কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-যুক্তির জোর ও জোরের যুক্তি by রণজিৎ বিশ্বাস
: টকশো দেখতে দেখতে আমার একটা অভিজ্ঞতা হলো। : কী অভিজ্ঞতা? : সবাই যুক্তি খণ্ডন করতে পারেও না, জানেও না, খালি মিনমিন করে। 'হিট দ্য আয়রন হোয়াইল ইট ইজ হট' করতে না পারলে হয় না। তখন যুক্তির জোরকে পেছনে ফেলে 'জোরের যুক্তি' সাময়িকভাবে হলেও এগিয়ে যায়। আপনি তো বুঝতে পারছেন, আমি কি বলতে চাচ্ছি?
: পারছি। আমার জানবার আগ্রহ, টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কারা আপনাকে টেনে-খিঁচে চেয়ারে বসিয়ে রাখে।
: তাদের মধ্যে কয়েকটা ক্যাটাগরি আছে।
এক. যাঁরা গোলগোল সুন্দর প্রমিত বাংলায় প্রায় সবটাই মিথ্যে বলেন এবং মাছের খণ্ডকে লুকিয়ে রাখার জন্য শাকের বোঝা চাপিয়ে দেন। দুই. যাঁরা আপাত নিরপেক্ষ, যেমন_আমার চিহ্নায়নে দুজন সম্পাদক, দুজন অধ্যাপক ও দুজন কান্তিময়ী জনপ্রতিনিধি ও নীতিপ্রণয়িত্রী।
তিন. যাঁদের চোখে-মুখে উদ্ভাস পাওয়া যায় যে, কোনো বিষয়ে তাঁরা যা বলছেন, তাই 'আলটিমেট' ও তার পরে আর কারো কোনো কথা থাকতে পারে না এবং চার. যাঁরা চিহ্নিত মৌলবাদী ও ঘোর সাম্প্রদায়িক, কিন্তু কখনো কখনো আধুনিকতার লেবাসও দেখাতে চান।
: তেমন দু-একজনের কথা বলুন, তারপর কথা শেষ করব। নতুন কোনো প্রসঙ্গে আজ আর যাব না।
: দুজনের কথা বলব। যাঁরা বলেছিলেন_মুক্তিযুদ্ধ গৃহযুদ্ধ, যাঁরা বলে পার পেয়ে গেছে_মুক্তিযুদ্ধ তো আসলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, সেই কুলাঙ্গারদের কথা এখন বলব না, পরে কোনো একদিন বিস্তৃতভাবে বলার জন্য রেখে দেব। এখন বলব একটি সাম্প্রদায়িক চ্যানেলে বারবার দেখা পাওয়া একজন অর্থনীতিকের কথা ও একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী স্যাটানিক চেহারার একজন মানুষের কথা। দুজনের বাণীই আমার স্বকর্ণশ্রুত।
প্রথমজন পাকিস্তান আমলে তাঁর বাম জীবনের কারাবাসের স্মৃতিচারণার সময় বলছিলেন, একজন দারোগা, 'জাতিতে হিন্দু' আমাকে বলছিলেন_ডাণ্ডা চিনেন, ডাণ্ডা? যেমন বলছি, তেমন না করলে ডাণ্ডা মেরে একেবারে ঠাণ্ডা করে দেব। তখন বুঝবেন।
আমি এখনো ভাবতে গেলে ঘোরে পড়ি_হিন্দু কি আসলে কোনো জাতির নাম! দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান আমলের ওই হিন্দু দারোগা যা করেছেন, হুকুমের দাস হয়ে অন্য কোনো দারোগাও কি তা করতে পারতেন না! তা ছাড়া 'জাতিতে হিন্দু' কথাটি কি অপরিহার্যভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল! বিস্ময়কর! তিনি অধ্যাপক, কোনো দিন হয়তো জাতীয় অধ্যাপক হওয়ার দাবিও তুলে বসবেন। হয়েও যেতে পারেন, হু নৌজ! সংসারে কোনো অবদান 'পুরস্কার' বিনে যায় না।
দ্বিতীয়জন এক ধর্মভিত্তিক অনুষ্ঠানে শ্রোতার প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন_আপনি যে বললেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিপালক, এই কথাটি এভাবে বলবেন না। বিশেষ করে 'ব্রহ্মাণ্ড', এর অর্থ হচ্ছে 'ব্রহ্মার অণ্ড', এটি ভালো শোনায় না। এ রকম শব্দ ব্যবহার না করাই ভালো! হোয়াট অ্যান এঙ্প্লেনেশান!!
: ইন্টারেস্টিং! এরা কারা? এদের দুজন সম্পর্কে আরেকটু ক্লিয়ারলি কি বলবেন? পাঠকের চিনে রাখার প্রয়োজনে?
: না, বেশি ক্লিয়ারলি বলব না। এদের একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের দক্ষিণে তার বড় বৈরী প্রতিপত্তি ছিল। বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিতি তার। এখন তাকে কোনো চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত সে পলাতক। এই উপমহাদেশের এক অতি বিখ্যাত ও অতি সম্মানিত শিক্ষিত এক মানুষের নামে তার নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মানুষকে সে হত্যা করেছে ও করিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। হতভাগ্যদের প্রায় সবাই ভিন জন্মপরিচয় ও উপাস্যপরিচয়ের নিরীহ মানুষ। তাঁদের মধ্যে স্কুল শিক্ষকও ছিলেন। অন্যজন মুণ্ডিতশ্মশ্রু। একেবারে ক্লিন শেইভড। ধনবিজ্ঞানের শিক্ষক, হুজ সেলফ-রেইটিং ইজ, আন-নেসেসারিলি, ভেরি হাই। একদা বাম ছিলেন, এখন ডানের চেয়েও ডান। কৃতিত্বে, দক্ষতায় ও পারঙ্গমতায় মহাজঙ্গম ডানেদেরও তিনি বামে নিয়ে গেছেন। তাঁর যুক্তিবিচার আমার আসন ও আমার শরীরের মাঝে বারবার 'গ্লু' লেপ্টে দেয়। তাঁর উপস্থাপন কুশলতা ও 'লগোস'-এর সামনে আমি অনেককেই দেখি নত হতে ও প্রণত থাকতে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
: তাদের মধ্যে কয়েকটা ক্যাটাগরি আছে।
এক. যাঁরা গোলগোল সুন্দর প্রমিত বাংলায় প্রায় সবটাই মিথ্যে বলেন এবং মাছের খণ্ডকে লুকিয়ে রাখার জন্য শাকের বোঝা চাপিয়ে দেন। দুই. যাঁরা আপাত নিরপেক্ষ, যেমন_আমার চিহ্নায়নে দুজন সম্পাদক, দুজন অধ্যাপক ও দুজন কান্তিময়ী জনপ্রতিনিধি ও নীতিপ্রণয়িত্রী।
তিন. যাঁদের চোখে-মুখে উদ্ভাস পাওয়া যায় যে, কোনো বিষয়ে তাঁরা যা বলছেন, তাই 'আলটিমেট' ও তার পরে আর কারো কোনো কথা থাকতে পারে না এবং চার. যাঁরা চিহ্নিত মৌলবাদী ও ঘোর সাম্প্রদায়িক, কিন্তু কখনো কখনো আধুনিকতার লেবাসও দেখাতে চান।
: তেমন দু-একজনের কথা বলুন, তারপর কথা শেষ করব। নতুন কোনো প্রসঙ্গে আজ আর যাব না।
: দুজনের কথা বলব। যাঁরা বলেছিলেন_মুক্তিযুদ্ধ গৃহযুদ্ধ, যাঁরা বলে পার পেয়ে গেছে_মুক্তিযুদ্ধ তো আসলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, সেই কুলাঙ্গারদের কথা এখন বলব না, পরে কোনো একদিন বিস্তৃতভাবে বলার জন্য রেখে দেব। এখন বলব একটি সাম্প্রদায়িক চ্যানেলে বারবার দেখা পাওয়া একজন অর্থনীতিকের কথা ও একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী স্যাটানিক চেহারার একজন মানুষের কথা। দুজনের বাণীই আমার স্বকর্ণশ্রুত।
প্রথমজন পাকিস্তান আমলে তাঁর বাম জীবনের কারাবাসের স্মৃতিচারণার সময় বলছিলেন, একজন দারোগা, 'জাতিতে হিন্দু' আমাকে বলছিলেন_ডাণ্ডা চিনেন, ডাণ্ডা? যেমন বলছি, তেমন না করলে ডাণ্ডা মেরে একেবারে ঠাণ্ডা করে দেব। তখন বুঝবেন।
আমি এখনো ভাবতে গেলে ঘোরে পড়ি_হিন্দু কি আসলে কোনো জাতির নাম! দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান আমলের ওই হিন্দু দারোগা যা করেছেন, হুকুমের দাস হয়ে অন্য কোনো দারোগাও কি তা করতে পারতেন না! তা ছাড়া 'জাতিতে হিন্দু' কথাটি কি অপরিহার্যভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল! বিস্ময়কর! তিনি অধ্যাপক, কোনো দিন হয়তো জাতীয় অধ্যাপক হওয়ার দাবিও তুলে বসবেন। হয়েও যেতে পারেন, হু নৌজ! সংসারে কোনো অবদান 'পুরস্কার' বিনে যায় না।
দ্বিতীয়জন এক ধর্মভিত্তিক অনুষ্ঠানে শ্রোতার প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন_আপনি যে বললেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিপালক, এই কথাটি এভাবে বলবেন না। বিশেষ করে 'ব্রহ্মাণ্ড', এর অর্থ হচ্ছে 'ব্রহ্মার অণ্ড', এটি ভালো শোনায় না। এ রকম শব্দ ব্যবহার না করাই ভালো! হোয়াট অ্যান এঙ্প্লেনেশান!!
: ইন্টারেস্টিং! এরা কারা? এদের দুজন সম্পর্কে আরেকটু ক্লিয়ারলি কি বলবেন? পাঠকের চিনে রাখার প্রয়োজনে?
: না, বেশি ক্লিয়ারলি বলব না। এদের একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের দক্ষিণে তার বড় বৈরী প্রতিপত্তি ছিল। বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিতি তার। এখন তাকে কোনো চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত সে পলাতক। এই উপমহাদেশের এক অতি বিখ্যাত ও অতি সম্মানিত শিক্ষিত এক মানুষের নামে তার নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মানুষকে সে হত্যা করেছে ও করিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। হতভাগ্যদের প্রায় সবাই ভিন জন্মপরিচয় ও উপাস্যপরিচয়ের নিরীহ মানুষ। তাঁদের মধ্যে স্কুল শিক্ষকও ছিলেন। অন্যজন মুণ্ডিতশ্মশ্রু। একেবারে ক্লিন শেইভড। ধনবিজ্ঞানের শিক্ষক, হুজ সেলফ-রেইটিং ইজ, আন-নেসেসারিলি, ভেরি হাই। একদা বাম ছিলেন, এখন ডানের চেয়েও ডান। কৃতিত্বে, দক্ষতায় ও পারঙ্গমতায় মহাজঙ্গম ডানেদেরও তিনি বামে নিয়ে গেছেন। তাঁর যুক্তিবিচার আমার আসন ও আমার শরীরের মাঝে বারবার 'গ্লু' লেপ্টে দেয়। তাঁর উপস্থাপন কুশলতা ও 'লগোস'-এর সামনে আমি অনেককেই দেখি নত হতে ও প্রণত থাকতে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
No comments