খোলা চোখে-তাহরির স্কয়ার-কায়রো, জুকোটি পার্ক-নিউইয়র্ক by হাসান ফেরদৌস
সাবওয়ে থেকে বেরোতেই কানে এল স্লোগান। একটা লম্বা মিছিল চলছে—মুখ্যত হাইতি থেকে আগত অভিবাসীদের, ওয়াল স্ট্রিটের দিকে। জুকোটি পার্কের দিকে না গিয়ে তারা বাঁয়ে ঘুরে সোজা এগিয়ে গেল। হাতে প্ল্যাকার্ড, কারও হাতে ড্রাম, হইহই করে চলেছে। খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই, এরা সবাই ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংহতি দেখাতে এসেছে।
মিছিল এড়িয়ে আমি জুকোটি পার্কের দিকে এগোই। শুক্রবারের বিকেল, সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। তেমন বড় কোনো পার্ক নয়, নিউইয়র্কে প্রায় সব আবাসিক এলাকায় এ ধরনের ছোট-বড় পার্ক রয়েছে, শহুরে মানুষেরা যাতে ইট-পাথরে থাকতে থাকতে সবুজের কথা একদম ভুলে না যায়, পায়ে হাঁটার বা শিশুদের নিয়ে খেলার সুযোগ পায়, সে কথা মনে রেখে নগর পরিকল্পনায় এ ধরনের পার্ক অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দূর থেকে কানে ভেসে এল ড্রামের শব্দ, ঠিক সমতানে নয়, যে যার মতো ঢাকে চাটি দিচ্ছে। হাজার দুয়েক মানুষ হবে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। প্রায় সবার হাতে হয় প্ল্যাকার্ড, নয়তো বুকে ঝোলানো কোনো কার্ড। অধিকাংশের মূল কথা: আমরা দেশের ৯৯ শতাংশ। দেশের দখল ফিরে পেতে আমরা প্রস্তুত।
লিবার্টি স্ট্রিটের গা ঘেঁষে ফুটপাতে বক্তৃতা হচ্ছে, নিচের পার্কে শ দুয়েক মানুষ। এখানে মেগাফোন বা কোনো ধরনের অ্যাম্পলিফায়ারের ব্যবহার নিষিদ্ধ, ফলে বক্তৃতা হচ্ছে খালি গলায়। বক্তা এক লাইন বলেন, আশপাশে সবাই সে কথা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পুনরাবৃত্তি করে, যাতে দূরের মানুষ সে কথা শুনতে পায়। এর নাম দেওয়া হয়েছে হিউম্যান মেগাফোন। দেখলাম গ্রিসের একজন বক্তৃতা করছেন, মার্কিন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংহতি দেখাতে আজই এসে পৌঁছেছেন। পার্কের অন্যদিকে ছোটমতো একটি চত্বর, সেখানে জনা দশেক ড্রামবাদক, কেউ সুরে কেউ বেসুরে ড্রাম বাজিয়ে চলেছে। তার তালে-বেতালে জনা পাঁচেক নারী-পুরুষ নাচছে। এরই মধ্যে সে চত্বরের চারদিকে একটি মিছিল চলছে। পার্কের ভেতর টেবিল বিছিয়ে ডজন দুয়েক স্বেচ্ছাসেবক, নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে, নতুন স্বেচ্ছাসেবকের নাম তালিকাভুক্ত করছে। মাটিতে প্লাস্টিকের চাদরের ওপর নানা ধরনের খাবার সাজানো—মাফিন, ডোনাট, পিৎজ্জা ছাড়াও আছে বাক্সভর্তি আপেল ও কমলা। সবই কোনো না কোনোভাবে উপহার হিসেবে পাওয়া। একদম উল্টো দিকে, রাস্তা ঘেঁষে লম্বা তাক বাঁধা হয়েছে, তাতে অসংখ্য বই, পত্রপত্রিকা, গানের সিডি। এটা একটা মুক্ত লাইব্রেরি। যে বই বা সিডি ইচ্ছা হয়, নিয়ে যান। চাইলে এক-আধা ডলার সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু কেউ আপনাকে টাকার কথা বলবে না। শুধু অনুরোধ, কাজ হয়ে গেলে ফেরত দেবেন। আপনার নিজের যদি দান করার মতো কোনো বই বা পত্রপত্রিকা থাকে, তা দিতেও অনুরোধ করা আছে। হাত দিতেই মিলে গেল আমার খুব প্রিয় একটি বই, হাওয়ার্ড জিন-এর পিপলস হিস্টরি অব আমেরিকা। দূরে জনা কয়েক পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে। কোথাও কোনো ভাড়াটে গুন্ডা নজরে এল না। তবে শুনেছি, পুলিশের সারভেলেন্স ক্যামেরা চালু আছে। কারা আসে, কারা যায়, তার ছবি চলে যাচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তরে। কিন্তু লোকজন তা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন মনে হলো না। সব মিলিয়ে বাতাসে বিপ্লবের বারুদের চেয়ে উৎসবের আমেজটাই বেশি।
এই হলো নিউইয়র্কের জুকোটি পার্কে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’-এর দৃশ্য। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভের সময় আমার যাওয়া হয়নি। টিভির পর্দায় যে ছবি দেখেছি, তার সঙ্গে মিল আছে বৈকি। আমার এক মিসরীয় বন্ধুই বললেন, কায়রোতে তাঁরা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলেন, কিন্তু ‘স্পিরিট’-এর দিকে দিয়ে এই দুয়ের মিল আছে। পুরোনো ব্যবস্থা আর মেনে নেওয়া যায় না, সে দাবি তাহরিরে যেমন ছিল, এই জুকোটি পার্কেও। শুরুতে জনা কয়েক বিক্ষোভকারী নিয়ে তাহরিরে বিপ্লবের শুরু। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটও তা-ই। গত ১৭ সেপ্টেম্বর যখন শুরু হয়, সে সময় কেউ ভাবেনি লম্বা সময় ধরে এই বিক্ষোভ চলবে। কিন্তু এক মাসের পরও লোক আসা কমেনি, বরং বেড়েছে। ক্রমশ দেশের অন্যত্র—এক হিসাবে প্রায় ৭০টি শহরে এই ধাঁচের বিক্ষোভ চলছে।
জুকোটি পার্কে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের অনেকের বিশ্বাস, এই বিক্ষোভ থেকে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। সত্যি যদি সমাজের শিকড় ধরে নাড়া দেওয়া যায়, তার ওপর কাঠামো-ভেতর কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, তাহলে সেটা একরকমের বিপ্লবই হবে। এখন পর্যন্ত গোলাগুলি ছোটেনি বটে, কিন্তু দেড়-দুই শ মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সবাই যে তরুণ বা যুবক, মোটেই নয়। মধ্য বয়সী, এমনকি ৭০-৮০ বছরের হাড় শক্ত এমন নারী-পুরুষও এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছেন। এঁদের কেউ কেউ ষাটের দশকে ভিয়েতনামবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইও করেছেন। একসময় বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন, হয়তো এখনো দেখেন। জুকোটি পার্কে আলাপ হলো সে রকম একজন, প্রায় ৮০ বছরের এক সাবেক শ্রমিকনেতার সঙ্গে। গায়ে চড়ানো চে গুয়েভারার চিত্রসংবলিত টি-শার্ট। আমার সঙ্গে সজোরে করমর্দন করে বললেন, ‘ইয়েস, দিস ইজ দি বিগিনিং।’ তাঁর কথা শুনে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল, যদিও জানি ব্যাপারটা অত সহজ নয়।
কিন্তু ঠিক কী পরিবর্তন এরা চায়? কীভাবেই বা সে পরিবর্তন আসবে? কায়রোর বিক্ষোভকারীদের সুস্পষ্টই দাবি ছিল হোসনি মোবারক ও তাঁর চামচাদের সরাতে হবে। কিন্তু এখানে কারও কোনো সুনির্দিষ্ট দাবি নেই। সবাই রুষ্ট আমেরিকার অর্থ-ব্যবস্থার ওপর। মাত্র ১ শতাংশ মানুষ—ওয়াল স্ট্রিট যার প্রতীক—তাদের নিয়ন্ত্রণে দেশের অধিকাংশ সম্পদ। মাত্র ছয়টি বড় ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থা দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৬০ শতাংশের সমপরিমাণ সম্পদের মালিক। চারটি ব্যাংক একাই সব ক্রেডিট কার্ডের সরবরাহকারী। আমেরিকার আজকের যে কঠিন সময়, তার এক প্রধান কারণ এসব ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থার সীমাহীন লোভ। ব্যাংকিং খাতে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ফলে গৃহায়ণ খাতে যে ধস নামে, মন্দাবস্থার সূচনা সেখান থেকেই। বলা হয়েছিল, বড় ব্যাংকগুলো প্রায় দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়। তাদের বাঁচাতে সরকারি টাঁকশাল থেকে প্রায় ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়। ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে তাদের সংকট কাটিয়ে উঠেছে। শুধু তা-ই না, এখন তারা লাভের পাহাড়ের ওপর বসে। অন্যদিকে সাধারণ নাগরিক, যারা এই সংকটের শিকার, তাদের উদ্ধারে কোনো কার্যকর চেষ্টা নেই, উল্টো সামাজিক খাতে ব্যয়সংকোচনের চেষ্টা চলছে। প্রতি ১০ জনের একজন এখন বেকার। প্রায় পাঁচ কোটি লোকের বাস দারিদ্রসীমার নিচে। কোনো স্বাস্থ্যবিমা নেই, এমন মানুষের সংখ্যা ছয় কোটির ওপর। সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ও দমকলকর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। টাকা নেই, এই অজুহাতে কোথাও কোথাও গার্হস্থ্য সহিংসতার ঘটনার পুলিশি অনুসন্ধান বন্ধ রাখা হচ্ছে।
সোজা কথায়, আমেরিকার আর্থিক ও সামাজিক অবকাঠামোয় বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের কথা, চলতি অসম সমাজব্যবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। সমাজের ভেতর বৈষম্য যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে। আজকের আমেরিকায় আসলে একধরনের অলিগার্ক চলছে, সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত গোটা কতক মানুষের হাতে। এ অবস্থার পরিবর্তন চাই।
যে দাবিগুলো উঠেছে তা যদি ভেঙে দেখি, দেখা যাবে মূল কথা সম্পদের অধিকতর সুসম বণ্টন। এর জন্য চাই অর্থ ও ব্যাংকিং খাতে কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা জালের সম্প্রসারণ। সরকারের ভূমিকার ব্যাপক সম্প্রসারণ ছাড়া এর কোনোটাই সম্ভব নয়। এর চেয়ে ঢের কম ‘র্যাডিক্যাল’ দাবি তোলার কারণে বারাক ওবামা ‘কমিউনিস্ট’ বলে গাল শুনেছেন। ফলে, মোটেই বিস্মিত হয়নি যে আমেরিকার দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকেরা, বিশেষত রিপাবলিকান দলের নেতারা, ওয়ার স্ট্রিটে বিক্ষোভকারীদের ‘মব’—সোজা বাংলায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, ওয়াল স্ট্রিটের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ মার্কিন-আদর্শের পরিপন্থী—‘আন-আমেরিকান’। টাকা বানানো বা বড়লোক হওয়া ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অপরাধ নয়। বরং সেটা বাহবার ব্যাপার। অতএব, এরা যে দাবি করছে তা কোনো ক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না।
আমেরিকার সমাজব্যবস্থায় যদি কোনো মৌল পরিবর্তন আসে, তা ঘটবে বুলেটে নয়, ব্যালটে। বারাক ওবামার নির্বাচনের পর এ দেশে শ্বেতকায়দের ক্রোধের প্রকাশ ঘটেছিল তথাকথিত টি-পার্টি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। গত বছরের অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনে কট্টর দক্ষিণপন্থী রিপাবলিকানদের বিজয়ের পেছনে সেই উত্থান একটি বড় ভূমিকা রাখে। অনেকেই বলছেন, ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন বস্তুত সেই উত্থানের একটি জবাব—বামমুখী জবাব। ডেমোক্র্যাটরা আশা করছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে ক্রোধ এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে, তা যদি ব্যালট বাক্সে রূপান্তরিত হয়, তাহলে অবস্থা বদলাবে।
ক্ষমতার হয়তো হাতবদল হবে, কিন্তু সমাজ সত্যি বদলাবে তো? ওবামার নির্বাচনের ভেতর বড় ধরনের পরিবর্তন হবে বলে ভাবা হয়েছিল। কিচ্ছু হয়নি। কারণ, ওবামা আর যা-ই হোক কমিউনিস্ট নন। পুনর্নির্বাচিত হতে তিনি গাল ভরা প্রতিশ্রুতি হয়তো দেবেন। ওয়াল স্ট্রিটের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে গলাগলি করলেও বিস্মিত হব না। কিন্তু বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে এক পা নড়ার ক্ষমতা তাঁর বা তাঁর দলের সদস্যদের নেই। রিপাবলিকানদের মতো তাঁদেরও সবার হাত-পা ও বিবেক বন্ধক দেওয়া আছে ওই বৃহৎ পুঁজির কাছে।
অতএব বন্ধুরা, পরিবর্তন যদি চাও, ভিন্ন পথের কথা ভাবো। ভিন্ন লোককে বাছতে শেখো। আর হ্যাঁ, মাঠের দখল ছেড়ো না।
৮ অক্টোবর ২০১১, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
লিবার্টি স্ট্রিটের গা ঘেঁষে ফুটপাতে বক্তৃতা হচ্ছে, নিচের পার্কে শ দুয়েক মানুষ। এখানে মেগাফোন বা কোনো ধরনের অ্যাম্পলিফায়ারের ব্যবহার নিষিদ্ধ, ফলে বক্তৃতা হচ্ছে খালি গলায়। বক্তা এক লাইন বলেন, আশপাশে সবাই সে কথা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পুনরাবৃত্তি করে, যাতে দূরের মানুষ সে কথা শুনতে পায়। এর নাম দেওয়া হয়েছে হিউম্যান মেগাফোন। দেখলাম গ্রিসের একজন বক্তৃতা করছেন, মার্কিন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংহতি দেখাতে আজই এসে পৌঁছেছেন। পার্কের অন্যদিকে ছোটমতো একটি চত্বর, সেখানে জনা দশেক ড্রামবাদক, কেউ সুরে কেউ বেসুরে ড্রাম বাজিয়ে চলেছে। তার তালে-বেতালে জনা পাঁচেক নারী-পুরুষ নাচছে। এরই মধ্যে সে চত্বরের চারদিকে একটি মিছিল চলছে। পার্কের ভেতর টেবিল বিছিয়ে ডজন দুয়েক স্বেচ্ছাসেবক, নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে, নতুন স্বেচ্ছাসেবকের নাম তালিকাভুক্ত করছে। মাটিতে প্লাস্টিকের চাদরের ওপর নানা ধরনের খাবার সাজানো—মাফিন, ডোনাট, পিৎজ্জা ছাড়াও আছে বাক্সভর্তি আপেল ও কমলা। সবই কোনো না কোনোভাবে উপহার হিসেবে পাওয়া। একদম উল্টো দিকে, রাস্তা ঘেঁষে লম্বা তাক বাঁধা হয়েছে, তাতে অসংখ্য বই, পত্রপত্রিকা, গানের সিডি। এটা একটা মুক্ত লাইব্রেরি। যে বই বা সিডি ইচ্ছা হয়, নিয়ে যান। চাইলে এক-আধা ডলার সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু কেউ আপনাকে টাকার কথা বলবে না। শুধু অনুরোধ, কাজ হয়ে গেলে ফেরত দেবেন। আপনার নিজের যদি দান করার মতো কোনো বই বা পত্রপত্রিকা থাকে, তা দিতেও অনুরোধ করা আছে। হাত দিতেই মিলে গেল আমার খুব প্রিয় একটি বই, হাওয়ার্ড জিন-এর পিপলস হিস্টরি অব আমেরিকা। দূরে জনা কয়েক পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে। কোথাও কোনো ভাড়াটে গুন্ডা নজরে এল না। তবে শুনেছি, পুলিশের সারভেলেন্স ক্যামেরা চালু আছে। কারা আসে, কারা যায়, তার ছবি চলে যাচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তরে। কিন্তু লোকজন তা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন মনে হলো না। সব মিলিয়ে বাতাসে বিপ্লবের বারুদের চেয়ে উৎসবের আমেজটাই বেশি।
এই হলো নিউইয়র্কের জুকোটি পার্কে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’-এর দৃশ্য। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভের সময় আমার যাওয়া হয়নি। টিভির পর্দায় যে ছবি দেখেছি, তার সঙ্গে মিল আছে বৈকি। আমার এক মিসরীয় বন্ধুই বললেন, কায়রোতে তাঁরা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলেন, কিন্তু ‘স্পিরিট’-এর দিকে দিয়ে এই দুয়ের মিল আছে। পুরোনো ব্যবস্থা আর মেনে নেওয়া যায় না, সে দাবি তাহরিরে যেমন ছিল, এই জুকোটি পার্কেও। শুরুতে জনা কয়েক বিক্ষোভকারী নিয়ে তাহরিরে বিপ্লবের শুরু। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটও তা-ই। গত ১৭ সেপ্টেম্বর যখন শুরু হয়, সে সময় কেউ ভাবেনি লম্বা সময় ধরে এই বিক্ষোভ চলবে। কিন্তু এক মাসের পরও লোক আসা কমেনি, বরং বেড়েছে। ক্রমশ দেশের অন্যত্র—এক হিসাবে প্রায় ৭০টি শহরে এই ধাঁচের বিক্ষোভ চলছে।
জুকোটি পার্কে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের অনেকের বিশ্বাস, এই বিক্ষোভ থেকে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। সত্যি যদি সমাজের শিকড় ধরে নাড়া দেওয়া যায়, তার ওপর কাঠামো-ভেতর কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, তাহলে সেটা একরকমের বিপ্লবই হবে। এখন পর্যন্ত গোলাগুলি ছোটেনি বটে, কিন্তু দেড়-দুই শ মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সবাই যে তরুণ বা যুবক, মোটেই নয়। মধ্য বয়সী, এমনকি ৭০-৮০ বছরের হাড় শক্ত এমন নারী-পুরুষও এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছেন। এঁদের কেউ কেউ ষাটের দশকে ভিয়েতনামবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইও করেছেন। একসময় বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন, হয়তো এখনো দেখেন। জুকোটি পার্কে আলাপ হলো সে রকম একজন, প্রায় ৮০ বছরের এক সাবেক শ্রমিকনেতার সঙ্গে। গায়ে চড়ানো চে গুয়েভারার চিত্রসংবলিত টি-শার্ট। আমার সঙ্গে সজোরে করমর্দন করে বললেন, ‘ইয়েস, দিস ইজ দি বিগিনিং।’ তাঁর কথা শুনে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল, যদিও জানি ব্যাপারটা অত সহজ নয়।
কিন্তু ঠিক কী পরিবর্তন এরা চায়? কীভাবেই বা সে পরিবর্তন আসবে? কায়রোর বিক্ষোভকারীদের সুস্পষ্টই দাবি ছিল হোসনি মোবারক ও তাঁর চামচাদের সরাতে হবে। কিন্তু এখানে কারও কোনো সুনির্দিষ্ট দাবি নেই। সবাই রুষ্ট আমেরিকার অর্থ-ব্যবস্থার ওপর। মাত্র ১ শতাংশ মানুষ—ওয়াল স্ট্রিট যার প্রতীক—তাদের নিয়ন্ত্রণে দেশের অধিকাংশ সম্পদ। মাত্র ছয়টি বড় ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থা দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৬০ শতাংশের সমপরিমাণ সম্পদের মালিক। চারটি ব্যাংক একাই সব ক্রেডিট কার্ডের সরবরাহকারী। আমেরিকার আজকের যে কঠিন সময়, তার এক প্রধান কারণ এসব ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থার সীমাহীন লোভ। ব্যাংকিং খাতে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ফলে গৃহায়ণ খাতে যে ধস নামে, মন্দাবস্থার সূচনা সেখান থেকেই। বলা হয়েছিল, বড় ব্যাংকগুলো প্রায় দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়। তাদের বাঁচাতে সরকারি টাঁকশাল থেকে প্রায় ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়। ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে তাদের সংকট কাটিয়ে উঠেছে। শুধু তা-ই না, এখন তারা লাভের পাহাড়ের ওপর বসে। অন্যদিকে সাধারণ নাগরিক, যারা এই সংকটের শিকার, তাদের উদ্ধারে কোনো কার্যকর চেষ্টা নেই, উল্টো সামাজিক খাতে ব্যয়সংকোচনের চেষ্টা চলছে। প্রতি ১০ জনের একজন এখন বেকার। প্রায় পাঁচ কোটি লোকের বাস দারিদ্রসীমার নিচে। কোনো স্বাস্থ্যবিমা নেই, এমন মানুষের সংখ্যা ছয় কোটির ওপর। সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ও দমকলকর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। টাকা নেই, এই অজুহাতে কোথাও কোথাও গার্হস্থ্য সহিংসতার ঘটনার পুলিশি অনুসন্ধান বন্ধ রাখা হচ্ছে।
সোজা কথায়, আমেরিকার আর্থিক ও সামাজিক অবকাঠামোয় বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের কথা, চলতি অসম সমাজব্যবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। সমাজের ভেতর বৈষম্য যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে। আজকের আমেরিকায় আসলে একধরনের অলিগার্ক চলছে, সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত গোটা কতক মানুষের হাতে। এ অবস্থার পরিবর্তন চাই।
যে দাবিগুলো উঠেছে তা যদি ভেঙে দেখি, দেখা যাবে মূল কথা সম্পদের অধিকতর সুসম বণ্টন। এর জন্য চাই অর্থ ও ব্যাংকিং খাতে কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা জালের সম্প্রসারণ। সরকারের ভূমিকার ব্যাপক সম্প্রসারণ ছাড়া এর কোনোটাই সম্ভব নয়। এর চেয়ে ঢের কম ‘র্যাডিক্যাল’ দাবি তোলার কারণে বারাক ওবামা ‘কমিউনিস্ট’ বলে গাল শুনেছেন। ফলে, মোটেই বিস্মিত হয়নি যে আমেরিকার দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকেরা, বিশেষত রিপাবলিকান দলের নেতারা, ওয়ার স্ট্রিটে বিক্ষোভকারীদের ‘মব’—সোজা বাংলায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, ওয়াল স্ট্রিটের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ মার্কিন-আদর্শের পরিপন্থী—‘আন-আমেরিকান’। টাকা বানানো বা বড়লোক হওয়া ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অপরাধ নয়। বরং সেটা বাহবার ব্যাপার। অতএব, এরা যে দাবি করছে তা কোনো ক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না।
আমেরিকার সমাজব্যবস্থায় যদি কোনো মৌল পরিবর্তন আসে, তা ঘটবে বুলেটে নয়, ব্যালটে। বারাক ওবামার নির্বাচনের পর এ দেশে শ্বেতকায়দের ক্রোধের প্রকাশ ঘটেছিল তথাকথিত টি-পার্টি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। গত বছরের অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনে কট্টর দক্ষিণপন্থী রিপাবলিকানদের বিজয়ের পেছনে সেই উত্থান একটি বড় ভূমিকা রাখে। অনেকেই বলছেন, ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন বস্তুত সেই উত্থানের একটি জবাব—বামমুখী জবাব। ডেমোক্র্যাটরা আশা করছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে ক্রোধ এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে, তা যদি ব্যালট বাক্সে রূপান্তরিত হয়, তাহলে অবস্থা বদলাবে।
ক্ষমতার হয়তো হাতবদল হবে, কিন্তু সমাজ সত্যি বদলাবে তো? ওবামার নির্বাচনের ভেতর বড় ধরনের পরিবর্তন হবে বলে ভাবা হয়েছিল। কিচ্ছু হয়নি। কারণ, ওবামা আর যা-ই হোক কমিউনিস্ট নন। পুনর্নির্বাচিত হতে তিনি গাল ভরা প্রতিশ্রুতি হয়তো দেবেন। ওয়াল স্ট্রিটের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে গলাগলি করলেও বিস্মিত হব না। কিন্তু বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে এক পা নড়ার ক্ষমতা তাঁর বা তাঁর দলের সদস্যদের নেই। রিপাবলিকানদের মতো তাঁদেরও সবার হাত-পা ও বিবেক বন্ধক দেওয়া আছে ওই বৃহৎ পুঁজির কাছে।
অতএব বন্ধুরা, পরিবর্তন যদি চাও, ভিন্ন পথের কথা ভাবো। ভিন্ন লোককে বাছতে শেখো। আর হ্যাঁ, মাঠের দখল ছেড়ো না।
৮ অক্টোবর ২০১১, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments