আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৩৪)-শিঙাড়া সমাচার by আলী যাকের
জ্যোতির্ময় স্যারের সঙ্গে আমার আরো একটি সম্পর্ক আমি আবিষ্কার করেছিলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে প্রবেশ করার পর। তাঁর পিতৃব্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ গুহঠাকুরতা আর আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হরিহর আত্মা যাকে বলা যায়। আমার এখনো মনে আছে, আমরা কলকাতায় গেলেই ধীরেন কাকুকে দেখতে গড়িয়ায় যাওয়া ছিল অবশ্যকর্তব্য।
বাবা তাঁর বন্ধুর জন্য কিছু না কিছু উপহার হিসেবে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দিতেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার আমরা ধীরু কাকার জন্য নিয়ে গেছি পদ্মার ইলিশ। এ ছাড়া ঢাকার নিখুঁতির লাড্ডুও নিয়ে যেতাম। ধীরু কাকা আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, 'আমার তাহেরের সন্তানরা আইছে।' দেশভাগের প্রতি তখনকার মুসলমান সম্প্রদায়, এমনকি আমার বাবারও সমর্থনের কথা আমি জানি। দেশভাগকে সমর্থন করার অর্থই হলো দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন। তা সত্ত্বেও রাজনীতি ছাড়িয়ে দুই ধর্মের দুই বাঙালির মধ্যে যে সম্পর্ক কত ঘনিষ্ঠ হতে পারে, তা ওঁদের প্রজন্ম থেকেই আমরা জানতে পারি। এমন আপাতবিরোধী মানসিকতা সচরাচর চোখে পড়ে না। তবে এই প্যারাডঙ্ ছিল বলেই সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত। আজকের দিনে এই গভীরতা আর দেখা যায় না। অল্ডাস হাঙ্লির 'মিউজিক অ্যাট নাইট অ্যান্ড আদার এসেজ' পড়াতেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমি তাঁর স্নেহধন্য আজও। তাঁর স্ত্রী নাজমা জেসমিন চৌধুরী, যিনি অকালপ্রয়াত হয়েছেন, একসময় আমাদের সঙ্গে মুকুল মেলার কর্মী ছিলেন। হাঙ্লির রচনা আমার ধ্যান-ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছে অনেক গুণ এবং নানাভাবে। হাঙ্লি মানুষের জীবন এবং পারিপাশ্বর্িক বিষয় নিয়ে সহজ ভাষায় লিখতেন। পড়তে বড্ড ভালো লাগত। সিরাজুল ইসলাম স্যারের পড়ানো আমাদের আকর্ষণ করত। আমরা বিমোহিত হয়ে শুনতাম। প্রথম বছরটিতে আমার মূল বিষয় সোশিওলজি নিয়ে খুব একটা চিন্তাভাবনা করেছিলাম বলে মনে পড়ে না। তবে মধুদার টিনের চালওয়ালা ক্যান্টিনে বিস্তর টেবিল টেনিস খেলতাম সময় পেলেই। আমার কলেজের এক বন্ধু ছিল, আরবাব। ওর সঙ্গেই খেলাটা জমত বেশি। তবে প্রচুর হেরেছিও ওর কাছে। দ্বিতীয় বর্ষে উঠে গেলাম সায়েন্স অ্যানেঙ্ ভবনে। ওই ভবনে আমাদের অনার্স এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবসিডিয়ারি ক্লাস হতো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাস ছিল আক্ষরিক অর্থেই একটা বাজার। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। তাঁদের মৃদুস্বরে কথাবার্তা, মনে হতো যেন সারাক্ষণ হাজার হাজার মৌমাছির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকরা কী পড়াতেন বোঝে কার সাধ্য! তবু এরই মধ্যে আমাদের ক্লাস চলত। আমরা প্রথাসিদ্ধভাবে ক্লাস করে যেতাম। এই অ্যানেঙ্ ভবনে বলাইয়ের ক্যান্টিনের শিঙাড়া আমাদের অতি প্রিয় ছিল। ওই দিয়ে আমি দুপুরের খাবার সেরেছি। শিঙাড়া সমাচার যখন উঠলই, তখন এ নিয়ে বোধ হয় একটু বিস্তারে যাওয়া যায়। বাল্যকাল থেকেই শিঙাড়ার প্রতি আমার প্রচণ্ড দুর্বলতা। মফস্বল শহরে আমার বাল্যকাল কেটেছে। আমার বয়সী যাঁরা, তাঁরা হয়তো জানবেন যে বাংলাদেশের প্রতিটি শহরেই দু-একটি খুব ভালো মিষ্টির দোকান থাকত। এসব দোকানে নিয়মিত প্রতি সন্ধ্যায় শিঙাড়া তৈরি করা হতো। এ ছিল মৌসুমি শিঙাড়া। একেক মৌসুমে একেক রকম তরকারি দিয়ে পুর দেওয়া হতো। শীতের শিঙাড়ার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। ওই সময় ফুলকপি আর মটরশুঁটি দিয়ে অতি উপাদেয় শিঙাড়া তৈরি করা হতো। ঢাকায় এসে পেয়েছি আমার মায়ের প্রিয় বাংলাবাজারের 'মেহেরবান সুইটমিট'-এর শিঙাড়া, যা ছিল অতি ক্ষুদ্রাকৃতির এবং প্রচণ্ড ঝাল। আমরা সেই শিঙাড়া মাঝেমধ্যে সন্ধ্যাবেলায় অতি আনন্দে খেতাম। নাকের জল, চোখের জল একাকার হয়ে যেত। সেই সময় বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি ভালো শিঙাড়া পাশের পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যেত। সেখানে দর্শনা পেরিয়ে ভারতীয় স্টেশন বানপুরে ট্রেন পেঁৗছালেই সেই উপাদেয় শিঙাড়ার জন্য আমরা ব্যাকুল হয়ে উঠতাম। এখনো কলকাতার শিঙাড়া অতি উপাদেয় সান্ধ্য নাশতা। যাহোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলাইয়ের ক্যান্টিনের শিঙাড়া ছাড়াও এর আগে নটর ডেম কলেজে থাকতে কলেজ ক্যান্টিনে দাদুর শিঙাড়া দিয়ে প্রায়ই লাঞ্চ সেরেছি, এখনো মনে আছে।
আমার মূল বিষয়, সমাজবিজ্ঞান কখনো আমায় টানত না। আজ এই এত বছর পরে এসে কারণটা কিছুটা অনুধাবন করতে পারি বোধ হয়। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সূচনার সময় প্রায় সব শিক্ষকই এসেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। তাই তাঁরা মনে করতেন, সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরই প্রসারণ। ইংরেজিতে যাকে ঊীঃবহংরড়হ বলা হয়ে থাকে। অথচ আজকে বুঝতে পারি, সমাজবিজ্ঞান আসলেই কত প্রয়োজনীয় একটি মৌলিক বিষয়, যার সঠিক অধ্যয়নে আমরা একটি সমাজে যূথবদ্ধ বিভিন্ন মনমানসিকতার, অর্থনৈতিক শ্রেণীর, বিচিত্র শিক্ষা ও সংস্কৃতির মানুষ সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারি। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষা আমার মনে যে কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসার জন্ম দিয়েছিল, তা পরবর্তী জীবনে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে নানা বিশ্লেষণধর্মী মতবাদ অধ্যয়ন করতে এবং মানুষের স্বভাবের সঠিক বিশ্লেষণ করতে। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমি অনেক সামাজিক অথবা ব্যবহারিক প্রচারের কাজে সঠিক পথনির্দেশনা পেয়েছি আমার পেশার ক্ষেত্রে।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমার মূল বিষয়, সমাজবিজ্ঞান কখনো আমায় টানত না। আজ এই এত বছর পরে এসে কারণটা কিছুটা অনুধাবন করতে পারি বোধ হয়। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সূচনার সময় প্রায় সব শিক্ষকই এসেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। তাই তাঁরা মনে করতেন, সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরই প্রসারণ। ইংরেজিতে যাকে ঊীঃবহংরড়হ বলা হয়ে থাকে। অথচ আজকে বুঝতে পারি, সমাজবিজ্ঞান আসলেই কত প্রয়োজনীয় একটি মৌলিক বিষয়, যার সঠিক অধ্যয়নে আমরা একটি সমাজে যূথবদ্ধ বিভিন্ন মনমানসিকতার, অর্থনৈতিক শ্রেণীর, বিচিত্র শিক্ষা ও সংস্কৃতির মানুষ সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারি। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষা আমার মনে যে কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসার জন্ম দিয়েছিল, তা পরবর্তী জীবনে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে নানা বিশ্লেষণধর্মী মতবাদ অধ্যয়ন করতে এবং মানুষের স্বভাবের সঠিক বিশ্লেষণ করতে। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমি অনেক সামাজিক অথবা ব্যবহারিক প্রচারের কাজে সঠিক পথনির্দেশনা পেয়েছি আমার পেশার ক্ষেত্রে।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments