একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-প্রসঙ্গ: যথাশব্দ by হায়াৎ মামুদ

পিটার মার্ক রজে নামে বিলেতের এক চোখের ডাক্তার ১৮৫২ সালে অভিধান গোত্রের একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। বইটি কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রের নয়। অবশ্য ডাক্তারির বই তিনি লিখেছিলেন, ছেপেও ছিলেন এবং তা বেশ আগে, ১৮২৪ সালে, যখন তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ। এখন অবসর গ্রহণের পরে, একষট্টি বছর বয়সে, ১৮৪০ সালে, তিনি একটি বই রচনায় হাত দিলেন, যা ইংরেজি পাঠকসমাজে জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছে।


রজেস্ থিসোরাস (Roget's Thesaurus of English words and Phrases) প্রথম বেরয় ১৮৫২ সালে, তখন তেয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ। বইটি অদ্যাবধি কত মুদ্রিত হয়েছে তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান যদিও নেই, অনুমিত হয়—লক্ষাধিক কপি তো নিশ্চয়ই। বিলেতের ব্লুম্সেবরি পাবলিশিং লিমিটেড (লন্ডন) থেকে যে প্রতিরূপ (ফ্যাকিসমিলি) সংস্করণ ১৯৮৭ সালে বেরিয়েছে তার সূচিপত্রে দেখতে পাচ্ছি—মোট ছয়টি বিভাগে (পরবর্তী দ্বিতীয় সংস্করণে আটটি বিভাগ হয়েছে) বিভক্ত করে বিষয় অনুসারে শব্দানুক্রমিকভাবে তা সাজানো। বাংলা ভাষায় এ-জাতীয় বই ছিল না।
বাংলায় অনুরূপ থিসোরাস প্রণয়নের প্রথম কৃতিত্ব বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের। তিনি বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ছাত্র কখনো ছিলেন না। তাঁর অধীত বিদ্যা ছিল ইতিহাস! তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপনাতেও ব্যাপৃত ছিলেন। যথাশব্দ বইটি বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে যখন প্রকাশিত হলো, তখন সবাই জানতে পারলেন, তাঁর কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসার ক্ষেত্র বাংলা ভাষা পর্যন্ত প্রসারিত। ওই বইয়ের ‘ভূমিকা’য় তিনি জানিয়েছিলেন: ‘জানা শব্দ অনেক সময় প্রয়োজনবোধে মনে আসে না। যে শব্দ মনে আছে অথচ মনে আসেছ না, সেই বিস্মৃত শব্দের সূত্রসন্ধানে এবং যে শব্দ মনে আসেছ অথচ মনে ধরছে না, অতৃপ্ত মনের সেই অভীপ্সিত শব্দের উদ্দেশ্যে এই ভাব-অভিধানের সূত্রপাত। অভিধান শব্দার্থ নিরূপণের জন্য বর্ণনানুক্রমে সাজান। এই পুস্তক ভাবপ্রকাশে যথার্থ শব্দ নির্বাচনে সহায়তার জন্য ব্যবহারিক সুবিধার্থে ভাবানুক্রমে বিন্যস্ত। বলাবাহুল্য, এই ভাব-অভিধান অভিধানের বিকল্প নয়, যদিও নির্ঘণ্টে প্রদত্ত শব্দের অর্থ ও প্রয়োগের বিশ্লেষণে প্রাসঙ্গিক পর্যায়ের নির্দেশনায় এবং প্রত্যেক পর্যায়ে পর্যায়-শব্দ ও প্রতিশব্দের সমাহারে শব্দের অর্থের দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনা পরস্ফুিট।’
পরে কলকাতায় প্রথমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ডক্টর জগন্নাথ চক্রবর্তীর মণিমঞ্জুষা বেরয় ১৯৮৬ সালে। তারপর সাহিত্য সংসদ থেকে, ১৯৮৭ সালে সমতুল্য একই চরিত্রের বই বেরয়: অশোক মুখেপাধ্যায়ের সমার্থকশব্দ কোষ। নির্দ্বিধায় বলা চলে, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বইটি এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবিদার। তিনি গ্রন্থশিরোনামে যে লিখেছেন যথাশব্দ: বাংলা ভাষার প্রথম ভাব অভিধান তাতে কোনো অত্যুক্তি নেই। তাঁর পরবর্তী গ্রন্থ মিত্রাক্ষরও (২০০০) বাংলা গ্রন্থজগতে তুলনাহীন।
১৯৯৩ সালে যথাশব্দর পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে দেখতে পাই তিনি লিখেছেন: ‘এ যাবৎ প্রকাশিত বিভিন্ন সমার্থক বা বিভিন্নার্থক শব্দকোষ, পরিভাষাকোষ ছাড়াও আইন, সংবিধান, বিজ্ঞান ও মানবিকবিদ্যায় ইদানীং ব্যবহূত এমন বহু শব্দ আমি প্রসারিত হস্তে গ্রহণ করেছি, যা অভিধানে এখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। শব্দের ব্যবহার বা সম্ভাব্য ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য রেখে নির্দ্বিধায় বহু বিদেশি শব্দও আমি গ্রহণ করলাম। আমাদের ব্যাপারী ভাষায় রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে যত প্রতিশব্দ জমে গেছে কালক্রমে অব্যবহারের দরুন তার অনেক শব্দ হারিয়ে যাবে। আমরা আর কেদারায় বসি না এবং কন্যারা মাহাফায় চ’ড়ে আর নাইয়রে আসে না। যথাশব্দের সন্ধানে বিশল্যকরণী আনতে গন্ধমাদন পর্বতের শব্দারণ্য হাজির করলাম কি না সে নিয়ে মনে একটা দ্বন্দ্ব রয়ে গেল।’
দ্বন্দ্ব থাকার কোনো কারণ আমরা, পাঠকেরা, অন্তত দেখতে পাচ্ছি না। আটটি ‘শ্রেণী’তে বিষয়বিভাজন করে তিনি যথাশব্দ বিন্যস্ত করেছেন; সেগুলো যথাক্রমে: নির্বস্তুক ভাব, স্থান, পদার্থবিজ্ঞান, বস্তু, সংবেদন, বুদ্ধিবৃত্তি, ইচ্ছা, চিত্তবৃত্তি। সব মিলিয়ে ভুক্তি আছে এক হাজারটি। প্রথম মুদ্রণ ও দ্বিতীয় সংস্করণে ভুক্তির সংখ্যায় কোনো তারতম্য নেই, কিন্তু অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলোতে বহু পরিমার্জন, পরিবর্তন, সংক্ষেপণ ইত্যাদি সম্পন্ন হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে যথাশব্দর পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোনোর পর প্রায় ২০ বছর হতে চলল। বাংলাবাজারে কিংবা অন্যত্র গ্রন্থবিপণিতে বইটি আর দেখা যায় না। অনুমান করি, বইটি নিঃশেষিত হয়েছে। এত দিনেও পুনর্মুদ্রিত হয়ে এ বইয়ের বাজারে না আসার কারণ বোধগম্য নয়। শিক্ষাদানে যাঁরা যুক্ত এবং বিদ্যার্থী যাঁরা, সবার নিকটই এ বই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আমাদের একান্ত প্রত্যাশা—যথাশব্দ: বাংলাভাষার প্রথম ভাব অভিধান পুনরায় সবার হাতে আসুক। তা যত দ্রুত ঘটে ততই মঙ্গল। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এ-গ্রন্থের জন্য আমাদের সাহিত্য-ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.