খাদ্যনিরাপত্তা-আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে by মহিউদ্দিন আহমদ

জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে দরকারি জিনিস কোনটি? উত্তরটি সবার জানা। প্রকৃতির দান আলো, বাতাস এবং পানি বাদ দিলে যে জিনিসটির কথা সবার আগে মনে আসে, তা হলো খাবার। খাবার ছাড়া জীবজগতের কোনো প্রাণী বাঁচে না।
পৃথিবীর সব দেশে খাদ্যের অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত।


এ দেশে আমরা ‘অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই’—এই স্লোগান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। আমাদের সংবিধানের ১৫(ক) ধারায় ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’ করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে উদ্ধৃত করা আছে। আমাদের রাষ্ট্র কি এ দায়িত্ব পালন করছে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এ দেশে ৩১.৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, যারা গড়ে দৈনিক প্রয়োজনীয় ২২০০ কিলো ক্যালরি সংগ্রহ করার মতো যথেষ্ট খাবার পায় না। যারা মাথাপিছু ন্যূনতম ১৮০৫ কিলো ক্যালরির সংস্থান করতে পারে না, তাদের বলা হয় হতদরিদ্র। এরা জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে হতদরিদ্রের সংখ্যা বেশি। গ্রামে এদের সংখ্যা ২৯ শতাংশ, আর শহরে ১৫ শতাংশ। তদুপরি রয়েছে আঞ্চলিক বৈষম্য। হতদরিদ্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে (৩৬ শতাংশ) এবং তার পরই রাজশাহী বিভাগে (৩৫ শতাংশ)। এদের জন্য বাস্তবিক অর্থেই নেই কোনো সরকার, নেই কোনো এনজিও।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেটুকু হয়েছে, তার ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান আরেকটু ভালো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম খুব বেশি বেড়ে যাওয়ায় মানুষ তার দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খেয়েছে। যার সঞ্চিত টাকা ছিল, সে তার সঞ্চয় খুইয়েছে। যার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সে কম খেয়েছে, কিংবা গ্রামের ভিটা ছেড়ে শহরের বস্তিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে কাজের সন্ধানে।
বিশ্ব অর্থনীতি একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশ নতুন করে খাদ্য সংকটে পড়ছে। বিশ্ববাজারে যেসব দেশ খাদ্যশস্যের সনাতন জোগানদার হিসেবে পরিচিত, তাদের কৃষিব্যবস্থায় যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের জমি কমে যায় ১৬ শতাংশ এবং ভুট্টা চাষের জমি বাড়ে ২৩ শতাংশ। জৈব জ্বালানি তৈরির জন্য তারা ভুট্টা ব্যবহার করছে। এর ফলে দেখা গেছে, ২০০৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৮ সালের মার্চ—এই সময়ে সয়াবিনের দাম ৭৫ শতাংশ বেড়ে যায়। দুই বছর আগে একটা অবস্থা তৈরি হয়েছিল যে নগদ টাকা দিয়েও অনেক দেশ চাল কিংবা গম কিনতে পারছিল না।
ইদানীং আমরা বেশ জোরেশোরে খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলছি। এই খাদ্যনিরাপত্তার সংজ্ঞা কী? কেউ কেউ বলেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেই এই নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব। আমরা কখনোই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম না। বিশেষ করে, এ দেশটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে চলে যাওয়ার পর থেকে। শেখ হাসিনার প্রথম সরকার (১৯৯৬-০১) মাঝেমধ্যে দাবি করে, ওই সময় বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল। কথাটা বেঠিক।
এরশাদ সরকারের আমলে বাংলাদেশ গড়ে প্রতিবছর ১৯ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছিল। খালেদা সরকারের প্রথম পর্বে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিল বছরে সাড়ে ১৭ লাখ টন। হাসিনা সরকার তার প্রথম পর্বে বছরে গড়ে আমদানি করেছিল ২৪ লাখ টন খাদ্যশস্য। দ্বিতীয় পর্বের খালেদা সরকারের বাৎসরিক আমদানির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২৭ লাখ টন। ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের সরকারের আমলে বাৎসরিক খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিল ২৯ লাখ টন। হাসিনা সরকারের বর্তমান পর্বে প্রথম দুই বছরের গড় আমদানি ছিল বাৎসরিক ৩২ লাখ টন। এই আমদানির হিসাব অবশ্য বৈদেশিক খাদ্যসাহায্য যোগ করেই, যার পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ১৯৯৪-৯৫ সাল পর্যন্ত খাদ্যসাহায্যের পরিমাণ আমদানির চেয়ে বেশি ছিল। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে সাহায্যের চেয়ে আমদানির পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে প্রতিবছর।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ২৫ লাখ। আর খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ছে বছরে সাড়ে চার লাখ টন। অন্যদিকে কৃষিজমির পরিমাণ কমছে প্রতিদিন গড়ে ৫৫০ একর। আমরা কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব?
বাংলাদেশের মানুষ যে পরিমাণ খাবার খায়, তাতে গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু দৈনিক ৪৭৭ গ্রাম চালের প্রয়োজন হয়। শহরে এর পরিমাণ মাথাপিছু ৩৮৯ গ্রাম। এই হিসাবে ২০১১ সালে চালের প্রয়োজন দাঁড়াচ্ছে দুই কোটি ৫০ লাখ টন। যদি এ বছর বোরো মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হয়, তাহলে বাৎসরিক উৎপাদন ধানের হিসাবে হবে তিন কোটি ৪৫ লাখ টন। এ থেকে চাল পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ দুই কোটি ৩১ লাখ টন। অর্থাৎ ১৪ লাখ টনের ঘাটতি থেকেই যাবে।
গত ১০ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। আবাদি জমি কমেছে ৭ শতাংশ। ২০২১ সালে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৭ কোটি ২০ লাখে। ২০০১ সালের আদমশুমারির প্রতিবেদনে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, তার ভিত্তিতে বলা যায়, ২০৫১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ন্যূনতম ২২ কোটি। এর মধ্যে ১৪ কোটি লোক বসবাস করবে শহরাঞ্চলে। আবাদি জমির পরিমাণ ভয়াবহ রকম হ্রাস পাবে। কীভাবে এ দেশের মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচবে? ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মুখের আহার জোগাতে ২০২১ সালে প্রয়োজন হবে দুই কোটি ৮০ লাখ টন চাল। ২০৫১ সালে চালের চাহিদা হবে তিন কোটি ৪০ লাখ টন। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। নগদ টাকা দিয়েও বিশ্ববাজার থেকে চাল কেনা যাবে না। কেননা, কেনার মতো উদ্বৃত্ত চাল বাজারে থাকবে না। আমরা কি এ ধরনের একটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত?
চালের চাহিদা কমানোর একটা রাস্তা আছে। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত আছে অনেকগুলো ‘যদি’। যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো হয়, যদি মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ে, যদি আমাদের খাদ্য তালিকায় চালের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে মাছ, মাংস, ডিম, সবজি, দুধ ও ফলমূলের পরিমাণ বাড়ে, অর্থাৎ পুষ্টিকর সুষম খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়ে, যদি ওই খাবারগুলো কিনে খাওয়ার ক্ষমতা বাড়ে, তাহলে খাবার তালিকা থেকে চালের পরিমাণ কমে যাবে। একটা হিসাবে দেখা যায়, যদি আগামী ১০ বছরে ভাত খাওয়ার পরিমাণ ১০ শতাংশ কমে, পরবর্তী ১০ বছরে যদি তা ২০ শতাংশ কমে, এবং তার ১০ বছর পর থেকে যদি ৩০ শতাংশ কমে তাহলে ২০৫১ সালে আমাদের চালের প্রয়োজন হবে দুই কোটি ৩০ লাখ টন। এটা সম্ভব। কারণ এ রকমটি ঘটেছে জাপানে এবং চীনে। এটা সম্ভব করতে হলে চাই বড়সড় পরিকল্পনা, বিশাল আয়োজন এবং প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কৃষি খাতের জন্য একটা বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এতে আছে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য ১২টি কার্যক্রম। এটা বাস্তবায়ন করতে লাগবে ৭.৮ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ৫৮,৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২.৮ বিলিয়ন ডলারের সংস্থান হয়েছে। রয়ে গেছে ৫.১ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি। আমাদের দেশের যারা অভিভাবক, তাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় না, এই বিষয়টি তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে।
গত ৪০ বছরে আমাদের কৃষকেরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়িয়েছেন তিন গুণ। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে এই অর্জনে যথাসাধ্য অংশ নিয়েছেন। নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য চাই আরও বিনিয়োগ, আরও অনুকূল পরিবেশ। আমরা অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি। আমাদের ভুলের জন্য বিনা অপরাধে শাস্তি পাবে পরবর্তী প্রজন্ম।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ এই সহজ সুন্দর আকাঙ্ক্ষা একদা উচ্চারিত হয়েছিল এক কবির মুখে। আমরা সেই আকাঙ্ক্ষার মর্যাদা রাখতে পারিনি। আমরা সবাই মিলে যদি চেষ্টা করি, তাহলে কিছুই অসম্ভব নয়। যে শিশু আজ ভূমিষ্ঠ হচ্ছে মাথায় দেড় শ ডলার বৈদেশিক ঋণের বোঝা নিয়ে, আমরা তার জন্য কী রকম পৃথিবী রেখে যাচ্ছি? আমাদের সবার উচিত নিজেকে এই প্রশ্নটি করা। আমাদের সবাইকেই এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.