মানসিক চাপ শত্রু নাকি বন্ধু by ডা. সাইফুন্ নাহার
আমাদের শরীর বা মন, যখন কোনো কাজ, জীব-জন্তু, মানুষ অথবা কোনো ঘটনাকে হুমকিস্বরূপ মনে করে তখন, অথবা কোনো প্রতিকূল পরিবেশে যেভাবে সাড়া দেয় সেটিই স্ট্রেস রেসপন্স বা মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া। আমাদের শরীর এবং মনের জন্য যা হুমকিস্বরূপ তাই স্ট্রেস বা মনের ওপর চাপ। তা শরীর অথবা মনের সামর্থ্যরে বাইরে কোনো চাহিদা বা অতিরিক্ত কাজের চাপ তা হতে পারে কিংবা জীবজন্তুর আক্রমণ, অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা (যেমন- দুর্ঘটনা, প্রিয়জনের সঙ্গে মনোমালিন্য)। আমরা প্রত্যেকেই জীবনের কোনো না কোনো সময় মানসিক চাপ অনুভব করি; যা মৃদু, মাঝারি বা গুরুতর ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ের হতে পারে। প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে এই চাপের কারণ যেমন ভিন্ন, তেমনি এই চাপ ভিন্নজনের ওপর ভিন্নরূপে প্রভাব বিস্তার করে। যার মূলে রয়েছে মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্য, সামাজিক দক্ষতা, সামাজিক সমর্থন ইত্যাদির মাঝে পার্থক্য। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মানসিক চাপ প্রত্যক্ষভাবে যতটা ক্ষতি করছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে পরোক্ষ মানসিক চাপবিষয়ক নেতিবাচক চিন্তা। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপে থাকা একজন ব্যক্তির মাঝে কগনিটিভ, শারীরিক, আবেগীয়, আচরণগত বিভিন্ন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। যেমন- চিন্তা ও চেতনায় পরিবর্তন/কগনিটিভ সিম্পটমস
* ভুলে যাওয়া
* মনোযোগে সমস্যা
* বিচারবুদ্ধি কমে যাওয়া
শারীরিক
* শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা হওয়া
* ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা
* বমিভাব, মাথা ঝিমঝিম করা
* বুক ব্যথা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, যৌনকাজে অনীহা তৈরি হওয়া
* ঘন ঘন সর্দি-কাশি হওয়া
আবেগীয়
* বিষণ্ণ থাকা বা সব সময় অসুখী বোধ করা
* উদ্বিগ্ন, অস্থির থাকা
* রেগে যাওয়া, বিরক্তবোধ করা
* ক্লান্ত বা বিপর্যস্ত বোধ করা
* একাকিত্বে ভোগা, বিচ্ছিন্ন থাকা
আচরণগত
* অতিরিক্ত অথবা কম খাদ্যগ্রহণ
* অনেক বেশি অথবা অনেক কম ঘুমানো
* সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া
* দায়িত্বপালনে অবহেলা করা অথবা গড়িমসি করা
* মানসিক প্রশান্তির জন্য সিগারেট, এলকোহল বা বিভিন্ন ড্রাগস নেয়া। তাছাড়া, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ ব্যক্তির মাঝে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, প্রজনন ক্ষমতাহ্রাস, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদির সৃষ্টি করতে পারে।
এ লক্ষণ কেন তৈরি হয়
মানুষ যখন কোনো কিছুকে হুমকি মনে করে, বিপদের আশঙ্কা করে বা ভয় পায়- তখন তৎক্ষণাৎ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে মস্তিষ্ক থেকে পাওয়া সিগন্যাল অনুসরণ করে এড্রেনাল গ্ল্যান্ড বেশি পরিমাণে এড্রেনালীন এবং কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) নামক হরমোন নিঃসরণ করে। এই হরমোনগুলো জরুরি অবস্থায় হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে দেয় যা আমাদের মাংসপেশিগুলোতে সর্বাধিক অক্সিজেন সমৃদ্ধ এবং এটিপি সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে এবং মাংসপেশিগুলোর শক্তি বাড়িয়ে দেয়, যকৃত থেকে বেশি পরিমাণে গ্লুকোজ রক্তে নিঃসৃত হয়- মস্তিষ্কের নিউরোনগুলোতে পর্যাপ্ত গ্লুকোজ সরবরাহ হয়। ফলে অনুভূতিগুলো তীক্ষ্ণ হয়, অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মনোযোগ বাড়ে, মানুষ প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে অথবা নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সমর্থ হয় অর্থাৎ fight or flight response এর জন্য তৈরি হয়। যখন কোনো জরুরি অবস্থা অথবা চ্যালেঞ্জিং কোনো কিছু মোকাবিলা করতে অথবা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে স্ট্রেস তৈরি হয় এবং অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয় তখন এই স্ট্রেস রেসপন্স গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু, যখন কেউ দীর্ঘদিন যাবৎ অথবা গুরুতর স্ট্রেস বা মানসিক চাপে থাকে তখন এই স্ট্রেস রেসপন্স ক্ষতিকারক। কারণ, অত্যধিক কর্টিসল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস নামক অঞ্চলের কোষগুলোকে মেরে ফেলে এবং স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয়, মস্তিষ্কের সেরোটোনিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে মেরে ফেলে, সেরোটোনিন এর উৎপাদন কমিয়ে দেয়- মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। রক্তে চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, রক্তচাপ বৃদ্ধি করে যা হার্ট এ্যাটাক বা স্ট্রোক এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। মানুষের চিন্তা, অনুভূতি, আচরণ এবং দৈনন্দিন কাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়, সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।
মানসিক চাপের কারণ
* দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ যেমন- হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থাইটিস ইত্যাদি।
* আবেগজনিত সমস্যা যেমন- বিষণ্ণতা, শোক, অপরাধবোধ, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি।
* ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে টানাপোড়েন, বন্ধুর অভাব, সহযোগিতা করার মানুষ না থাকা।
* জীবনে বড় কোনো পরিবর্তন যেমন- স্বামী/স্ত্রী, মা/বাবা এদের মাঝে কেউ মারা গেলে, চাকরিচ্যুত হলে, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ বা বিবাহবিচ্ছেদ হলে, সন্তানের জন্মদান ও শিশু সন্তানের পরিচর্যার দায়িত্ব, নতুন কোনো শহর বা দেশে স্থানান্তর ইত্যাদি মানসিক চাপের কারণ হতে পারে।
* পরিবারে কেউ অসুস্থ হলে, মানসিক চাপের মাঝে থাকলে তা একই পরিবারের অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে।
* দারিদ্র্য বা অর্থহানি।
* কর্মস্থলে অতিরিক্ত কাজের চাপ থাকলে অথবা কাজের পরিবেশ কর্মবান্ধব না হলে।
* বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে।
* বয়োবৃদ্ধিজনিত শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণে।
* নিজের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ইত্যাদির মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে। অল্প-বিস্তর চাপ সবসময়ই থাকবে। কিছুটা চাপ সবসময় কাক্সিক্ষত; যা মানুষকে কাজে প্রেষণা জোগায়, মানুষের বৃদ্ধিতে, উৎপাদনশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব রাখে। তাই চাপ কমানো বা চাপমুক্ত থাকার চিন্তা না করে চাপ ম্যানেজ করে চলতে হবে। মানসিক চাপ শত্র“ না বন্ধু হবে তা নির্ভর করে মানুষ তা কিভাবে মোকাবেলা করে তার ওপর।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
* ভুলে যাওয়া
* মনোযোগে সমস্যা
* বিচারবুদ্ধি কমে যাওয়া
শারীরিক
* শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা হওয়া
* ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা
* বমিভাব, মাথা ঝিমঝিম করা
* বুক ব্যথা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, যৌনকাজে অনীহা তৈরি হওয়া
* ঘন ঘন সর্দি-কাশি হওয়া
আবেগীয়
* বিষণ্ণ থাকা বা সব সময় অসুখী বোধ করা
* উদ্বিগ্ন, অস্থির থাকা
* রেগে যাওয়া, বিরক্তবোধ করা
* ক্লান্ত বা বিপর্যস্ত বোধ করা
* একাকিত্বে ভোগা, বিচ্ছিন্ন থাকা
আচরণগত
* অতিরিক্ত অথবা কম খাদ্যগ্রহণ
* অনেক বেশি অথবা অনেক কম ঘুমানো
* সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া
* দায়িত্বপালনে অবহেলা করা অথবা গড়িমসি করা
* মানসিক প্রশান্তির জন্য সিগারেট, এলকোহল বা বিভিন্ন ড্রাগস নেয়া। তাছাড়া, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ ব্যক্তির মাঝে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, প্রজনন ক্ষমতাহ্রাস, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদির সৃষ্টি করতে পারে।
এ লক্ষণ কেন তৈরি হয়
মানুষ যখন কোনো কিছুকে হুমকি মনে করে, বিপদের আশঙ্কা করে বা ভয় পায়- তখন তৎক্ষণাৎ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে মস্তিষ্ক থেকে পাওয়া সিগন্যাল অনুসরণ করে এড্রেনাল গ্ল্যান্ড বেশি পরিমাণে এড্রেনালীন এবং কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) নামক হরমোন নিঃসরণ করে। এই হরমোনগুলো জরুরি অবস্থায় হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে দেয় যা আমাদের মাংসপেশিগুলোতে সর্বাধিক অক্সিজেন সমৃদ্ধ এবং এটিপি সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে এবং মাংসপেশিগুলোর শক্তি বাড়িয়ে দেয়, যকৃত থেকে বেশি পরিমাণে গ্লুকোজ রক্তে নিঃসৃত হয়- মস্তিষ্কের নিউরোনগুলোতে পর্যাপ্ত গ্লুকোজ সরবরাহ হয়। ফলে অনুভূতিগুলো তীক্ষ্ণ হয়, অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মনোযোগ বাড়ে, মানুষ প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে অথবা নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সমর্থ হয় অর্থাৎ fight or flight response এর জন্য তৈরি হয়। যখন কোনো জরুরি অবস্থা অথবা চ্যালেঞ্জিং কোনো কিছু মোকাবিলা করতে অথবা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে স্ট্রেস তৈরি হয় এবং অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয় তখন এই স্ট্রেস রেসপন্স গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু, যখন কেউ দীর্ঘদিন যাবৎ অথবা গুরুতর স্ট্রেস বা মানসিক চাপে থাকে তখন এই স্ট্রেস রেসপন্স ক্ষতিকারক। কারণ, অত্যধিক কর্টিসল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস নামক অঞ্চলের কোষগুলোকে মেরে ফেলে এবং স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয়, মস্তিষ্কের সেরোটোনিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে মেরে ফেলে, সেরোটোনিন এর উৎপাদন কমিয়ে দেয়- মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। রক্তে চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, রক্তচাপ বৃদ্ধি করে যা হার্ট এ্যাটাক বা স্ট্রোক এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। মানুষের চিন্তা, অনুভূতি, আচরণ এবং দৈনন্দিন কাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়, সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।
মানসিক চাপের কারণ
* দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ যেমন- হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থাইটিস ইত্যাদি।
* আবেগজনিত সমস্যা যেমন- বিষণ্ণতা, শোক, অপরাধবোধ, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি।
* ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে টানাপোড়েন, বন্ধুর অভাব, সহযোগিতা করার মানুষ না থাকা।
* জীবনে বড় কোনো পরিবর্তন যেমন- স্বামী/স্ত্রী, মা/বাবা এদের মাঝে কেউ মারা গেলে, চাকরিচ্যুত হলে, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ বা বিবাহবিচ্ছেদ হলে, সন্তানের জন্মদান ও শিশু সন্তানের পরিচর্যার দায়িত্ব, নতুন কোনো শহর বা দেশে স্থানান্তর ইত্যাদি মানসিক চাপের কারণ হতে পারে।
* পরিবারে কেউ অসুস্থ হলে, মানসিক চাপের মাঝে থাকলে তা একই পরিবারের অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে।
* দারিদ্র্য বা অর্থহানি।
* কর্মস্থলে অতিরিক্ত কাজের চাপ থাকলে অথবা কাজের পরিবেশ কর্মবান্ধব না হলে।
* বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে।
* বয়োবৃদ্ধিজনিত শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণে।
* নিজের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ইত্যাদির মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে। অল্প-বিস্তর চাপ সবসময়ই থাকবে। কিছুটা চাপ সবসময় কাক্সিক্ষত; যা মানুষকে কাজে প্রেষণা জোগায়, মানুষের বৃদ্ধিতে, উৎপাদনশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব রাখে। তাই চাপ কমানো বা চাপমুক্ত থাকার চিন্তা না করে চাপ ম্যানেজ করে চলতে হবে। মানসিক চাপ শত্র“ না বন্ধু হবে তা নির্ভর করে মানুষ তা কিভাবে মোকাবেলা করে তার ওপর।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
No comments