বাঘা তেঁতুল-নারায়ণগঞ্জ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আমাদের ছোটবেলায় যখন স্টিমারে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতাম, তখন নারায়ণগঞ্জ হয়ে আসতে হতো। স্টিমার সিরাজগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ হয়ে শিবালয় (আরিচা) আসত। শিবালয় থেকে ভাগ্যকুল হয়ে নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশন। জীবনে আমি প্রথম ঢাকা দেখার আগে নারায়ণগঞ্জ দেখেছি। তখন নদী ছিল দুকূল প্লাবিত। ‘অস্ট্রিচ’, ‘কির্ডয়ি’ নামে বড় বড় স্টিমার চলত।
সেকালে নারায়ণগঞ্জের খুব নাম ছিল। দেশের অন্যতম প্রধান নদীবন্দর। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্র, বিশেষ করে পাটের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত। বন্দরটি ছোট হলেও এর একটি কসমোপলিটান চরিত্র ছিল। নানা জাতির ব্যবসায়ীরা এখানে ব্যবসা করতেন। ইউরোপীয়, মাড়োয়ারি প্রভৃতি ব্যবসায়ী ছিলেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। ঢাকা প্রথমে প্রাদেশিক রাজধানী ও পরে জাতীয় রাজধানী হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের অতীত গৌরব হারিয়ে যেতে থাকে। পাটেরও ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে, নারায়ণগঞ্জেরও ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে। ছিল মহকুমা শহর, তারপর জেলা সদর, এবার নারায়ণগঞ্জ উন্নীত হয় সিটি করপোরেশন হিসেবে। এই পরিবর্তন পুরোনো এই নগরবাসীর জীবনে কী পরিবর্তন আনে, সেটাই দেখার বিষয়।
সিটি করপোরেশন ঘোষিত হওয়ার পরে প্রথম নির্বাচন হতে যাচ্ছে। প্রার্থী ও নাগরিকদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশি থাকাই স্বাভাবিক। উৎসবমুখর পরিবেশে প্রচার-প্রচারণা হবে, সেটাই কাম্য। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ও সমস্যায় জর্জরিত দেশে আমাদের সংবাদপত্র তার প্রথম পাতার অর্ধেক উপহার দিয়েছে নারায়ণগঞ্জকে। চ্যানেলগুলোর জাতীয় সংবাদ শুরু হয় নারায়ণগঞ্জ দিয়ে। ভাবখানা এই—নারায়ণগঞ্জের ওপর গোটা জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বাঙালি বহু গুণে গুণান্বিত, তবে একটি ব্যাপারে রয়েছে তার ঘাটতি, তা হলো মাত্রাজ্ঞান। যে বিষয়কে সে একবার ধরে, তাকে লেম্বুচেপা না চিপে ছাড়ে না।
আত্মপ্রবঞ্চিত এই জাতির দৈনন্দিন সামাজিক আচার-আচরণের মতো নির্বাচনী প্রচারণারও একটি স্থায়ী চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে। প্রার্থীদের ছায়ার ৫০ গজের মধ্যে আগে কেউ যেতে পারত না। গেলেও বুক করত ধড়ফড়। নির্বাচনের আগে প্রার্থী নিজেই বুকে জড়িয়ে ধরছেন লোকজনকে।
বস্তির যে বৃদ্ধাকে গলির মোড়ের পান-সিগারেটের দোকানিও খালা বলে সম্বোধন করে না, বলে ‘এই বেটি’, তাকে জড়িয়ে ধরছেন বাঘের মতো প্রার্থী। নেতার পাঞ্জাবির ঘামে ভিজে যাচ্ছে বুড়ির গতর। তার হাড়সর্বস্ব হাতখানি বলিষ্ঠ হাতে প্রার্থী তাঁর নিজের চাঁদিতে নিয়ে ঘষে বলছেন, ‘দোয়া করেন মা, দোয়া করেন। এবার আমি জিতলে এই জায়গায় টিনশেড বানাইয়া দিমু। রাস্তা থিকা বিদ্যুৎ টাইনা আইনা দিমু, কোনো বিল দেওন লাগব না।’
ঘরে ঘরে গিয়ে প্রার্থী মুরব্বিদের কদমবুসি করছেন, যুবকদের সঙ্গে করছেন করমর্দন, শিশুদের করছেন গালে হাত দিয়ে আদর। নানা রকম আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি বর্ষিত হচ্ছে বৃষ্টির মতো। দাঁতখিলাল ঠোঁটে চেপে আঁটো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ১০-১২ জন সফরসঙ্গী আছেন প্রার্থীর সঙ্গে। তাঁদের দিকে তাকিয়ে ভোটারদের অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া। প্রার্থীদের আচরণ ও অভিনয় টিভি চ্যানেলগুলো সুচারুভাবে প্রচার করছে। তাতে প্রার্থীদের উৎসাহ আরও বেড়েছে।
গত সাধারণ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ ও গতিশীল করতে এক কমিটি গঠন করেছিল সরকার। তখন সেখানে আমার মতো অনভিজ্ঞ ও অভাজনকেও ডাকা হয়েছিল মতামতের জন্য। একটি জিনিস আমি খুব ভালো জানি যে, কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেই কোনো গুরুতর ব্যাপারে আমার কাঁচা পরামর্শ গ্রহণযোগ্য হবে না। ওই কমিটিকে আমি বলেছিলাম, যে দেশে চাকরি-বাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু নয়, ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদি, বউভাত ও কুলখানি পর্যন্ত দলীয় ভিত্তিতে হয়, সেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে করার যুক্তি কোথায়?
নির্দলীয়ভাবে যদি নির্বাচন হয়ও, প্রার্থীর দলীয় পরিচয় কীভাবে মুছে ফেলা যাবে? বাতাবিলেবু ও আপেলের জুস খেতে দিয়ে যদি কাউকে বলা হয়—খেয়ে নিন, ভাববেন না এটা কিসের জুস। কিন্তু যে খাবে, সে ঠিকই টের পাবে কোনটা আপেল আর কোনটা বাতাবির রস। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে জিনিসটি কী, তার পরও যদি কেউ বলে এর পরিচয় জানার দরকার নেই, এর পরিচয় ভুলে থাকুন অমুক তারিখ রাত ১২টা পর্যন্ত—তা কোন ধরনের প্রবঞ্চনা!
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ যে খেল দেখাল, তার তুলনা কি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে? দলের মধ্যে নেতৃত্বের যে মাঠপর্যায়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তার পরিচয় পাওয়া গেল। একদল নেতা আজ বলছেন এক কথা, তার প্রকাণ্ড শিরোনাম হচ্ছে। পরদিন অন্য নেতা বলছেন তার বিপরীত কথা, তারও মস্ত বড় শিরোনাম হচ্ছে। দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা যে প্রচার পেলেন, তা প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেই কেউ পেয়ে থাকেন। তার পরও বলা হচ্ছে নির্দলীয় নির্বাচন। বাংলাদেশে আইন মানতে হয় দুর্বলকে, প্রবল আইনকে পদাঘাত করলে কিছু আসে-যায় না।
খুব বিপজ্জনক মানুষকে নিয়েও যদি অত্যধিক প্রচার হয়, তার একটি ইতিবাচক মূর্তিও তৈরি হয় মানুষের মধ্যে। কোনো মহাদানবও মহামানবের ভাবমূর্তি অর্জন করতে পারে। মিডিয়ার বিষয়টি ভাবা দরকার।
প্রচলিত ধারার সর্বনাশা রাজনীতি নিজে নিজে টিকে থাকতে পারে না, শক্তি সঞ্চয় তো নয়ই—যদি না পায় নানা দিকের আনুকূল্য। মিডিয়ার আনুকূল্য, ব্যবসায়ী শ্রেণীর আনুকূল্য, সমাজের এলিট বা অধিপতিশ্রেণীর আনুকূল্য। এত দিক থেকে আনুকূল্য ও সুবিধা পাওয়ার পর ওই ধারার রাজনীতিকে—তা যত ক্ষতিকর ও গণবিরোধীই হোক, তা নড়ানো আর সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। নারায়ণগঞ্জ থেকে আমরা সেই শিক্ষাই পেলাম।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সিটি করপোরেশন ঘোষিত হওয়ার পরে প্রথম নির্বাচন হতে যাচ্ছে। প্রার্থী ও নাগরিকদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশি থাকাই স্বাভাবিক। উৎসবমুখর পরিবেশে প্রচার-প্রচারণা হবে, সেটাই কাম্য। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ও সমস্যায় জর্জরিত দেশে আমাদের সংবাদপত্র তার প্রথম পাতার অর্ধেক উপহার দিয়েছে নারায়ণগঞ্জকে। চ্যানেলগুলোর জাতীয় সংবাদ শুরু হয় নারায়ণগঞ্জ দিয়ে। ভাবখানা এই—নারায়ণগঞ্জের ওপর গোটা জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বাঙালি বহু গুণে গুণান্বিত, তবে একটি ব্যাপারে রয়েছে তার ঘাটতি, তা হলো মাত্রাজ্ঞান। যে বিষয়কে সে একবার ধরে, তাকে লেম্বুচেপা না চিপে ছাড়ে না।
আত্মপ্রবঞ্চিত এই জাতির দৈনন্দিন সামাজিক আচার-আচরণের মতো নির্বাচনী প্রচারণারও একটি স্থায়ী চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে। প্রার্থীদের ছায়ার ৫০ গজের মধ্যে আগে কেউ যেতে পারত না। গেলেও বুক করত ধড়ফড়। নির্বাচনের আগে প্রার্থী নিজেই বুকে জড়িয়ে ধরছেন লোকজনকে।
বস্তির যে বৃদ্ধাকে গলির মোড়ের পান-সিগারেটের দোকানিও খালা বলে সম্বোধন করে না, বলে ‘এই বেটি’, তাকে জড়িয়ে ধরছেন বাঘের মতো প্রার্থী। নেতার পাঞ্জাবির ঘামে ভিজে যাচ্ছে বুড়ির গতর। তার হাড়সর্বস্ব হাতখানি বলিষ্ঠ হাতে প্রার্থী তাঁর নিজের চাঁদিতে নিয়ে ঘষে বলছেন, ‘দোয়া করেন মা, দোয়া করেন। এবার আমি জিতলে এই জায়গায় টিনশেড বানাইয়া দিমু। রাস্তা থিকা বিদ্যুৎ টাইনা আইনা দিমু, কোনো বিল দেওন লাগব না।’
ঘরে ঘরে গিয়ে প্রার্থী মুরব্বিদের কদমবুসি করছেন, যুবকদের সঙ্গে করছেন করমর্দন, শিশুদের করছেন গালে হাত দিয়ে আদর। নানা রকম আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি বর্ষিত হচ্ছে বৃষ্টির মতো। দাঁতখিলাল ঠোঁটে চেপে আঁটো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ১০-১২ জন সফরসঙ্গী আছেন প্রার্থীর সঙ্গে। তাঁদের দিকে তাকিয়ে ভোটারদের অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া। প্রার্থীদের আচরণ ও অভিনয় টিভি চ্যানেলগুলো সুচারুভাবে প্রচার করছে। তাতে প্রার্থীদের উৎসাহ আরও বেড়েছে।
গত সাধারণ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ ও গতিশীল করতে এক কমিটি গঠন করেছিল সরকার। তখন সেখানে আমার মতো অনভিজ্ঞ ও অভাজনকেও ডাকা হয়েছিল মতামতের জন্য। একটি জিনিস আমি খুব ভালো জানি যে, কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেই কোনো গুরুতর ব্যাপারে আমার কাঁচা পরামর্শ গ্রহণযোগ্য হবে না। ওই কমিটিকে আমি বলেছিলাম, যে দেশে চাকরি-বাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু নয়, ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদি, বউভাত ও কুলখানি পর্যন্ত দলীয় ভিত্তিতে হয়, সেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে করার যুক্তি কোথায়?
নির্দলীয়ভাবে যদি নির্বাচন হয়ও, প্রার্থীর দলীয় পরিচয় কীভাবে মুছে ফেলা যাবে? বাতাবিলেবু ও আপেলের জুস খেতে দিয়ে যদি কাউকে বলা হয়—খেয়ে নিন, ভাববেন না এটা কিসের জুস। কিন্তু যে খাবে, সে ঠিকই টের পাবে কোনটা আপেল আর কোনটা বাতাবির রস। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে জিনিসটি কী, তার পরও যদি কেউ বলে এর পরিচয় জানার দরকার নেই, এর পরিচয় ভুলে থাকুন অমুক তারিখ রাত ১২টা পর্যন্ত—তা কোন ধরনের প্রবঞ্চনা!
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ যে খেল দেখাল, তার তুলনা কি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে? দলের মধ্যে নেতৃত্বের যে মাঠপর্যায়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তার পরিচয় পাওয়া গেল। একদল নেতা আজ বলছেন এক কথা, তার প্রকাণ্ড শিরোনাম হচ্ছে। পরদিন অন্য নেতা বলছেন তার বিপরীত কথা, তারও মস্ত বড় শিরোনাম হচ্ছে। দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা যে প্রচার পেলেন, তা প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেই কেউ পেয়ে থাকেন। তার পরও বলা হচ্ছে নির্দলীয় নির্বাচন। বাংলাদেশে আইন মানতে হয় দুর্বলকে, প্রবল আইনকে পদাঘাত করলে কিছু আসে-যায় না।
খুব বিপজ্জনক মানুষকে নিয়েও যদি অত্যধিক প্রচার হয়, তার একটি ইতিবাচক মূর্তিও তৈরি হয় মানুষের মধ্যে। কোনো মহাদানবও মহামানবের ভাবমূর্তি অর্জন করতে পারে। মিডিয়ার বিষয়টি ভাবা দরকার।
প্রচলিত ধারার সর্বনাশা রাজনীতি নিজে নিজে টিকে থাকতে পারে না, শক্তি সঞ্চয় তো নয়ই—যদি না পায় নানা দিকের আনুকূল্য। মিডিয়ার আনুকূল্য, ব্যবসায়ী শ্রেণীর আনুকূল্য, সমাজের এলিট বা অধিপতিশ্রেণীর আনুকূল্য। এত দিক থেকে আনুকূল্য ও সুবিধা পাওয়ার পর ওই ধারার রাজনীতিকে—তা যত ক্ষতিকর ও গণবিরোধীই হোক, তা নড়ানো আর সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। নারায়ণগঞ্জ থেকে আমরা সেই শিক্ষাই পেলাম।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments