ক্যান্টনমেন্ট ও বাসস্থান কোথায় কী হবে, সেই চিত্র জনগণের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। তবে সামরিক বাহিনী যত সহজে সাইনবোর্ড লাগিয়ে জমি দখলে রাখতে পারে, তত সহজে বেসামরিক কোনো বান্দা পারে না। কেরানীগঞ্জে বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলে সেনাবাহিনীর নতুন সাইনবোর্ড পড়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদেরা হতভম্ব।
২২ তলা র্যাংগস ভবন যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান এখন একটি নতুন রাস্তা হয়েছে। নতুন একটি রাস্তা পাওয়ায় জনগণ র্যাংগস ভবনটি ভেঙে ফেলার প্রতি তেমন সহানুভূতিসম্পন্ন হতে পারেনি। ৭০০ কোটি টাকার একটি সম্পদকে আমরা জাতীয় সম্পদ হিসেবে দেখতে পারিনি। কিন্তু এর আড়ালে রয়েছে মূলত পুরোনো বিমানবন্দর। আজ মেট্রোরেল রুটের সঙ্গে আপসই একমাত্র বিবেচ্য নয়। র্যাংগসের মতো উচ্চ কোনো ভবনই আর হতে দেওয়া হবে না ওই এলাকায়। তবে যদি ফৌজি সাম্রাজ্যের স্বার্থে ট্রাস্ট ব্যাংকের মতো কোনো উচ্চ ইমারত করতে হয়, তাহলে সমস্যা নেই। আইনও সে জন্য তাদের মনের মতো করে লেখা। পাকিস্তানের বিধি পড়ে যে কেউ বুঝবেন, রানওয়ে থেকে কত দূরে কী উচ্চতায় ভবন করা যাবে। বাংলাদেশে বোঝার উপায় নেই। এটা নির্ধারণের চূড়ান্ত এখতিয়ার ওই চেয়ারম্যানের।
র্যাংগসের জমিতে যদি জনস্বার্থে রাস্তা তৈরি করাই লক্ষ্য থাকত, তাহলে সেখানে একতলা ভবন নির্মাণেরও অনুমোদন দেওয়ার কথা নয়। তাদের একমাত্র মাথাব্যথা ছিল এরশাদ যে তেজগাঁও বিমানবন্দরকে সরকারিভাবে পরিত্যক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাকে বাস্তবায়িত হতে না দেওয়া। সে কারণে তারা ছয়তলা পর্যন্ত র্যাংগস ভবন নির্মাণ মেনে নেয়। শুধু বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে তেজগাঁওয়ে তথাকথিত পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর ধরে নিয়ে র্যাংগসের ছয়তলার অতিরিক্ত তলাগুলো ভাঙার রায় আসে। শুনানি হয়েছিল জরুরি অবস্থায় যখন সেনা দাপট মধ্যগগনে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একটি হলফনামায় বলেছিলেন, পাঁচ বছর পার হলো বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের কোনো খবরই ছিল না। এখন তারা তড়িঘড়ি করে শুনানি করতে চাইছে। সত্যি সেখানে নাটকীয়তা ছিল। আপিল বিভাগের রায়টি আইনের চেয়ে অনুমানের ওপর বেশি দাঁড়িয়ে। আপিল বিভাগ ধরে নিয়েছেন, ওখানে একটি বিমানবন্দর আছে।
শুনেছি পুরোনো বিমানবন্দরের জমিতে বিমানবাহিনীর জন্য একটি হাউজিং প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল। সেটি আর কখনো হবে না, সেটা তো জোর দিয়ে বলা যাবে না। তেজগাঁও বিমানবন্দর পরিত্যক্ত হয়েছে। কুর্মিটোলাও (বর্তমান শাহজালাল) একদিন হবে, যদিও সেটা তারা শুরু থেকেই ব্যবহার করে আসছে। দুটোর দূরত্ব মাত্র সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এখন বিমান সদর আমাদের ঘুম পাড়ানি গান শোনাচ্ছে। তারা বলছে, তেজগাঁওয়ে বিমানবন্দর না থাকলে দেশের মধ্যাঞ্চলের নিরাপত্তা লাটে উঠবে। বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একাধিক দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা বলেছেন, এটা একেবারেই ভিত্তিহীন।
এটুকু আমজনতাও বুঝবে, সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে একটি বড় বিমানবন্দর থাকতে এ রকম কথা বলা কত উদ্ভট। তাই এটা যে বন্দুকের নলের জোরে ঘটছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কের উন্নতি চাইলে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রস্তাব অনুযায়ী এটি হোক উন্মুক্ত স্থান। বিমানবাহিনী এই সিদ্ধান্ত নিলে সিভিল-মিলিটারি সম্পর্কের বিরাট উন্নতি ঘটবে। অন্যথায় আমাদের মনে পড়বে ফৌজি বাণিজ্যের কথা। যেখানে একজন হোটেল ব্যবসায়ী বিবিসিকে বলেন, ঢাকার জমির আকাশচুম্বী দাম। সেই জমি বিনে পয়সায় পেয়ে তারা হোটেল ব্যবসা করলে আমরা তো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারি না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments