বিজ্ঞান-নাম দিয়ে যায় চেনা by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দেশের প্রত্যেক নাগরিক, স্থাপনা, কর্মকাণ্ডকে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করতে না পারলে তথ্যপ্রযুক্তির সুফল ভোগ করা সম্ভব হবে না। তাই সব প্রতিষ্ঠান, কর্মকাণ্ডকে শনাক্তকরণের পাশাপাশি দেশের নাগরিকদেরও সন্দেহাতীতভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এর জন্য যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র প্রয়োজন, ঠিক তেমনি নামকরণেও একটি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
বিজ্ঞানসম্মত নামকরণ করা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে মহাকাব্যের বিভিন্ন বস্তু ও ঘটনায় নামকরণ করার বৈধ কর্তৃপক্ষ হলো ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন। সামুদ্রিক ঝড়, টর্নেডোর নামকরণের জন্যও বৈধ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। রোমান সভ্যতায় পুরুষ নাগরিকদের নামের তিনটি অংশ ছিল। প্রথম অংশ Prayenomen, মধ্যাংশ nomen এবং শেষাংশ cognomen (পরিবারের নাম)। নারীদের নাম সাধারণত তাদের বাবা কিংবা স্বামীর cognomen অথবা nomen-এর স্ত্রীরূপ দিয়ে হতো। প্রাচীন রোমে সামাজিক অবস্থান, মর্যাদা কিংবা দায়িত্বের পরিধির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নামেরও পরিবর্তন হতো। প্রাচীন যুগের কথা বাদই দিলাম, এমনকি একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিজ্ঞানসম্মতভাবে আমাদের নামকরণ করা হচ্ছে না। আমার বাবার নাম আনিছ উদ্দিন আহমেদ এবং আমার নাম মোহাম্মদ কায়কোবাদ। আমার বাবার নাম থেকে যেমন আমার নামের কোনো ক্ষুদ্রাংশও আঁচ করার সুযোগ নেই, তেমনি আমার ভাইবোনদের নামও অনুমান করা যাবে না। এটি নগণ্য অংশ বাদ দিলে সারা দেশের এটাই চিত্র।
আমার অস্ট্রেলীয় সুপারভাইজার ফ্রান্স জোহান মারিয়া সলজবর্ন ও তাঁর স্ত্রী অ্যাডা ডিউরহফ ইউরোপের দ্রুত জীবন পছন্দ করতে না পেরে অস্ট্রেলিয়ায় ধীরলয়ের জীবন গ্রহণ করেছেন। এখন অবসর জীবনে প্রতি গ্রীষ্মে ইউরোপে বেড়াতে যান এবং অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে নিজের ফ্যামিলি ট্রিকে সমৃদ্ধ করছেন। ইতিমধ্যেই তাঁরা উভয় দিকের ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে আত্মীয়স্বজনের নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে তাঁদের ফ্যামিলি ট্রি সমৃদ্ধ করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে নামকরণের শৃঙ্খলা থেকে। বংশ নামের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না যুগ যুগ ধরে। কেবল নারীদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে; তা-ও নিয়মকানুন অনুসরণ করে, স্বামীর বংশ নাম দিয়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শত চেষ্টা করলেও আমাদের দেশের কোনো পরিবারের পক্ষেই এ রকম সমৃদ্ধ ফ্যামিলি ট্রি করা সম্ভব হবে না। কারণ, আমাদের নামকরণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করা হচ্ছে না। বছর দশেক আগের কথা, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের জেনোগ্রাফিক প্রকল্পে নাম লিখিয়েছিলাম আমরা পূর্বপুরুষদের গতিবিধি সম্পর্কে জানতে। আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করে আরব ভূখণ্ড, পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে ইউরোপ ঘুরে ককেশিয়ান অঞ্চল পর্যন্ত আমার পূর্বপুরুষদের ভ্রমণ ও বিচরণভূমি বিস্তৃত। তবে এরা যেই পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করবে, তারপর আর তথ্য-উপাত্ত পাওয়া তত সহজ হবে না। এরও কারণ আমাদের নাম বিজ্ঞানসম্মত নয়।
তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে, নিঃসন্দেহে এখনো ওই এলাকায়, মানুষের নামের তিনটি অংশ। প্রথম অংশ দিয়ে তাকে ডাকা হয়, মধ্যের অংশে হলো তার বাবার নামের প্রথম অংশ এবং সর্বশেষ হলো তার বংশের নাম। যেমন—বিখ্যাত লেখক তলস্তয়ের পূর্ণ নাম হলো লেভ নিকলায়েভিচ তলস্তয়। লেভ নামে তাঁকে ডাকা হয়, তাঁর বাবার নামের প্রথমাংশ নিকলাই এবং তলস্তয় হলো তাঁর বংশের নাম। তাঁর বাবার নাম নিকলাই ইলিচ তলস্তয়। তাঁর মাতার নাম মারিয়া নিকলায়েডনা তলস্তায়া এবং বিয়ের আগে বংশ নাম ছিল ভলকনস্কাইয়া। বিবাহিত নারীরা স্বামীর বংশ নাম ধারণ করে। লেভের কোনো বোন থাকলে তাঁর নামের মধ্যাংশে নিকলায়েভনা লিখতে হতো এবং বংশ নামের স্ত্রীরূপ তলস্তায়া।
প্রকৃতপক্ষে ইউরোপজুড়েই এই তিন অংশে বিভক্ত নামের সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয়। পারস্য দেশে অবশ্য নামের সঙ্গে শহরের নামও জুড়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। আমরা যদি আমাদের নাম বিজ্ঞানসম্মতভাবে না করি, তাহলে আধুনিক প্রযুক্তির যে ফলাফল—যেমন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের শনাক্তকরণ থেকে আমরা বঞ্চিত হব। আজ হোক কাল হোক সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগুলো আমাদের করতেই হবে। প্রযুক্তির নানা সুবিধা থেকে যাতে করে আরও অধিককাল বঞ্চিত না হই, এর জন্য নামকরণের নতুন সংস্কৃতি চালু করা উচিত। এখন আমাদের দেশে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করা চালু হয়েছে। সুতরাং একটি শিশু জন্মগ্রহণ করলে তার সম্ভাব্য নাম সম্পর্কে মা-বাবাকে সাহায্য করা যেতে পারে। শুধু নাম কেন, নামের বানানকে আমরা প্রমিত করতে পারি। ফলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আরও অনেক সহজ হবে।
অনেক সময় আমরা অজ্ঞতাপ্রসূত নামের শুদ্ধ কিংবা গ্রহণযোগ্য বানানও ব্যবহার করতে পারি না। এসব ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সহায়তা করতে পারে। আমরা যদি এ কাজটি এখনই শুরু করি, তাহলে ৫০-৬০ বছর পর বিজ্ঞানসম্মত নামের সব সুযোগ-সুবিধাই আমরা ভোগ করতে পারব। বিশেষ করে আমাদের মা-বাবা, ভাইবোনের পারিবারিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা তখন অনেক সহজ হবে। কোনো জমি কিংবা সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণের বিষয়গুলোর জটিলতা বহুগুণে হ্রাস পাবে। তা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি যেসব কর্মকাণ্ডে পারিবারিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো অনেক সহজ হয়ে আসবে। বাংলাদেশে এখন জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। একটি শিশুর জন্মলগ্নেই যদি তার নাম ও প্রয়োজনীয় উপাত্তগুলো সঠিকভাবে ধারণ করা হয়, তখন জাতীয় পরিচয়পত্রেও সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য উঠে আসবে।
সুতরাং কালবিলম্ব না করে আইনের মাধ্যমে সব শিশুর নামকরণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে মা-বাবাকে অনুপ্রাণিত করা হোক, প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হোক। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নামকরণের এই আধুনিক পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অবশ্য মানুষের নাম ছাড়াও প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য নামেও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা দরকার।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
আমার অস্ট্রেলীয় সুপারভাইজার ফ্রান্স জোহান মারিয়া সলজবর্ন ও তাঁর স্ত্রী অ্যাডা ডিউরহফ ইউরোপের দ্রুত জীবন পছন্দ করতে না পেরে অস্ট্রেলিয়ায় ধীরলয়ের জীবন গ্রহণ করেছেন। এখন অবসর জীবনে প্রতি গ্রীষ্মে ইউরোপে বেড়াতে যান এবং অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে নিজের ফ্যামিলি ট্রিকে সমৃদ্ধ করছেন। ইতিমধ্যেই তাঁরা উভয় দিকের ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে আত্মীয়স্বজনের নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে তাঁদের ফ্যামিলি ট্রি সমৃদ্ধ করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে নামকরণের শৃঙ্খলা থেকে। বংশ নামের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না যুগ যুগ ধরে। কেবল নারীদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে; তা-ও নিয়মকানুন অনুসরণ করে, স্বামীর বংশ নাম দিয়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শত চেষ্টা করলেও আমাদের দেশের কোনো পরিবারের পক্ষেই এ রকম সমৃদ্ধ ফ্যামিলি ট্রি করা সম্ভব হবে না। কারণ, আমাদের নামকরণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করা হচ্ছে না। বছর দশেক আগের কথা, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের জেনোগ্রাফিক প্রকল্পে নাম লিখিয়েছিলাম আমরা পূর্বপুরুষদের গতিবিধি সম্পর্কে জানতে। আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করে আরব ভূখণ্ড, পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে ইউরোপ ঘুরে ককেশিয়ান অঞ্চল পর্যন্ত আমার পূর্বপুরুষদের ভ্রমণ ও বিচরণভূমি বিস্তৃত। তবে এরা যেই পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করবে, তারপর আর তথ্য-উপাত্ত পাওয়া তত সহজ হবে না। এরও কারণ আমাদের নাম বিজ্ঞানসম্মত নয়।
তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে, নিঃসন্দেহে এখনো ওই এলাকায়, মানুষের নামের তিনটি অংশ। প্রথম অংশ দিয়ে তাকে ডাকা হয়, মধ্যের অংশে হলো তার বাবার নামের প্রথম অংশ এবং সর্বশেষ হলো তার বংশের নাম। যেমন—বিখ্যাত লেখক তলস্তয়ের পূর্ণ নাম হলো লেভ নিকলায়েভিচ তলস্তয়। লেভ নামে তাঁকে ডাকা হয়, তাঁর বাবার নামের প্রথমাংশ নিকলাই এবং তলস্তয় হলো তাঁর বংশের নাম। তাঁর বাবার নাম নিকলাই ইলিচ তলস্তয়। তাঁর মাতার নাম মারিয়া নিকলায়েডনা তলস্তায়া এবং বিয়ের আগে বংশ নাম ছিল ভলকনস্কাইয়া। বিবাহিত নারীরা স্বামীর বংশ নাম ধারণ করে। লেভের কোনো বোন থাকলে তাঁর নামের মধ্যাংশে নিকলায়েভনা লিখতে হতো এবং বংশ নামের স্ত্রীরূপ তলস্তায়া।
প্রকৃতপক্ষে ইউরোপজুড়েই এই তিন অংশে বিভক্ত নামের সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয়। পারস্য দেশে অবশ্য নামের সঙ্গে শহরের নামও জুড়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। আমরা যদি আমাদের নাম বিজ্ঞানসম্মতভাবে না করি, তাহলে আধুনিক প্রযুক্তির যে ফলাফল—যেমন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের শনাক্তকরণ থেকে আমরা বঞ্চিত হব। আজ হোক কাল হোক সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগুলো আমাদের করতেই হবে। প্রযুক্তির নানা সুবিধা থেকে যাতে করে আরও অধিককাল বঞ্চিত না হই, এর জন্য নামকরণের নতুন সংস্কৃতি চালু করা উচিত। এখন আমাদের দেশে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করা চালু হয়েছে। সুতরাং একটি শিশু জন্মগ্রহণ করলে তার সম্ভাব্য নাম সম্পর্কে মা-বাবাকে সাহায্য করা যেতে পারে। শুধু নাম কেন, নামের বানানকে আমরা প্রমিত করতে পারি। ফলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আরও অনেক সহজ হবে।
অনেক সময় আমরা অজ্ঞতাপ্রসূত নামের শুদ্ধ কিংবা গ্রহণযোগ্য বানানও ব্যবহার করতে পারি না। এসব ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সহায়তা করতে পারে। আমরা যদি এ কাজটি এখনই শুরু করি, তাহলে ৫০-৬০ বছর পর বিজ্ঞানসম্মত নামের সব সুযোগ-সুবিধাই আমরা ভোগ করতে পারব। বিশেষ করে আমাদের মা-বাবা, ভাইবোনের পারিবারিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা তখন অনেক সহজ হবে। কোনো জমি কিংবা সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণের বিষয়গুলোর জটিলতা বহুগুণে হ্রাস পাবে। তা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি যেসব কর্মকাণ্ডে পারিবারিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো অনেক সহজ হয়ে আসবে। বাংলাদেশে এখন জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। একটি শিশুর জন্মলগ্নেই যদি তার নাম ও প্রয়োজনীয় উপাত্তগুলো সঠিকভাবে ধারণ করা হয়, তখন জাতীয় পরিচয়পত্রেও সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য উঠে আসবে।
সুতরাং কালবিলম্ব না করে আইনের মাধ্যমে সব শিশুর নামকরণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে মা-বাবাকে অনুপ্রাণিত করা হোক, প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হোক। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নামকরণের এই আধুনিক পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অবশ্য মানুষের নাম ছাড়াও প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য নামেও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা দরকার।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments