হাতে বেশি সময় নেই, ডিসেম্বরে- নির্বাচন
নির্বাচন প্রসঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে খুব বেশি সময় নাই, আমরা অলরেডি সাত মাস পার করে এসেছি। আমরা তো বলেছি- ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। এর মধ্যে যা আমরা করতে চাই, যা করার সামর্থ্য আছে, এগুলো করে ফেলা। যত সংস্কার করার দরকার আছে করে ফেলা। কারও জন্য অপেক্ষা করে আমাদের কোনো ফায়দা হবে না।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ এবং রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ফারজানা ইসলাম।
কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আইন হলো আমাদের সবার আশ্রয়। পুলিশ হলো সেই আশ্রয়দাতা। পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আইন আপনাকে সুরক্ষা দেবে। এই ইমেজ যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, অতীতের সব কথা মানুষ ভুলে যাবে।
তিনি বলেন, সরকার যাই কিছু করতে চায় না কেন, যে ভঙ্গিতেই করতে চায় না কেন, শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতেই বাস্তবায়ন করতে হয়। তারা করে দেবে না, তারা পরিবেশটা সৃষ্টি করে। ওই পরিবেশ না থাকলে তাহলে কোনো কাজই হয় না। তিনি বলেন, পুলিশকে অবহেলা করে বা পাশ কাটিয়ে দেশ গড়তে পারবো না। তারাই সম্মুখসারির মানুষ। তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেই তখন বাকি জিনিসগুলো হয়।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পুলিশের কথা প্রসঙ্গে দুটি শব্দ বারবারই আমরা বলেছি, তা হলো আইন ও শৃঙ্খলা। এটিই হলো পুলিশ। আইন যদি না থাকে তাহলে সরকার কি, গণতন্ত্র কি, অধিকার কি, মানুষ-নাগরিক কি কিছুই থাকে না। আইনশৃঙ্খলা ঠিক না থাকলে যত বড় চিন্তা থাকুক, যত টাকা ঢালুক, কোনো কাজে আসবে না। পুলিশ সদস্যরা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, সেসব নিয়ে বৈঠক করবেন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সমাধান করতে পারবো কি না-জানি না। কিছু কিছু জিনিস সমাধান করা অনেক কঠিন হয়ে যায়, কিন্তু চেষ্টা করবো যে-কী করা যায়। যদি ব্যর্থ হই, তবে মনে করবেন-আমি চেষ্টা করেছিলাম, ব্যর্থ হয়েছি। চেষ্টার অভাবে ব্যর্থ হইনি।
তিনি বলেন, যাদের হাতে পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব, দেশকে তৈরি করার দায়িত্ব, তাদের তৈরি করতে না পারলে বাকি কাজ হলো না। সেই জন্য আমরা অগ্রাধিকার দিতে চাই, যেটা আমরা পারি।
বাংলাদেশ একটা মস্ত বড় সম্ভাবনার দেশ মন্তব্য করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ব্যক্তি হিসেবে এটা অনুভব করি। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে আনতে পারছি না, ঠেকে যাচ্ছে। আজকে আমরা সুযোগ পেয়েছি, মস্ত বড় সুযোগ সেই সম্ভাবনাকে কাজে পরিণত করা। জুলাইয়ে অভ্যুত্থানের ফলে সেই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই সম্ভাবনার যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। যেটুকু সময় আমাদের আছে, চেষ্টা করি। ভবিষ্যতেও যারা আসবে তারা চেষ্টা করবে, পথটা যেন আমরা সৃষ্টি করে দিই। এই পথে আমরা এগোলে সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে পরিণত হবে।
সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর যে সমস্ত অগ্রগামী দেশ, যারা পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেয়-তাদের মধ্যে একটি হতে পারে। সেরকম সম্ভাবনা আছে। এটা কোনো আত্মতুষ্টির জন্য না। একটু বিচার করলেই মনে হয়, হ্যাঁ, এরকম সম্ভাবনা আছে।
ড. ইউনূস আরও বলেন, গণ-অভ্যুত্থান হলো, বিরাট একটা কাণ্ড। ইতিহাসের বিরাট একটা পরিবর্তন সূচিত হলো। লণ্ডভণ্ড অবস্থার মধ্যে আমরা এই যাত্রা শুরু করলাম। সারা দুনিয়ার যত দেশ আছে, সবাই আমাদের সমর্থন করলো। শুধু মিনমিনে সমর্থন না, উৎসাহ সহকারে এগিয়ে এলো। তারা মনে করেছে, এই দেশ যদি উঠে দাঁড়াতে পারে, সেটা সবার ভালো সঙ্গী হবে। তারা আমাদের ওপর যেরকম ভরসা করেছে, আমরা আমাদের ওপর সেরকম ভরসা আনতে চাই। নতুন করে যে যাত্রা শুরু হলো, এটা মস্ত বড় সুযোগ। এই সুযোগটা যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আইন যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারি, শৃঙ্খলা যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলে যেকোনো যুদ্ধ জয় সম্ভব। তিনি বলেন, আমরা নতুন বাংলাদেশ বলি, এটা কথার কথা না; নতুন বাংলাদেশ বলি এই কারণে যে, পুরনো বাংলাদেশ অন্ধকার যুগ আমাদের। ভয়ঙ্কর। সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো থেকে আমরা সুন্দর, ঝলমলে দিনে আসতে চাই। সেটাই নতুন বাংলাদেশ।
ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ টেনে বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে ইউনূস বলেন, পুলিশ বাহিনীর মুশকিল হলো, ওই অন্ধকার যুগে তারা অ্যাকটিভ পার্টিসিপ্যান্ট ছিল। নিজের ইচ্ছায় না, সরকারি কাজ করতে হয়। কাজেই ‘আমরা কাজ করেছি, আমরা হুকুম পেয়েছি, করেছি; করতে করতে আমরাও ওরকম চিন্তার ওপর গেছি’। কাজেই নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার জন্য তোমাদের ওই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে, আমরা নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করবো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের অনেক দোষ দেয়। আমরা দেখিয়ে দেবো, আমরা মানুষ খারাপ না। আমরা খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়েছিলাম। আমরা সেই খারাপ মানুষ থেকে বেরিয়ে এসেছি। ভালো মানুষ আমরা। আমরা দেখবো, কী করতে পারি। সেই দৃঢ় চিন্তা মাথার ভেতরে রাখতে হবে। আমরা দেখিয়ে ছাড়বো-আমরা কী করতে পারি। আমাদের কাজের মাধ্যমে দেখাবো-আমাদের হাত দিয়েই নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি হবে।
পুলিশ হবে বন্ধু মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন পুলিশ দেখলেই মানুষ ভয় পায়, কী সিস্টেমের মধ্যে আটকে ফেলে, একটা ভয়ঙ্কর ক্যারেক্টার। আইন হলো আমাদের সবার আশ্রয়। পুলিশ হলো সেই আশ্রয়দাতা। পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আইন আপনাকে সুরক্ষা দেবে। এই ইমেজ যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, অতীতের সব কথা মানুষ ভুলে যাবে।
জাতীয় ঐক্য গড়তে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা কি শুরু হয়ে গেল?
অনানুষ্ঠানিক আলোচনা-পর্ব কি শুরু হয়ে গেল? সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। সংস্কার কার্যক্রম চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত এক সপ্তাহে ভিন্ন ভিন্ন দিনে এ বৈঠকগুলো হয়েছে।
কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ ও সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার ইতিমধ্যেই দফায় দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছেন। এসব আলোচনায় তারা মূলত বুঝতে চেয়েছেন যে, সংস্কার কমিশনসমূহের কোন্ কোন্ সুপারিশ নিয়ে বড় দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া সংস্কারের বিষয়ে দলগুলোর সামগ্রিক মনোভাব জানা এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশন তথা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি জানানোর লক্ষ্যেই এসব অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে।
এ বিষয়ে ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার মানবজমিনকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ সামগ্রিক প্রক্রিয়ারই অংশ। কিন্তু সংস্কার কার্যক্রমকে পরবর্তী ধাপে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের আনুষ্ঠানিক আলোচনা পর্ব আগামী ২/৩ দিনের মধ্যেই শুরু হতে পারে।
No comments