সাদাকালো-সড়ক হত্যাকাণ্ড বন্ধে দরকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আইন by আহমদ রফিক
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রাক দুর্ঘটনায় মৃত ৪৪ ছাত্র। সাদামাটা বাক্যের একটি খবর। কিন্তু শোকে আচ্ছন্ন কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা। শোকাহত আবু তোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। উপজেলায় পালিত হলো তিন দিনের শোক পালন। মন্ত্রী, নেতা-নেত্রী, শিক্ষা ও প্রশাসনিক শীর্ষ কর্মকর্তারা অকুস্থল থেকে ছাত্রদের অভিভাবকদের কাছে যাচ্ছেন সান্ত্বনা জোগাতে। ঘোষণা করছেন সাহায্য।
কিন্তু কী হবে তাতে? ওই ৪৪ ছাত্র ফিরে আসবে তাদের সহপাঠীদের কাছে, তাদের মায়ের কোলে? এক ব্যক্তির অবহেলায় এত মৃত্যু! কী কৈফিয়ত ওই চালকের? কানে মোবাইল ফোন চেপে রাজসিক চালে একসিলেটরে পা চেপে গল্প করাকে কি গাড়ি চালানো বলে? কদিন ধরে পত্রপত্রিকায় বেজায় লেখালেখি চলছে। খবরে, কলামে, মন্তব্য প্রতিবেদনে এবং বিচার-ব্যাখ্যায়।
আর কদিন পর 'সব ঠিক হয়ে যাবে'_ওই যেমন টিভি সিরিয়ালগুলোর বহু কথিত 'ডায়ালগ'। হ্যাঁ, সবই ঠিকঠাক চলবে, তবে সহজে চলতে চাইবে না ওই প্রয়াতদের মা-বাবার সংসার, তাদের ভাইবোনের গভীর শোক নানা সূত্রে উথলে উঠবে। মা-বাবা চাইবেন সেই রক্তঝরা শোক সামলাতে। সময়ের ধুলোয় একসময় হয়তো সব ঢাকা পড়বে, আবার পড়বেও না।
এর মধ্যেই যথারীতি ঘটতে থাকবে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা, যা বাংলাদেশের সড়ক-জনপথে ডালভাতের মতো সচরাচর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু 'হাইওয়ে'তেই নয়, কাগজপড়ুয়াদের মনে পড়তে পারে, শাহবাগের কাছে একাধিক ছাত্রছাত্রী বেহাল চালকের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিয়েছে। ক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে ভাঙচুরের শিকার হয়েছে অনেক নিরপরাধ যান। কিন্তু সেই সব ঘাতক চালকের কী শাস্তি হয়েছে, আদৌ হয়েছে কি না আমরা জানি না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কদিনের শোক_তারপর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এমনটাই স্বাভাবিক।
লক্ষ করার মতো বিষয় যে এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, প্রশাসন ও সব সূত্র থেকে শোক প্রকাশসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা ঘোষণা দেওয়া হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া অকুস্থলে পেঁৗছে স্বজনহারাদের কান্নায় সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করেন। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ বলেছেন, 'এই কান্নার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।' এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবেন না।
কিন্তু প্রশ্ন, কে খেয়াল রাখবেন? দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে তার উপায় নিয়ে কেউ ভাবছেন না। পথে পথে প্রতিদিন একের পর এক দুর্ঘটনায় যাত্রী বা পথচারীদের মৃত্যু যেন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু গাড়ি ভাঙচুর (যা আদৌ ন্যায়সংগত নয়), এরপর সব শেষ। অথচ সবাই জানেন, এসব কথিত দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কারণ গাড়িচালকের অবহেলা, অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে রাস্তার অন্য গাড়ি অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার দুর্দমনীয় চেষ্টা, অত্যধিক সুরাপান বা মাদক সেবন করে গাড়ি চালানোর মতো ঘটনাবলি। বড় কথা, বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালানো।
এ ছাড়া একাধিক নতুন উপদ্রবের মধ্যে অন্যতম হলো 'হেলপার' বা শিক্ষানবিসের গাড়ি চালনা। একাধিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এমন খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিকার হিসেবে কেউ হয়তো বলবেন, দরকার সর্বাংশে 'ফিট' গাড়ির রাস্তায় চলা নিশ্চিত করা, চালকদের সর্বমাত্রিক প্রশিক্ষণ, এমনকি মানসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তাতেই কি কাজ হবে? কে তোয়াক্কা করে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের, নিয়মকানুন মেনে চলার? নিয়ম না মানাই তো এখানকার নিয়ম! নিয়ম মানার সংস্কৃতি এখনো অনেক দূরে।
তাই আমাদের বিবেচনায় ওই সড়কমৃত্যু ঠেকাতে দরকার কঠোর আইন, ঘাতক ড্রাইভারের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানসংবলিত আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন। প্রচলিত আইনে শাস্তির বিধান কঠিন নয় বলেই গাড়িচালক বেপরোয়া বা বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালাতে উৎসাহ বোধ করে থাকে।
একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখেছি, 'সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার মামলায় ঘাতক চালকের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। একজন মারা গেলে যে শাস্তি, ৫০ জন মারা গেলেও ওই একই মেয়াদে শাস্তি'_অর্থাৎ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। এই উদ্ভট প্রাচীন আইনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন। না হলে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কোনোটাই কমবে না।
আরেকটি কথা। এ জাতীয় মৃত্যুর ঘটনাকে কোনোক্রমেই দুর্ঘটনা বলা চলে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত কারণে এগুলোকে হত্যাকাণ্ডরূপে বিবেচনা করা উচিত এবং সে হিসেবে বিচার হওয়া দরকার। অনেকেরই হয়তো মনে থাকার কথা, আশির দশকে পরপর কয়েকটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘাতক চালকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন চালুর চেষ্টা করেছিলেন। তাতে সমর্থন ছিল দেশের নাগরিক-সাধারণের। কিন্তু গাড়িচালক ও মালিকদের প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের মুখে প্রয়োজনীয় শাস্তির ধারা বাতিল করতে হয়। সত্যিই বিচিত্র এই দেশ!
বিচিত্র বলছি এ জন্য যে অনেকটা এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, এই চট্টগ্রামের সড়কেই 'টেম্পো দুর্ঘটনায় ১১ ক্রিকেটারের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ঘাতক চালকের সাজা হয়েছিল মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড।' এমন অনেক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে পত্র-পত্রিকায়। স্বজন হারানো মানুষের দাবি, 'এ ধরনের ঘটনায় যাতে ঘাতক চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়।' কিন্তু আইন সে পথে চলে না।
গত ১৬ জুলাইয়ের কাগজে দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর অকুস্থল সফরের বিস্তারিত বিবরণ। সঙ্গে কয়েকজন মন্ত্রী। পড়েছি শোকাহত স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে 'প্রধানমন্ত্রীর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ার' কথা। তিনি বলেছেন, 'এভাবে মায়ের কোল খালি হোক, আমরা তা চাই না। রাস্তায় কেন দুর্ঘটনা হয়, তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
বর্তমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'ঘটনার সব কিছু খতিয়ে দেখা হবে। কোনো হেলপার গাড়ি চালাতে পারবে না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো যাবে না।' এ বিষয়ে আমরা বলি, প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা যেন কার্যকর হয়। তার চেয়েও বড় কথা, ফিট নয়, এমন গাড়ির 'ফিটনেস' পেতে তো খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। কাজেই ওই দিকটাতেও প্রধানমন্ত্রীর নজর দিতে হবে। তবু কথা হচ্ছে, কোনো ব্যবস্থাতেই কিছু হবে না, সড়ক হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না, যদি না ঘাতক চালকের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন প্রণীত এবং সে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়। প্রসঙ্গত বলি, এসব দিক থেকে গাড়ির মালিকের দায়ও কম নয়। সেদিকেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ও আইনপ্রণেতার নজর দেওয়া দরকার। ঢাকার রাজপথে কিছুসংখ্যক বাসের চেহারা ও তেমনি কিছু ট্রাকের চলন দেখলে সংগত কারণে সন্দেহ হয়_এগুলো 'ফিটনেস' পাওয়ার যোগ্যতা রাখে কি না।
বর্তমান মর্মান্তিক ঘটনার অনুরূপ ঘটনা আবার যে ঘটবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই বলেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আমাদের আহ্বান, অন্তত এ ঘটনাটি যাতে হালকা আইনি ধারার মধ্য দিয়ে পার হতে না পারে, সে জন্য অবিলম্বে অনুরূপ ঘটনায় যাতে ঘাতক গাড়িচালকের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়, সে জন্য আইনমন্ত্রীকে তিনি যেন নির্দেশ দেন এবং আইন যাতে দ্রুত প্রণীত হয় সেদিকে নজর রাখেন।
কারণ ইতিমধ্যে ওই ঘাতক গাড়িচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে। এসব কিছুটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। আমরা চাই অর্থাৎ দেশবাসীও চাইবে এবং তা বলার অপেক্ষা রাখে না, ইতিমধ্যে অর্থাৎ তদন্ত শেষ হওয়া এবং বিচার শুরু হওয়ার আগেই বা এর মধ্যেই যাতে আকাঙ্ক্ষিত আইনটি পাস হয়। যাতে ওই ঘাতকের যথোচিত শাস্তি নতুন আইনে হয়। তাতে নিহত ছাত্রদের মা-বাবা ও স্বজনরা এবং শোকার্ত দেশবাসী কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেতে পারেন।
আর দৈনিক পত্রিকা অর্থাৎ গণমাধ্যমের প্রতি আমাদের অনুরোধ, তারা যেন এ বিষয়গুলোর অগ্রগতি নিয়ে সচেতন থাকে, সময় সময় কাগজে তা প্রকাশ করে। আর এক দিনের নয়, বলা যায় প্রতিদিনের কাগজেই থাকে এ ধরনের ঘটনায় (দুর্ঘটনা বলব না) অবাধ মৃত্যুর খবর। অধিকাংশই শোকাবহ। কাজেই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সচেতনতা ও মতামত প্রকাশের দায়ও কিন্তু গণমাধ্যমের রয়েছে এবং তা জাতীয় স্বার্থের দায়।
এ লেখা যখন শেষ তখনি পত্রিকার প্রথম পাতার খবর : 'মর্মান্তিক দুর্ঘটনা'_'অকালেই ঝরে গেলেন সাংবাদিক বেলাল'। যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় রোকেয়া সরণির আগারগাঁও এলাকায় সাংবাদিক বেলাল হোসেনের (বয়স ৩৩ বছর) মৃত্যু। তিনি 'সময়' টেলিভিশনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক
আর কদিন পর 'সব ঠিক হয়ে যাবে'_ওই যেমন টিভি সিরিয়ালগুলোর বহু কথিত 'ডায়ালগ'। হ্যাঁ, সবই ঠিকঠাক চলবে, তবে সহজে চলতে চাইবে না ওই প্রয়াতদের মা-বাবার সংসার, তাদের ভাইবোনের গভীর শোক নানা সূত্রে উথলে উঠবে। মা-বাবা চাইবেন সেই রক্তঝরা শোক সামলাতে। সময়ের ধুলোয় একসময় হয়তো সব ঢাকা পড়বে, আবার পড়বেও না।
এর মধ্যেই যথারীতি ঘটতে থাকবে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা, যা বাংলাদেশের সড়ক-জনপথে ডালভাতের মতো সচরাচর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু 'হাইওয়ে'তেই নয়, কাগজপড়ুয়াদের মনে পড়তে পারে, শাহবাগের কাছে একাধিক ছাত্রছাত্রী বেহাল চালকের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিয়েছে। ক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে ভাঙচুরের শিকার হয়েছে অনেক নিরপরাধ যান। কিন্তু সেই সব ঘাতক চালকের কী শাস্তি হয়েছে, আদৌ হয়েছে কি না আমরা জানি না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কদিনের শোক_তারপর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এমনটাই স্বাভাবিক।
লক্ষ করার মতো বিষয় যে এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, প্রশাসন ও সব সূত্র থেকে শোক প্রকাশসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা ঘোষণা দেওয়া হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া অকুস্থলে পেঁৗছে স্বজনহারাদের কান্নায় সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করেন। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ বলেছেন, 'এই কান্নার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।' এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবেন না।
কিন্তু প্রশ্ন, কে খেয়াল রাখবেন? দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে তার উপায় নিয়ে কেউ ভাবছেন না। পথে পথে প্রতিদিন একের পর এক দুর্ঘটনায় যাত্রী বা পথচারীদের মৃত্যু যেন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু গাড়ি ভাঙচুর (যা আদৌ ন্যায়সংগত নয়), এরপর সব শেষ। অথচ সবাই জানেন, এসব কথিত দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কারণ গাড়িচালকের অবহেলা, অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে রাস্তার অন্য গাড়ি অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার দুর্দমনীয় চেষ্টা, অত্যধিক সুরাপান বা মাদক সেবন করে গাড়ি চালানোর মতো ঘটনাবলি। বড় কথা, বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালানো।
এ ছাড়া একাধিক নতুন উপদ্রবের মধ্যে অন্যতম হলো 'হেলপার' বা শিক্ষানবিসের গাড়ি চালনা। একাধিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এমন খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিকার হিসেবে কেউ হয়তো বলবেন, দরকার সর্বাংশে 'ফিট' গাড়ির রাস্তায় চলা নিশ্চিত করা, চালকদের সর্বমাত্রিক প্রশিক্ষণ, এমনকি মানসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তাতেই কি কাজ হবে? কে তোয়াক্কা করে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের, নিয়মকানুন মেনে চলার? নিয়ম না মানাই তো এখানকার নিয়ম! নিয়ম মানার সংস্কৃতি এখনো অনেক দূরে।
তাই আমাদের বিবেচনায় ওই সড়কমৃত্যু ঠেকাতে দরকার কঠোর আইন, ঘাতক ড্রাইভারের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানসংবলিত আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন। প্রচলিত আইনে শাস্তির বিধান কঠিন নয় বলেই গাড়িচালক বেপরোয়া বা বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালাতে উৎসাহ বোধ করে থাকে।
একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখেছি, 'সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার মামলায় ঘাতক চালকের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। একজন মারা গেলে যে শাস্তি, ৫০ জন মারা গেলেও ওই একই মেয়াদে শাস্তি'_অর্থাৎ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। এই উদ্ভট প্রাচীন আইনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন। না হলে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কোনোটাই কমবে না।
আরেকটি কথা। এ জাতীয় মৃত্যুর ঘটনাকে কোনোক্রমেই দুর্ঘটনা বলা চলে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত কারণে এগুলোকে হত্যাকাণ্ডরূপে বিবেচনা করা উচিত এবং সে হিসেবে বিচার হওয়া দরকার। অনেকেরই হয়তো মনে থাকার কথা, আশির দশকে পরপর কয়েকটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘাতক চালকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন চালুর চেষ্টা করেছিলেন। তাতে সমর্থন ছিল দেশের নাগরিক-সাধারণের। কিন্তু গাড়িচালক ও মালিকদের প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের মুখে প্রয়োজনীয় শাস্তির ধারা বাতিল করতে হয়। সত্যিই বিচিত্র এই দেশ!
বিচিত্র বলছি এ জন্য যে অনেকটা এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, এই চট্টগ্রামের সড়কেই 'টেম্পো দুর্ঘটনায় ১১ ক্রিকেটারের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ঘাতক চালকের সাজা হয়েছিল মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড।' এমন অনেক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে পত্র-পত্রিকায়। স্বজন হারানো মানুষের দাবি, 'এ ধরনের ঘটনায় যাতে ঘাতক চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়।' কিন্তু আইন সে পথে চলে না।
গত ১৬ জুলাইয়ের কাগজে দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর অকুস্থল সফরের বিস্তারিত বিবরণ। সঙ্গে কয়েকজন মন্ত্রী। পড়েছি শোকাহত স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে 'প্রধানমন্ত্রীর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ার' কথা। তিনি বলেছেন, 'এভাবে মায়ের কোল খালি হোক, আমরা তা চাই না। রাস্তায় কেন দুর্ঘটনা হয়, তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
বর্তমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'ঘটনার সব কিছু খতিয়ে দেখা হবে। কোনো হেলপার গাড়ি চালাতে পারবে না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো যাবে না।' এ বিষয়ে আমরা বলি, প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা যেন কার্যকর হয়। তার চেয়েও বড় কথা, ফিট নয়, এমন গাড়ির 'ফিটনেস' পেতে তো খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। কাজেই ওই দিকটাতেও প্রধানমন্ত্রীর নজর দিতে হবে। তবু কথা হচ্ছে, কোনো ব্যবস্থাতেই কিছু হবে না, সড়ক হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না, যদি না ঘাতক চালকের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন প্রণীত এবং সে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়। প্রসঙ্গত বলি, এসব দিক থেকে গাড়ির মালিকের দায়ও কম নয়। সেদিকেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ও আইনপ্রণেতার নজর দেওয়া দরকার। ঢাকার রাজপথে কিছুসংখ্যক বাসের চেহারা ও তেমনি কিছু ট্রাকের চলন দেখলে সংগত কারণে সন্দেহ হয়_এগুলো 'ফিটনেস' পাওয়ার যোগ্যতা রাখে কি না।
বর্তমান মর্মান্তিক ঘটনার অনুরূপ ঘটনা আবার যে ঘটবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই বলেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আমাদের আহ্বান, অন্তত এ ঘটনাটি যাতে হালকা আইনি ধারার মধ্য দিয়ে পার হতে না পারে, সে জন্য অবিলম্বে অনুরূপ ঘটনায় যাতে ঘাতক গাড়িচালকের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়, সে জন্য আইনমন্ত্রীকে তিনি যেন নির্দেশ দেন এবং আইন যাতে দ্রুত প্রণীত হয় সেদিকে নজর রাখেন।
কারণ ইতিমধ্যে ওই ঘাতক গাড়িচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে। এসব কিছুটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। আমরা চাই অর্থাৎ দেশবাসীও চাইবে এবং তা বলার অপেক্ষা রাখে না, ইতিমধ্যে অর্থাৎ তদন্ত শেষ হওয়া এবং বিচার শুরু হওয়ার আগেই বা এর মধ্যেই যাতে আকাঙ্ক্ষিত আইনটি পাস হয়। যাতে ওই ঘাতকের যথোচিত শাস্তি নতুন আইনে হয়। তাতে নিহত ছাত্রদের মা-বাবা ও স্বজনরা এবং শোকার্ত দেশবাসী কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেতে পারেন।
আর দৈনিক পত্রিকা অর্থাৎ গণমাধ্যমের প্রতি আমাদের অনুরোধ, তারা যেন এ বিষয়গুলোর অগ্রগতি নিয়ে সচেতন থাকে, সময় সময় কাগজে তা প্রকাশ করে। আর এক দিনের নয়, বলা যায় প্রতিদিনের কাগজেই থাকে এ ধরনের ঘটনায় (দুর্ঘটনা বলব না) অবাধ মৃত্যুর খবর। অধিকাংশই শোকাবহ। কাজেই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সচেতনতা ও মতামত প্রকাশের দায়ও কিন্তু গণমাধ্যমের রয়েছে এবং তা জাতীয় স্বার্থের দায়।
এ লেখা যখন শেষ তখনি পত্রিকার প্রথম পাতার খবর : 'মর্মান্তিক দুর্ঘটনা'_'অকালেই ঝরে গেলেন সাংবাদিক বেলাল'। যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় রোকেয়া সরণির আগারগাঁও এলাকায় সাংবাদিক বেলাল হোসেনের (বয়স ৩৩ বছর) মৃত্যু। তিনি 'সময়' টেলিভিশনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক
No comments