ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও এম জি কিবরিয়া সরকার-ইভিএম : কয়েকটি কারিগরি ও আইনি প্রশ্ন

এক. সম্প্রতি রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে ই-ভোটিং তথা ইভিএম। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জনসভায় বলছেন, ভোটে যাতে কারচুপি না হয়, সে জন্যই ই-ভোটিং। আর বিরোধী দল বলছে, তাদের হারানোর লক্ষ্যে সহজ কারচুপির জন্যই ই-ভোটিংব্যবস্থা। বাংলাদেশে ই-ভোটিংয়ের (ইভিএম) প্রয়োগ একদমই নতুন।


চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষুদ্র পরিসরে ইভিএমের যাত্রা শুরু। বিরোধী দলের একতরফাভাবে ই-ভোটিংকে 'নির্বাচনী কারচুপি' বলা আর সরকারের পক্ষ থেকে 'ই-ভোটিং মানেই জালিয়াতি বন্ধ'_এই দুই ধরনের কথার মধ্যে গলদ রয়েছে। সরকারের যেকোনো উন্নয়নকাজে বিরোধিতা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। সেদিক থেকে আমরা খুব অবাক হই না, যখন দেখি, একতরফাভাবে ই-ভোট নিয়ে বিরোধী দল জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে সরকার যদি 'ভোট জালিয়াতি বন্ধ'কে ই-ভোটিং বাস্তবায়নের এজেন্ডা হিসেবে রাজনীতির মাঠে চালাতে চায়, তাহলে সেটাও নিছক মিথ্যা কথা হিসেবেই প্রতিভাত হবে। ই-ভোটিং এক ধরনের যান্ত্রিক সুবিধা মাত্র। আর এর প্রয়োগ ঘটে মূলত ইভিএম যন্ত্রের মাধ্যমে। এই যন্ত্রকে আপনি ভালো, না খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন, তা নির্ভর করবে আর দশটি যন্ত্রের মতোই আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। তবে যন্ত্র কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর চলে না; চলে নির্দিষ্ট কিছু নীতি এবং নিয়মের মধ্য দিয়ে। সেক্ষেত্রে কোনো গলদ পরিলক্ষিত হলে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার পথ ধরে সমাধানের উপায় খোঁজা জরুরি।
দুই. নির্বাচন কমিশন চট্টগ্রামে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণের আগে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করে। প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাচন কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, যদি ইভিএমের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে এই নীতিমালার কিছুটা প্রভাব নিশ্চয়ই নির্বাচনী রাজনীতিতে পড়বে। সেক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই নীতিমালায় সংযোজন-বিয়োজন খুবই জরুরি হবে বলে আমাদের ধারণা। নির্বাচন কমিশন ই-ভোটিং নীতিমালার ৩ নম্বর এই ব্যালট সংক্রান্ত বিধিমালায় ভোটের নিয়ম-কানুন উল্লেখ করেছে। নিয়ম অনুযায়ী, ভোট প্রদান সম্পন্ন হওয়ার পর কোনো ব্যক্তি যদি দাবি করেন, তিনি পুরো বিষয়টি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি কিংবা তার কাছে জটিল মনে হওয়ায় ভুল করে অন্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিষয়টি চূড়ান্ত করে ফেলেছেন, এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের করণীয় কী, তা এখানে উল্লেখ নেই। লক্ষণীয়, বাংলাদেশের ভোটাররা একটি নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এ ধরনের ভুল এবং আশঙ্কা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং সংসদীয় নির্বাচনী বিধিতে এই বিষয়ের স্পষ্ট সমাধান থাকাটা খুবই জরুরি বলে মনে করার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কোনো ব্যক্তি ভোট দানের পর গোপন কক্ষ থেকে বেরিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যদি কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করেন, যন্ত্র সঠিকভাবে বুঝতে না পারায় তাঁর ভোটটি তিনি সঠিক জায়গায় দেননি এবং তিনি তাঁর আগের ভোটটি বাতিল করে পুনরায় ভোট দিতে চান, তাহলে অবশ্যই তাঁকে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। কারণ ইভিএমব্যবস্থা দেশে প্রথমবারের মতো চালু হতে যাচ্ছে। কাজেই এ ধরনের ভুল হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই গণনাজনিত জটিলতার অবসান হতে হবে। যেসব ভোটার তাঁদের আগের ভোট বাতিল করে তাৎক্ষণিকভাবে পুনরায় ভোট দিয়েছেন, তাঁদের নাম এবং ভোটার আইডি তাৎক্ষণিকভাবে পোলিং বুথে টানিয়ে দিতে হবে। আর যদি এত কিছু করা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে অন্তত প্রদানকৃত ভোটটি বাতিল করার সুযোগ থাকা উচিত।
তিন. আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং দলীয় পোলিং এজেন্টরা যদি এই ইভিএম সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা না রাখেন, তাহলে যন্ত্রটির প্রতি তাঁদের আস্থা কোনোভাবেই জন্মাবে না। এক ধরনের চিপ এই যন্ত্রের স্মৃতিশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হবে, যেটাকে বলা হচ্ছে ওয়ান টাইম প্রোগ্রাম্যাবল (ওটিপি) চিপ, যেখানে তথ্য একবার লিপিবদ্ধ হলে সেগুলো আর পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু এই ওটিপি পরীক্ষার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট যন্ত্র কি পোলিং এজেন্ট বা নির্বাচন পর্যবেক্ষকের হাতে থাকবে? না থাকলে শুধু যন্ত্রের বাহ্যিক দিক পর্যবেক্ষণ করে কিভাবে বোঝা সম্ভব হবে, সেটার ভেতর সবকিছু ঠিকঠাক আছে? বিধিমালার ৫ নম্বর ধারায় হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়্যার সম্পর্কে যেসব জটিল যান্ত্রিক বিষয় বলা হয়েছে, সেগুলো একজন পাড়াগাঁয়ের পোলিং এজেন্ট কিভাবে বুঝবেন, এটাও একটা প্রশ্ন। কেবল এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন এমন মানুষই পারেন এর কারিগরি দিকটির ভুল-ত্রুটির হিসাব-নিকাশ মিলাতে। ব্যালটিব্যবস্থায় যে কেউ অতি সহজেই সবকিছু বুুঝতে পারে, কিন্তু এ ব্যবস্থায় পোলিং এজেন্ট বা নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কমবেশি কারিগরি জ্ঞান না দিলে তাঁরা অন্ধকারে থেকে যাবেন এবং তাঁদের পক্ষ থেকে অস্বচ্ছতার আঙুল তোলা বিচিত্র কিছু নয়। সে জন্য নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক বা পোলিং এজেন্ট যদি ইভিএমকে চ্যালেঞ্জ করেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন সেই পরিস্থিতিতে কী ভূমিকা নেবে, সেটাও এই নীতিমালায় স্পষ্ট করা জরুরি।
চার. সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে ইভিএমের লালবাতি আর নীলবাতি জ্বলা দেখে এসে বাংলাদেশের কেউ কেউ এ দেশীয় পত্রিকায় সেটার প্রশস্তিগাথা রচনা করেছেন। লালবাতি সার্থকভাবে না জ্বললে যে সত্যিকারভাবে নির্বাচন কমিশনেরই লালবাতি জ্বলে যেতে পারে, সেটাও মাথায় রাখা জরুরি। ইভিএমের ওপর ভারতের জনগণের আস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি। ইভিএম যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘ ২০ বছর পাড়ি দিয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশন সেটাতে সাফল্য লাভ করে। সেখানে আস্থার জায়গাটা তাই এত শক্ত। তা ছাড়া ভারতের নির্বাচনী গণতন্ত্রের ইতিহাস আর আমাদেরটি এক নয়। তবে সরকার এবং বিরোধী দলের সম্পর্ক উন্নত হলে এ দেশেও অনেক কিছু সহজে সম্ভব হতে পারে। পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতারা তা বোঝেন না বা বুঝেও না বোঝার ভান করেন। ভারতের এই নির্বাচনে প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে। প্রতিটি পোলিং বুথ কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। তাই আমাদের মতো দেশে এত বিপুল সংখ্যক ভোটারের ভোট কিভাবে নিরাপদ হবে, তা ভেবে দেখার এখনই সময়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শুধু ইভিএমই যদি ভোট জালিয়াতি নিশ্চিত করত, তাহলে এত টাকা খরচ করে ভারতের এই নির্বাচনে প্রতিটি পোলিং বুথে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করার দরকার ছিল না। তাই এ দেশের নির্বাচনে ইভিএম প্রবর্তনের জন্য সব কারিগরি ত্রুটির কথা বিবেচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অন্যদিকে আমাদের নির্বাচনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট প্রদান যথাযথ হবে কি না, এ ব্যাপারে তাদের কারিগরি মতামত গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন বলে প্রতীয়মান হয়।
পাঁচ. বিভিন্ন কারণে গড়িমসি করে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল ও ইনফরমেশন সুপার হাইওয়েতে যোগ দিতে প্রায় এক যুগ দেরি করেছে। আর একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ তথ্যপ্রযুুক্তি নীতিমালার জন্য আমাদের প্রায় এক যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু তার পরও সেই নীতিমালায় ই-ভোটিং বা ইভিএম সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের উল্লেখ নেই। প্রশাসনিক কাজের ধীরগতি যেখানে উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা, সেখানে মাত্র একটি ওয়ার্ডের কয়েকটি পোলিং বুথে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে পুরো জাতীয় নির্বাচন ই-ভোটিংয়ের আওতায় আনা কতটা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত, তা আবারও ভেবে দেখা জরুরি। বিগত কয়েকটি উপনির্বাচন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। এ অবস্থায় কমিশন যদি আমাদের আশান্বিত করে এই বলে যে জাতীয় নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে, তাহলে আমরা আশাবাদী হতে রাজি। এর আগে স্থানীয় নির্বাচনের কয়েকটি আসনে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলেও নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত তা করেনি। তাই পুরো বিষয়টির কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। তবে নির্বাচন কমিশনের বড় আকারে একটি ইভিএম প্রকল্প হাতে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সামনে ঢাকা সিটি করপোরেশন বা অন্য কোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পুরোপুরি ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন যদি সফল হতে পারে, তাহলে অন্তত এ ব্যাপারে তাদের সক্ষমতা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবে না। কেবল সেই পরিস্থিতিতেই প্রতীয়মান হবে, আমরা শিগগিরই ইভিএম বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে সবার আগে এই চ্যালেঞ্জটি হাতে নেওয়া। ইভিএমের সফল বাস্তবায়ন এ দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে যে অনেক বড় উন্নতির স্বাক্ষর রাখবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ বাস্তবায়ন যেন কোনোভাবেই ইভিএমের সার্বিক প্রয়োগের সময়কে দীর্ঘায়িত না করে, সেটাই আমাদের উদ্বেগের বিষয়। সে জন্য ইভিএমের কারিগরি এবং আইনি প্রশ্নগুলো মোকাবিলা করে এর প্রতি সংশ্লিষ্টদের আস্থার জায়গাটি তৈরির কোনো বিকল্প নেই।

লেখকবৃন্দ : প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ডিরেক্টর-ইন-চার্জ, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, বিসিএস শিক্ষা এবং এম জি কিবরিয়া সরকার, এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল : janipop1995@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.