কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম : জীবনের নানা বাঁকে by মুশতাক হোসেন
অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা বীর বিপ্লবী কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর আসামের বদরপুর স্টেশনে, নানার বাড়িতে। তাঁর বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ এবং মা আশরাফুন্নেসা। তাহেরের পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে।
কিশোর বয়সেই তাঁর প্রতিবাদী মনোভাবের পরিচয় মেলে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়। ট্রেনে ভ্রমণরত পূর্ব বাংলার কুখ্যাত মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের কামরায় তাহেরের নেতৃত্বে জনতা পাথর হামলা চালায়। তাহেরের বাবা ছিলেন রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার। চাকরির সুবাদে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ঘুরতে হতো তাঁকে। ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫৭ সালে সিলেটের এম সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। বিপ্লবী সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন তাহের। ১৯৫৯ সালে এই কলেজ থেকেই স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে কিছুদিনের জন্য শিক্ষকতা করার সময় তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীদের সাহচর্য লাভ করেন।
তাহের ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এমএ প্রথম পর্বে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন_লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যুৎপত্তি অর্জন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন তিনি।
১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে তাহের ক্যাপ্টেন থেকে মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৬৯ সালের ৭ আগস্ট জঙ্গলবাড়ী নিবাসী ডা. খুরশীদ উদ্দিন আহমেদের মেয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের ছাত্রী লুৎফার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
ওই দিন সন্ধ্যায়ই পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা অফিসার্স ক্লাবে জনৈক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা ফোড়ন কেটে মন্তব্য করেন : গঁলরন রং ধ ঃৎধরঃড়ৎ. এ মন্তব্যে উত্তেজিত তাহের তাঁর জামার কলার চেপে ধরেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলেন। অন্যথায় হত্যা করার হুমকি দেন। তাহেরের দৃঢ়তায় ভীত হয়ে ওই কর্মকর্তা তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার করে আত্মরক্ষা করেন।
৭ এপ্রিল বিমানে করে তাহেরকে কোয়েটা থেকে খারিয়া সেনানিবাসে পাঠানো হয়। ৮ থেকে ২৮ এপ্রিল ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করেন তিনি। শেষদিকে তাঁকে খারিয়া থেকে অ্যাবোটাবাদ বেলুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে বদলি করা হয়।
আগস্টে মুক্তিযুদ্ধে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে পেঁৗছেন তাহের। দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী কর্তৃক বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মতামত দানের জন্য প্রেরিত হন তিনি। ১২ আগস্টের মধ্যেই মেঘালয় সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পেঁৗছে যান তাহের।
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট কামালপুরের পাকিস্তানি ঘাঁটিতে তিনি তাঁর প্রথম সুসংগঠিত আক্রমণ পরিচালনা করেন। ৭ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পরিচালিত হয় ঐতিহাসিক 'কামালপুর অভিযান'। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আরো পাঁচজন সামরিক কর্মকর্তা ১১ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। বিভিন্ন সাব-সেক্টরে তাঁদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। ৭ থেকে ১২ অক্টোবর বিখ্যাত 'চিলমারী রেইড'-এ প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দেন তাহের; এবং অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে ১৩ তারিখ রৌমারী প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯৩ হাজার সদস্য আত্মসমর্পণ করে রেসকোর্স ময়দানে। ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারাই সর্বপ্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেন। ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার দেশে ফিরে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ২৫ ডিসেম্বর গুয়াহাটি মিলিটারি হাসপাতাল থেকে লক্ষ্নৌতে আরেকটি অপারেশনের জন্য যান তিনি। ইতিমধ্যে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে ব্রিটেন হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে পুনা আর্টিফিশিয়াল লিম্ব সেন্টার থেকে কৃত্রিম পা সংযোজন করে কর্নেল তাহের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আত্মপ্রকাশ ঘটে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে। জাসদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হলে তিনি অন্যতম সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারায়ণগঞ্জ সদর দপ্তরে ড্রেজিং সংস্থায় পরিচালক পদে নিয়োগ পান। এই সংস্থাটি কেবল তাঁর সময়ই লাভজনক ছিল।
জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়, জিয়া টেলিফোনে তাহেরের কাছে প্রাণ রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানান। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা তাহেরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সন্ধ্যায় ঢাকায় নিয়ে আসেন। ৪ নভেম্বর জিয়া তাঁর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিকেলে আবার তাহেরের কাছে প্রাণ বাঁচাতে কিছু করার আবেদন জানান।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর উদ্যোগে আবু তাহেরের নেতৃত্বে ঘটে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান।
১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর জাসদ নেতা মেজর (অব.) এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, আবু ইউসুফ খান, কে বি এম মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাসদের সঙ্গে আলোচনার দরজা বন্ধ করে দিলেন জিয়া। ১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের বাসা থেকে আবু তাহের ও কয়েকজন বিপ্লবী সৈনিককে গ্রেপ্তার করে সরাসরি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কিছুদিনের মধ্যেই দ্রুত রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন সেলে পাঠানো হয় তাহেরকে।
১৯৭৬ সালের ২২ মে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হেলিকপ্টারে করে তাহেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। ১৯৭৬ সালের ১৫ জুন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে চেয়ারম্যান করে ১ নম্বর বিশেষ সামরিক আইন আদালত গঠনের সরকারি ঘোষণা দেওয়া হয়। তাহেরসহ ৩৩ জন অভিযুক্ত হন। তাঁদের মধ্যে ২২ জন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। এ দিনই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান কারাগারে তাহেরের সঙ্গে দেখা করেন। অর্থাৎ ১৫ তারিখ ঘোষণা দেওয়া হলেও ওই সামরিক আদালত আরো আগে থেকেই প্রস্তুত করা হচ্ছিল। ১৯৭৬ সালের ২১ জুন ১ নম্বর বিশেষ সামরিক আইন আদালতের প্রথম অধিবেশন বসে। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুন সামরিক আদালতের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়। কারাগারে বিচারানুষ্ঠানের জন্য প্রবেশরত প্রধান অভিযোগকারী এ টি এম আফজাল, বিচারক কর্নেল ইউসুফ হায়দারসহ অন্যদের ছবি তোলায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের ক্যামেরা ছিনতাই করে ফিল্ম নষ্ট করে এবং লিফশুলজকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ও পরে মুক্তি দেয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ জুন লিফশুলজকে আবারও গ্রেপ্তার, তিন দিন গৃহবন্দি, অবশেষে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২৮ জুন থেকে ৮ জুলাই অভিযোগকারী ও সরকারি সাক্ষীরা বক্তব্য দেন। ১৯৭৬ সালের ১১ থেকে ১৪ জুলাই অভিযুক্তদের জবানবন্দি প্রদান, ১২ জুলাই অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যেও তাহের একটানা ছয় ঘণ্টা বক্তব্য রাখেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই কর্নেল ইউসুফ হায়দার গোপন সামরিক আদালতের পক্ষে রায় ঘোষণা করেন। এতে আবু তাহেরের মৃত্যুদণ্ড এবং জলিল-রব-ইনুসহ অন্যান্য নেতাকে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোর ৪টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম ফাঁসির মঞ্চে বীরোচিত আত্মদান করেন।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু),
১৯৮৯-৯০
তাহের ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এমএ প্রথম পর্বে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন_লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যুৎপত্তি অর্জন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন তিনি।
১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে তাহের ক্যাপ্টেন থেকে মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৬৯ সালের ৭ আগস্ট জঙ্গলবাড়ী নিবাসী ডা. খুরশীদ উদ্দিন আহমেদের মেয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের ছাত্রী লুৎফার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
ওই দিন সন্ধ্যায়ই পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা অফিসার্স ক্লাবে জনৈক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা ফোড়ন কেটে মন্তব্য করেন : গঁলরন রং ধ ঃৎধরঃড়ৎ. এ মন্তব্যে উত্তেজিত তাহের তাঁর জামার কলার চেপে ধরেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলেন। অন্যথায় হত্যা করার হুমকি দেন। তাহেরের দৃঢ়তায় ভীত হয়ে ওই কর্মকর্তা তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার করে আত্মরক্ষা করেন।
৭ এপ্রিল বিমানে করে তাহেরকে কোয়েটা থেকে খারিয়া সেনানিবাসে পাঠানো হয়। ৮ থেকে ২৮ এপ্রিল ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করেন তিনি। শেষদিকে তাঁকে খারিয়া থেকে অ্যাবোটাবাদ বেলুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে বদলি করা হয়।
আগস্টে মুক্তিযুদ্ধে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে পেঁৗছেন তাহের। দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী কর্তৃক বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মতামত দানের জন্য প্রেরিত হন তিনি। ১২ আগস্টের মধ্যেই মেঘালয় সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পেঁৗছে যান তাহের।
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট কামালপুরের পাকিস্তানি ঘাঁটিতে তিনি তাঁর প্রথম সুসংগঠিত আক্রমণ পরিচালনা করেন। ৭ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পরিচালিত হয় ঐতিহাসিক 'কামালপুর অভিযান'। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আরো পাঁচজন সামরিক কর্মকর্তা ১১ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। বিভিন্ন সাব-সেক্টরে তাঁদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। ৭ থেকে ১২ অক্টোবর বিখ্যাত 'চিলমারী রেইড'-এ প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দেন তাহের; এবং অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে ১৩ তারিখ রৌমারী প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯৩ হাজার সদস্য আত্মসমর্পণ করে রেসকোর্স ময়দানে। ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারাই সর্বপ্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেন। ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার দেশে ফিরে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ২৫ ডিসেম্বর গুয়াহাটি মিলিটারি হাসপাতাল থেকে লক্ষ্নৌতে আরেকটি অপারেশনের জন্য যান তিনি। ইতিমধ্যে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে ব্রিটেন হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে পুনা আর্টিফিশিয়াল লিম্ব সেন্টার থেকে কৃত্রিম পা সংযোজন করে কর্নেল তাহের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আত্মপ্রকাশ ঘটে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে। জাসদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হলে তিনি অন্যতম সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারায়ণগঞ্জ সদর দপ্তরে ড্রেজিং সংস্থায় পরিচালক পদে নিয়োগ পান। এই সংস্থাটি কেবল তাঁর সময়ই লাভজনক ছিল।
জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়, জিয়া টেলিফোনে তাহেরের কাছে প্রাণ রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানান। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা তাহেরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সন্ধ্যায় ঢাকায় নিয়ে আসেন। ৪ নভেম্বর জিয়া তাঁর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিকেলে আবার তাহেরের কাছে প্রাণ বাঁচাতে কিছু করার আবেদন জানান।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর উদ্যোগে আবু তাহেরের নেতৃত্বে ঘটে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান।
১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর জাসদ নেতা মেজর (অব.) এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, আবু ইউসুফ খান, কে বি এম মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাসদের সঙ্গে আলোচনার দরজা বন্ধ করে দিলেন জিয়া। ১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের বাসা থেকে আবু তাহের ও কয়েকজন বিপ্লবী সৈনিককে গ্রেপ্তার করে সরাসরি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কিছুদিনের মধ্যেই দ্রুত রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন সেলে পাঠানো হয় তাহেরকে।
১৯৭৬ সালের ২২ মে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হেলিকপ্টারে করে তাহেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। ১৯৭৬ সালের ১৫ জুন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে চেয়ারম্যান করে ১ নম্বর বিশেষ সামরিক আইন আদালত গঠনের সরকারি ঘোষণা দেওয়া হয়। তাহেরসহ ৩৩ জন অভিযুক্ত হন। তাঁদের মধ্যে ২২ জন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। এ দিনই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান কারাগারে তাহেরের সঙ্গে দেখা করেন। অর্থাৎ ১৫ তারিখ ঘোষণা দেওয়া হলেও ওই সামরিক আদালত আরো আগে থেকেই প্রস্তুত করা হচ্ছিল। ১৯৭৬ সালের ২১ জুন ১ নম্বর বিশেষ সামরিক আইন আদালতের প্রথম অধিবেশন বসে। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুন সামরিক আদালতের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়। কারাগারে বিচারানুষ্ঠানের জন্য প্রবেশরত প্রধান অভিযোগকারী এ টি এম আফজাল, বিচারক কর্নেল ইউসুফ হায়দারসহ অন্যদের ছবি তোলায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের ক্যামেরা ছিনতাই করে ফিল্ম নষ্ট করে এবং লিফশুলজকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ও পরে মুক্তি দেয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ জুন লিফশুলজকে আবারও গ্রেপ্তার, তিন দিন গৃহবন্দি, অবশেষে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২৮ জুন থেকে ৮ জুলাই অভিযোগকারী ও সরকারি সাক্ষীরা বক্তব্য দেন। ১৯৭৬ সালের ১১ থেকে ১৪ জুলাই অভিযুক্তদের জবানবন্দি প্রদান, ১২ জুলাই অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যেও তাহের একটানা ছয় ঘণ্টা বক্তব্য রাখেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই কর্নেল ইউসুফ হায়দার গোপন সামরিক আদালতের পক্ষে রায় ঘোষণা করেন। এতে আবু তাহেরের মৃত্যুদণ্ড এবং জলিল-রব-ইনুসহ অন্যান্য নেতাকে দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোর ৪টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম ফাঁসির মঞ্চে বীরোচিত আত্মদান করেন।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু),
১৯৮৯-৯০
No comments