তারিক রামাদানের কারাবাস : বিচারব্যবস্থার অনিয়ম by ডক্টর চন্দ্র মুজাফফর

সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সমকালীন ইসলামী শিক্ষা’ বিষয়ের অধ্যাপক তারিক রামাদানকে, যা ফ্রান্সের আইনব্যবস্থার অন্যায় ও অমানবিক দিকটিকেই প্রকাশ করে। প্যারিসের ফ্লিউরি-মেরোগিস কারাগারের একটি নির্জন কক্ষে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আটকে রাখা হয়েছে তাকে। তার বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে লিয়নে ও ২০১২ সালে প্যারিসে দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। বিষয়টিতে মামলা দায়েরের জন্য তদন্ত শুরু হয়েছে। তারিক রামাদানের সাথে পরিবারের কোনো সদস্যকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না, এমনকি ফোনেও তাদের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়া হচ্ছে না। মনে করিয়ে দেয়া দরকার, গত ৩১ জানুয়ারি প্রফেসর তারিক রামাদান তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করতে স্বেচ্ছায় প্যারিস পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তাদের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন; কিন্তু তারপরও তার সাথে করা হচ্ছে অন্যায় আচরণ। যে অভিযোগে তাকে আটকে রাখা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। লিয়নের ঘটনার বিষয়ে অভিযোগকারী বলেছে, ২০০৯ সালের ৯ অক্টোবর বিকেলে একটি হোটেলের রুমে তিনি ধর্ষিত হয়েছেন তারিকের হাতে। এর জবাবে তারিক রামাদানের আইনজীবী যে প্রমাণ হাজির করেছেন তাতে দেখা গেছে, ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর লন্ডন থেকে আসা, তাকে বহনকারী বিমানটি প্যারিসে অবতরণ করেছে এবং একটি অডিটরিয়ামে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তিনি কয়েশ’ মানুষের উপস্থিতিতে বক্তৃতা করেছেন।
ফ্রান্সের পুলিশ বলছে, এ সংক্রান্ত প্রমাণ তারিক রামাদানের ফাইলে নেই। পরে তারা প্রমাণের কাগজপত্র গ্রহণ করার কথা স্বীকার করলেও বলছে, সেটি হারিয়ে গেছে। বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটি একটি ভয়াবহ অস্বচ্ছতা। বিষয়টিকে আরো সন্দেহজনক করে তুলেছে ২০০৯ সালে অভিযোগকারীর সাথে ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট মাইকেল ডিবাকের একটি বৈঠক। তারিক রামাদানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের উদ্দেশ্যে আয়োজিত ওই বৈঠকের বিষয়ে সহযোগিতা করেছে ফ্রান্সের কুখ্যাত ইসলামবিদ্বেষী ক্যারোলিন ফুরেস্ট ও অ্যান্তোনি এসফেইর। প্রফেসর রামাদানের বিরুদ্ধে এবং নয় বছর আগে ডিবাকের সাথে ফুরেস্ট ও ‘ক্রিস্টেলে’র (অভিযোগকারী) এই বৈঠক ছিল সম্পূর্ণ অনৈতিক। বর্তমানে ফ্রান্সের একটি আদালতে কর্মরত ডিবাক। ‘ক্রিস্টেলে’ কিংবা এই মামলার সাথে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি গোপন রাখছেন, যদিও এ ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ফ্রান্সের আইনে অবৈধ। প্যারিসের ঘটনার বিষয়েও অভিযোগকারীর বক্তব্যের সত্যতা নেই। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে ওই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। অভিযোগকারী হেন্দা আয়ারি ২০১৪ সালের জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে ফেসবুকে তারিক রামাদানকে ২৮০টিরও বেশি মেসেজ পাঠিয়েছেন, যা ধর্ষণ অভিযোগের দুই বছর পরের ঘটনা। ফরাসি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, আয়ারি দ্বিতীয় আরেকটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রফেসর তারিককে মেসেজগুলো পাঠিয়েছে। কারণ তার প্রথম অ্যাকাউন্ট আগেই ব্লক করে রেখেছেন প্রফেসর তারিক। তাকে ফাঁদে ফেলতেই এসব করেছেন ওই নারী। এসব ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পরই বোঝা গেছে, কেন তিনি ফরাসি পুলিশের আহ্বান সত্ত্বেও তাদের কাছে সাক্ষ্য দিতে যাননি। উভয় নারীর কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন হলেও তারিক রামাদানকে বন্দী করে রেখে মামলার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে, যার উদ্দেশ্য তাকে আদালতে সোপর্দ করা। মূলধারার ফরাসি সংবাদমাধ্যম এ ঘটনায় নীরব সমর্থন দিচ্ছে। শুধু এই হাস্যকর অভিযোগ দুটির বিষয়ে নয়, তারিক রামাদানকে অপদস্থ করতে বিভিন্ন মিথ্যারও আশ্রয় নিচ্ছে তারা। উদাহরণস্বরূপ, কয়েকটি ফরাসি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তারিকের মিসরীয় পাসপোর্ট রয়েছে, যা ব্যবহার করে তিনি মিসরে পালাতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, তার কোনো মিসরীয় পাসপোর্ট নেই, তিনি শুধু সুইজারল্যান্ডের নাগরিক।
তারিক রামাদানের বিষয়ে ফরাসি সংবাদমাধ্যমের মনোভাব এবং সে দেশের আইনব্যবস্থার তিক্ত আচরণ বড় কোনো সমস্যার ইঙ্গিত বহন করে। ইসলামের বিষয়ে ফরাসি প্রভাবশালী নাগরিকদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে, তাদের এবং তাদের সমর্থকদের বিষয়ে এই গোষ্ঠীর কখনো কোনো সহানুভূতি ছিল না। তারিক রামাদান দীর্ঘ দিন ধরে এই কাজটিই করছেন। ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে মুসলিমদের প্রতি যে বৈষম্য চলছে, তার বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার। ইউরোপজুড়েই ‘ইসলামভীতি’র কারণে মুসলিমদের যেভাবে কোনঠাসা করে তোলা হচ্ছে সে বিষয়েও তিনি বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। একই সাথে, তিনি উগ্র মুসলিমগোষ্ঠী ও মুসলিম স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার। এমন অনেক গোষ্ঠী আছে যারা তারিক রামাদানকে থামাতে চান। ফ্রান্সে তার এই বিচার শুধু ইসলাম ও মুসলিমদের বিরোধিতার কারণে নয়, বরং ফ্রান্সের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তার সদা সোচ্চার কণ্ঠ থামানোর অঙ্গীকার নিয়ে শুরু হয়েছে এই বিচার। ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়ে ফ্রান্স তথা ইউরোপের যে ভণ্ডামিমূলক নীতি, তাও প্রকাশ পায় এ ঘটনায়। বিশেষ করে, কোনো মৌলিক বিষয় সামনে এলেই দেখা যায়, তারা কতটা পরমতের প্রতি অসহিষ্ণু। সব দিক থেকে এমন মনোভাবের পর কিভাবে তারিক রামাদানের ব্যাপারে ন্যায়বিচার হবে বলে আশা করা যায়? তথাপি তারিক মুক্তি আন্দোলনসহ সুশীলসমাজ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তার সত্বর ও নিঃশর্ত মুক্তি কামনা করেছেন।
লেখক : ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট ফর অ্যা জাস্ট ওয়ার্ল্ড, মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট
ইনফ্রন্ট অনলাইন থেকে ভাষান্তর : আহমেদ বায়েজীদ

No comments

Powered by Blogger.