কেন ইলন মাস্কের স্টারলিংকে যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ ও ভারত?

ভারতে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি জোট সরকার আর বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে এই মুহূর্তে হাজারটা বিষয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে- কিন্তু বিশেষ একটি ক্ষেত্রে এই দুই নেতারই লক্ষ্য এক, আর সে জন্য তারা দুজনেই সক্রিয়! এই জিনিসটা আর কিছুই নয়- ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংস্থা স্টারলিংককে তাদের নিজ নিজ দেশে নিয়ে আসা। খবর বিবিসি বাংলার।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন ডিসিতে গিয়ে ইলন মাস্কের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছিলেন। তারপর গত সপ্তাহে ভারতের দুই ইন্টারনেট ও টেলিকম জায়ান্ট- এয়ারটেল ও রিলায়েন্স জিও মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর ঘোষণা করেছে যে স্টারলিংকের সঙ্গে তাদের সমঝোতা চূড়ান্ত, যার মাধ্যমে ওই সংস্থাটি ভারতে তাদের পরিষেবা দিতে পারবে। ভারতে স্টারলিংক কবে আর কীভাবে চালু হবে তা নিয়ে এখনো অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে, তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত যে, এদেশের কমিউনিকেশন খাতে সেটা একটা যুগান্তকারী ঘটনা হতে চলেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রী মোদি যেদিন আমেরিকায় ইলন মাস্কের সঙ্গে দেখা করেন (১৩ই ফেব্রুয়ারি), ঠিক সেদিনই বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও মাস্কের সঙ্গে টেলিফোনে দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বলেন। বাংলাদেশে স্টারলিংক ‘লঞ্চ’ করার জন্য সেদিন মাস্ককে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ড. ইউনূস, ক’দিন পরে তিনি চিঠি লিখে বাংলাদেশ সফরে আসার জন্যও ইলন মাস্ককে আমন্ত্রণ জানান। মাত্র ৯০ দিনের ভেতর বাংলাদেশে স্টারলিংকের যাত্রা শুরু করা সম্ভব বলেও ওই চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এরপর স্টারলিংকের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে, সে দেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গ্রাউন্ড আর্থ স্টেশন স্থাপন ও আরও নানা অবকাঠামোগত বিষয়ে স্টারলিংকের বোঝাপড়াও সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ ও ভারত- দুই প্রতিবেশী দেশেই স্টারলিংকের পরিষেবা পাওয়াটা এখন নেহাত আর কিছু সময়ের অপেক্ষা বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে, যদিও অতীত অভিজ্ঞতা বলে এই দুটো দেশেই বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তেও নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়ে থাকে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য একটি দেশে স্টারলিংক সার্ভিস কিন্তু ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে- আর সেই দেশটি হলো ভুটান। বস্তুত ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেই ভুটানে স্টারলিংকের ইন্টারনেট প্ল্যান চালু হয়ে গিয়েছিল, তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই অঞ্চলের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ভারত বা বাংলাদেশ- যেখানেই স্টারলিংক আগে চালু হোক, স্যাটেলাইট-নির্ভর ইন্টারনেট পরিষেবার একটা চাহিদা যে এই দেশগুলোও অনুভব করছে সেই ইঙ্গিত কিন্তু স্পষ্ট। এমনকি গৃহযুদ্ধে দীর্ণ মিয়ানমারও চাইছে তাদের দেশে স্টারলিংক আসুক। এখন প্রশ্ন হলো, স্টারলিংক ভারত বা বাংলাদেশে এলে বাড়তি কী সুবিধা মিলবে? প্রযুক্তিগত সুবিধার বাইরেও কি স্টারলিংককে এনে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সুবিধা আশা করছে এই দেশগুলো? স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট পরিষেবায় অনুমতি দেয়ার মানে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করা, এই ধরনের আশঙ্কাকেই বা কীভাবে ‘অ্যাড্রেস’ করা হবে? সবচেয়ে বড় কথা, এই পরিষেবার খরচ কি আদৌ সাধারণ মানুষের নাগালের ভেতর থাকবে? না কি শুধু ধনী কর্পোরেটরাই স্টারলিংক ‘অ্যাফোর্ড’ করতে পারবে? এই প্রতিবেদনে বিবিসি বাংলা উত্তর খুঁজেছে এই সব প্রশ্নেরই।

স্টারলিংক কী, এর বিশেষত্ব কোথায়?
স্টারলিংক হলো আসলে একটি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা, যেটি অপারেট করে ইলন মাস্কের মালিকানাধীন এরোস্পেস কোম্পানি স্পেসএক্স। এই মুহূর্তে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া-আফ্রিকা জুড়ে বিশ্বের শতাধিক দেশে স্টারলিংকের পরিষেবা পাওয়া যায়। গত বছরের জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীকে ঘিরে বিভিন্ন কনস্টেলেশনে এই কোম্পানির প্রায় হাজার সাতেক ‘লো-আর্থ অরবিট’ (এলইও) স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ আছে- যেগুলোর মাধ্যমে তারা ভূপৃষ্ঠে ইন্টারনেট পরিষেবা দিয়ে থাকে। ইলন মাস্ক দাবি করেছেন, মহাকাশে স্টারলিংকের এই ‘মেগাকনস্টেলেশন’ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ঢেলে সাজানো হবে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা স্টারলিংক গ্রাহকরা তার সুবিধা পাবেন। সাবেকি ব্রডব্যান্ড সার্ভিস যেখানে ভূগর্ভস্থ কেবল বা টাওয়ারের ওপর নির্ভরশীল, স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলো কিন্তু পৃথিবীর বুকে ছোট ছোট ‘ইউজার টার্মিনালে’র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমেই ইন্টারনেট পরিষেবা দিয়ে থাকে। যেহেতু এক্ষেত্রে টাওয়ার বসানোর বা মাটির নিচে কেবল পাতার কোনো ঝামেলা নেই, তাই দুর্গম প্রত্যন্ত প্রান্তরে বা গ্রামীণ এলাকাতেও খুব সহজে স্টারলিংকের পরিষেবা পাওয়া সম্ভব। গ্রাহকের কাছে শুধু কোম্পানির ছোট ‘ইউজার টার্মিনাল’টি থাকলেই যথেষ্ট। অতি দুর্গম জায়গা থেকেও বেশ সহজে স্ট্রিমিং, ভিডিও কল, অনলাইন গেমিং বা রিমোট ওয়ার্কিং করা যায় বলেই স্টারলিংক দুনিয়া জুড়ে এত জনপ্রিয় হয়েছে। তবে বিশ্বে স্টারলিংক বৃহত্তম স্যাটেলাইট-নির্ভর ইন্টারনেট প্রোভাইডার হলেও তারা একমাত্র নয়- ওয়ানওয়েব ইউটেলসেট, আমাজনের প্রজেক্ট কুইপার, ভায়াস্যাট কিংবা হিউজেসনেটের মতো আরও অনেক কোম্পানিই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট পরিষেবা দেয় বা দিতে চলেছে। ইউটেলসেটে আবার ভারতীয় কোম্পানি এয়ারটেলেরও বিপুল লগ্নি আছে, যদিও তারা এদিকে ভারতে স্টারলিংকের সঙ্গেও সমঝোতার কথা ঘোষণা করেছে। গত ১১ই মার্চ যখন এয়ারটেল স্টারলিংকের সঙ্গে তাদের অংশীদারিত্বের কথা ঘোষণা করেছিল, পর্যবেক্ষকরা সেটাকে ভারতের ডিজিটাল কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে একটা ‘ক্যু’-র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সুনীল ভারতী মিত্তালের কোম্পানি এয়ারটেল তখন প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছিল, সারা দেশ জুড়ে তাদের যে রিটেল স্টোরের (খুচরো দোকান) বিশাল নেটওয়ার্ক আছে, সেখান থেকেই স্টারলিংক তাদের নিজস্ব ডিভাইস বিপণন ও বিতরণ করতে পারবে। এর ফলে ভারতে স্টারলিংকের প্রাথমিক বিনিয়োগও অনেক কম করতে হবে। এই মুহূর্তে ভারতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বাজারে সবচেয়ে বড় ‘প্লেয়ার’ হলো মুকেশ আম্বানির মালিকানাধীন রিলায়েন্স জিও- যাদের সারা দেশে ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি ‘ক্যাবল-ওলা’ ইন্টারনেট গ্রাহক আছে। এয়ারটেল-স্টারলিংকের সমঝোতার ফলে জিও যখন বিপাকে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, ঠিক তখনই মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর জিও প্ল্যাটফরমস লিমিটেডও ঘোষণা করে তারাও স্টারলিংকের সঙ্গে অনেকটা একই ধরনের পার্টনারশিপে যাচ্ছে। ফলে ভারতের প্রধান দুই কমিউনিকেশন জায়ান্ট- ভারতী এয়ারটেল ও রিলায়েন্স জিও- উভয় কোম্পানিই এখন ইলন মাস্কের স্টারলিংকের সঙ্গে বোঝাপড়া করে গ্রাহকদের স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা দেয়ার দিন গুনছে। তবে এই দুটো সমঝোতাই ভারতের রেগুলেটরি অথরিটির অনুমোদন সাপেক্ষে হবে বলে জানানো হয়েছে, অর্থাৎ সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমতি পাওয়ার পরই কেবল স্টারলিংক সে দেশে ব্যবসা করতে পারবে।

ভূরাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত?
আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘ই-ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসে’ গত মাসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে গবেষক এমা গ্যাটি ও মার্ক লিন্ডার স্টারলিংককে এই সময়ের সবচেয়ে বড় ‘জিওপলিটিক্যাল ডিসরাপ্টর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ তারা বলছেন, বর্তমান ভূরাজনীতিতে এত বড় উথাল-পাথাল আর কোনো সংস্থাই ফেলতে পারেনি। আগামী দিনে স্টারলিংক জেন-থ্রি স্যাটেলাইটের সাহায্যে যখন ১ টেরাবিট-পার-সেকেন্ড (টিবিপিএস) গতিতে সারা দুনিয়ায় ইন্টারনেট দিতে পারবে- তখন পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’ বা অধিক ক্ষমতাশালীর ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলেও এই গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন। ইতালির উদাহরণ দিয়ে তারা বলছেন, এ বছরের গোড়ার দিকে যখন ব্লুমবার্গ খবর প্রকাশ করে ইতালি তাদের দেশে স্টারলিংকে ১৫০ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করার কথা ভাবছে- তখন ইউরোপের মহাকাশ গবেষণা মহলে রীতিমতো ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে গিয়েছিল! ওই নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে, ইউরোপের নিজস্ব কানেক্টিভিটি প্রকল্প ‘আইরিস-টু’ যখন অনেক বাধা-বিপত্তির পর অবশেষে প্রায় শেষের পথে- তখন সেই ইউরোপেরই একটি বৃহৎ অর্থনীতি যদি সেটাকে ছেড়ে মার্কিন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে আস্থা রাখে তখন তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কতোটা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না! এদিকে গত মাসেও যখন ইউক্রেনের ‘রেয়ার আর্থ’ খনিজদ্রব্যে অধিকার পাওয়ার জন্য মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তখন দরকষাকষির অংশ হিসেবে ইউক্রেন থেকে স্টারলিংক পরিষেবা প্রত্যাহার করার হুমকি দেয়া হয়েছিল বলে রয়টার্স জানিয়েছে। অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে অবকাঠামো এখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত-তাদেরই এখন স্টারলিংক সবচেয়ে বেশি দরকার! ফলে ইলন মাস্কের স্টারলিংককে যে গ্লোবাল জিওপলিটিক্সে একটি নতুন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই পটভূমিতেই ভারত সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে ইলন মাস্কই হলেন আমেরিকার নতুন ‘ডিফেন্স কন্ট্রাক্টর’- বা প্রতিরক্ষা ঠিকাদার!” তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, এতদিন আমেরিকার বিভিন্ন কোম্পানি সারা দুনিয়ায় অস্ত্রশস্ত্র, সাবমেরিন বা যুদ্ধজাহাজ বেচে তাদের ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’ বানাতো- আর এখন ঠিক সেই কাজটাই করা হচ্ছে স্টারলিংক পরিষেবা বেচে। বস্তুত বিশ্বের এমন বহু দেশেই স্টারলিংক বড় বাজার তৈরি করতে পেরেছে, যেখানে ব্রডব্যান্ড কেবল বা টাওয়ার নেটওয়ার্ক যথেষ্ট ভালো- দুর্গম বা প্রত্যন্ত এলাকা ততটা নেই। ফলে আপাতদৃষ্টিতে স্টারলিংকের তেমন চাহিদা থাকার কারণ নেই, কিন্তু তবু সে সব দেশেও তাদের গ্রাহক বাড়ছে। যুক্তরাজ্য বা বৃটেন এর একটা বড় উদাহরণ, যা থেকে বোঝা যায় কোনো দেশে স্টারলিংকের প্রবেশ আসলে যতটা না ‘কানেক্টিভিটি’ সংক্রান্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘স্ট্র্যাটেজিক’ সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আমেরিকার নতুন প্রশাসনে ব্যক্তি ইলন মাস্কের সাংঘাতিক প্রভাব ও ক্ষমতা। নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই তিনি শুধু ডনাল্ড ট্রাম্পের ডান হাত নন, মি. ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে আসার পর থেকে ইলন মাস্কই প্রশাসনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এমন একজন সাবেক কূটনীতিবিদের কথায়, “ভারতই বলি বা বাংলাদেশ, কিংবা ধরা যাক থাইল্যান্ড- যারাই ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাইবে তারা যে ইলন মাস্ককেও সন্তুষ্ট করতে চাইবেন এর মধ্যে তো কোনো রকেট সায়েন্স নেই!” ফলে এই সব দেশে স্টারলিংকের আসন্ন প্রবেশের নেপথ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার তাগিদেরও ভূমিকা আছে বলেই অনেকে মনে করছেন। গত মাসে হোয়াইট হাউসের এক সংবাদ সম্মেলনে যখন ইলন মাস্ক ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠক নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জবাব দেন, “হ্যাঁ, ও (মাস্ক) বোধহয় ভারতে কী সব ব্যবসা-ট্যাবসা করতে চাইছে!” আবার বিবিসি বাংলার সঙ্গে সামপ্রতিক এক সাক্ষাৎকারে যখন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টাতেই ইলন মাস্ককে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে কিনা, তিনি কিন্তু সরাসরি সেটা মানতে চাননি। ওই সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “না, এটা মূলত ছিল স্টারলিংক নিয়ে- ব্যবসায়িক সম্পর্কের একটা বিষয় ছিল। সে বিষয়েই আমরা আলাপ করেছি, যে স্টারলিংকের কানেকশনটা আমরা নিতে চাই।”

জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে?
এয়ারটেল ও জিও’র সঙ্গে সমঝোতার ঘোষণার পর ভারতে স্টারলিংক পরিষেবা পাওয়াটা এখন আর অল্প কিছু সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে ঘটনা হলো, বহু চেষ্টা করেও এতদিন কিন্তু স্টারলিংক ভারতে ব্যবসা করার অনুমোদন পায়নি। ভারতে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্টারলিংক নিজেদের নথিভুক্ত করেছিল সেই ২০২১ সালের নভেম্বর মাসেই। এর কয়েকদিন পরেই কেন্দ্রীয় সরকার একটি বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করে, এই কোম্পানি কিন্তু এখনো ব্যবসা করার প্রয়োজনীয় লাইসেন্স পায়নি- কাজেই সাধারণ মানুষ এদের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করলেই ভালো করবেন। বস্তুত স্টারলিংককে নিয়ে ভারতে যাবতীয় সন্দেহ বা অবিশ্বাসের মূলে আছে এই প্রশ্নটাই- এই স্যাটেলাইট-নির্ভর পরিষেবা জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে না তো? দিল্লিতে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওই বিশেষজ্ঞের কথায়, “ঠিক যে কারণে টিকটক-সহ অনেকগুলো চীনা অ্যাপকে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বলতে পারেন অনেকটা একই কারণে স্টারলিংককে এতদিন এ দেশে ঢুকতে দেয়া হয়নি।” এর মাঝে গত ডিসেম্বরেই ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেটের কর্মকর্তারা জানান, মাদকবিরোধী একটি অভিযানে গিয়ে তারা চোরাকারবারিদের কাছ থেকে স্টারলিংকের ডিভাইস উদ্ধার করেছেন। কয়েক সপ্তাহ পরেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর থেকে খবর আসে, সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী  পাচার করে আনা স্টারলিংক ডিভাইস ব্যবহার করছে। মণিপুরে উদ্ধার করা অস্ত্রশস্ত্রের যে ছবি ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী প্রকাশ করেছিল, তাতে একটি স্টারলিংকের ডিভাইসও দেখা যায়। এক্স হ্যান্ডেলে সেই ছবির জবাব দিয়ে ইলন মাস্ক অতঃপর লেখেন, “এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভারতের আকাশে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট বিম সুইচ অফ করা আছে।” তবে যেকোনো কারণেই হোক, স্টারলিংককে ঘিরে ভারতের সরকারি মহলে সন্দেহ ও সংশয় আপাতত অনেকটাই কেটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। “এর একটা কারণ হতে পারে স্টারলিংক ভারতে তাদের যন্ত্রপাতি কিন্তু নিজেরা বেচবে না, এগুলো বিলি করা হবে এয়ারটেল ও জিও’র মতো দুটো ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে। ভারতে স্টারলিংকের নিজস্ব কোনো গ্রাহকও থাকবে না, এরা হবেন ওই দুটি কোম্পানির গ্রাহক।” “আমি অনুমান করছি স্টারলিংকের ডিভাইসে এখানে একটা কোনো বাড়তি সফটওয়্যার যোগ করা হবে, যাতে ডেটা মনিটরিং করার একটা সুযোগ থাকে। এটা যদিও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, তবে হতেই পারে সেই কাজও অনেক দূর এগিয়ে গেছে”, বিবিসিকে বলছিলেন দিল্লির একজন নামি ইন্টারনেট প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। প্রসঙ্গত, ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ কিন্তু সে দেশে স্টারলিংক আনার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলছে- এর মাধ্যমে মুক্ত ইন্টারনেটের অধিকারই আরও জোরালো হবে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ভবিষ্যতে সরকারগুলো যাতে কোনো অজুহাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতেই স্টারলিংককে বাংলাদেশে ডাকা হয়েছে। তিনি আরও লেখেন, “বাংলাদেশে স্টারলিংকের আসার অর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যতে এ দেশে কোনো সরকার ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারবে না। অন্তত নতুন কোনো ইন্টারনেট বন্ধের চেষ্টার আঘাত বিপিও ফার্ম, কল সেন্টার ও ফ্রিল্যান্সারদের ওপর আসবে না।” তবে সমপ্রতি ইউক্রেনে আমেরিকার হুমকির মধ্যে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, একটা দেশে স্টারলিংকের থাকা-না থাকা শুধু সে দেশের সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না- আমেরিকাও সেখানে অবধারিত প্রভাব খাটাতে চাইবে।

স্টারলিংক পরিষেবার খরচ কেমন পড়বে?
তবে যাবতীয় ভূরাজনৈতিক বা নিরাপত্তাগত কচকচির বাইরে গিয়ে ভারত বা বাংলাদেশের সাধারণ একজন গ্রাহক হয়তো সবার আগে জানতে চাইবেন, স্টারলিংক পরিষেবা নিতে চাইলে খরচ কতো হবে? সেটা কি আদৌ আমার বাজেটের নাগালে হবে? এক কথায় এর উত্তর দেয়া কঠিন- কারণ এই বাজারগুলোতে স্টারলিংকের ‘প্রাইস পয়েন্ট’ ঠিক কী হবে সেটা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি, আর তা ছাড়া বিশ্বের এক একটা বাজারে তাদের পরিষেবার খরচও এক এক রকম। বিশ্বের যে একশ’টিরও বেশি দেশে স্টারলিংক এখন চালু আছে, সেখানে তাদের মান্থলি সাবস্ক্রিপশন প্ল্যানগুলোর খরচ ১০ ডলার থেকে শুরু করে ৫০০ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আফ্রিকায় খরচ অনেক কম, ইউরোপের তুলনায় অনেক বেশি। তবে এটি আনলিমিটেড নয়। এর সঙ্গে এককালীন খরচ দিয়ে স্টারলিংকের হার্ডওয়্যারও (ডিভাইস) গ্রাহককে কিনতে হয়, যার খরচ ২৫০ ডলার থেকে ৩৮০ ডলারের মতো পড়ে। সেই জায়গায় তুলনা করলে দেখা যাবে ভারতের টেলিকম কোম্পানিগুলো অনেক সস্তায় ‘হোম ব্রডব্যান্ড’ প্ল্যান অফার করে থাকে, যার খরচ মাসে মাত্র ৫ ডলার (৪৫০ রুপি) বা ৭ ডলার (৬০০ রুপি) থেকে শুরু। হাইস্পিড প্রিমিয়াম প্ল্যানের খরচ অবশ্য চার বা পাঁচ হাজার রুপিও হতে পারে। তার ওপর স্টারলিংকের ডেটা ব্যবহারে একটা ঊর্ধ্বসীমা আছে, কিন্তু ভারতে রিলায়েন্স জিও বা এয়ারটেলের বেশির ভাগ প্ল্যানই ‘আনলিমিটেড’। ফলে ভারতের মতো একটি ‘প্রাইস-সেনসিটিভ’ বা দাম-সচেতন বাজারে সফল হতে গেলে স্টারলিংককে খুবই প্রতিযোগিতামূলক দামে প্ল্যান অফার করতে হবে। তবে এই বাজারে প্রবেশ করাটাই যদি তাদের মূল লক্ষ্য হয়, ব্যবসা বাড়ানো নয়- তাহলে অন্য কথা। যেমন আফ্রিকার যে ১৬টি দেশে এই মুহূর্তে স্টারলিংক চালু আছে, তার মধ্যে ৫টিতেই আবার তাদের মান্থলি সাবস্ক্রিপশনের খরচ সে দেশের প্রধান ফিক্সড ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের তুলনায় কম। হিমালয়ের কোলে ভুটানে স্টারলিংক সদ্যই পরিষেবা চালু করেছে- সেখানে আবার রয়েছে তাদের দুটি প্ল্যান। ‘রেসিডেন্সিয়াল লাইট’ প্ল্যানের খরচ মাসে ৩০০০ ন্যু (৩০০০ রুপি), কিন্তু তাতে অফুরন্ত ডেটা ব্যবহারের সুযোগ নেই। ‘স্ট্যান্ডার্ড’ প্ল্যান নিলে আবার মাসে ৪২০০ ন্যু (৪২০০ রুপি) দিয়েই গ্রাহক আনলিমিটেড ইউসেজ পাবেন। সোজা কথায়, দামের ক্ষেত্রে স্টারলিংক এক এক দেশে পরিস্থিতি অনুযায়ী এক এক ধরনের মডেল ব্যবহার করে থাকে। ভারতে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এদেশে স্টারলিংকের খরচ প্রতিষ্ঠিত টেলিকম জায়ান্টদের তুলনায় অনেকটাই বেশি হবে, স্টারলিংকের ডেটা স্পিডও কম থাকবে। অন্যভাবে বললে, এ দেশের দুর্গম ও ‘আন্ডারসার্ভড’ (যেখানে ক্যাবল বা টাওয়ার নেই) এলাকাগুলোতে পৌঁছানোই হবে স্টারলিংকের প্রধান লক্ষ্য- জিও বা এয়ারটেলের ব্রডব্যান্ড সার্ভিসকে তারা সেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারবে না।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.