গণতন্ত্রের জন্য অনশন by লুৎফর রহমান রনো
একটি প্রশ্ন খুব সাদামাটা_কেন ওনারা ক্ষমতায় যেতে চান? নিশ্চয়ই গরিব দেশের দুস্থ মানুষের খেদমত করার 'নিঃস্বার্থ' মানবিক প্রেরণাই তাঁদের উদ্বুদ্ধ করে। তাই তাঁরা সাধারণ মানুষ নন, মহান, দেশ ও দশের তথা মানুষের সেবায় জীবনটাকে বিরামহীন সংগ্রামে সঁপে দিয়েছেন। আর এ সেবার প্রাথমিক শর্ত হলো গণতন্ত্র।
তাই তো আমাদের বিরোধীদলীয় নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ দেশের 'ভবিষ্যৎ কর্ণধার', তরুণ নেতা তারেক রহমানের মা গণ-অনশনের মঞ্চে দুর্বার আন্দোলনের আহ্বান করেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। গণতন্ত্র এখন পুলিশের বুটের নিচে পিষ্ট হচ্ছে বলে তিনি মর্মাহত। বলেছেন, "পাঁচ-পাঁচবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুককে 'সামান্য পুলিশ' স্যালুট দেওয়ার কথা...।" এসব সম্পূর্ণ সত্য উচ্চারণ। কারণ গণতন্ত্র কী এবং তার চর্চা কিভাবে করতে হয়, তা-ও মহাজোট সরকার নিকট-অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারত। কিন্তু তা না করে তারা তাদের মতো গণতন্ত্রের ঘোড়া চাবকে চলেছে। বিরোধীদলীয় নেতার খেদোক্তি যথাযথ। ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর পাঁচ বছরের যে গণতন্ত্র চর্চার আদর্শ তৈরি করে রেখেছে জোট সরকার, তা অনুসরণ না করাই মহাজোটের মহাভুল? হয়তোবা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আরো যথার্থ যে কথাটি তা হলো, তাঁরা ক্ষমতায় গেলে সংশোধিত সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেবেন। তত্ত্বগতভাবে একেবারে নির্ভুল কথা। কারণ তাঁর দল, দলের প্রতিষ্ঠাতা এর আগেও একাধিকবার সংবিধান সংশোধন করেছেন, কিন্তু ফলাফল শূন্য। কেউ সাংবিধানিক আদর্শ চরিত্র বজায় রাখে না। এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বলতেই পারেন, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেবেন। তা ছাড়া সংবিধান ছুড়ে দিয়ে বা সংবিধান অমান্য করেই তো মূলত বিএনপি নামের দলের আত্মপ্রকাশ। তা না হলে 'সর্বগ্রাসী' বাকশাল থেকে দেশকে উদ্ধার করত কে? আর এখনো শেখ হাসিনা বাকশাল কায়েম করতে চান ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে। এটা তো সবচেয়ে বেশি জানে, যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াত ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তাই আমরা দেখেছি, ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর গণতন্ত্রের কী চমৎকার সাংবিধানিক সরকার ও সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নজিরবিহীন নমুনা।
গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সেই অধিকারবলে প্রথমেই আঘাত আসে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর। তাঁদের মতে, বাঙালি সংস্কৃতিতে মুসলমানি কিছু নেই_সবই হিন্দুয়ানি, আর যেহেতু আল্লাহর নাম নিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানানোরই একটি শুভ-সুপরিকল্পনা, তাই ফরজ হয়ে উঠেছিল উদীচী আয়োজিত সাংস্কৃতিক মঞ্চে বোমা হামলা, তারপর মহানগরের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র রমনা বটমূলে বোমাঘাত করাও জরুরি ছিল এবং তা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নিরঙ্কুশ 'গণতন্ত্র' কায়েম করেছিল জোট সরকার। ক্ষমতা যুগ যুগ ধরে নিষ্কণ্টকভাবে কুক্ষিগত করতে হলে একটি ভূখণ্ডের মানুষের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হয়। তারপর বিদ্বান, বিজ্ঞান, তারপর সত্যিকার জননেতাদের রাজনীতির মঞ্চ থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে হয়। অবশেষে প্রয়োজনে অচেতন জনগোষ্ঠীকে আফগানি বোরকা পরিয়ে দিয়ে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন রেখে শাসন-শোষণ চিরস্থায়ী করা সহজ হয়। সেই নীলনকশা অনুসারে হুমায়ুন আজাদকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আরো কিছু বুদ্ধিজীবীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। অবশ্য জোট সরকারের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে একাত্তরের পুরোটাই রয়েছে তো, তাই তারা ভেবেছিল বিষয়টি সহজ। এই ধারাবাহিকতায় অসাধারণ জনপ্রিয় নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার ও পরে জননেতা ও আপাদমস্তক নির্লোভ ভালো মানুষ সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। এমন অনেক ছিলেন তালিকায়। যে তালিকা তৈরি হয়েছিল ছায়া সরকারের কুখ্যাত হাওয়া ভবনে। মহাজোট সরকার গণতন্ত্রকে এমন একটি কার্যকরী ধারায় পরিচালিত করতে পারছে না। পথে খামাখা ধরে পেটাল দশাসই নেতা জয়নুল আবদিনকে। জোট সরকার 'সামান্য পুলিশ' দিয়ে নাসিম, সাবের হোসেন ও মতিয়া চৌধুরীকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক ঠেঙ্গিয়েছিল। এসবই তো গণতন্ত্রের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে তারেক-কোকো হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন। আর বর্তমান সরকার সেই 'জনগণের সরকার ও দলকে' পাত্তা দিচ্ছে না। অর্থপাচারের অভিযোগ এনে শাহজাদাদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর যারা জনগণের নিঃস্বার্থ সেবা করে গেল সরাসরি হাওয়া ভবন থেকে, তাদের হেনস্তা করছে মহাজোট সরকার। এমন কিছু যে এরা করবে, তা দূরদর্শী জামায়াত-বিএনপির নেতারা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁরা সংগোপনে জঙ্গিদের কাজে লাগালেন। কারণ জঙ্গিরাও সমমনা_তাদেরও লক্ষ্য পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানানো বাংলাদেশকে। এরই ধারাবাহিকতায় এল ইতিহাসের কলঙ্কিত দিন, তথাকথিত গণতন্ত্রের ধারক-পালক সরকারের লক্ষ্যস্থির হলো আওয়ামী লীগকে এ মাটি থেকে বিদায় করে দিতে।
এই যে এত সব করা হলো, সবই তো ১৫ কোটি মানুষের মুক্তির জন্য। সংবিধানে কী আছে বা না আছে, তা বিবেচনায় নিয়ে জোট সরকার দেশ শাসন করলে আগে উলি্লখিত নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটতে পারত? না পারত না। তাই সুহৃদ পাঠক, গণ-অনশন থেকে উচ্চারিত গণ-আন্দোলনের ডাকে জনগণ পুনরুজ্জীবিত হবে_এমন আশা করা যায়? আমি আশা করি না; কিন্তু আশঙ্কা করি, জনগণের একাংশ দেশ ও মানুষের জন্য নয়, দলের জন্য ২০০১-এর গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে চাইবে।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আরো যথার্থ যে কথাটি তা হলো, তাঁরা ক্ষমতায় গেলে সংশোধিত সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেবেন। তত্ত্বগতভাবে একেবারে নির্ভুল কথা। কারণ তাঁর দল, দলের প্রতিষ্ঠাতা এর আগেও একাধিকবার সংবিধান সংশোধন করেছেন, কিন্তু ফলাফল শূন্য। কেউ সাংবিধানিক আদর্শ চরিত্র বজায় রাখে না। এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বলতেই পারেন, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেবেন। তা ছাড়া সংবিধান ছুড়ে দিয়ে বা সংবিধান অমান্য করেই তো মূলত বিএনপি নামের দলের আত্মপ্রকাশ। তা না হলে 'সর্বগ্রাসী' বাকশাল থেকে দেশকে উদ্ধার করত কে? আর এখনো শেখ হাসিনা বাকশাল কায়েম করতে চান ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে। এটা তো সবচেয়ে বেশি জানে, যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াত ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তাই আমরা দেখেছি, ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর গণতন্ত্রের কী চমৎকার সাংবিধানিক সরকার ও সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নজিরবিহীন নমুনা।
গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সেই অধিকারবলে প্রথমেই আঘাত আসে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর। তাঁদের মতে, বাঙালি সংস্কৃতিতে মুসলমানি কিছু নেই_সবই হিন্দুয়ানি, আর যেহেতু আল্লাহর নাম নিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানানোরই একটি শুভ-সুপরিকল্পনা, তাই ফরজ হয়ে উঠেছিল উদীচী আয়োজিত সাংস্কৃতিক মঞ্চে বোমা হামলা, তারপর মহানগরের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র রমনা বটমূলে বোমাঘাত করাও জরুরি ছিল এবং তা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নিরঙ্কুশ 'গণতন্ত্র' কায়েম করেছিল জোট সরকার। ক্ষমতা যুগ যুগ ধরে নিষ্কণ্টকভাবে কুক্ষিগত করতে হলে একটি ভূখণ্ডের মানুষের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হয়। তারপর বিদ্বান, বিজ্ঞান, তারপর সত্যিকার জননেতাদের রাজনীতির মঞ্চ থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে হয়। অবশেষে প্রয়োজনে অচেতন জনগোষ্ঠীকে আফগানি বোরকা পরিয়ে দিয়ে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন রেখে শাসন-শোষণ চিরস্থায়ী করা সহজ হয়। সেই নীলনকশা অনুসারে হুমায়ুন আজাদকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আরো কিছু বুদ্ধিজীবীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। অবশ্য জোট সরকারের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে একাত্তরের পুরোটাই রয়েছে তো, তাই তারা ভেবেছিল বিষয়টি সহজ। এই ধারাবাহিকতায় অসাধারণ জনপ্রিয় নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার ও পরে জননেতা ও আপাদমস্তক নির্লোভ ভালো মানুষ সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। এমন অনেক ছিলেন তালিকায়। যে তালিকা তৈরি হয়েছিল ছায়া সরকারের কুখ্যাত হাওয়া ভবনে। মহাজোট সরকার গণতন্ত্রকে এমন একটি কার্যকরী ধারায় পরিচালিত করতে পারছে না। পথে খামাখা ধরে পেটাল দশাসই নেতা জয়নুল আবদিনকে। জোট সরকার 'সামান্য পুলিশ' দিয়ে নাসিম, সাবের হোসেন ও মতিয়া চৌধুরীকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক ঠেঙ্গিয়েছিল। এসবই তো গণতন্ত্রের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে তারেক-কোকো হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন। আর বর্তমান সরকার সেই 'জনগণের সরকার ও দলকে' পাত্তা দিচ্ছে না। অর্থপাচারের অভিযোগ এনে শাহজাদাদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর যারা জনগণের নিঃস্বার্থ সেবা করে গেল সরাসরি হাওয়া ভবন থেকে, তাদের হেনস্তা করছে মহাজোট সরকার। এমন কিছু যে এরা করবে, তা দূরদর্শী জামায়াত-বিএনপির নেতারা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁরা সংগোপনে জঙ্গিদের কাজে লাগালেন। কারণ জঙ্গিরাও সমমনা_তাদেরও লক্ষ্য পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানানো বাংলাদেশকে। এরই ধারাবাহিকতায় এল ইতিহাসের কলঙ্কিত দিন, তথাকথিত গণতন্ত্রের ধারক-পালক সরকারের লক্ষ্যস্থির হলো আওয়ামী লীগকে এ মাটি থেকে বিদায় করে দিতে।
এই যে এত সব করা হলো, সবই তো ১৫ কোটি মানুষের মুক্তির জন্য। সংবিধানে কী আছে বা না আছে, তা বিবেচনায় নিয়ে জোট সরকার দেশ শাসন করলে আগে উলি্লখিত নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটতে পারত? না পারত না। তাই সুহৃদ পাঠক, গণ-অনশন থেকে উচ্চারিত গণ-আন্দোলনের ডাকে জনগণ পুনরুজ্জীবিত হবে_এমন আশা করা যায়? আমি আশা করি না; কিন্তু আশঙ্কা করি, জনগণের একাংশ দেশ ও মানুষের জন্য নয়, দলের জন্য ২০০১-এর গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে চাইবে।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com
No comments