দুই দু’গুণে পাঁচ-সশস্ত্র বাহিনী সমাচার by আতাউর রহমান

গল্প আছে: বাঙালি-তনয় জেনারেল জে এন চৌধুরী যখন ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ তথা সেনাধ্যক্ষ, তখন তিনি একবার তাঁর সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ইউনিটে বেশ কিছু বাঙালি সৈন্যও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তো ইউনিটের সিও তথা কমান্ডিং অফিসার একপর্যায়ে বলে বসলেন, ‘স্যার, বাঙালিরা তাদের মেজাজগত কারণে ভালো সৈনিক হতে পারে না।


’ জেনারেল চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে স্মিতহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আপনি যথার্থই বলেছেন, ওরা কেবল ভালো জেনারেলই হয়।’
তা ভালো জেনারেল হতে হলে ভালো সৈনিকও হতে হয় বৈকি এবং প্রথম আলোয় দীর্ঘদিন যাবৎ ‘তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না’ শীর্ষক কলামে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনি এটাই প্রমাণ করে, বাঙালিরা উপযুক্ত প্রেরণা পেলে ভালো সৈনিক হতে পারে বটে। আর এই পরিদর্শন-সংক্রান্ত গল্পও আছে—এক জেনারেল বলেছিলেন, তিনি ভোর পাঁচটায় ইউনিট পরিদর্শনে যাবেন। সেটা চেইন-অব-কমান্ড অনুসারে নিম্নমুখী হয়ে ব্রিগেডিয়ার, কর্নেল, মেজর থেকে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত পৌঁছাতে গিয়ে প্রত্যেকে অতিরিক্ত সতর্কতাবশত আধা ঘণ্টা করে মার্জিন রেখে অধস্তনকে বলায় শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, রাত তিনটার সময় আর্মির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে জেনারেল সাহেবের বাসভবনে গিয়ে হাজির।
সে যা হোক। সেনাবাহিনী সম্পর্কে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনানায়ক সম্রাট নেপোলিয়ন, যিনি লম্বায় ছিলেন মাত্র পাঁচ ফুট আড়াই ইঞ্চি, দুটি সুন্দর কথা বলেছেন—এক. সর্বোত্তম জেনারেল হচ্ছেন তিনি, যিনি সবচেয়ে কম ভুল করেন। দুই. সৈনিকরাই সাধারণত যুদ্ধ জয় করেন আর জেনারেলরা তজ্জন্য বাহবা পেয়ে থাকেন। তা, এ সম্পর্কেও একটা মজার গল্প আছে—একজন সৈনিক একবার একটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর সপক্ষের একজন তাঁকে থামিয়ে দিয়ে ওখানে তিনি কী করছেন জিজ্ঞেস করলেন। সৈনিকটি সম্পূর্ণ নিরুত্তর রইলে তিনি বললেন, ‘তুমি জানো, আমি কে? আমি হচ্ছি একজন জেনারেল।’ ‘ও গড,’ সৈনিকটি সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘আমি এতটা পেছনে চলে এসেছি!’ বলা বাহুল্য, যুদ্ধক্ষেত্রে আর্মি অফিসাররা সচরাচর পেছনেই থাকেন এবং তখন তাঁদের উর্দিতে কোনো র‌্যাংকও থাকে না।
প্রসঙ্গত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নাকি একজন জেনারেল একাকী একটি ফ্রন্ট লাইন দেখতে চাইলে তাঁকে ঘুরিয়ে দেখাতে জনৈক জিপচালক সৈনিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পর সৈনিকটি জেনারেলের উদ্দেশে ফিসফিস করে বললেন, ‘বাঁয়ে শত্রুপক্ষের শেলের আঘাতের চিহ্ন।’ জেনারেল মাথা নাড়লেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আবার ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘ডানে শত্রুপক্ষের পরিত্যক্ত পরিখা।’ জেনারেলও ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘আমি ওগুলো দেখতে পাচ্ছি।’ আরও কিছুক্ষণ এভাবে জিপ চলার পর জেনারেল ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘চারদিক নিস্তব্ধ দেখছি। ফ্রন্টলাইন থেকে আমরা আর কত দূরে আছি?’ ‘প্রায় দুই মাইল’, জবাব এল। এবার জেনারেল উষ্মার ভাব দেখিয়ে বললেন, ‘তাহলে আমরা ফিসফিস করে কথা বলছি কেন?’ সৈনিকটি তখন জবাব দিলেন, ‘আমি তো ফিসফিস করছি না, স্যার। ঠান্ডায় আমার গলাটা বসে গেছে। আপনার ফিসফিস করার প্রয়োজন নেই।’
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন বলে গেছেন, ‘শৃঙ্খলা হচ্ছে সেনাবাহিনীর আত্মা। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, ঢাকায় গাড়ি চালিয়ে জাহাঙ্গীর গেট অতিক্রম করে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করলেই এই শৃঙ্খলাবোধের বেশ খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। এ-সংক্রান্ত বিদেশি মজার গল্পটি—একজন ব্রিটিশ ও একজন আমেরিকান আর্মি অফিসারের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল, কোন আর্মিতে শৃঙ্খলাবোধ বেশি? আমেরিকান অফিসারটির কথার মাঝখানেই এক সৈনিক হঠাৎ এসে বললেন, ‘ক্যাপ, আমি কি আপনার জিপটা রাতের জন্য নিতে পারি? আমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াব।’ অফিসারটির সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিয়ে ব্রিটিশ অফিসারের দিকে ফিরে বললেন, ‘এটাতেই আমাদের শৃঙ্খলার প্রমাণ নিহিত। ওর আমাকে জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।’
বাদ রইল নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রসঙ্গ। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের ভারপ্রাপ্ত অফিসার সবার অলক্ষ্যে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছিলেন। একজন নৌসেনা হঠাৎ দেখতে পেয়ে অনেক কষ্টে তাঁকে বাঁচালেন। তিনি বেঁচে উঠে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘তোমাকে আমি প্রকাশ্যে পুরস্কৃত করব।’ তিনি হাত জোড় করে বলতে লাগলেন, ‘ব্যাপারটা গোপনই থাক, স্যার। আমি আপনাকে বাঁচিয়েছি এটা অন্যরা জানতে পারলে আমাকে পানিতে চুবিয়ে মারবে।’
উল্লেখ্য, নৌবাহিনীতে লিখিত অনুমতি ছাড়া দাড়ি রাখার নিয়ম নেই। এদিকে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষক নতুন রিক্রুটদের উড়োজাহাজ থেকে জরুরি অবস্থায় প্যারাসুটসহ লাফ দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর মহড়া দিচ্ছিলেন। একজন প্রশিক্ষণার্থী তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, আমি প্যারাসুটসহ উড়োজাহাজ থেকে লাফ দিলাম; অতঃপর নির্দিষ্ট বোতাম চাপলেও প্যারাসুট খুলল না। তখন আমাকে কী করতে হবে?’ ‘ফেরত নিয়ে এসো’, প্রশিক্ষক বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে জবাব দিলেন, ‘তোমাকে তৎপরিবর্তে আরেকটা দিয়ে দেব।’
তা সশস্ত্র বাহিনীতে এ রকম কত মজার ঘটনাই না ঘটে থাকে! এই যেমন—একজন সৈনিককে তাঁর কমান্ডিং অফিসার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কি বলতে পারো, পূর্ণ মিলিটারি মর্যাদায় সমাহিত হতে হলে একজন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যকে কী করতে হবে?’
‘তাঁকে মরতে হবে, স্যার’, ঝটপট জবাব এল।
আরেকবার সরাসরি কমিশনপ্রাপ্ত এক কর্নেল ও প্রমোশনপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সাহেব একসঙ্গে আর্মি ব্যারাক পরিদর্শনকালে সৈনিকদের স্যালুটের জবাবে ক্যাপ্টেন বারবার বলছিলেন, ‘সেইম টু ইউ, সেইম টু ইউ’। কর্নেল সাহেব এটা লক্ষ করে কৌতূহলবশত কারণ জিজ্ঞেস করতেই ক্যাপ্টেন সহাস্যে বলে উঠলেন, ‘স্যার, আমি একসময় সাধারণ সৈনিক ছিলাম এবং আমি জানি ওরা মনে মনে কী ভাবছে।’
আর হ্যাঁ, আমি যখন পোস্টমাস্টার-জেনারেল ছিলাম, তখন পুরোনো সহপাঠী ও বন্ধুবান্ধব ঠাট্টা করে বলত, ‘বাংলাদেশে খুব কমসংখ্যক জেনারেল আছেন, তুমি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।’ আমি মুচকি হেসে বলতাম, ‘অবশ্যই।’ কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে ও রকম, নেমপ্লেটে লেখা আছে এমবিবিএস ডাক্তার, তবে ব্র্যাকেটে হোমিও।
পুনশ্চ: পাকিস্তান আমলে তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক জাস্টিস কায়ানি—মালিক রুস্তম কায়ানি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, তির্যক কথার জন্য খুব বিখ্যাত। তো তিনি একবার বলেছিলেন, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা যখন পর দেশ জয় করতে পারে না, তখন নিজের দেশ জয় করে ফেলে। পাকিস্তানে সেটা অহরহই ঘটেছে ও ঘটছে।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.