মিথ্যা দোষারোপ জঘন্য অপরাধ by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মানব জীবনের একটি মারাত্মক ও নিন্দনীয় বদস্বভাব হচ্ছে মিথ্যা দোষারোপ করা, ইহকাল ও পরকালে যার পরিণতি খুব কঠিন ও ভয়াবহ। মিথ্যা অপবাদ বা দোষারোপ মানব চরিত্রের অত্যন্ত অপছন্দনীয় ও নিকৃষ্ট স্বভাব। জঘন্য এ মন্দ কাজের সঙ্গে মিথ্যাচার, পরচর্চা, পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ, ছিদ্রান্বেষণ, পরশ্রীকাতরতার মতো ঘৃণ্য তত্পরতা জড়িত। মিথ্যাচারে অভ্যস্ত মানুষই কেবল কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ করতে পারে। মিথ্যা দোষারোপ মিথ্যাচারের চরম বহিঃপ্রকাশ। মিথ্যাচার জঘন্য ধরনের পাপাচার, এটি তাকওয়ার সম্পূর্ণ পরিপন্থী, কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ ও শরিয়ত-গর্হিত কাজ। পবিত্র কোরআনে নিষেধ করা হয়েছে যে ‘তোমরা মিথ্যা কথন থেকে দূরে থাক।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত-৩০)
কারও কাছ থেকে কোনো কথা শোনার পর তার সত্যাসত্য যাচাই-বাছাই না করে অন্যের কাছে বলে বেড়ানো মিথ্যার শামিল। কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শোনে তা-ই বলে বেড়ায়। মিথ্যা দোষারোপ মানুষের দুশ্চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের অপকর্মে অভ্যস্ত দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপের প্রবণতা এমন একটি সামাজিক ব্যাধি, যার কুফল মারাত্মক। মিথ্যা দোষারোপের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে কু-ধারণার সৃষ্টি হয়। ইসলামে কোনো দলিল প্রমাণ ছাড়া কারও প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা হারাম। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনদের প্রতি তোমরা ভালো ধারণা পোষণ করবে।’
মানব জাতিকে অহেতুক অনুমান থেকে দূরে থাকার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ, অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত-১২) এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা এরূপ কু-ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। আর কারও দোষ অনুসন্ধান করো না, কারও গোপনীয় বিষয় তালাশ করো না, একে অন্যকে ধোঁকা দেবে না, আর পরস্পর হিংসা করবে না, একে অপরের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করবে না এবং পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ করবে না বরং সবাই আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মিথ্যা অপবাদের দ্বারা দোষারোপকৃত ব্যক্তির যথেষ্ট মানহানি করা হয়। ইসলামে এ জাতীয় গুনাহর কাজকে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া জঘন্য ধরনের পাপ। এ জাতীয় পাপের কোনো কাফ্ফারা হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পাঁচটি পাপ এমন, যার কাফ্ফারা নেই। তন্মধ্যে তৃতীয়টি হলো কোনো মুমিনকে অপবাদ দেওয়া।’ (মুসনাদে আহমাদ)
মিথ্যা দোষারোপ বা অপবাদের কারণে সমাজজীবনে মানুষের সম্মানহানি ঘটে। তাই কারও মানহানি করা থেকে বিরত থাকার জন্য মুসলমানদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে সম্মানহানি করা থেকে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা নিজের জন্য অপরিহার্য করে নেন।’ (আহমাদ, তাবারানী) পক্ষান্তরে কেউ অন্যায়ভাবে তার মুসলমান ভাইয়ের মান-ইজ্জত খাটো করলে সম্মান বিনষ্টকারীকে আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘কোনো মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে যদি এমন স্থানে লাঞ্ছিত করে যেখানে তার মানহানি ঘটে এবং সর্বদা খাটো করা হয়, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে লাঞ্ছিত করবেন, যেখানে তার সাহায্য প্রাপ্তির আশা ছিল।’ (আবু দাউদ)
মিথ্যা দোষারোপ করার কারণ নিজেকে ভালো বা উপযুক্ত অথবা যোগ্য হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা, অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা অর্জন, নিজের অবৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, ব্যর্থতা বা অযোগ্যতা আড়াল করা, পরশ্রীকাতরতা ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ, অপরের মঙ্গল বা কল্যাণ মেনে না নেওয়ার মানসিকতা প্রভৃতি অন্যতম। মিথ্যা দোষারোপ খুবই মন্দ স্বভাব। কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ মানবচরিত্রের জঘন্যতম কু-অভ্যাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাকবে। কেননা মিথ্যা পাপাচার পর্যন্ত পৌঁছে দেয় আর পাপাচার জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মিথ্যা দোষারোপ করার ক্ষেত্রে দোষারোপকারীকে পরচর্চা ও পরনিন্দার আশ্রয় নিতে হয়। ইসলামে পরনিন্দা ও পরচর্চাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরনিন্দাকারীকে কঠোর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।’ (সূরা আল-হুমাযা, আয়াত-১) পরনিন্দা ব্যভিচার থেকেও গুরুতর অপরাধ। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘গিবতকারী ব্যক্তিকে যে পর্যন্ত সে ব্যক্তি ক্ষমা না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাকে মাফ করবেন না।’ (মিশকাত)
কারও বিপক্ষে মিথ্যা দোষারোপ করতে হিংসা-বিদ্বেষ মানুষকে প্ররোচিত করে। মানুষ সাধারণত পরশ্রীকাতর হয়ে এবং অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে মিথ্যা দোষারোপের অপরাধে লিপ্ত হয়। মানব চরিত্রের ক্ষতিকর মন্দ স্বভাবের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ জঘন্য ধরনের বদঅভ্যাস। নেতৃত্বের মোহ, সুযোগ-সুবিধা লাভের ক্ষেত্র তৈরি, অসত্ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা, নিজেকে জোরপূর্বক যোগ্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা প্রভৃতি খারাপ মানসিকতা মানুষকে হিংসা ও বিদ্বেষপরায়ণ হতে প্ররোচিত করে। হিংসা ও বিদ্বেষপোষণকারীর অনিষ্ট থেকে পানাহ চাওয়ার আহ্বান জানিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে (পানাহ চাই), যখন সে হিংসা করে।’ (সূরা আল-ফালাক, আয়াত-৫)
ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে মিথ্যা দোষারোপের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে চরম দুরবস্থা দেখা দিয়েছে মানুষের স্ব স্ব কর্মস্থলে; যেখানে মিথ্যা দোষারোপের ব্যাপক প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়। কর্মস্থলে বিশেষ করে চাকরিস্থলে দক্ষতা, সততা ও পারদর্শিতা প্রদর্শনের পরিবর্তে অনেকেই মিথ্যা দোষারোপের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অধস্তন বা ঊর্ধ্বতনদের সম্পর্কে মিথ্যা দোষারোপ করা চরম এক বদঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শুধু চাকরিস্থল নয়, পরিবার ও সমাজ মারাত্মক এ দুষ্ট ব্যাধিতে আক্রান্ত। হাদিস শরিফে মিথ্যা দোষারোপ করার জন্য কঠোর শাস্তির কথা বিধৃত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে এমন দোষে দোষারোপ করবে যা থেকে সে মুক্ত, আল্লাহ তাকে ‘রাদগাতুল খাবাল’ নামক জাহান্নামের গর্তে বাসস্থান করে দেবেন, যতক্ষণ সে অপবাদ থেকে ফিরে না আসে।’ (আবু দাউদ)
মিথ্যা অপবাদের ফলে একদিকে দোষারোপকারীরা অবৈধভাবে নানা ধরনের ফায়দা লুটছে, অন্যদিকে যাকে মিথ্যা দোষারোপ করা হচ্ছে, তাকে দারুণভাবে হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। এর দ্বারা ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটে, হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়, সামাজিক বন্ধনের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে এবং পারস্পরিক ঐক্য ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় ক্ষেত্রে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলে। তাই ইসলামের শিক্ষার আলোকে প্রত্যেকেরই মিথ্যা অপবাদ ও দোষারোপের ন্যায় জঘন্য সামাজিক অনাচারমূলক কর্মকাণ্ড থেকে সর্বাবস্থায় বিরত থাকা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.