ভালেন্টাইন দিবস-ভালোবাসা কারে কয়! by মোহীত উল আলম
ভ্যালেন্টাইনস ডে, ১৪ ফেব্রুয়ারি। দিনটি উৎসর্গ করা হয় সন্ত ভ্যালেন্টাইনরা (একাধিক) যাঁরা প্রাচীন রোমে এবং অন্যান্য শহরে নানা কারণে শহীদ হন, তাঁদের উদ্দেশে। কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি এক অজানা কারণে সন্ত ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক যুক্ত হয়ে উদ্যাপিত হতে থাকে।
আধুনিক যুগে ভ্যালেন্টাইনস ডে হূদয়ের পান পাতার মতো প্রতীকী ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী বিপুল উৎসাহে উদ্যাপিত হয়। এ আলোকে ভালোবাসার ওপর ইতিহাস ও সাহিত্য-আখ্যাননির্ভর একটি রচনা পেশ করছি।
রবীন্দ্রনাথের এক সখী আরেক সখীকে জিজ্ঞেস করছে, ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়?’ দিবস রজনী সবাই ভালোবাসার কথা বলে, কিন্তু সেটা কী? পৃথিবীতে এর চেয়ে আর কোনো গভীর ক্রন্দন আছে কি না জানি না। বৃদ্ধ সম্রাট শাহজাহান জীবনের শেষ আট বছর পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী অবস্থায় কাটান। শুধু একটি দয়া তিনি পিতাকে করেছিলেন। যে আগ্রা দুর্গে পিতাকে বন্দী রেখেছিলেন, সেখানে একটা গবাক্ষ রাখলেন, যেখান থেকে যমুনা নদীর পাড়ে শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহলকে দেখা যেত, যার পাষাণ বেদির তলায় চিরশায়িত ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ জাহান। নজরুল লিখলেন, ‘যমুনার তীরে শাহজাহানের স্বপ্ন শতদল/ তাজমহল’।
ইংল্যান্ডের দুর্ধর্ষ রাজা চণ্ড স্বভাবের অষ্টম হেনরি প্রেমে পড়লেন এ্যান বলিন নামের এক প্রটেস্ট্যান্ট রমণীর। রমণীর মন গলাতে তিনি ঘোড়সওয়ারের দ্বারা দীর্ঘ দীর্ঘ প্রেমপত্র পাঠাতে লাগলেন। ওই চিঠিগুলো রমণীর মন গলাল, কিন্তু বাদ সাধলেন রোম থেকে পোপ। ইংল্যান্ড তখনো ক্যাথলিক রাজ্য। রোমের পোপ হচ্ছে এর ধর্মীয় গুরু। কিন্তু রাজা হেনরি পোপের কথা শুনবেন কেন! ইংল্যান্ডকে তিনি প্রটেস্ট্যান্ট দেশ করলেন। বললেন, ইংল্যান্ড একটি স্বাধীন দেশ, কাজেই এর চার্চও স্বাধীন। আসল কারণ প্রটেস্ট্যান্ট রমণী এ্যান বলিনকে তিনি বিয়ে করবেনই। বিয়ের কারণে রাষ্ট্রের ধর্ম বদল হয়ে গেল। সহসা এ্যান বলিন এলিজাবেথের জন্ম দিলেন। এলিজাবেথ পরে ১৫৫৮ সালে ইংল্যান্ডের রানি হন, কিন্তু তার বহু আগেই তাঁর পিতা রাজা হেনরি তাঁর মাকে দুশ্চরিত্র রমণী অভিধা দিয়ে গিলোটিনে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এককালের প্রেমিকা এবং পরে রানি এ্যান বলিন তাঁর স্বামীর কাছে ব্যভিচারিণী আখ্যা পেয়ে নিহত হলেন। ভালোবাসা কারে কয়?
মিসরের রানি ক্লিওপেট্রা এন্টনির বিরহে কাতর। সেই যে এন্টনি রোমে গেছে একটা বিবাদ নিরসনের জন্য আর ফেরার নাম নেই। এদিকে ক্লিওপেট্রা দিনে বিশ-ত্রিশজন করে বার্তাবাহক পাঠাচ্ছেন আলেকজান্দ্রিয়া থেকে রোমে এন্টনি কী করছে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য। পারিষদ আলেক্সাস রানিকে বলছেন, ‘রানি মাতা, এত সংবাদবাহক পাঠানোর দরকার কী?’ ক্লিওপেট্রার জবাব, ‘দরকার হলে পুরো মিসর জনশূন্য করে দেব, আর যেদিন বার্তাবাহক পাঠাতে পারব না সেদিন যেন নীল নদের মাছ আমাকে ভক্ষণ করে, কিন্তু আমার এন্টনির খবর আমার চাই-ই।’ অধৈর্য প্রতীক্ষা! আমাদের শচীনদেব বর্মন ডুকরে উঠে গাইছেন, ‘জ্বালাইয়া চাঁদের বাতি জেগে রব সারা রাতি গো’। কিন্তু ক্লিওপেট্রা যেটা শুনলেন তাতে তাঁর অক্কা পাওয়ার মতো অবস্থা। এন্টনি নাকি অক্টেভিয়াস সিজারের বিধবা বোন অক্টেভিয়াকে বিয়ে করেছেন!
ক্লিওপেট্রার তখন সংবাদবাহককে জেরা শুরু হলো:
-‘মেয়েটাকে তুমি দেখছ?’
-‘জি।’
-‘দেখতে কেমন?’
-‘তেমন কিছু না, সাধারণ, আমাদের গোয়ালিনীদের মতো।’
-‘গলার স্বর?’
-‘ম্যাডাম, কর্কশ।’
-‘মুখের ছাঁদ কেমন?’
এ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আবার সংবাদবাহককে হুঁশিয়ারও করে দিচ্ছেন ক্লিওপেট্রা: ‘সাবধান, তুমি কিন্তু রানি দেখতে কী রকম হয়, তা জানো।’
ক্লিওপেট্রার মুখের ছাঁদ ছিল লম্বাটে। তাই সংবাদবাহক বলল, ‘ম্যাডাম, গোলাকার।’
-‘কপাল?’
-‘ম্যাডাম, ছোট।’
-‘হাঁটার ভঙ্গি?’
-‘ম্যাডাম, জড় পদার্থের মতো। হাঁটছে না দাঁড়িয়ে আছে বোঝা যায় না।’
-‘বয়স?’
-‘ম্যাডাম’ বলে সংবাদবাহক যে সংখ্যাটা বলল, ক্লিওপেট্রা দেখলেন তাঁর বয়স অক্টেভিয়া চেয়ে অনেক বেশি। তাই উত্তরটা তিনি আমলে না নিয়ে আর কয়েকটা মামুলি প্রশ্ন করে সখীদের তৃপ্ত হয়ে বললেন, ‘যাক, এন্টনি বেশি দিন এ রমণীর সঙ্গে ঘর করবেন না।’
এদিকে শেক্সপিয়ারের রোমিও আর জুলিয়েটের কথায় আসি। জুলিয়েট জানে না যে রোমিও চুপিসারে এসে তার ব্যালকনির তলায় দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছে। সে তো এদিকে ‘রোমিও, রোমিও’ করে জান দিয়ে দিচ্ছে। বলছে, ‘কেন তোমার নাম রোমিও হলো। অন্য কিছু হলেও তো তুমি আমার কাছে রোমিও থাকতে।’ আবার বলছে, ‘নামে কী এসে যায়! গোলাপকে যে নামেই ডাকো না কেন, গোলাপ গোলাপই।’ জুলিয়েট যখন রেলিংয়ে ভর দিয়ে চিবুকে হাত রেখে রাত্রির উদ্দেশে তার ভাবনাগুলো ছুড়ে দিচ্ছে, তখন রোমিও নিচে থেকে বলছে, ‘ইশ্, আমি যদি তার হাতের দস্তানা হতাম, তাহলে তো আমি তার চিবুক ছুতে পারতাম।’ রোমিও শেষ পর্যন্ত যখন জানান দেয় যে সে এতক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে জুলিয়েটের প্রেম-স্ফুরিত শ্লোক শুনছিল, জুলিয়েট জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে এখানে কে পথ দেখাল।’ রোমিওর উত্তর: ‘আমার ভালোবাসা।’ জুলিয়েট বলল, ‘এত সুউচ্চ প্রাচীর টপকালে কীভাবে?’ রোমিও বলল, ‘আমার প্রেমের কাছে পাথুরে বাধা কোনো বাধা নয়।’ জুলিয়েট বলল, ‘প্রহরীরা দেখলে তোমাকে মেরে ফেলবে।’ রোমিও বলল, ‘তোমার চোখে যদি দেখি আমাকে প্রত্যাখ্যান করার আলো, সেটাই আমাকে মেরে ফেলবে, অন্যথায় কুড়িজন প্রহরীও তাদের নাঙা তলোয়ার নিয়ে আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।’ শিল্পী নামক চলচ্চিত্রে সুচিত্রা তাঁর ধনী পিতা বিকাশ রায়কে বলছেন, ‘আমি রায়, রায় বংশের মেয়ে অঞ্জনা রায় নই, আমি শিল্পী ধীমান পালের (উত্তমকুমার) স্ত্রী অঞ্জনা পাল।’ প্রেমের জন্য ধনী ঘরের তনয়া সুচিত্রা গরিব শিল্পী-প্রেমিক উত্তমকে নিয়ে ঘর ছাড়বেনই। সেটি অবশ্য হয়নি। সিনেমাটি বিয়োগান্ত।
রবীন্দ্রনাথের গান ঋতু গুহ গাইছেন, ‘আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ।’ আর দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে ওসমান আয়েশাকে কহিলেন, ‘আমি আশা-লতা ধরিয়া আছি, আর কত কাল তাহার তলে জলসিঞ্চন করিব?’ কারণ, তখন আয়েশার মন পড়ে গেছে আহত শত্রুপক্ষের বীর জগৎ সিংয়ের ওপর।
আমেরিকান ঔপন্যাসিক এ্যাফ স্কট ফিটজারেলডের দ্য গ্রেট গ্যাটসবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্যাটসবির বুকটা খাঁ খাঁ করে জ্বলছে তাঁর প্রণয়িনী ডেইজির ভালোবাসা পায়নি বলে। তাঁর অবস্থা সচ্ছল ছিল না বলে ডেইজি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। গ্যাটসবি তখন বিভিন্ন চোরা পথে নানা কারবার করে বিরাট ধনী হয়ে ডেইজির ধনী স্বামীর প্রতিবেশী এলাকায় বাড়ি কেনেন। এ অবস্থায় আসতে গ্যাটসবির সময় লাগে পাঁচটি বছর। কিন্তু এ সময়ে মুহূর্তের জন্যও তিনি ডেইজিকে ভোলেননি। পুনঃপরিচয়ের পর একদিন তিনি ডেইজিকে তাঁর বাসায় নিয়ে আসেন। ওয়ার্ডরোব খুলে তাঁর দামী দামী শার্ট টেবিলের ওপর একটার পর একটা বের করে স্তূপ করতে থাকে। একদিকে গ্যাটসবির তাঁর প্রতি অক্ষয় ভালোবাসা আর অন্যদিকে তাঁর (গ্যাটসবি) মূঢ়তা দেখে ডেইজি ওই শার্টগুলোর ওপর মাথা রেখে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকেন। ডেইজির মনে কখনো যে বস্তুকেন্দ্রিক ভালোবাসা ছিল না, যেটি গ্যাটসবি এত দিন ধরে মনে করে এসেছেন, সেই মনের ফাঁকটুকু বুঝতে পেরে ডেইজির এ কান্না।
ভালোবাসার আলো। আইরিশ গায়ক ক্রিস ডি বার্গ গাইছেন, যখন নিশুতি রাতে একলা হাঁটবে, তখন যদি আলোর দরকার হয়, তখন আমাকে তোমার হূদয়ে আলোর মতো বহন করো। ‘ক্যারি মি লাইক আ ফায়ার ইন ইয়োর হার্ট’। জন ডেনভার গাইছেন, ‘আমার অনুভূতিকে তুমি সেভাবে ভরে দাও, যেভাবে বনকে ঢেকে দেয় রাত্রি।’
ভালোবাসা ফুরিয়ে যায় না। ভালোবাসা বারবার আসে: ‘কে আবার বাজায় বাঁশি এ আমার ভাঙা কুঞ্জে’।
ইংরেজি কবি আর্নেস্ট ডসনের সেই আকুতিই মনে হয় যেন সত্য: সিনারা, আমি তোমার প্রতি আমার মতো করেই সৎ ছিলাম। ‘আই হ্যাভ বিন ফেইথফুল টু দি, সিনারা, ইন মাই ফ্যাশন’।
আমেরিকান গায়ক সাইমন গাইছেন, ‘লাইক আ ব্রিজ ওভার ট্রাবলড ওয়াটারস/ আই উল লে মি ডাউন’। তোমার জন্য, তোমার বিপদের সময় আমি নিজেকে বিক্ষুব্ধ নদীর ওপর সেতুর মতো বিছিয়ে দেব।
ভালোবাসার মহিমা ফুটে ওঠে ত্যাগে, প্রাপ্তিতে নয়, এ যেন ভ্যালেন্টাইনস ডের মূল সুর।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মানববিদ্যা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস।
রবীন্দ্রনাথের এক সখী আরেক সখীকে জিজ্ঞেস করছে, ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়?’ দিবস রজনী সবাই ভালোবাসার কথা বলে, কিন্তু সেটা কী? পৃথিবীতে এর চেয়ে আর কোনো গভীর ক্রন্দন আছে কি না জানি না। বৃদ্ধ সম্রাট শাহজাহান জীবনের শেষ আট বছর পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী অবস্থায় কাটান। শুধু একটি দয়া তিনি পিতাকে করেছিলেন। যে আগ্রা দুর্গে পিতাকে বন্দী রেখেছিলেন, সেখানে একটা গবাক্ষ রাখলেন, যেখান থেকে যমুনা নদীর পাড়ে শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহলকে দেখা যেত, যার পাষাণ বেদির তলায় চিরশায়িত ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ জাহান। নজরুল লিখলেন, ‘যমুনার তীরে শাহজাহানের স্বপ্ন শতদল/ তাজমহল’।
ইংল্যান্ডের দুর্ধর্ষ রাজা চণ্ড স্বভাবের অষ্টম হেনরি প্রেমে পড়লেন এ্যান বলিন নামের এক প্রটেস্ট্যান্ট রমণীর। রমণীর মন গলাতে তিনি ঘোড়সওয়ারের দ্বারা দীর্ঘ দীর্ঘ প্রেমপত্র পাঠাতে লাগলেন। ওই চিঠিগুলো রমণীর মন গলাল, কিন্তু বাদ সাধলেন রোম থেকে পোপ। ইংল্যান্ড তখনো ক্যাথলিক রাজ্য। রোমের পোপ হচ্ছে এর ধর্মীয় গুরু। কিন্তু রাজা হেনরি পোপের কথা শুনবেন কেন! ইংল্যান্ডকে তিনি প্রটেস্ট্যান্ট দেশ করলেন। বললেন, ইংল্যান্ড একটি স্বাধীন দেশ, কাজেই এর চার্চও স্বাধীন। আসল কারণ প্রটেস্ট্যান্ট রমণী এ্যান বলিনকে তিনি বিয়ে করবেনই। বিয়ের কারণে রাষ্ট্রের ধর্ম বদল হয়ে গেল। সহসা এ্যান বলিন এলিজাবেথের জন্ম দিলেন। এলিজাবেথ পরে ১৫৫৮ সালে ইংল্যান্ডের রানি হন, কিন্তু তার বহু আগেই তাঁর পিতা রাজা হেনরি তাঁর মাকে দুশ্চরিত্র রমণী অভিধা দিয়ে গিলোটিনে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এককালের প্রেমিকা এবং পরে রানি এ্যান বলিন তাঁর স্বামীর কাছে ব্যভিচারিণী আখ্যা পেয়ে নিহত হলেন। ভালোবাসা কারে কয়?
মিসরের রানি ক্লিওপেট্রা এন্টনির বিরহে কাতর। সেই যে এন্টনি রোমে গেছে একটা বিবাদ নিরসনের জন্য আর ফেরার নাম নেই। এদিকে ক্লিওপেট্রা দিনে বিশ-ত্রিশজন করে বার্তাবাহক পাঠাচ্ছেন আলেকজান্দ্রিয়া থেকে রোমে এন্টনি কী করছে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য। পারিষদ আলেক্সাস রানিকে বলছেন, ‘রানি মাতা, এত সংবাদবাহক পাঠানোর দরকার কী?’ ক্লিওপেট্রার জবাব, ‘দরকার হলে পুরো মিসর জনশূন্য করে দেব, আর যেদিন বার্তাবাহক পাঠাতে পারব না সেদিন যেন নীল নদের মাছ আমাকে ভক্ষণ করে, কিন্তু আমার এন্টনির খবর আমার চাই-ই।’ অধৈর্য প্রতীক্ষা! আমাদের শচীনদেব বর্মন ডুকরে উঠে গাইছেন, ‘জ্বালাইয়া চাঁদের বাতি জেগে রব সারা রাতি গো’। কিন্তু ক্লিওপেট্রা যেটা শুনলেন তাতে তাঁর অক্কা পাওয়ার মতো অবস্থা। এন্টনি নাকি অক্টেভিয়াস সিজারের বিধবা বোন অক্টেভিয়াকে বিয়ে করেছেন!
ক্লিওপেট্রার তখন সংবাদবাহককে জেরা শুরু হলো:
-‘মেয়েটাকে তুমি দেখছ?’
-‘জি।’
-‘দেখতে কেমন?’
-‘তেমন কিছু না, সাধারণ, আমাদের গোয়ালিনীদের মতো।’
-‘গলার স্বর?’
-‘ম্যাডাম, কর্কশ।’
-‘মুখের ছাঁদ কেমন?’
এ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আবার সংবাদবাহককে হুঁশিয়ারও করে দিচ্ছেন ক্লিওপেট্রা: ‘সাবধান, তুমি কিন্তু রানি দেখতে কী রকম হয়, তা জানো।’
ক্লিওপেট্রার মুখের ছাঁদ ছিল লম্বাটে। তাই সংবাদবাহক বলল, ‘ম্যাডাম, গোলাকার।’
-‘কপাল?’
-‘ম্যাডাম, ছোট।’
-‘হাঁটার ভঙ্গি?’
-‘ম্যাডাম, জড় পদার্থের মতো। হাঁটছে না দাঁড়িয়ে আছে বোঝা যায় না।’
-‘বয়স?’
-‘ম্যাডাম’ বলে সংবাদবাহক যে সংখ্যাটা বলল, ক্লিওপেট্রা দেখলেন তাঁর বয়স অক্টেভিয়া চেয়ে অনেক বেশি। তাই উত্তরটা তিনি আমলে না নিয়ে আর কয়েকটা মামুলি প্রশ্ন করে সখীদের তৃপ্ত হয়ে বললেন, ‘যাক, এন্টনি বেশি দিন এ রমণীর সঙ্গে ঘর করবেন না।’
এদিকে শেক্সপিয়ারের রোমিও আর জুলিয়েটের কথায় আসি। জুলিয়েট জানে না যে রোমিও চুপিসারে এসে তার ব্যালকনির তলায় দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছে। সে তো এদিকে ‘রোমিও, রোমিও’ করে জান দিয়ে দিচ্ছে। বলছে, ‘কেন তোমার নাম রোমিও হলো। অন্য কিছু হলেও তো তুমি আমার কাছে রোমিও থাকতে।’ আবার বলছে, ‘নামে কী এসে যায়! গোলাপকে যে নামেই ডাকো না কেন, গোলাপ গোলাপই।’ জুলিয়েট যখন রেলিংয়ে ভর দিয়ে চিবুকে হাত রেখে রাত্রির উদ্দেশে তার ভাবনাগুলো ছুড়ে দিচ্ছে, তখন রোমিও নিচে থেকে বলছে, ‘ইশ্, আমি যদি তার হাতের দস্তানা হতাম, তাহলে তো আমি তার চিবুক ছুতে পারতাম।’ রোমিও শেষ পর্যন্ত যখন জানান দেয় যে সে এতক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে জুলিয়েটের প্রেম-স্ফুরিত শ্লোক শুনছিল, জুলিয়েট জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে এখানে কে পথ দেখাল।’ রোমিওর উত্তর: ‘আমার ভালোবাসা।’ জুলিয়েট বলল, ‘এত সুউচ্চ প্রাচীর টপকালে কীভাবে?’ রোমিও বলল, ‘আমার প্রেমের কাছে পাথুরে বাধা কোনো বাধা নয়।’ জুলিয়েট বলল, ‘প্রহরীরা দেখলে তোমাকে মেরে ফেলবে।’ রোমিও বলল, ‘তোমার চোখে যদি দেখি আমাকে প্রত্যাখ্যান করার আলো, সেটাই আমাকে মেরে ফেলবে, অন্যথায় কুড়িজন প্রহরীও তাদের নাঙা তলোয়ার নিয়ে আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।’ শিল্পী নামক চলচ্চিত্রে সুচিত্রা তাঁর ধনী পিতা বিকাশ রায়কে বলছেন, ‘আমি রায়, রায় বংশের মেয়ে অঞ্জনা রায় নই, আমি শিল্পী ধীমান পালের (উত্তমকুমার) স্ত্রী অঞ্জনা পাল।’ প্রেমের জন্য ধনী ঘরের তনয়া সুচিত্রা গরিব শিল্পী-প্রেমিক উত্তমকে নিয়ে ঘর ছাড়বেনই। সেটি অবশ্য হয়নি। সিনেমাটি বিয়োগান্ত।
রবীন্দ্রনাথের গান ঋতু গুহ গাইছেন, ‘আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ।’ আর দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে ওসমান আয়েশাকে কহিলেন, ‘আমি আশা-লতা ধরিয়া আছি, আর কত কাল তাহার তলে জলসিঞ্চন করিব?’ কারণ, তখন আয়েশার মন পড়ে গেছে আহত শত্রুপক্ষের বীর জগৎ সিংয়ের ওপর।
আমেরিকান ঔপন্যাসিক এ্যাফ স্কট ফিটজারেলডের দ্য গ্রেট গ্যাটসবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্যাটসবির বুকটা খাঁ খাঁ করে জ্বলছে তাঁর প্রণয়িনী ডেইজির ভালোবাসা পায়নি বলে। তাঁর অবস্থা সচ্ছল ছিল না বলে ডেইজি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। গ্যাটসবি তখন বিভিন্ন চোরা পথে নানা কারবার করে বিরাট ধনী হয়ে ডেইজির ধনী স্বামীর প্রতিবেশী এলাকায় বাড়ি কেনেন। এ অবস্থায় আসতে গ্যাটসবির সময় লাগে পাঁচটি বছর। কিন্তু এ সময়ে মুহূর্তের জন্যও তিনি ডেইজিকে ভোলেননি। পুনঃপরিচয়ের পর একদিন তিনি ডেইজিকে তাঁর বাসায় নিয়ে আসেন। ওয়ার্ডরোব খুলে তাঁর দামী দামী শার্ট টেবিলের ওপর একটার পর একটা বের করে স্তূপ করতে থাকে। একদিকে গ্যাটসবির তাঁর প্রতি অক্ষয় ভালোবাসা আর অন্যদিকে তাঁর (গ্যাটসবি) মূঢ়তা দেখে ডেইজি ওই শার্টগুলোর ওপর মাথা রেখে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকেন। ডেইজির মনে কখনো যে বস্তুকেন্দ্রিক ভালোবাসা ছিল না, যেটি গ্যাটসবি এত দিন ধরে মনে করে এসেছেন, সেই মনের ফাঁকটুকু বুঝতে পেরে ডেইজির এ কান্না।
ভালোবাসার আলো। আইরিশ গায়ক ক্রিস ডি বার্গ গাইছেন, যখন নিশুতি রাতে একলা হাঁটবে, তখন যদি আলোর দরকার হয়, তখন আমাকে তোমার হূদয়ে আলোর মতো বহন করো। ‘ক্যারি মি লাইক আ ফায়ার ইন ইয়োর হার্ট’। জন ডেনভার গাইছেন, ‘আমার অনুভূতিকে তুমি সেভাবে ভরে দাও, যেভাবে বনকে ঢেকে দেয় রাত্রি।’
ভালোবাসা ফুরিয়ে যায় না। ভালোবাসা বারবার আসে: ‘কে আবার বাজায় বাঁশি এ আমার ভাঙা কুঞ্জে’।
ইংরেজি কবি আর্নেস্ট ডসনের সেই আকুতিই মনে হয় যেন সত্য: সিনারা, আমি তোমার প্রতি আমার মতো করেই সৎ ছিলাম। ‘আই হ্যাভ বিন ফেইথফুল টু দি, সিনারা, ইন মাই ফ্যাশন’।
আমেরিকান গায়ক সাইমন গাইছেন, ‘লাইক আ ব্রিজ ওভার ট্রাবলড ওয়াটারস/ আই উল লে মি ডাউন’। তোমার জন্য, তোমার বিপদের সময় আমি নিজেকে বিক্ষুব্ধ নদীর ওপর সেতুর মতো বিছিয়ে দেব।
ভালোবাসার মহিমা ফুটে ওঠে ত্যাগে, প্রাপ্তিতে নয়, এ যেন ভ্যালেন্টাইনস ডের মূল সুর।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মানববিদ্যা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস।
No comments