বাংলাদেশ ও মুসলিম-বিরোধিতা বাড়তে পারে
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো: ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেছেন, চীনের সহায়তায় পাকিস্তান বাংলাদেশের মুসলমানদের ভারতে পাঠাচ্ছে। ভারতের সেনাপ্রধানদের মুখে সাধারণত রাজনৈতিক বক্তব্য শোনা যায় না। এমন মন্তব্যের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: এ ধরনের বক্তব্য দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের দেখা দরকার যে তিনি কেন এ কথা বলেছেন। বক্তব্যটি পরিষ্কারভাবেই রাজনৈতিক, তাই এর পেছনে সেনাপ্রধানের নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। তিনি অবসরে যাবেন, সরকারি দল বিজেপিকে হয়তো কোনো কারণে তুষ্ট করতে চাইছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর চলমান নির্বাচনের সঙ্গেও এর সম্পর্ক থাকতে পারে।
প্রথম আলো: এই মন্তব্য দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আসলে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ বা এ ধরনের কথাবার্তা ভারতের রাজনৈতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। এর মূল কারণ আসলে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। এই ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানো হয়। ক্রমাগত এসব বলার ফলে রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলেও এর একটা প্রভাব পড়েছে। এসব বক্তব্য ভারতে বাংলাদেশ ও মুসলিমবিরোধী মনোভাব বাড়াতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও আমরা একই চর্চা দেখেছি ও দেখি। এখানেও ভারত-বিরোধিতার রাজনীতির চেষ্টা হয়। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে ওই মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। ভারতীয় সেনাপ্রধান যে মন্তব্য করেছেন তার সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক-দুই ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। আগেই বলেছি ভারতে বাংলাদেশ ও মুসলমান-বিরোধিতা বাড়তে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বাড়তে পারে ভারত-বিরোধিতা। এ ধরনের মন্তব্য আসলে বাংলাদেশের ভারতবিরোধীদের খুশি করবে, কারণ একে তারা সহজেই কাজে লাগাতে পারবে।
প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতকে উদ্বিগ্ন না হতে বলেছেন। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ভারতের মধ্যে কি কোনো অস্বস্তি দেখা দিয়েছে? যে কারণে প্রধানমন্ত্রী ভারতকে আশ্বস্ত করলেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেছেন।
প্রথম আলো: তার মানে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ভারতের অস্বস্তি রয়েছে এবং সে কারণেই ভারতীয় সাংবাদিকেরা এমন প্রশ্ন করেছেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ: আসলে চীন-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি খুব জটিল।’ ৬২ সালের যুদ্ধের ছায়া এখানে ভূমিকা পালন করে। সেই যুদ্ধে পরাজয়ের বিষয়টিকে ভারত সব সময় মাথায় রাখে। ভারতের চলচ্চিত্র, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় ও রাজনীতিতে এসব বিষয় চর্চা হয়। আবার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে দেখবেন একক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য চীনের সঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে যত শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশোনা করতে গেছে, সবচেয়ে বেশি গেছে চীনে। দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভারতের কোনো প্রতিবেশী দেশ যখন চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক করতে চায়, তখন ভারত তা মানতে ও পছন্দ করতে চায় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে তোমরা চীনের সঙ্গে যেমন উন্নয়নের স্বার্থে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করো, আমরাও তা-ই করছি।
প্রথম আলো: ভারতের বিচলিত হওয়ার পেছনে কী কাজ করেছে বলে মনে করেন? চীনের প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর, বিশাল আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি? নাকি চীন থেকে বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনা?
ইমতিয়াজ আহমেদ: সমস্যা হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যে মাত্রায় পরিশীলিত হওয়া উচিত, কার্যত তেমন নয়। ভারত হয়তো ভেবেছিল গত নির্বাচনে তারা যেভাবে বর্তমান সরকারকে সমর্থন করেছে তাতে বাংলাদেশ তাদের চাওয়ার বাইরে কিছু করবে না। কিন্তু বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে, তাদের কাছ থেকে সাবমেরিন কিনেছে-এসব হয়তো ভারত ভালো চোখে দেখছে না। যদি এমন ভেবে থাকে তবে বলতেই হবে যে ভারতে পররাষ্ট্রনীতির পরিপক্বতার অভাব রয়েছে।
প্রথম আলো: সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি যে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব আগের তুলনায় কমেছে। এটা কেন হচ্ছে বলে মনে করেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: ভারতের চিন্তায় প্রতিবেশী দেশের দুটি মডেল রয়েছে বলে মনে হয়। একটি পাকিস্তান ও অন্যটি ভুটান। প্রতিবেশী দেশগুলোকে তারা এভাবেই দেখতে চায়। ভারতকে এটা বুঝতে হবে যে প্রতিবেশীদের এভাবে দেখা যায় না। বাংলাদেশ কোনোভাবেই পাকিস্তান নয়। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। আবার ভুটানের অনেক কিছু যেভাবে ভারত নিয়ন্ত্রণ করে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা করা সম্ভব নয়। নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় এসব করতে গিয়ে ভারত তার অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেসব দেশে ভারত-বিরোধিতা বেড়েছে। রাজনীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা বা নেপালের ক্ষেত্রে এখন দেখবেন যে সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে একধরনের মতৈক্য হয়েছে। কিন্তু ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনছে না। ভারত নিজে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখবে কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোকে তা করতে দেবে না-এমন নীতি পরিপক্বতার লক্ষণ নয়।
প্রথম আলো: কিন্তু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তো শুধুই অর্থনৈতিক নয়। সামরিক ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা এবং সেখান থেকে সমরাস্ত্র কেনার বিষয়টি তো দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ: বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। কোনো দেশ যখন অস্ত্র কেনে তখন স্বাভাবিকভাবেই সে নিকট প্রতিবেশী দেশের চেয়ে আলাদা ও ভিন্ন ধরনের অস্ত্র কিনতে চায়। এটা ভারতের না বোঝার কোনো কারণ নেই। বিশ্বের সব দেশ তা-ই করে। আপনি এর আগে চীন থেকে সাবমেরিন কেনার কথা বলেছেন। ভারতের বোঝা উচিত যে এখন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। এই সমুদ্রসীমা পাহারার প্রয়োজন রয়েছে। জলদস্যুদের তৎপরতা ও অবৈধভাবে মাছ ধরা ঠেকানোর বিষয়টি খুবই জরুরি। এসব ঠেকাতে আমাদের নৌবাহিনীর জন্য অনেক জাহাজ কেনার চেয়ে সাবমেরিন কেনা অনেক সাশ্রয়ী উদ্যোগ। ভারত পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশ, শক্তিশালী নৌবাহিনী রয়েছে তাদের। এখন বাংলাদেশ চীন থেকে অস্ত্র কিনলে বা দুটি সাবমেরিন কিনলে ভারত যদি তা মেনে নিতে না পারে, তাহলে তো বিপদ।
প্রথম আলো: এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইমতিয়াজ আহমেদ: আগেই বলেছি চীন-ভারত প্রতিযোগিতার কিছু মানসিক দিক রয়েছে, আবার রয়েছে কিছু কৌশলগত দিক। মানসিক দিক থেকে ভারতের অবস্থানের কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। আসলে ভারতের ব্যবসায়ীরা চীনকে যতটা বোঝেন, ভারতের আমলারা তা বোঝেন না। ভারত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না হলেও ভারতের অনেক ব্যবসায়ী কিন্তু তা চান। এখন চীনের সঙ্গে একধরনের বিরোধ টিকিয়ে রাখার পেছনে কিছু কৌশলগত কারণ রয়েছে। ভারত যদি এটা দেখাতে পারে যে চীনের সঙ্গে তার বৈরিতা রয়েছে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করা সম্ভব। ভারত এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এর সুবিধা নিয়েছে। পারমাণবিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাচ্ছে। ভারত জানে যে চীনের সঙ্গে বৈরিতা থাকলেও তারা একে সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যাবে না। কৌশলগত কারণেও চীন-বিরোধিতা বা একটি বৈরিতার পরিস্থিতি জারি রাখা জরুরি।
প্রথম আলো: এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ কীভাবে একই সঙ্গে দুই বড় ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: সম্পর্ককে ব্যাপকভাবে অর্থনীতিকেন্দ্রিক করে ফেলা উচিত। ভারত ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিতে পারে। এই তিন দেশের অর্থনৈতিক উদ্যোগে সব পক্ষই লাভবান হবে। বিশেষ করে ভারতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সেখানকার জনগণেরও অর্থনৈতিক উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। বাংলাদেশের এখানে বড় ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। কারণ, এই বড় দেশ দুটির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো শত্রুতা বা প্রতিযোগিতা নেই, ভূখণ্ডগত কোনো সমস্যাও নেই।
প্রথম আলো: রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের বর্বরতা এবং শরণার্থী সংকটে আমরা দেখলাম ভারত ও চীন স্পষ্টতই মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, কিন্তু ভারতের মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়া বিস্ময়কর। বাংলাদেশ কেন ভারতকে পাশে পেল না?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আমি মনে করি, ভারত আসলে বড় ভুল করেছে। রোহিঙ্গা ইস্যু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নেতৃত্ব দেওয়ার ও ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা জাতি নিধন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারত একাত্তর সালে বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল ও সে জন্য দেশ হিসেবে বিশ্বে যে সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করেছিল, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে চুপ থেকে ভারত তার সেই অবস্থানকে অনেকটাই দুর্বল করেছে। ভারতের এটা বোঝা উচিত যে চীনের অর্থনৈতিক শক্তির ধারেকাছে যাওয়ার অবস্থায়ও ভারত নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও সেই অবস্থা নেই। ফলে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় ভারত চীনের সঙ্গে পেরে উঠবে না। আর মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক তাতে দেশটিকে ভারত চীনের কাছ থেকে নিজের বলয়ে আনতে পারবে না। মাঝখান থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন হারিয়েছে এবং দেশটির ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণকে হতাশ করেছে। চীন থেকে সাবমেরিন কেনা বা আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ভারত এমনটি করেছে কি না, কে জানে।
প্রথম আলো: রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: চীন নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে ভেটো দিয়েছে। এরপর আমরা দেখেছি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং সমস্যা সমাধানে তিন পর্যায়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। মিয়ানমারে গিয়েও তিনি একই প্রস্তাব দিয়েছেন। এর ওপর ভিত্তি করেই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি করেছে। আমরা দেখলাম যে চীন যে রকমই হোক একটি ভূমিকা পালন করেছে। ভারত কিন্তু কোনো ভূমিকা রাখতে পারল না।
প্রথম আলো: মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে চুক্তি হয়েছে তা কতটুকু কার্যকর হবে, সেই সংশয় কিন্তু দিনে দিনে জোরদার হচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখন বাংলাদেশের তরফে কিছু করণীয় আছে কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আমরা দেখেছি যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীনের অবস্থান কাছাকাছি। কিন্তু এই সংকট সমাধানে দেশ দুটির করণীয় রয়েছে। আমি মনে করি শুধু রোহিঙ্গা ইস্যুকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উচিত বেইজিং ও দিল্লি সফর করা। এ ধরনের সফর অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ তো সব সময়ই দুই দেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা ও সংবেদনশীলতাকে বিবেচনায় নিয়েছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির জন্য চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করার সব উদ্যোগ নিয়েও বাংলাদেশ মূলত ভারতের আপত্তির কারণে তা করেনি।
ইমতিয়াজ আহমেদ: চীনের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অন্য দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশলের পার্থক্য রয়েছে। চীন সম্পর্ক তৈরি করার জন্য সময় নিয়ে লেগে থাকে। কোনো কিছুতে বাধা এলে তারা তা বাদ দিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করে। পুরোনো কিছু নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। তারা অপেক্ষা করার নীতি নেয়। সোনাদিয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ রাজি হয়নি, এতে কিন্তু চীন দমে যায়নি বা এতে বিরক্তি প্রকাশ করেনি। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসেছেন এবং বিপুল সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি নিয়েই এসেছেন। বাংলাদেশের উচিত এ ধরনের কাঠামো যাতে সবাই মিলে করা যায়, তেমন উদ্যোগ নেওয়া। প্রয়োজনে ভারত ও চীনের যৌথ বিনিয়োগেই গভীর সমুদ্রবন্দর হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে তার ফল ভারত ও চীনসহ আশপাশের অনেক দেশই ভোগ করতে পারবে। কলম্বো সমুদ্রবন্দরে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। সেই বন্দর কিন্তু ভারত ব্যবহার করছে। কারণ, বন্দর তো শুধু একটি দেশের সুবিধার জন্য তৈরি হয় না।
প্রথম আলো: সম্প্রতি দিল্লিতে এক সেমিনারে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের তরফেই বলা হয়েছে যে ভারতীয় কূটনীতিতে বাংলাদেশ যথাযথ মনোযোগ পায় না, অথচ এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আপনার মন্তব্য কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ: ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা প্রতিবেশী দেশগুলোকে মানচিত্রের বিবেচনায় দেখেন। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ছোট। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে মানচিত্র সবকিছু বলে না। সেখানে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, কৌশলগত গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব-এসব দেখা যায় না। সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার আকার মানচিত্রে দেখে এর গুরুত্ব বিবেচনা করলে হবে না। বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। এত জনসংখ্যার একটি দেশকে যেকোনো বিবেচনাতেই উপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ভারতকে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে ভারতের স্বার্থ জড়িত আছে। বাংলাদেশের অনুন্নয়ন বা অস্থিতিশীল ভারতের জন্য ভালো কিছু নয়। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের চেয়ে ভালো করছে। এখন ভারত কি এতে ঈর্ষান্বিত হবে নাকি এই অগ্রগতিকে সমর্থন করবে। ভারতকে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশ বা প্রতিবেশীদের যেকোনো উন্নয়ন ভারতের নিজের স্বার্থেই জরুরি। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। মানচিত্র দেখে প্রতিবেশীদের বিবেচনা করার মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের গত একতরফা নির্বাচনকে ভারত কোনো রাখঢাক না করেই সমর্থন করেছিল। সামনে নির্বাচন আসছে। এবার ভারতের অবস্থান কী হতে পারে বলে মনে করেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: গত চার বছরে ভারতের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। সরকারি দলকে সহায়তা করলেই সবকিছু মিলবে-এমন ধারণা যে ভুল, তা হয়তো তারা টের পেয়েছে। আসলে আগে যে ধরনের নির্বাচন বাংলাদেশে হয়েছে তা করা গেছে আমাদের নিজস্ব রাজনীতির সমস্যার কারণে। এবার ভারত কোনো দলের পক্ষে সরাসরি থাকতে চাইবে বলে মনে হয় না। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দিকেই তাদের আগ্রহ থাকবে বলে মনে হয়।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
ইমতিয়াজ আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো: ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেছেন, চীনের সহায়তায় পাকিস্তান বাংলাদেশের মুসলমানদের ভারতে পাঠাচ্ছে। ভারতের সেনাপ্রধানদের মুখে সাধারণত রাজনৈতিক বক্তব্য শোনা যায় না। এমন মন্তব্যের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: এ ধরনের বক্তব্য দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের দেখা দরকার যে তিনি কেন এ কথা বলেছেন। বক্তব্যটি পরিষ্কারভাবেই রাজনৈতিক, তাই এর পেছনে সেনাপ্রধানের নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। তিনি অবসরে যাবেন, সরকারি দল বিজেপিকে হয়তো কোনো কারণে তুষ্ট করতে চাইছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর চলমান নির্বাচনের সঙ্গেও এর সম্পর্ক থাকতে পারে।
প্রথম আলো: এই মন্তব্য দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আসলে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ বা এ ধরনের কথাবার্তা ভারতের রাজনৈতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। এর মূল কারণ আসলে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। এই ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানো হয়। ক্রমাগত এসব বলার ফলে রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলেও এর একটা প্রভাব পড়েছে। এসব বক্তব্য ভারতে বাংলাদেশ ও মুসলিমবিরোধী মনোভাব বাড়াতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও আমরা একই চর্চা দেখেছি ও দেখি। এখানেও ভারত-বিরোধিতার রাজনীতির চেষ্টা হয়। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে ওই মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। ভারতীয় সেনাপ্রধান যে মন্তব্য করেছেন তার সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক-দুই ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। আগেই বলেছি ভারতে বাংলাদেশ ও মুসলমান-বিরোধিতা বাড়তে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বাড়তে পারে ভারত-বিরোধিতা। এ ধরনের মন্তব্য আসলে বাংলাদেশের ভারতবিরোধীদের খুশি করবে, কারণ একে তারা সহজেই কাজে লাগাতে পারবে।
প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতকে উদ্বিগ্ন না হতে বলেছেন। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ভারতের মধ্যে কি কোনো অস্বস্তি দেখা দিয়েছে? যে কারণে প্রধানমন্ত্রী ভারতকে আশ্বস্ত করলেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেছেন।
প্রথম আলো: তার মানে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ভারতের অস্বস্তি রয়েছে এবং সে কারণেই ভারতীয় সাংবাদিকেরা এমন প্রশ্ন করেছেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ: আসলে চীন-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি খুব জটিল।’ ৬২ সালের যুদ্ধের ছায়া এখানে ভূমিকা পালন করে। সেই যুদ্ধে পরাজয়ের বিষয়টিকে ভারত সব সময় মাথায় রাখে। ভারতের চলচ্চিত্র, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় ও রাজনীতিতে এসব বিষয় চর্চা হয়। আবার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে দেখবেন একক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য চীনের সঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে যত শিক্ষার্থী বিদেশে পড়াশোনা করতে গেছে, সবচেয়ে বেশি গেছে চীনে। দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভারতের কোনো প্রতিবেশী দেশ যখন চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক করতে চায়, তখন ভারত তা মানতে ও পছন্দ করতে চায় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে তোমরা চীনের সঙ্গে যেমন উন্নয়নের স্বার্থে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করো, আমরাও তা-ই করছি।
প্রথম আলো: ভারতের বিচলিত হওয়ার পেছনে কী কাজ করেছে বলে মনে করেন? চীনের প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর, বিশাল আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি? নাকি চীন থেকে বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনা?
ইমতিয়াজ আহমেদ: সমস্যা হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যে মাত্রায় পরিশীলিত হওয়া উচিত, কার্যত তেমন নয়। ভারত হয়তো ভেবেছিল গত নির্বাচনে তারা যেভাবে বর্তমান সরকারকে সমর্থন করেছে তাতে বাংলাদেশ তাদের চাওয়ার বাইরে কিছু করবে না। কিন্তু বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে, তাদের কাছ থেকে সাবমেরিন কিনেছে-এসব হয়তো ভারত ভালো চোখে দেখছে না। যদি এমন ভেবে থাকে তবে বলতেই হবে যে ভারতে পররাষ্ট্রনীতির পরিপক্বতার অভাব রয়েছে।
প্রথম আলো: সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি যে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব আগের তুলনায় কমেছে। এটা কেন হচ্ছে বলে মনে করেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: ভারতের চিন্তায় প্রতিবেশী দেশের দুটি মডেল রয়েছে বলে মনে হয়। একটি পাকিস্তান ও অন্যটি ভুটান। প্রতিবেশী দেশগুলোকে তারা এভাবেই দেখতে চায়। ভারতকে এটা বুঝতে হবে যে প্রতিবেশীদের এভাবে দেখা যায় না। বাংলাদেশ কোনোভাবেই পাকিস্তান নয়। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। আবার ভুটানের অনেক কিছু যেভাবে ভারত নিয়ন্ত্রণ করে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা করা সম্ভব নয়। নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় এসব করতে গিয়ে ভারত তার অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেসব দেশে ভারত-বিরোধিতা বেড়েছে। রাজনীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা বা নেপালের ক্ষেত্রে এখন দেখবেন যে সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে একধরনের মতৈক্য হয়েছে। কিন্তু ভারত তার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনছে না। ভারত নিজে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখবে কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোকে তা করতে দেবে না-এমন নীতি পরিপক্বতার লক্ষণ নয়।
প্রথম আলো: কিন্তু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তো শুধুই অর্থনৈতিক নয়। সামরিক ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা এবং সেখান থেকে সমরাস্ত্র কেনার বিষয়টি তো দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ: বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। কোনো দেশ যখন অস্ত্র কেনে তখন স্বাভাবিকভাবেই সে নিকট প্রতিবেশী দেশের চেয়ে আলাদা ও ভিন্ন ধরনের অস্ত্র কিনতে চায়। এটা ভারতের না বোঝার কোনো কারণ নেই। বিশ্বের সব দেশ তা-ই করে। আপনি এর আগে চীন থেকে সাবমেরিন কেনার কথা বলেছেন। ভারতের বোঝা উচিত যে এখন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। এই সমুদ্রসীমা পাহারার প্রয়োজন রয়েছে। জলদস্যুদের তৎপরতা ও অবৈধভাবে মাছ ধরা ঠেকানোর বিষয়টি খুবই জরুরি। এসব ঠেকাতে আমাদের নৌবাহিনীর জন্য অনেক জাহাজ কেনার চেয়ে সাবমেরিন কেনা অনেক সাশ্রয়ী উদ্যোগ। ভারত পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশ, শক্তিশালী নৌবাহিনী রয়েছে তাদের। এখন বাংলাদেশ চীন থেকে অস্ত্র কিনলে বা দুটি সাবমেরিন কিনলে ভারত যদি তা মেনে নিতে না পারে, তাহলে তো বিপদ।
প্রথম আলো: এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইমতিয়াজ আহমেদ: আগেই বলেছি চীন-ভারত প্রতিযোগিতার কিছু মানসিক দিক রয়েছে, আবার রয়েছে কিছু কৌশলগত দিক। মানসিক দিক থেকে ভারতের অবস্থানের কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। আসলে ভারতের ব্যবসায়ীরা চীনকে যতটা বোঝেন, ভারতের আমলারা তা বোঝেন না। ভারত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না হলেও ভারতের অনেক ব্যবসায়ী কিন্তু তা চান। এখন চীনের সঙ্গে একধরনের বিরোধ টিকিয়ে রাখার পেছনে কিছু কৌশলগত কারণ রয়েছে। ভারত যদি এটা দেখাতে পারে যে চীনের সঙ্গে তার বৈরিতা রয়েছে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করা সম্ভব। ভারত এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এর সুবিধা নিয়েছে। পারমাণবিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাচ্ছে। ভারত জানে যে চীনের সঙ্গে বৈরিতা থাকলেও তারা একে সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যাবে না। কৌশলগত কারণেও চীন-বিরোধিতা বা একটি বৈরিতার পরিস্থিতি জারি রাখা জরুরি।
প্রথম আলো: এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ কীভাবে একই সঙ্গে দুই বড় ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: সম্পর্ককে ব্যাপকভাবে অর্থনীতিকেন্দ্রিক করে ফেলা উচিত। ভারত ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিতে পারে। এই তিন দেশের অর্থনৈতিক উদ্যোগে সব পক্ষই লাভবান হবে। বিশেষ করে ভারতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সেখানকার জনগণেরও অর্থনৈতিক উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। বাংলাদেশের এখানে বড় ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। কারণ, এই বড় দেশ দুটির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো শত্রুতা বা প্রতিযোগিতা নেই, ভূখণ্ডগত কোনো সমস্যাও নেই।
প্রথম আলো: রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের বর্বরতা এবং শরণার্থী সংকটে আমরা দেখলাম ভারত ও চীন স্পষ্টতই মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, কিন্তু ভারতের মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়া বিস্ময়কর। বাংলাদেশ কেন ভারতকে পাশে পেল না?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আমি মনে করি, ভারত আসলে বড় ভুল করেছে। রোহিঙ্গা ইস্যু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নেতৃত্ব দেওয়ার ও ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা জাতি নিধন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারত একাত্তর সালে বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল ও সে জন্য দেশ হিসেবে বিশ্বে যে সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করেছিল, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে চুপ থেকে ভারত তার সেই অবস্থানকে অনেকটাই দুর্বল করেছে। ভারতের এটা বোঝা উচিত যে চীনের অর্থনৈতিক শক্তির ধারেকাছে যাওয়ার অবস্থায়ও ভারত নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও সেই অবস্থা নেই। ফলে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় ভারত চীনের সঙ্গে পেরে উঠবে না। আর মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক তাতে দেশটিকে ভারত চীনের কাছ থেকে নিজের বলয়ে আনতে পারবে না। মাঝখান থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন হারিয়েছে এবং দেশটির ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণকে হতাশ করেছে। চীন থেকে সাবমেরিন কেনা বা আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ভারত এমনটি করেছে কি না, কে জানে।
প্রথম আলো: রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: চীন নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে ভেটো দিয়েছে। এরপর আমরা দেখেছি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং সমস্যা সমাধানে তিন পর্যায়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। মিয়ানমারে গিয়েও তিনি একই প্রস্তাব দিয়েছেন। এর ওপর ভিত্তি করেই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি করেছে। আমরা দেখলাম যে চীন যে রকমই হোক একটি ভূমিকা পালন করেছে। ভারত কিন্তু কোনো ভূমিকা রাখতে পারল না।
প্রথম আলো: মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে চুক্তি হয়েছে তা কতটুকু কার্যকর হবে, সেই সংশয় কিন্তু দিনে দিনে জোরদার হচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখন বাংলাদেশের তরফে কিছু করণীয় আছে কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ: আমরা দেখেছি যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীনের অবস্থান কাছাকাছি। কিন্তু এই সংকট সমাধানে দেশ দুটির করণীয় রয়েছে। আমি মনে করি শুধু রোহিঙ্গা ইস্যুকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উচিত বেইজিং ও দিল্লি সফর করা। এ ধরনের সফর অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ তো সব সময়ই দুই দেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা ও সংবেদনশীলতাকে বিবেচনায় নিয়েছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির জন্য চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করার সব উদ্যোগ নিয়েও বাংলাদেশ মূলত ভারতের আপত্তির কারণে তা করেনি।
ইমতিয়াজ আহমেদ: চীনের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অন্য দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশলের পার্থক্য রয়েছে। চীন সম্পর্ক তৈরি করার জন্য সময় নিয়ে লেগে থাকে। কোনো কিছুতে বাধা এলে তারা তা বাদ দিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করে। পুরোনো কিছু নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। তারা অপেক্ষা করার নীতি নেয়। সোনাদিয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ রাজি হয়নি, এতে কিন্তু চীন দমে যায়নি বা এতে বিরক্তি প্রকাশ করেনি। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসেছেন এবং বিপুল সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি নিয়েই এসেছেন। বাংলাদেশের উচিত এ ধরনের কাঠামো যাতে সবাই মিলে করা যায়, তেমন উদ্যোগ নেওয়া। প্রয়োজনে ভারত ও চীনের যৌথ বিনিয়োগেই গভীর সমুদ্রবন্দর হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে তার ফল ভারত ও চীনসহ আশপাশের অনেক দেশই ভোগ করতে পারবে। কলম্বো সমুদ্রবন্দরে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। সেই বন্দর কিন্তু ভারত ব্যবহার করছে। কারণ, বন্দর তো শুধু একটি দেশের সুবিধার জন্য তৈরি হয় না।
প্রথম আলো: সম্প্রতি দিল্লিতে এক সেমিনারে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের তরফেই বলা হয়েছে যে ভারতীয় কূটনীতিতে বাংলাদেশ যথাযথ মনোযোগ পায় না, অথচ এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আপনার মন্তব্য কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ: ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা প্রতিবেশী দেশগুলোকে মানচিত্রের বিবেচনায় দেখেন। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ছোট। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে মানচিত্র সবকিছু বলে না। সেখানে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, কৌশলগত গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব-এসব দেখা যায় না। সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার আকার মানচিত্রে দেখে এর গুরুত্ব বিবেচনা করলে হবে না। বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। এত জনসংখ্যার একটি দেশকে যেকোনো বিবেচনাতেই উপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ভারতকে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে ভারতের স্বার্থ জড়িত আছে। বাংলাদেশের অনুন্নয়ন বা অস্থিতিশীল ভারতের জন্য ভালো কিছু নয়। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ভারতের চেয়ে ভালো করছে। এখন ভারত কি এতে ঈর্ষান্বিত হবে নাকি এই অগ্রগতিকে সমর্থন করবে। ভারতকে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশ বা প্রতিবেশীদের যেকোনো উন্নয়ন ভারতের নিজের স্বার্থেই জরুরি। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। মানচিত্র দেখে প্রতিবেশীদের বিবেচনা করার মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের গত একতরফা নির্বাচনকে ভারত কোনো রাখঢাক না করেই সমর্থন করেছিল। সামনে নির্বাচন আসছে। এবার ভারতের অবস্থান কী হতে পারে বলে মনে করেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: গত চার বছরে ভারতের কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। সরকারি দলকে সহায়তা করলেই সবকিছু মিলবে-এমন ধারণা যে ভুল, তা হয়তো তারা টের পেয়েছে। আসলে আগে যে ধরনের নির্বাচন বাংলাদেশে হয়েছে তা করা গেছে আমাদের নিজস্ব রাজনীতির সমস্যার কারণে। এবার ভারত কোনো দলের পক্ষে সরাসরি থাকতে চাইবে বলে মনে হয় না। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দিকেই তাদের আগ্রহ থাকবে বলে মনে হয়।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
ইমতিয়াজ আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments