মৃদুকণ্ঠ-বিদায়ী নির্বাচন কমিশনকে সাধুবাদ by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
নবাগতকে স্বাগত জানানো এবং বিদায়ীকে ধন্যবাদ জানানো সভ্য সমাজের প্রচলিত রীতি। আমরা সভ্য হয়েও সভ্যতার রীতি মানি না। ভব্যতার পরিচয় দিই না। বরং উল্টোটাই করে থাকি। নবাগতকে সম্ভাষণের বদলে একচোট শাসিয়ে দিই, যাতে ভয় করে চলে। বিদায়ীকে অস্তগামী সূর্য মনে করে। তুলোধুনো করে ছেড়ে দিই, যাতে স্থলাভিষিক্ত নবাগতরা ভয়ে ভয়ে নতজানু হয়ে কাজ করে। ফলে জাতি পায় সন্ত্রস্ত পদধারী একটি দুর্বল সংস্থা।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করে বিদায় নিচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা এবং তাঁর দুজন সহযোগী সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন এবং ছহুল হোসাইন। তাঁরা নিয়োগ পেয়েছিলেন বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তাঁরা কোনো দলীয় নিয়োগ পাননি। একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাঁদের খুঁজে নিয়েছিল।
তবে নিয়োগের এই পটভূমি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়া উচিত তাঁদের আচরণ, দক্ষতা, সাফল্য ও বিফলতা। দুঃখের বিষয়, যুক্তিযুক্ত মূল্যায়নের উদারতা অনেকেই দেখাতে পারছেন না। সরকারি দল কথা বললেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে যত যুক্তিপূর্ণ কথাই বলুক না কেন। সরকারি দল অবশ্য মনোভাব প্রকাশ করেনি। আর বিরোধী দলের প্রসঙ্গ টানাও বিব্রতকর। তারা তথ্য মানে না। যুক্তি বোঝে না। কী চায়, তাও বুঝি জানে না। জানে শুধু একটি শব্দ- 'না'। সব কিছুতেই তাদের 'না'। তাদের কাছে নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছরের কাজকর্মের নির্মোহ বিশ্লেষণ আশা করা যায় না।
বাকি থাকে আমজনতা এবং সুশীল সমাজ। সুশীল সমাজ দলীয় রঙে রঞ্জিত। হয় জাতীয়তাবাদী, না হয় আওয়ামী। তাঁদের কথাবার্তা, বিশ্লেষণ- সব কিছুই প্রায় পছন্দের দলের অভিরুচিমাফিক। সুশীল সমাজের কোনো স্বকীয়তা নেই। তাদের বিপরীতে নাগরিক সমাজ 'সুশীল' পরিচিতির চেয়ে নাগরিক পরিচিতিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এরা সুশীলদের চেয়ে অনেক বেশি স্বকীয়তা প্রদর্শন করে। নাগরিকরা কোনো দলকে সমর্থন করলেও দলের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় না। নাগরিক সমাজের কোনো ফোরাম নেই। লোকারণ্যে তাদের কথা শোনা যায়। আড্ডায় তাদের কথা শোনা যায়। গানের জলসায় তাদের কথা শোনা যায়। কবিতার আসরে তাদের কথা শোনা যায়। অপেক্ষাকৃত পরিচিত নাগরিকরা কখনো বা সংবাদপত্রে লিখে মতামত প্রকাশ করেন। টক শোতেও স্বল্পমাত্রায় তাদের সীমিত উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সুশীলরা যখন তারস্বরে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন, নাগরিকরা তখন মৃদুকণ্ঠে স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যুক্তি-তথ্য চয়ন ও বিশ্লেষণ করেন। লক্ষ করলেই বোঝা যায়, দুজন দুই প্রজাতির। সুশীলদের দলীয় মতামত নিয়ে পৃথক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কারণ সেগুলো দলীয় মতামত। তবে নাগরিক মতামত যেটুকু চয়ন করেছি, তাতে মনে হয়েছে, নাগরিক সমাজ বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের কাজকর্মে পজিটিভ ধারণা পোষণ করে। সাধারণ ভোটাররা বলেছেন যে- ক. তাঁরা নির্ভয়ে এবং নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছেন, খ. তাঁদের ভোট অন্যরা দিয়ে দেয়নি, গ. তাঁদের কেউ বল প্রয়োগ করেনি, ঘ. ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম বাদ যায়নি, ঙ. তালিকায় ভুয়া ভোটার প্রায় নেই, চ. বিজয়ী প্রার্থীর প্রতিহিংসা কম দৃষ্ট হয়েছে, ছ. ইভিএম সম্বন্ধে বিরোধী দল অহেতুক ভীতি ছড়ালেও এর ব্যবহার সহজ ও স্বচ্ছ।
এখন কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করা যাক। ২০০৭ সালে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর কতগুলো মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব তারা গ্রহণ করে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো নির্ভুল ভোটার তালিকা। এ লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় কমিশন নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করল। সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজটি তাঁরা সম্পন্ন করল। দক্ষতার অভাবে প্রকৃত ভোটার যেমন তালিকা থেকে বাদ যায়নি, তেমনি ভয় দেখিয়ে বা প্রভাবিত করে দলীয় ক্যাডাররা ভুয়া বা ভুতুড়ে ভোটারদের তালিকাভুক্ত করতে পারেনি। এই সাহসী সফলতার জন্য বিদায়ী কমিশন পঞ্চমুখ প্রশংসা পেতে পারে। এটুকু প্রশংসা যাঁরা করছেন না, তাঁরা কি তাহলে ভুয়া ভোটারদের প্রতিভূ? উল্লেখ্য, আগের ভোটার তালিকা থেকে প্রায় ১.৩০ কোটি ভোটার (?) বাদ পড়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছিল পাঁচ কোটির বেশি। বিএনপি পেয়েছিল ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.১৩ শতাংশ ভোট। সোয়া কোটি ভোটই যদি ভুয়া হয়ে থাকে, তাহলে ওই নির্বাচনের ফলাফল কী করে গ্রহণযোগ্য হয়? এ কারণেই কি ১.৩০ কোটি ভুয়া ভোটার বাদ পড়ায় কমিশনের ওপর খেপে গেছে চারদলীয় জোট? ভুয়া ভোটার বাদ যাওয়ায় অর্থাৎ ভূত তাড়ানোর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট পেয়েছিল ৫৫ শতাংশ, আর চারদলীয় জোট পেয়েছিল ৩৭ শতাংশ ভোট। বিএনপির গোসার কারণ কি এটাই?
বিগত নির্বাচন কমিশনের আরেকটি যুগান্তকারী কাজ ছিল, ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান। কমিশনের সঙ্গে কাজ করার জন্য সামরিক বাহিনী কৃতিত্বের দাবিদার। অতি অল্প সময়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্ভুলভাবে এই বিশাল কর্মটি সুসম্পন্ন করার জন্য দেশবাসী ও বিশ্ববাসী অভিনন্দন জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। দেশের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল দুর্মুখ দলীয় ব্যক্তি মুখ গোমড়া করে ছিল। কারণ তারা আর খেলা খেলতে পারবে না। কমিশনের এই অনন্য কর্মটির প্রশংসা যাঁরা করবেন না, তাঁরা গণতন্ত্রবিরোধী।
বিগত নির্বাচন কমিশনের আরো একটি প্রো-অ্যাকটিভ পদক্ষেপ ছিল নির্বাচনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (সংক্ষেপে ইভিএম) তাঁরা সফলতার সঙ্গে প্রবর্তন করেছেন। মাত্র সেদিনের কথা। বিরোধী দল নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্লজ্জের মতো প্রযুক্তির বিরোধিতা করেছে। ইভিএম ব্যবহৃত হলে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। সাধারণ ভোটারদের প্ররোচিত করেছে প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। নির্বাচনের পরিবেশকে তারা বিষিয়ে তুলেছিল। এমন হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতার মধ্যে বৈরী পরিবেশে নির্বাচন কমিশন যে সাহস, স্বচ্ছতা ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল, তা অভূতপূর্ব। ড. এ টি এম শামসুল হুদা সৎ ও সাহসী নেতৃত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন ইভিএমের ওপর জনগণের আস্থা অর্জনের প্রক্রিয়ায়। দ্বিধাদ্বন্দ্বে দোদুল্যমান ভোটাররা সেদিন ইভিএম ব্যবহার করে চমৎকৃত হয়েছিলেন। তাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে ইভিএম সহজ, স্বচ্ছ ও নির্ভুল। বিরোধী দলের মিথ্যা প্রচারণা ভেস্তে গিয়েছিল ভোটারদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়। মূর্খ বিরোধিতার মুখে কমিশন যে ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সঙ্গে ভোটারদের প্রতি আস্থা প্রদর্শন করেছিল, তা অভূতপূর্ব। একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার এ ধরনের সাহসিকতা ও সাফল্য একটি বিরল ঘটনা। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে।
এরপর ফিরে তাকাই নির্বাচন পরিচালনার দিকে। দীর্ঘ পাঁচ বছরে এই নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালে একটি সাধারণ নির্বাচন এবং পরবর্তী বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করেছে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে কমবেশি সাত কোটি মানুষ ভোট দিয়েছিল, যা মোট ভোটার সংখ্যার ৮৮ শতাংশের মতো। এত অধিক হারে এবং বেশিসংখ্যক ভোটার এর আগে আর কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে আসেনি। ভোটারদের এই অভূতপূর্ব আস্থা অর্জন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় অর্জন। ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ প্রায় ছিলই না। এত অধিক হারে ভোটারের উপস্থিতিতে কারচুপির সুযোগ থাকে না। নির্বাচন পরিচালনা ছিল স্বচ্ছ। পরিবেশ ছিল শান্তিমুখর। গোলযোগের তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনটি দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি অর্জন করেছিল।
নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লার সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচন দুটি দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। ইভিএম ব্যবহার নিয়ে প্রধান বিরোধী দল ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছিল এবং প্রবল বিরোধিতা করেছিল। নির্বাচন কমিশন গোয়ার্তুমি পরিহার করে দৃঢ়সংকল্প হয়ে স্বচ্ছভাবে ইভিএম ব্যবহার করে খোদ ভোটারদের ব্যাপক আস্থা অর্জন করেছিল। এ ছাড়া গোলযোগের হুমকি অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে দক্ষভাবে মোকাবিলা করে সফল হয়েছে নির্বাচন কমিশন। দুই স্থানেই সরকারি দলের প্রার্থী হেরে যায়। ফলে বিরোধী দল কর্তৃক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরকারের তাঁবেদারি করার অভিযোগ ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচন নিয়েও গ্রহণযোগ্য আপত্তি উত্থাপিত হয়নি। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক আমলে গঠিত হওয়ার পর থেকেই কমিশনকে বিরাট পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছিল। জনবল ছিল না, নিয়োগ দিতে হয়েছে। দক্ষতা ছিল না। প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। মনোবল ছিল না। দৃঢ় ও সহায়ক নেতৃত্বের দ্বারা মনোবল চাঙ্গা করতে হয়েছে। দুর্নীতির দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। একটি ঘুণে ধরা জীর্ণ অবয়ব ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সঠিক ও সবল নেতৃত্বের গুণে। আজকের নির্বাচন কমিশন অনেক আত্মপ্রত্যয়ী।
গত পাঁচ বছরে নির্বাচন কমিশনে মোটামুটি একটি বিপ্লব ঘটে গেছে। দক্ষতা অর্জন করেছে। মনোবল ফিরে পেয়েছে। পজিটিভ ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রত্যয় অর্জন করেছে। কৌশল শিখেছে। এগুলো 'অটোমেটিক' ঘটেনি। এর মূলে ছিল একটি যোগ্য নেতৃত্ব। সে নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন ড. এ টি এম শামসুল হুদা।
জাতি হিসেবে আমরা প্রশংসা-কৃপণ এবং নিন্দা-পটীয়সী। তাই বিদায়বেলায় কৃতিত্বের দাবিদার এই নির্বাচন কমিশন প্রাপ্য প্রশংসা তেমনটা পাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। বিরোধীরা খৰহস্ত হলেও বাকসংযম লক্ষণীয়। বর্তমান পরিবেশে এটাই বা মন্দ কী। বিদায়ের পর ধীরে ধীরে হয়তো অর্জনগুলো বারবার উচ্চারিত হবে, প্রশংসিত হবে। অত্যুজ্জ্বল সাফল্যের পর ড. হুদার যোগ্য উত্তরসূরিপ্রাপ্তি একটি সুকঠিন কাজ হবে। সময়েই সে কথা বলে দেবে।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর,
বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলামিস্ট
তবে নিয়োগের এই পটভূমি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়া উচিত তাঁদের আচরণ, দক্ষতা, সাফল্য ও বিফলতা। দুঃখের বিষয়, যুক্তিযুক্ত মূল্যায়নের উদারতা অনেকেই দেখাতে পারছেন না। সরকারি দল কথা বললেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে যত যুক্তিপূর্ণ কথাই বলুক না কেন। সরকারি দল অবশ্য মনোভাব প্রকাশ করেনি। আর বিরোধী দলের প্রসঙ্গ টানাও বিব্রতকর। তারা তথ্য মানে না। যুক্তি বোঝে না। কী চায়, তাও বুঝি জানে না। জানে শুধু একটি শব্দ- 'না'। সব কিছুতেই তাদের 'না'। তাদের কাছে নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছরের কাজকর্মের নির্মোহ বিশ্লেষণ আশা করা যায় না।
বাকি থাকে আমজনতা এবং সুশীল সমাজ। সুশীল সমাজ দলীয় রঙে রঞ্জিত। হয় জাতীয়তাবাদী, না হয় আওয়ামী। তাঁদের কথাবার্তা, বিশ্লেষণ- সব কিছুই প্রায় পছন্দের দলের অভিরুচিমাফিক। সুশীল সমাজের কোনো স্বকীয়তা নেই। তাদের বিপরীতে নাগরিক সমাজ 'সুশীল' পরিচিতির চেয়ে নাগরিক পরিচিতিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এরা সুশীলদের চেয়ে অনেক বেশি স্বকীয়তা প্রদর্শন করে। নাগরিকরা কোনো দলকে সমর্থন করলেও দলের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় না। নাগরিক সমাজের কোনো ফোরাম নেই। লোকারণ্যে তাদের কথা শোনা যায়। আড্ডায় তাদের কথা শোনা যায়। গানের জলসায় তাদের কথা শোনা যায়। কবিতার আসরে তাদের কথা শোনা যায়। অপেক্ষাকৃত পরিচিত নাগরিকরা কখনো বা সংবাদপত্রে লিখে মতামত প্রকাশ করেন। টক শোতেও স্বল্পমাত্রায় তাদের সীমিত উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সুশীলরা যখন তারস্বরে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন, নাগরিকরা তখন মৃদুকণ্ঠে স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যুক্তি-তথ্য চয়ন ও বিশ্লেষণ করেন। লক্ষ করলেই বোঝা যায়, দুজন দুই প্রজাতির। সুশীলদের দলীয় মতামত নিয়ে পৃথক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কারণ সেগুলো দলীয় মতামত। তবে নাগরিক মতামত যেটুকু চয়ন করেছি, তাতে মনে হয়েছে, নাগরিক সমাজ বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের কাজকর্মে পজিটিভ ধারণা পোষণ করে। সাধারণ ভোটাররা বলেছেন যে- ক. তাঁরা নির্ভয়ে এবং নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছেন, খ. তাঁদের ভোট অন্যরা দিয়ে দেয়নি, গ. তাঁদের কেউ বল প্রয়োগ করেনি, ঘ. ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম বাদ যায়নি, ঙ. তালিকায় ভুয়া ভোটার প্রায় নেই, চ. বিজয়ী প্রার্থীর প্রতিহিংসা কম দৃষ্ট হয়েছে, ছ. ইভিএম সম্বন্ধে বিরোধী দল অহেতুক ভীতি ছড়ালেও এর ব্যবহার সহজ ও স্বচ্ছ।
এখন কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করা যাক। ২০০৭ সালে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর কতগুলো মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব তারা গ্রহণ করে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো নির্ভুল ভোটার তালিকা। এ লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় কমিশন নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করল। সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজটি তাঁরা সম্পন্ন করল। দক্ষতার অভাবে প্রকৃত ভোটার যেমন তালিকা থেকে বাদ যায়নি, তেমনি ভয় দেখিয়ে বা প্রভাবিত করে দলীয় ক্যাডাররা ভুয়া বা ভুতুড়ে ভোটারদের তালিকাভুক্ত করতে পারেনি। এই সাহসী সফলতার জন্য বিদায়ী কমিশন পঞ্চমুখ প্রশংসা পেতে পারে। এটুকু প্রশংসা যাঁরা করছেন না, তাঁরা কি তাহলে ভুয়া ভোটারদের প্রতিভূ? উল্লেখ্য, আগের ভোটার তালিকা থেকে প্রায় ১.৩০ কোটি ভোটার (?) বাদ পড়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছিল পাঁচ কোটির বেশি। বিএনপি পেয়েছিল ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.১৩ শতাংশ ভোট। সোয়া কোটি ভোটই যদি ভুয়া হয়ে থাকে, তাহলে ওই নির্বাচনের ফলাফল কী করে গ্রহণযোগ্য হয়? এ কারণেই কি ১.৩০ কোটি ভুয়া ভোটার বাদ পড়ায় কমিশনের ওপর খেপে গেছে চারদলীয় জোট? ভুয়া ভোটার বাদ যাওয়ায় অর্থাৎ ভূত তাড়ানোর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট পেয়েছিল ৫৫ শতাংশ, আর চারদলীয় জোট পেয়েছিল ৩৭ শতাংশ ভোট। বিএনপির গোসার কারণ কি এটাই?
বিগত নির্বাচন কমিশনের আরেকটি যুগান্তকারী কাজ ছিল, ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান। কমিশনের সঙ্গে কাজ করার জন্য সামরিক বাহিনী কৃতিত্বের দাবিদার। অতি অল্প সময়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্ভুলভাবে এই বিশাল কর্মটি সুসম্পন্ন করার জন্য দেশবাসী ও বিশ্ববাসী অভিনন্দন জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। দেশের কিছু প্রতিক্রিয়াশীল দুর্মুখ দলীয় ব্যক্তি মুখ গোমড়া করে ছিল। কারণ তারা আর খেলা খেলতে পারবে না। কমিশনের এই অনন্য কর্মটির প্রশংসা যাঁরা করবেন না, তাঁরা গণতন্ত্রবিরোধী।
বিগত নির্বাচন কমিশনের আরো একটি প্রো-অ্যাকটিভ পদক্ষেপ ছিল নির্বাচনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (সংক্ষেপে ইভিএম) তাঁরা সফলতার সঙ্গে প্রবর্তন করেছেন। মাত্র সেদিনের কথা। বিরোধী দল নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্লজ্জের মতো প্রযুক্তির বিরোধিতা করেছে। ইভিএম ব্যবহৃত হলে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। সাধারণ ভোটারদের প্ররোচিত করেছে প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। নির্বাচনের পরিবেশকে তারা বিষিয়ে তুলেছিল। এমন হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতার মধ্যে বৈরী পরিবেশে নির্বাচন কমিশন যে সাহস, স্বচ্ছতা ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল, তা অভূতপূর্ব। ড. এ টি এম শামসুল হুদা সৎ ও সাহসী নেতৃত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন ইভিএমের ওপর জনগণের আস্থা অর্জনের প্রক্রিয়ায়। দ্বিধাদ্বন্দ্বে দোদুল্যমান ভোটাররা সেদিন ইভিএম ব্যবহার করে চমৎকৃত হয়েছিলেন। তাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে ইভিএম সহজ, স্বচ্ছ ও নির্ভুল। বিরোধী দলের মিথ্যা প্রচারণা ভেস্তে গিয়েছিল ভোটারদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়। মূর্খ বিরোধিতার মুখে কমিশন যে ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সঙ্গে ভোটারদের প্রতি আস্থা প্রদর্শন করেছিল, তা অভূতপূর্ব। একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার এ ধরনের সাহসিকতা ও সাফল্য একটি বিরল ঘটনা। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে।
এরপর ফিরে তাকাই নির্বাচন পরিচালনার দিকে। দীর্ঘ পাঁচ বছরে এই নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালে একটি সাধারণ নির্বাচন এবং পরবর্তী বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করেছে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে কমবেশি সাত কোটি মানুষ ভোট দিয়েছিল, যা মোট ভোটার সংখ্যার ৮৮ শতাংশের মতো। এত অধিক হারে এবং বেশিসংখ্যক ভোটার এর আগে আর কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে আসেনি। ভোটারদের এই অভূতপূর্ব আস্থা অর্জন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় অর্জন। ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ প্রায় ছিলই না। এত অধিক হারে ভোটারের উপস্থিতিতে কারচুপির সুযোগ থাকে না। নির্বাচন পরিচালনা ছিল স্বচ্ছ। পরিবেশ ছিল শান্তিমুখর। গোলযোগের তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনটি দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি অর্জন করেছিল।
নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লার সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচন দুটি দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। ইভিএম ব্যবহার নিয়ে প্রধান বিরোধী দল ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছিল এবং প্রবল বিরোধিতা করেছিল। নির্বাচন কমিশন গোয়ার্তুমি পরিহার করে দৃঢ়সংকল্প হয়ে স্বচ্ছভাবে ইভিএম ব্যবহার করে খোদ ভোটারদের ব্যাপক আস্থা অর্জন করেছিল। এ ছাড়া গোলযোগের হুমকি অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে দক্ষভাবে মোকাবিলা করে সফল হয়েছে নির্বাচন কমিশন। দুই স্থানেই সরকারি দলের প্রার্থী হেরে যায়। ফলে বিরোধী দল কর্তৃক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরকারের তাঁবেদারি করার অভিযোগ ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচন নিয়েও গ্রহণযোগ্য আপত্তি উত্থাপিত হয়নি। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক আমলে গঠিত হওয়ার পর থেকেই কমিশনকে বিরাট পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছিল। জনবল ছিল না, নিয়োগ দিতে হয়েছে। দক্ষতা ছিল না। প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। মনোবল ছিল না। দৃঢ় ও সহায়ক নেতৃত্বের দ্বারা মনোবল চাঙ্গা করতে হয়েছে। দুর্নীতির দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। একটি ঘুণে ধরা জীর্ণ অবয়ব ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সঠিক ও সবল নেতৃত্বের গুণে। আজকের নির্বাচন কমিশন অনেক আত্মপ্রত্যয়ী।
গত পাঁচ বছরে নির্বাচন কমিশনে মোটামুটি একটি বিপ্লব ঘটে গেছে। দক্ষতা অর্জন করেছে। মনোবল ফিরে পেয়েছে। পজিটিভ ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রত্যয় অর্জন করেছে। কৌশল শিখেছে। এগুলো 'অটোমেটিক' ঘটেনি। এর মূলে ছিল একটি যোগ্য নেতৃত্ব। সে নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন ড. এ টি এম শামসুল হুদা।
জাতি হিসেবে আমরা প্রশংসা-কৃপণ এবং নিন্দা-পটীয়সী। তাই বিদায়বেলায় কৃতিত্বের দাবিদার এই নির্বাচন কমিশন প্রাপ্য প্রশংসা তেমনটা পাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। বিরোধীরা খৰহস্ত হলেও বাকসংযম লক্ষণীয়। বর্তমান পরিবেশে এটাই বা মন্দ কী। বিদায়ের পর ধীরে ধীরে হয়তো অর্জনগুলো বারবার উচ্চারিত হবে, প্রশংসিত হবে। অত্যুজ্জ্বল সাফল্যের পর ড. হুদার যোগ্য উত্তরসূরিপ্রাপ্তি একটি সুকঠিন কাজ হবে। সময়েই সে কথা বলে দেবে।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর,
বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলামিস্ট
No comments