শান্তিনিকেতনে একদিন by শারমিন সেলিম তুলি
১৪
থেকে ১৯ ডিসেম্বর কলকাতায় ৩১৫ এ/১ লায়ন্স ইন্টারন্যাশনালের সেমিনার ‘ইসামি
ফোরামে’ যোগ দিতে ভারতে গিয়েছিলাম। সেমিনার শেষে ১৯ ডিসেম্বর আমরা কয়েকজন
লায়ন্স মেম্বার মিলে ঘুরে এলাম ঠাকুরবাড়ি (কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
বাসস্থান, জন্মস্থান) রবিঠাকুরের জন্মস্থান আঁতুড়ঘর, শৈশব, কৈশোরের
স্মৃতিবিজড়িত ঘর, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, পোশাকপরিচ্ছদসহ ঠাকুর পরিবারের
জীবনশৈলী, আভিজাত্য আজো নিজের মহিমায় মহিমান্বিত। এরপর ঠিক করি আমরা
রবীন্দ্রনাথের আরেক সৃষ্টি শান্তিনিকেতন আশ্রম ঘুরতে যাবো। কবির
স্মৃতিবিজড়িত স্থান দেখার জন্য অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলাম। আজ চোখের সামনে
এগুলো দেখতে পাবো ভেবেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল। ঠাকুরবাড়ি তো দেখে এলাম, এবার
সকালের অপেক্ষায়। পশ্চিম বাংলার মাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গড়েছিলেন
শান্তিনিকেতন। বাঙালি সংস্কৃতির, সভ্যতার, শিল্পচর্চার ও শিক্ষার মিলিত
সংমিশ্রণে পরিচালিত হয় সমগ্র প্রতিষ্ঠানের আতিথ্য ও জীবনধারা। আমরা সকাল
৭টায় রওনা হলাম কলকাতা শহর থেকে দূরে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের
উদ্দেশে। রাস্তার দুই ধারে গ্রামের শুষ্ক ধূসর পথঘাট। সবুজ ক্ষেত, গাছপালা
মাঝে মধ্যে কিছু চালাঘর। কনকনে শীতে কুয়াশার চাদরে মোড়ানো প্রকৃতির মধ্য
দিয়ে আমাদের নিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি। কিছু সময়ের জন্য পথের পাশে খোলা জায়গায়
গাড়ি থামল।
পথের পাশে একটি দোকানে দাঁড়িয়ে চা-নাশতা করে নিলাম আমরা। তারপর
আবার চলতে শুরু করলাম। গাছের সারির ভেতর দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। সূর্যের
আলো উঁচু গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। গাড়ি চলতে চলতে
অবশেষে এসে পৌঁছলাম শান্তিনিকেতনে। সাথে একজন গাইড নিয়েছিলাম, সে আমাদের
পাশে থাকবে। শান্তিনিকেতনের প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি বাঁধা
শালগাছ, আমবাগান, তাল, ঝাউ ও নারকেলগাছ। উত্তর-পশ্চিমের প্রান্তে প্রাচীন
দু’টি ছাতিমের তলার মার্বেল পাথরে বাঁধানো বেদি (মহাঋষি দেবেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের প্রার্থনা করার স্থান ছিল)। ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম মন্দির
(উপাসনা গৃহ), প্রাচীন কদমগাছ, নন্দলাল বোস, রামকিনকর, বিনোদবিহারি
মুখার্জীর ভাস্কর্য ঘেরা কলা ভবন, সঙ্গীত ভবন এবং বইয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।
আশ্রম থেকে খানিকটা পূর্বে ছোট্ট টিলার ওপর প্রাচীন বটগাছ। শান্তিনিকেতনে
ঘুরে বেড়ানোর সময় দেখলাম একটি বিশাল খোলা মাঠে মেলার আয়োজন চলছে, চার পাশে
স্টল তৈরির কাজ চলছে। দোকানিরা কেউ কেউ তাদের পসরা নিয়ে দোকান সাজাতে শুরু
করেছেন। প্রতি বছর ৭ পৌষ শান্তিনিকেতনে বিশাল পৌষমেলার আয়োজন হয়। ওই দিনটি
শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে সবচেয়ে পবিত্র দিন বলে কবিগুরু উল্লেখ করে গেছেন।
দিনটিতে তার বাবা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত
হয়েছিলেন। দুই দিন পরই মেলা বসবে। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল, মেলার সময়
থাকতে না পারার কথা ভেবে। এরপর দেখলাম শিল্পকলার অনন্য একটি নিদর্শন
উত্তরায়নে অবস্থিত মাটির তৈরী ‘শ্যামলী বাড়ি’। উত্তরণ কমপ্লেক্সে
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে।
চার পাশে বাগানে ঘেরা। পাখিদের কলকাকলি, ফুলে ফুলে প্রজাপতিদের খেলা, শান্ত
নিরিবিলি পরিবেশ। তারপর গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন রবীন্দ্রভবন মিউজিয়ামে,
এটি বিচিত্রা বাড়ি নামেও পরিচিত। এ মিউজিয়ামে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা
কবিতার, গদ্য, গল্প, প্রবন্ধ, নাটকের পাণ্ডুলিপি আর গানের শ্রুতলিপি,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে লেখা চিঠি, পদক আর নোবেল প্রাইজ, সার্টিফিকেট,
চিত্রকর্ম, শিল্পকর্ম, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি। প্রতি শনিবার বসে খোয়াই মেলা।
খোয়াই জমির রূপবিরল এবং আকর্ষণীয় খোয়াই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছেন।
শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন, দেশ-বিদেশের বিখ্যাত ফটোগ্রাফাররা খোয়াইয়ের ছবি
তুলেছেন। প্রতিকৃতিগুলোর কিছু রবীন্দ্রভবনের ফটো আর্কাইভসে দেখা যায়। বেলা
গড়িয়ে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেল। খাবারের পর্বটা শান্তিনিকেতনের ভেতরেই
সেরে নিলাম আমরা।
একটু বিশ্রাম নিয়ে গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন ‘আমার কুঠিরে’
কারুপল্লীর কারুশিল্প প্রদর্শনী কেন্দ্র। গ্রামবাংলার হস্তশিল্প,
তাঁতবস্ত্র, চামড়াজাত শিল্প, বাটিক, মৃৎশিল্প ইত্যাদি আছে এখানে- যা বাংলার
ঐতিহ্য। এরপর প্রবেশ করলাম ভারতের অন্যতম একটি প্রাকৃতিক মিউজিয়াম
‘প্রকৃতি ভবনে’। সেখানে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল সৌন্দর্যের এক ঝলক। সবুজে
ছাওয়া প্রান্তরজুড়ে নানা রকম বৃক্ষরাশি দিয়ে তৈরী ভাস্কর্য, কাঠের তৈরী
শিল্পকর্ম, পাথরখচিত ভাস্কর্য, নাম না জানা অসংখ্য ছোট ছোট গাছ মাথা উঁচু
করে দাঁড়িয়ে আছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সারি সারি বাগান সমৃদ্ধ করেছে
ওই স্থানকে। বিকেল বেলা আম্রকুঞ্জে (আমতলায়) বসে শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের
পরিবেশনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং লোকগীতি শুনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত চার
পাশের মাঝে সুরের মূর্ছনায় মুহূর্তেই মনটা প্রশান্তির আনন্দে ভরে গেল।
রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ চিন্তা এবং পরিবেশ শিক্ষার সাক্ষী হয়ে আছে বিশ্বভারতী
বিশ্ববিদ্যালয়। ঘুরে ঘুরে দেখলাম শ্রীনিকেতন ক্যাম্পাস, বাংলার অনেক বড় বড়
কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীর শিক্ষাজীবন কেটেছে এখানে। আশ্রমের শেষ প্রান্তে
বয়ে চলেছে কোপাই নদী (রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত শিশুতোষ ছড়া ‘আমাদের ছোট্ট
নদী’) এ নদীর আকর্ষণ থেকেই কবিগুরু এ ছড়াটি লিখেছেন। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে
রইলাম কিছু সময়। সূর্যটা ক্রমেই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ক্ষিধেও পেয়েছে
বেশ। মোমো আর চা খেয়েই ক্ষিধে মিটালাম। এবার ফেরার পালা। দুই চোখ মেলে
দেখলাম সুন্দরের সুর, প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
অসাধারণ সৃষ্টি শান্তিনিকেতন, আর মনের কুটিরে বন্দী করে রাখলাম এ ভ্রমণের
স্মৃতি।
No comments