চরাচর-কমিউনিটি রেডিও by বদরুল হায়দার চৌধুরী

চলতি জুলাই মাসের মধ্যে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিটি রেডিওর সম্প্রচার কার্যক্রম শুরু হবে। ইতিমধ্যেই বরগুনা থেকে 'লোক বেতার' নামে একটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন পরীক্ষামূলক সম্প্রচার কার্যক্রম শুরু করেছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে 'রেডিও সাগরগিরি' এবং কঙ্বাজার থেকে 'রেডিও নাফ'-এর সম্প্রচার প্রস্তুতি প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পেঁৗছেছে। এ ধরনের মোট ১৪টি কমিউনিটি রেডিও স্টেশনকে সরকার সম্প্রচারের অনুমতি দিয়েছে।


এসব রেডিও স্টেশন দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল এবং অনগ্রসর জনপদ থেকে সম্প্রচার কার্যক্রম চালাবে। উদ্দেশ্য, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। দেশের প্রতিষ্ঠিত এনজিওগুলো সম্পূর্ণ জনস্বার্থে এসব রেডিও স্টেশন পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। কেমন হবে এর যাত্রাপথ? এর অনুষ্ঠানমালা কেমন হবে? বাণিজ্যিক রেডিওর সঙ্গে এর পার্থক্য কেমন হবে? এ রকম নানা প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে। প্রশ্ন যেমনই থাকুক, তবে বলা যায়, কমিউনিটির স্বার্থ রক্ষায় এ রেডিও স্টেশনগুলো অনন্য ভূমিকা পালন করবে। কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্তগুলো দেখে এমনটিই মনে হচ্ছে। প্রথম শর্তই হচ্ছে, বাণিজ্যিকভাবে একে ব্যবহার করা যাবে না। এটি হবে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের রেডিওর সম্প্রচার কার্যক্রম একমাত্র বিজ্ঞাপননির্ভর হবে না। তবে টিকে থাকার জন্য, উন্নয়নমূলক সেবাসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন তারা প্রচার করতে পারবে। রেডিও স্টেশনের মালিকরা কোনোভাবেই অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু বা এর নীতিমালার ব্যাপারে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। কোনো একক ব্যক্তি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কমিউনিটি রেডিও স্টেশন পরিচালনার জন্য অনুমতি পাবে না। শুধু গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কল্যাণে কাজ করা এনজিও বা সরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো এ ধরনের রেডিও স্টেশন পরিচালনার অনুমতি পাবে। সরকারের দেওয়া এসব শর্ত উপকূলীয় ও দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামীণ জনপদে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। শর্তগুলো কেউ অমান্য করছে কি না, তা দেখার জন্য রয়েছে একটি শক্তিশালী মনিটরিং কমিটি। এ কমিটিতে থাকবেন স্থানীয় ইউএনও, শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকৌশলী, নির্বাচিত প্রতিনিধি, বাংলাদেশ বেতারের প্রতিনিধি ও স্থানীয় একটি স্কুলের প্রধান। কমিটি প্রতি মাসে এ বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। এ কমিটি শুধু মনিটরিং নয়, অনুষ্ঠানমালার মানোন্নয়নেও কাজ করবে এবং প্রয়োজনে কাউন্সেলিং সেবা দেবে। কিছুটা দেরি হয়ে গেছে, তার পরও ভালো যে সরকার অবশেষে সমাজের কল্যাণে এ ধরনের বিশেষ রেডিওর ভূমিকা অনুধাবন করতে পেরেছে। পৃথিবীর উন্নত, অনুন্নত নানা দেশে কমিউনিটি রেডিও চালু রয়েছে। সমাজের গণসচেতনতা বাড়াতে গণশিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনোদন ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রামীণ অনুন্নত সমাজে উদ্দীপনা সৃষ্টিতে এটি একটি পরীক্ষিত মাধ্যম। বলিভিয়ার খনিশ্রমিকরা কমিউনিটি রেডিওকে তাদের জীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় কৌশলযন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। রেডিও স্টেশন সচল রাখার জন্য তারা প্রতি মাসে এক দিনের বেতন কর্তৃপক্ষকে দান করে দেয়। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে দিন দিন কমিউনিটি রেডিওর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বর্তমানে জাভা দ্বীপে চার শতাধিক কমিউনিটি রেডিও স্টেশন চালু রয়েছে। এ দ্বীপের ইয়োগিয়াকার্তায় অবস্থিত একটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের নাম 'অ্যাংক্রিংগান'। গ্রামের মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষায় এ স্টেশনটি পরিচালনা করে। আমাদের দেশটি গ্রামপ্রধান এবং অনুন্নত জনপদ। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও নানা রকম কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আমাদের দেশে আরো আগে থেকে এ ধরনের রেডিওর সম্প্রচার শুরু হলে সমাজে এর সুফল অনেক দীর্ঘ হতো। অনেকের ধারণা, দেশে কমিউনিটি রেডিও চালু থাকলে 'সিডর', 'আইলা' বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি অনেক কমানো যেত। উপকূলের মানুষ এর কল্যাণে আগেই দুর্যোগের খবর জেনে যেত। সময় পেত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার। এ ছাড়া খরা, চাষাবাদ, বাণিজ্য কৌশল, বাল্যবিবাহ রোধ ও গণশিক্ষা বাড়াতে নিঃসন্দেহে কমিউনিটি রেডিও অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
বদরুল হায়দার চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.