মত ও মন্তব্য-ভারত-বাংলাদেশের টেকসই সম্পর্ক by হারুন হাবীব
ভূখণ্ডগত দিক থেকে প্রতিবেশীর অবস্থান নড়চড়যোগ্য হয় না। আমরা জানি, অবিভক্ত পাকিস্তানের ২৪ বছর ভারতের পরিচিতি ছিল 'শত্রু দেশ'। দেশটির নাগরিকদের সে মানসিকতাতেই গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। এটিও বলা সংগত হবে যে পাকিস্তানকে 'শত্রু দেশ' হিসেবেই গ্রহণ করেছিলও ভারত। ফলে উপমহাদেশের প্রধান দুটি দেশ কখনো সৌহার্দ্যের মুখ দেখেনি।
ইউরোপ এগিয়ে গেছে, পূর্ব এশিয়া এগিয়ে গেছে, এমনকি আফ্রিকার বহু অঞ্চলও বিভেদ ভুলে পরস্পরের স্বার্থে শক্ত আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলেছে। কিন্তু এ অঞ্চল ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার ফসল হিসেবে ঘরে উঠেছে ঘৃণা, সংঘর্ষ, অনুন্নয়ন, বিদ্বেষ এবং সার্বিক অস্থিরতা-যা প্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে এ অঞ্চলের সহযোগিতা, সহমর্মিতা, মানবতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশীয় বলয়ে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। পাকিস্তানের ধর্মাশ্রিত ও সামরিক আধিপত্যবাদী বলয় থেকে বেরিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম হয়, সে দেশটি ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে। নতুন এ সম্পর্ক, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত, একদিকে যেমন ভারত লালন করে, লালন করে বাংলাদেশও। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারও পাকিস্তানি ভূত ফিরে আসে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক ও আধাসামরিক শাসকরা পুরনো পাকিস্তানি নীতির প্রত্যাবর্তন ঘটায়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিলি্ল সফর সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। দুই রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাহসে একযোগে সামনে এগোনোর বলিষ্ঠ প্রত্যয় ঘোষণা করেন। 'সেনসিটিভ' বা 'ঝুঁকিপূর্ণ' বলে যে বিষয়গুলোকে যুগের পর যুগ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেগুলোতেও মনমোহন সিং এবং শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্তে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর ২০১০ সালের সিদ্ধান্তগুলো যদি সুচারুভাবে বাস্তবায়িত হয়, আমার বিশ্বাস, এ অঞ্চলটিতে তা ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফর করবেন আগামী সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ। সফরটি একদিকে একটি ফিরতি সফর, অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে বলে আমার ধারণা। এরই মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ তিন দিনের সফর শেষ করে গেলেন। কৃষ্ণর সফরটি প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতির অংশ। এ সময় দুটি চুক্তিও স্বাক্ষর করা হয়েছে। একটি বিনিয়োগ সুরক্ষা এবং অপরটি ভুটানের পণ্যবাহী ট্রাক ভারতের ভূখণ্ড দিয়ে বাংলাদেশের স্থলবন্দর পর্যন্ত যাতায়াত-সম্পর্কিত। দুটি চুক্তিই ট্রানজিট ও যোগাযোগের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ।
যেকোনো রাষ্ট্র তার আপন প্রয়োজন ও বাস্তবতার বিবেচনায় নীতি নির্ধারণ করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। এর প্রমাণ তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দিয়েছে। এ ছাড়া আমাদের অর্থনীতি ও বাণিজ্যে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর পরও কিছু বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে জটিলতা আছে। আছে সীমান্ত উত্তেজনা, সমুদ্রসীমা, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর ও চিহ্নিতকরণের বিষয়। দুই দেশের শান্তি ও প্রগতির স্বার্থেই এ বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রায়ই খবর প্রচার করে যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মানুষ মরছে সীমান্তে। এ খবর কেবল সীমান্ত উত্তেজনাই জিইয়ে রাখে না, দুই দেশের জনজীবনেও বিস্তর প্রভাব ফেলে। নয়াদিলি্লর কর্ণধাররা এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করবেন-সেটিই প্রত্যাশা। সীমান্ত সমস্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা জিইয়ে রাখা উচিত নয়। এতে কোনো পক্ষই লাভবান হয় না। বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো ভারত, নেপাল ও ভুটানকে মালামাল পরিবহনে ট্রানজিট দিতে সম্মত হয়েছে। ট্রানজিট কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়। তার পরও দীর্ঘদিন একে রাজনীতির বিষয় বানিয়ে সস্তা ফায়দা লোটার চেষ্টা হয়েছে। আমি বলব, বাস্তবতার নিরিখেই বর্তমান সরকার ভারতকে ট্রানজিট দিতে মনস্থ করেছে। ভারতও বাস্তবতার স্বার্থেই তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই সিদ্ধান্তগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা হবে-এটিই কাম্য। তবে বলতেই হবে, দেশ দুটির অর্থনৈতিক সহযোগিতা দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করতে হলে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাগুলোর সুষম বণ্টন প্রয়োজন। বাংলাদেশ দুর্বল অর্থনীতির দেশ, বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন।
সংকট হচ্ছে, রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্তের পরও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপকে নেতিবাচকে পরিণত করে। যেমন-যৌথ বিনিয়োগে খুলনায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, ভারতে বাংলাদেশের ৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ আছে, যা কাম্য নয়।
যতটা জেনেছি, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে নানা বিষয়ে যথেষ্ট ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। বাণিজ্য বিষয়ে অগ্রগতি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৮০ লাখ পিস থেকে এক কোটি পিসে উন্নীত করার বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। সব মিলিয়ে আমার বিশ্বাস, এস এম কৃষ্ণর সফরটি বেশ আশাজাগানিয়া। তবে দুই পক্ষকেই সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে সিদ্ধান্তগুলো আটকে না থাকে। যেকোনো সুবিবেচক মানুষই চাইবেন দুই দেশের মানুষকে শান্তি ও সৌহার্দ্যে সামনে এগিয়ে নিতে দুই পক্ষের মধ্যে নানা বিষয়ে সমঝোতা হোক। ট্রানজিট পেয়ে ভারত কোনো সামরিক পরিবহন করবে না বলে এস এম কৃষ্ণ জানিয়েছেন। এতে ট্রানজিটের বিরোধীরা তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা ক্ষান্ত দেবেন ভাবার কারণ নেই, তবে ঘোষণাটি এ প্রচারণাকে অসার প্রমাণিত করার পথে বড় পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে। কেননা ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ-ভারতের সুসম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। আশা করব, সম্পাদিত চুক্তিগুলোর দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন হবে এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সুরাহার পথ সুগম হবে।
রাজনীতিবিদরা মানুষকে যেমন আশা দেখান, আশাহতও করেন। সতর্কতাটি উচ্চারণের পরও সর্বান্তকরণে আশা করি, ড. সিংয়ের আসন্ন সফর দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে মনমোহনের কিছু 'অব দ্য রেকর্ড' মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের কূটনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট টানাপড়েন এস এম কৃষ্ণর সফরের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে কেটেছে এবং আস্থা ও আশার সম্পর্কে নতুন গতি পেয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
সমস্যা থাকবেই, নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে তো বটেই; এ বাস্তবতা মেনেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। মনমোহনের সফরের সময়ে স্বাক্ষরের জন্য ইতিমধ্যেই কয়েকটি চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে বলে জেনেছি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যে চুক্তিগুলো সম্পাদিত হবে-তাতে সাম্যতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে এবং সীমান্ত চিহ্নিতকরণে ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি অনুসরণ করা হবে। এ বিশ্বাস রাখতে চাই যে অন্যান্য বিষয়গুলো, যেমন-পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, অমীমাংসিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, তিনবিঘা করিডরের ব্যবহার ও ছিটমহল সমস্যার সমাধান, জ্বালানি নিরাপত্তা, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা তৈরি-ইত্যাদি প্রশ্নও দুই প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন। অনেককালই ঝুলে আছে এগুলো, আর উচিত নয়। পরিশেষে বলতে চাই, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আমাদের মতো দেশের বড় সংকট। মনে রাখা উচিত, এ জটিলতা যেন নতুন বন্ধুত্বের এই আশাজাগানিয়া যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ এবং প্রশংসাযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। যোগাযোগ উন্নয়ন, উন্নয়ন সহযোগিতা, সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করাসহ নানা দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে ঢাকা-দিলি্ল মতৈক্য তৈরি করেছে। নয়াদিলি্লতে ঐতিহাসিক ইশতেহারও স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু ইশতেহারের অনেক কিছুই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এস এম কৃষ্ণর আগে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাও ঢাকা সফর করেন। বলতেই হবে, ভারত মনমোহন সিংয়ের সফরটিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। ভৌগোলিক অবস্থান স্পষ্ট বলে দেয়, দুই দেশের সার্বিক উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। দুই দেশের স্বার্থে চুক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ তার বাস্তবায়ন। অথচ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন দূরে থাক, আলোচনা থেকেও যেন হারিয়ে যায়! অতএব, চুক্তিগুলো কার্যকর করার দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ও জনগণকে এ-ও বুঝতে হবে, প্রতিবেশী হিসেবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ প্রদর্শন ছাড়া দুই দেশের পক্ষে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ভারত বড় দেশ, বড় অর্থনীতি। কাজেই এ ক্ষেত্রে তার বড় ভূমিকা প্রত্যাশা করা অসংগত নয়। দুই দেশের সম্পর্কের বাস্তবতা সাধারণ মানুষের সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্প্রসারণের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে এর প্রবল প্রতিপক্ষ আছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দ্বিমত স্বাভাবিক, কিন্তু পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমাদের যে বিপরীতমুখী অবস্থান-তা একেবারেই কাম্য নয়। যাই হোক, বাস্তবতা মেনে নিয়েই দৃষ্টি রাখাটা জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট
hh1971@gmail. Com
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিলি্ল সফর সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। দুই রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাহসে একযোগে সামনে এগোনোর বলিষ্ঠ প্রত্যয় ঘোষণা করেন। 'সেনসিটিভ' বা 'ঝুঁকিপূর্ণ' বলে যে বিষয়গুলোকে যুগের পর যুগ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেগুলোতেও মনমোহন সিং এবং শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্তে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর ২০১০ সালের সিদ্ধান্তগুলো যদি সুচারুভাবে বাস্তবায়িত হয়, আমার বিশ্বাস, এ অঞ্চলটিতে তা ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফর করবেন আগামী সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ। সফরটি একদিকে একটি ফিরতি সফর, অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে বলে আমার ধারণা। এরই মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ তিন দিনের সফর শেষ করে গেলেন। কৃষ্ণর সফরটি প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতির অংশ। এ সময় দুটি চুক্তিও স্বাক্ষর করা হয়েছে। একটি বিনিয়োগ সুরক্ষা এবং অপরটি ভুটানের পণ্যবাহী ট্রাক ভারতের ভূখণ্ড দিয়ে বাংলাদেশের স্থলবন্দর পর্যন্ত যাতায়াত-সম্পর্কিত। দুটি চুক্তিই ট্রানজিট ও যোগাযোগের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ।
যেকোনো রাষ্ট্র তার আপন প্রয়োজন ও বাস্তবতার বিবেচনায় নীতি নির্ধারণ করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। এর প্রমাণ তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দিয়েছে। এ ছাড়া আমাদের অর্থনীতি ও বাণিজ্যে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর পরও কিছু বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে জটিলতা আছে। আছে সীমান্ত উত্তেজনা, সমুদ্রসীমা, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর ও চিহ্নিতকরণের বিষয়। দুই দেশের শান্তি ও প্রগতির স্বার্থেই এ বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রায়ই খবর প্রচার করে যে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মানুষ মরছে সীমান্তে। এ খবর কেবল সীমান্ত উত্তেজনাই জিইয়ে রাখে না, দুই দেশের জনজীবনেও বিস্তর প্রভাব ফেলে। নয়াদিলি্লর কর্ণধাররা এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করবেন-সেটিই প্রত্যাশা। সীমান্ত সমস্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা জিইয়ে রাখা উচিত নয়। এতে কোনো পক্ষই লাভবান হয় না। বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো ভারত, নেপাল ও ভুটানকে মালামাল পরিবহনে ট্রানজিট দিতে সম্মত হয়েছে। ট্রানজিট কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়। তার পরও দীর্ঘদিন একে রাজনীতির বিষয় বানিয়ে সস্তা ফায়দা লোটার চেষ্টা হয়েছে। আমি বলব, বাস্তবতার নিরিখেই বর্তমান সরকার ভারতকে ট্রানজিট দিতে মনস্থ করেছে। ভারতও বাস্তবতার স্বার্থেই তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই সিদ্ধান্তগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা হবে-এটিই কাম্য। তবে বলতেই হবে, দেশ দুটির অর্থনৈতিক সহযোগিতা দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করতে হলে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাগুলোর সুষম বণ্টন প্রয়োজন। বাংলাদেশ দুর্বল অর্থনীতির দেশ, বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন।
সংকট হচ্ছে, রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্তের পরও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপকে নেতিবাচকে পরিণত করে। যেমন-যৌথ বিনিয়োগে খুলনায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, ভারতে বাংলাদেশের ৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ আছে, যা কাম্য নয়।
যতটা জেনেছি, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে নানা বিষয়ে যথেষ্ট ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। বাণিজ্য বিষয়ে অগ্রগতি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৮০ লাখ পিস থেকে এক কোটি পিসে উন্নীত করার বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। সব মিলিয়ে আমার বিশ্বাস, এস এম কৃষ্ণর সফরটি বেশ আশাজাগানিয়া। তবে দুই পক্ষকেই সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে সিদ্ধান্তগুলো আটকে না থাকে। যেকোনো সুবিবেচক মানুষই চাইবেন দুই দেশের মানুষকে শান্তি ও সৌহার্দ্যে সামনে এগিয়ে নিতে দুই পক্ষের মধ্যে নানা বিষয়ে সমঝোতা হোক। ট্রানজিট পেয়ে ভারত কোনো সামরিক পরিবহন করবে না বলে এস এম কৃষ্ণ জানিয়েছেন। এতে ট্রানজিটের বিরোধীরা তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা ক্ষান্ত দেবেন ভাবার কারণ নেই, তবে ঘোষণাটি এ প্রচারণাকে অসার প্রমাণিত করার পথে বড় পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে। কেননা ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ-ভারতের সুসম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। আশা করব, সম্পাদিত চুক্তিগুলোর দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন হবে এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সুরাহার পথ সুগম হবে।
রাজনীতিবিদরা মানুষকে যেমন আশা দেখান, আশাহতও করেন। সতর্কতাটি উচ্চারণের পরও সর্বান্তকরণে আশা করি, ড. সিংয়ের আসন্ন সফর দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে মনমোহনের কিছু 'অব দ্য রেকর্ড' মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের কূটনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট টানাপড়েন এস এম কৃষ্ণর সফরের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে কেটেছে এবং আস্থা ও আশার সম্পর্কে নতুন গতি পেয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
সমস্যা থাকবেই, নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে তো বটেই; এ বাস্তবতা মেনেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। মনমোহনের সফরের সময়ে স্বাক্ষরের জন্য ইতিমধ্যেই কয়েকটি চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে বলে জেনেছি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যে চুক্তিগুলো সম্পাদিত হবে-তাতে সাম্যতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে এবং সীমান্ত চিহ্নিতকরণে ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি অনুসরণ করা হবে। এ বিশ্বাস রাখতে চাই যে অন্যান্য বিষয়গুলো, যেমন-পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, অমীমাংসিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, তিনবিঘা করিডরের ব্যবহার ও ছিটমহল সমস্যার সমাধান, জ্বালানি নিরাপত্তা, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা তৈরি-ইত্যাদি প্রশ্নও দুই প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন। অনেককালই ঝুলে আছে এগুলো, আর উচিত নয়। পরিশেষে বলতে চাই, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আমাদের মতো দেশের বড় সংকট। মনে রাখা উচিত, এ জটিলতা যেন নতুন বন্ধুত্বের এই আশাজাগানিয়া যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ এবং প্রশংসাযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। যোগাযোগ উন্নয়ন, উন্নয়ন সহযোগিতা, সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করাসহ নানা দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে ঢাকা-দিলি্ল মতৈক্য তৈরি করেছে। নয়াদিলি্লতে ঐতিহাসিক ইশতেহারও স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু ইশতেহারের অনেক কিছুই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এস এম কৃষ্ণর আগে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাও ঢাকা সফর করেন। বলতেই হবে, ভারত মনমোহন সিংয়ের সফরটিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। ভৌগোলিক অবস্থান স্পষ্ট বলে দেয়, দুই দেশের সার্বিক উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। দুই দেশের স্বার্থে চুক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ তার বাস্তবায়ন। অথচ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন দূরে থাক, আলোচনা থেকেও যেন হারিয়ে যায়! অতএব, চুক্তিগুলো কার্যকর করার দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ও জনগণকে এ-ও বুঝতে হবে, প্রতিবেশী হিসেবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ প্রদর্শন ছাড়া দুই দেশের পক্ষে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ভারত বড় দেশ, বড় অর্থনীতি। কাজেই এ ক্ষেত্রে তার বড় ভূমিকা প্রত্যাশা করা অসংগত নয়। দুই দেশের সম্পর্কের বাস্তবতা সাধারণ মানুষের সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্প্রসারণের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে এর প্রবল প্রতিপক্ষ আছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দ্বিমত স্বাভাবিক, কিন্তু পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমাদের যে বিপরীতমুখী অবস্থান-তা একেবারেই কাম্য নয়। যাই হোক, বাস্তবতা মেনে নিয়েই দৃষ্টি রাখাটা জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট
hh1971@gmail. Com
No comments