আইন ও সংবিধান-অস্বচ্ছ নিয়োগে প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠু থাকে না by শাহ্দীন মালিক

ছয়জন নতুন অতিরিক্ত বিচারপতির নামসংবলিত সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। প্রস্তাবিত ছয়জন নতুন অতিরিক্ত বিচারপতির নাম জানা গেছে। প্রধান বিচারপতি এখনো তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করাননি। যেদিন শপথ হবে, তখন থেকেই তাঁরা অতিরিক্ত বিচারপতি পদে নিয়োজিত হবেন।


শপথে দেরি হওয়ায় কোর্টপাড়ায় বেজায় গুজব—আরও বেশ কিছুসংখ্যক অতিরিক্ত বিচারপতিকে নিয়ে একসঙ্গে জনা পনেরো না হলেও অন্তত নতুন ১০ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ করা হবে। লোকমুখে শুনেছি, দু-একটা পত্রপত্রিকাও এ ধরনের খবর ছেপেছে।
নতুন প্রস্তাবিত ছয়জন অতিরিক্ত বিচারপতির নাম প্রকাশিত হওয়ার পর বিএনপি-সমর্থিত সুপ্রিম কোর্ট বার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তবে তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বর্তমান সরকার-সমর্থক আইনজীবীদের অসন্তোষ (‘বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে নেতাদের অসন্তোষ’—প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর দ্বিতীয় পৃষ্ঠা)। সংবাদমাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগের সংবাদে কেউ পুলকিত হয়েছেন বলে চোখে পড়েনি।

২.
অধমের লেখালেখির সুবাদেই সম্ভবত গত কয়েক দিনে বেশ কিছু আইনজীবী বন্ধু এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করেছেন, সবার মধ্যেই হতাশার সুর। অধমের প্রতি সবারই বন্ধুসুলভ উপদেশ—লেখালেখি করে আর কী হবে!
আমরা যাঁরা মামুলি আইনজীবী, নিয়োগ তো আর আমাদের এখতিয়ারে নেই। কিন্তু নেই বলে তো আর যে প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে আমাদের জীবন, সে প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল কামনা এবং ফল হোক না হোক মঙ্গলের চেষ্টা করা সবারই সহজাত প্রবৃত্তি। সে তাগিদেই চেষ্টা।
দুটি ব্যাপার এখন প্রায় সর্বজনস্বীকৃত। প্রথমত, গত কমবেশি এক যুগের প্রায় সব নিয়োগই রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত। আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপিপন্থী আইনজীবী আর বিএনপির আমলে আওয়ামী আইনজীবী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাননি বললেই চলে। দু-চারটি যে ব্যতিক্রম নেই তা নয়, তবে সে সংখ্যা নগণ্য এবং ক্রমশ বিলুপ্তপ্রায়। দ্বিতীয়ত, নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিদের অনেকেরই যোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়। এটা অনস্বীকার্য যে, যোগ্যতা বা দক্ষতার কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। তা সত্ত্বেও অভিজ্ঞতার স্বল্পতা, বয়সের ঘাটতি, অতীতে পাবলিক পরীক্ষায় সাফল্য, ভাষার দখল ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশ কিছু নেতিবাচক রিপোর্ট, মন্তব্য বা বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে।
যোগ্যতা-দক্ষতার নির্ভুল পরিমাপ, আগেই উল্লিখিত, অসম্ভবপ্রায়। তা সত্ত্বেও ওকালতি অনেকটা নাটকের মতো আমরা করি জনসমক্ষে, অর্থাৎ আমাদের পেশায় নিয়োজিত অন্য সহকর্মীদের সামনে।
যখন একটা মামলায় মক্কেলের পক্ষে কথা বলতে দাঁড়াই, তখন কোর্টরুমে মাননীয় বিচারপতিরা ছাড়া বহুসংখ্যক বিজ্ঞ আইনজীবী উপস্থিত থাকেন। একটু পরই তাঁদের মামলায় ডাক পড়বে, তাই অপেক্ষা করছেন। অনেক ক্ষেত্রে নতুন বা কনিষ্ঠ আইনজীবী কোর্টে বসে মামলা শুনে শেখার চেষ্টা করেন। সেই জন্যও ভিড়। আর আজকাল প্রায় সব কোর্টেই পেছনের সারিতে কিছু কিছু মক্কেলও উপস্থিত থাকেন। কিছু কিছু কোর্টে গরম গরম খবরের তল্লাশি সাংবাদিকদের উৎসাহের জন্য কোর্টরুমে প্রবেশ করাই দুরূহ।
মোদ্দাকথা, আমাদের ওকালতি কমবেশি জনসমক্ষে। এতে আমরা প্রতিনিয়ত একধরনের পাবলিক মূল্যায়নের সম্মুখীন হই। মহামান্য আদালতের সামনে যখন দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সবাই দেখছে-বুঝছে-শুনছে। আইনি এলেম কতটুকু, তা অকপটে জাহির হচ্ছে, সবাই টের পাচ্ছে।
এভাবে একটা পাবলিক পারফরম্যান্সের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন হচ্ছে। কার দক্ষতা, যোগ্যতা, ইংরেজির বিদ্যা কতটুকু, তা গোপন থাকার বা রাখার উপায় নেই। ব্যক্তিবিশেষে মূল্যায়নে কিছুটা হেরফের হতেই পারে। কিন্তু একজনে ৮০ নম্বর দিলে অন্যজন ৭০ বা ৬০ দিতে পারে, কিন্তু ২০ তো আর দেবে না।
আর তাই সিনিয়ররা যখন মন্তব্য করেন, ওকে তো কোর্টেই দেখিনি, তখন নিশ্চয় বুঝতে হবে, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।


প্রথম আলোর ১২ অক্টোবরের ‘বিচারক নিয়োগে অস্বচ্ছতা’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে ‘১০ বিচারপতি’ মামলা রায়ের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।
গত কয়েক বছরে বিচারক নিয়োগ-সংক্রান্ত তিনটি বড় মামলা হয়েছে। মাসদার হোসেন মামলা নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের রায়ের পর যখন সরকারি কর্মকমিশন বিচারক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করল, তখন প্রথম মামলা হলো। মামলায় দাবি ছিল, সরকারি কর্মকমিশন অন্যান্য সরকারি চাকুরেদের মতো অধস্তন আদালতের নিয়োগসংক্রান্ত কোনো পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা আর নিতে পারবেন না। কারণ বিচার বিভাগ এখন পৃথক। প্রায় বছর পাঁচেক অধস্তন আদালতের বিচারক অর্থাৎ সহকারী বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। শেষতক অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য নতুন কমিশন অর্থাৎ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠিত হলো। বিচারপতি ও জেলা আদালতের বিচারকেরা এই কমিশনের হর্তাকর্তা আর তাঁরাই নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে এখন সহকারী বিচারক নিয়োগের জন্য বাছাই করেন।
অর্থাৎ বিচার বিভাগ আলাদা ও পৃথক। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সুউচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের জন্য একটা আইন, অর্থাৎ অধ্যাদেশ জারি হয়। এই অধ্যাদেশ চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়। কারণ অধ্যাদেশে বিচারপতি বাছাই কমিটিতে কিছু অবাঞ্ছিত ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া প্রক্রিয়ায়ও গলদ ছিল। হাইকোর্ট একটি রায়ে অধ্যাদেশটি অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন।
তৃতীয় মামলাটি ‘১০ বিচারপতি’ নিয়োগের মামলা। এই মামলার রায়ে নিয়োগের জন্য বিচারপতি বাছাই-প্রক্রিয়া সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর অন্তত বিচারপতি নিয়োগে যে স্বচ্ছতা আসবে বলে সবাই আশা করেছিল, সে আশা গত এক যুগ ধরে শুধু অপূর্ণই থাকেনি বরং নিয়োগ-প্রক্রিয়া আরও কলুষিত হয়েছে, দলীয়করণ বেড়েছে, যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্নগুলো আরও তীক্ষ হয়েছে।
আর বেশির ভাগ আইনজীবীই এখন হাল ছেড়ে দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু বিচারপতি নিয়োগে এই অস্বচ্ছতা চলতে দেওয়া যায় না।
সুপ্রিম কোর্টের রায় আর পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংশোধিত সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের কারণ, বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া যাতে স্বচ্ছ হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির।
১০ বিচারপতির মামলার রায়ে যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিচারপতি নিয়োগের জন্য প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষে তাঁর মতামত লিপিবদ্ধ করবেন।
১০ বিচারপতি মামলায় আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে যে আইন বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তার সম্পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে পঞ্চদশ সংশোধনীতে।
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতির নিয়োগ দান করবেন। অর্থাৎ নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় প্রধান বিচারপতির কোনো ভূমিকার উল্লেখ ছিল। এখন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যম এই ৯৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়েছে,
‘...প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারপতিকে নিয়োগ দান করিবেন।’
পঞ্চদশ সংশোধনীর গুটি কয়েক ভালো দিকের এটি একটা। অর্থাৎ বিচারপতি নিয়োগে সংবিধান এবং রায়—এই দুই ধরনের শক্তির বলে প্রধান বিচারপতির ভূমিকা ও দায়িত্ব অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

৪.
স্পষ্টত এই দায়িত্ব পালন নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনামূলক প্রশ্ন উঠেছে।
এটা দৃশ্যমান যে রায়ের মর্মবাণী অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ও আইনজীবীদের খোলামেলা ও গঠনমূলক আলোচনা হচ্ছে না। কারণ, আলোচনা হলে নতুন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগে আওয়ামী ঘরানার আইনজীবী নয়, এমন দু-চারজন নিশ্চয় নিয়োগ পেতেন।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগদানের জন্য লিখিতভাবে কী সুপারিশ করেছেন, তা জানার আইনগত অধিকার আমাদের সম্ভবত এখনো নেই। তবে বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এটা জানার অধিকার স্বীকৃত। জানার অধিকার থাকলে আমরা আগেভাগে জেনে নিশ্চিত হতাম যে প্রধান বিচারপতি যাঁদের নাম প্রস্তাব করেছেন, তাঁদের সবার অন্তত ২০ বছরের আইন পেশায় সক্রিয় অভিজ্ঞতা আছে, বেশ কয়েকটি বড় মামলার আইনজীবী ছিলেন, শিক্ষাজীবনে কখনো থার্ডক্লাস পাননি এবং ন্যূনতম মাস্টার্স ডিগ্রি আছে, পেশা জীবনের সাফল্যের কারণে আর্থিকভাবে সচ্ছল, বয়স অন্তত ৫০ বছর ইত্যাদি।
সাংবিধানিক অন্য পদের তুলনায় বিচারপতিরা একটি ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে আইন প্রণীত হয়, অর্থাৎ রায়ে আইনের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, সেটা আইনসম, আমরা সবাই মানতে বাধ্য।
সংসদ যে আইন পাস করে, সেটা আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়, মন্ত্রিসভায় আলোচনা হয়, সংশ্লিষ্ট অনেক পক্ষ প্রাথমিক পর্যায়ে মতামত দেয়। তারপর সংসদে। সংসদীয় কমিটি এত কিছু করে তবেই আইন। সে জায়গায় সুপ্রিম কোর্ট রায়ে যা বলবেন, সেটাই আইন। তা ছাড়া সংসদে পাস করা যেকোনো আইনও বাতিল করতে পারেন। এমনকি সংবিধান সংশোধনীও। সরকারের ভূরি ভূরি নির্বাহী সিদ্ধান্ত প্রতিদিন বাতিল করছেন বিচারপতিরা।
আর তাঁদের নিয়োগ চূড়ান্ত হচ্ছে বলতে গেলে রাতের অন্ধকারে চুপিসারে। কাকে কেন কোন বিচারে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা হবে না, কেউ জানতে পারবে না আর এটা একজন বা দুজন ব্যক্তির একচ্ছত্র ক্ষমতা—আইনের শাসনের দেশে এটা আর হতে পারে না। বিশেষত, এই ব্যবস্থার সবাই যখন সমালোচনা করছে। সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতির সংখ্যা প্রায় ৯০। নতুন নিয়োগে দু-চার মাস দেরি হলে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। অশুদ্ধ হবে বিচারপতি নিয়োগসংক্রান্ত আইন পাস না করে অল্প কিছু লোকের ইচ্ছামতো, দলীয় বিবেচনায় এবং যে নিয়োগে প্রধান বিচারপতিসহ বিচারসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সবার সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাব করার কথা সেভাবে না হলে।
অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে চালানো যায় না বা চলে না।
আমাদের সুপ্রিম কোর্ট যদি সুষ্ঠুভাবে না চলে, তাহলে আমাদের আর দেশের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে?
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.