বিবিসি’র বিশ্লেষণ: বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে বাঁক পরিবর্তন, অস্বস্তিতে ভারত
ভারতের মাধ্যমে পৃথক হওয়া দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক বেদনাদায়ক সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালে তাদের মধ্যে ছিল শত্রুতা। তৎকালীন বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ইসলামাবাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেতে সংগ্রাম শুরু করে এখানকার মানুষ। নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের সময় বাঙালিদের সমর্থন করেছিল ভারত। স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশটির প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল। সেই সময়ের ক্ষত দিন দিন গভীর হলেও ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বেশ আন্তরিক। সে সময় বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল বিএনপি ও জামায়াত। তবে এই মোড় ঘুরে যায় ২০০৯ সালে, যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনামলে দিল্লির প্রতি সমর্থন দৃঢ় হয়। পক্ষান্তরে পাকিস্তানকে দূরে ঠেলে দেন হাসিনা। তবে গত বছরের আকস্মিক গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা যখন ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তখন ঢাকা-ইসলামাবাদের সম্পর্কের বরফ ক্রমশ গলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেছেন, গত ১৫ বছর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্ক কিছুটা কঠিন ছিল। তবে বর্তমানে সম্পর্কটা প্রতিবেশীর মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে বলে মনে করেন তিনি। এসব ঘটনাবলী নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ভারত। যেহেতু তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্ক রয়েছে।
হাসিনার পতনের পর থেকে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বেড়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন হাসিনা। তাকে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশের দাবির কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি ভারত। এ ছাড়া সকল অভিযোগও অস্বীকার করেছেন হাসিনা।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, ঢাকা এবং ইসলামাবাদের মধ্যকার সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা একধরনের কৌশলগত পদক্ষেপ। লন্ডনের কিংস কলেজের সিনিয়র ফেলো আয়েশা সিদ্দিকা বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। কেননা, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে ভারতের আধিপত্যকে সজোরে আঘাত করতে চায়। এই সম্পর্কের আরেকটি কৌশলগত দিক হচ্ছে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একাধিকবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্কও রয়েছে। বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তারা জানুয়ারিতে পাকিস্তান সফর করেছেন। বিরল ওই সফরে তারা পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফেব্রুয়ারিতে করাচি উপকূলে পাকিস্তান আয়োজিত একটি বহুজাতিক মহড়ায় বাংলাদেশের নৌবাহিনী অংশ নেয়।
বিবিসি বলছে, ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন বীণা সিক্রি। ঢাকা ও ইসলামাবাদের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতাকে ‘দেজা ভ্যু মোমেন্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। বলেছেন, তার দায়িত্বপালনকালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একাংশের সহায়তায় ভারতীয় বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেছিল ভারত। সেসময় বাংলাদেশকে এ বিষয়ে প্রমাণও দেয়া হয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি। যদিও ভারতের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান। বিবিসি’র খবরে বলা হয়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অনুপ্রবেশ অনেকটা সহজ। কিন্তু ২০০৯ সালে হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তারা গোষ্ঠীগুলোর ওপর কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং তাদের ঘাঁটি ভেঙে দেয়। সুতরাং বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত হওয়া ভারতের জন্য বেশ উদ্বেগের বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন বীণা সিক্রি। তিনি যোগ করেন, এটি কেবল সামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়। কেননা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসলামাবাদকে সমর্থনকারী জামায়াতে ইসলামীর মতো বাংলাদেশি ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে।
ভারতীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঢাকা সফর করেছেন। তবে ওই প্রতিবেদনের খবর সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন ড. ইউনূসের প্রেস সচিব। ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে পুনরায় সচল করতে পাকিস্তান সহায়তা করছে বলে মিডিয়া যে প্রতিবেদন করেছে তা ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশে আইএসআই-এর ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে বিবিসি’র প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশি রাজনীতিবিদরা এ বিষয়টি জানেন যে, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ঢাকা ভারত-বিরোধী অবস্থান নিতে পারে না। দিল্লির আশঙ্কা সত্ত্বেও বাংলাদেশের কূটনীতিকরা যুক্তি দেন যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের বিষয়টি মীমাংসা না হলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যাবে না। যুদ্ধে লাখ লাখ বাঙালি নিহত হয় এবং ধর্ষণের শিকার হয় লাখো নারী। পরে ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি নিরাপত্তা ও বেসামরিক কর্মী ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শেষ হয় যুদ্ধ। এ বিষয়টি ইসলামাবাদ নিজেদের জন্য অপমানজনক হিসেবে দেখে। যুদ্ধের সময় সংঘটিত নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ইসলামাবাদ তা করতে কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য পাকিস্তানের দায় স্বীকার করা উচিত। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ১৯৭১ সালের আগের সম্পদের বিভাজনের বিষয়টিও উত্থাপন করেছি। এমনকি ইকরাম সেহগালের মতো সাবেক পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাও স্বীকার করেন, পাকিস্তানিদের ১৯৭১ সালে যা ঘটেছিল তার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং এটাই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই মেজর জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের উচিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় উর্দুভাষীদের ওপর বাঙালিদের আক্রমণের বিষয়টিও সমাধান করা। করাচিতে বসবাসকারী সাবেক এই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা বলেন, (পূর্ব পাকিস্তানে) উর্দুভাষী বিহারি জনগণের ওপর যে নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল তার সাক্ষী ছিলাম আমি। যদিও ইতিহাস ঢাকা এবং ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলেছে, তারপরও অর্থনীতিবিদরা উল্লেখ করেছেন, দেশ দুটি প্রথমে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উন্নত করার দিকে মনোনিবেশ করতে পারে, যার পরিমাণ বর্তমানে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের কম। আর এই বাণিজ্যের বেশির ভাগই পাকিস্তানের পক্ষে।
ডেলাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক সাবরিন বেগ বলেন, পাকিস্তানের ২৫ কোটির বেশি জনসংখ্যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বাজার। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বর্তমানে উভয় পক্ষেরই উচ্চ শুল্কসহ আরও বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা ভিসা ও ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তবে উন্নত দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এসব সীমাবদ্ধতা কমিয়ে আনবে বলে মনে করেন তিনি। আগামী এপ্রিলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরের সময় এ বিষয়গুলো আলোচনা হতে পারে। এ বছরের শেষেই বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকারের জন্য বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকারে ভিন্নতা থাকতে পারে। তবে যাই ঘটুক না কেন, এতে দিল্লির জন্য ঝুঁকি অনেক বেশি। কেননা, তারা মনে করে যে, ভারতের উত্তর-পূর্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় দিল্লি।
No comments