বৈশ্বিক অর্থনীতি- অধিকাংশ মানুষের স্থায়ী দুর্দশা by জোসেফ স্টিগলিৎস
২০০৮ সালে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ার পরপরই আমি সতর্ক করে বলেছিলাম, সঠিক নীতি গ্রহণ করা না হলে জাপানের মতো বছরের পর বছর ধরে ধীর প্রবৃদ্ধি ও আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে প্রায়-স্থবিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
তখন আটলান্টিকের উভয় তীরের নেতারা দাবি করেছিলেন যে তাঁরা জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, কিন্তু কার্যত দ্রুতই তাঁরা একই ধরনের ভুলভ্রান্তির পুনরাবৃত্তির দিকে অগ্রসর হন। এখন যুক্তরাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাবেক কর্মকর্তা অর্থনীতিবিদ ল্যারি সামার্স পর্যন্ত এমন সতর্কতা উচ্চারণ করছেন যে একটা দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।
আধা দশক আগে আমি যে বিষয়টি উত্থাপন করেছিলাম, তার মূল কথাটি ছিল মৌলিক অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি রুগ্ণ হয়ে পড়েছিল, এমনকি সংকট শুরু হওয়ার আগেই। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি হয়ে উঠেছিল একটা সম্পদ-মূল্যের বুদ্বুদ, যা সৃষ্টি হয়েছিল শিথিল ব্যবস্থাপনা/নিয়ন্ত্রণ ও সুদের নিম্ন হারের কারণে। এ দুয়ের ফলে অর্থনীতিটাকে বেশ হূষ্টপুষ্ট দেখাচ্ছিল। কিন্তু উপরিতলের নিচে, ভেতরে ভেতরে অসংখ্যা সমস্যা ঘনিয়ে উঠছিল। যেমন, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য আরও বেড়ে চলেছিল, কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছিল না (কলকারখানায় উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সেবামুখী অর্থনীতির দিকে যাওয়া, বৈশ্বিক পরিসরে তুলনামূলক সুযোগ-সুবিধাগুলোর পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা); দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক ভারসাম্যহীনতা; এমন এক আর্থিক ব্যবস্থা, যেখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং সামাজিক কল্যাণ বাড়ানোর লক্ষ্যে উদ্বৃত্ত সম্পদের পুনর্ব্যবহার করার পরিবর্তে ফাটকা বাজারি অধিকতর সুবিধাজনক।
সেসব সংকটের ব্যাপারে নীতিনির্ধারকেরা যা করেছেন, তাতে সংকট মেটেনি। আরও খারাপ কথা হলো, তাঁদের কৃতকর্মের ফলে কিছু সংকট তীব্রতর হয়েছে, নতুন আরও কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ফলে, অনেক দেশের জিডিপিতে ধস নেমে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গিয়েছে এবং তাদের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। উপরন্তু, সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার ফলে এমন এক তরুণ প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছে, যারা বছরের পর বছর কর্মহীন অলস দিন পার করেছে এবং জীবনের একটা পর্যায়ে উৎপাদনক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে; অথচ তাদের তখন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা কাজে লাগানোর সময়।
আটলান্টিকের উভয় পারে ২০১৩ সালের তুলনায় সামনের দিনগুলোতে জিডিপি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব নেতা কৃচ্ছ্রসাধনের নীতিকে আলিঙ্গন করেছিলেন, তাঁরা এবার উল্লাসে শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে পারেন। কিন্তু সেটা করতে যাওয়ার আগে তাঁদের ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত এখন আমাদের অবস্থা কী; তাঁদের গৃহীত সেসব নীতির ফলে যে প্রায়-অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
প্রত্যেক নিম্নমুখী প্রবণতাই একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়। এ রকম ক্ষেত্রে একটা ভালো নীতি হয় সেটাই, যা গ্রহণের ফলে সেই নিম্নমুখী প্রবণতা বেশি গভীরে যেতে পারে না এবং বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে না। যেসব দেশের সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করেছিল, সেসব দেশে অর্থনীতির নিম্নমুখী প্রবণতা অনেক গভীর পর্যন্ত গেছে এবং বেশি দীর্ঘ হয়েছে, যার পরিণতিগুলো হবে দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু এ রকম হওয়া অনিবার্য ছিল না।
উত্তর আটলান্টিকের অধিকাংশ দেশে ২০০৭ সালে মাথাপিছু প্রকৃত (মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয়কৃত) জিডিপি ছিল বেশ কম; গ্রিসে অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে সফল অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে ছয় বছর ধরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সংকটের আগে যে সামান্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছিল, তা অব্যাহত থাকলে আজ এ অর্থনীতির যে আকার দাঁড়াতে পারত, এখন তার থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ ছোট এ অর্থনীতি।
কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে এসব পরিসংখ্যানে প্রকৃত চিত্রটা ফুটে ওঠে না; কারণ সাফল্য পরিমাপের ভালো সূচক জিডিপি নয়। গৃহস্থালির আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে কী ঘটছে, সেটা বরং অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। সিকি শতক আগে, ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৃত গৃহস্থালি আয় (মিডিয়ান রিয়্যাল ইনকাম) যা ছিল, এখন তার থেকে কম; আর আজ থেকে ৪০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে একজন সার্বক্ষণিক পুরুষ শ্রমিকের আয় (মিডিয়ান ইনকাম) যা ছিল, এখন তার থেকে কম।
অর্থনীতিবিদ রবার্ট গর্ডনের মতো কেউ কেউ বলেছেন, বিগত শতাব্দীজুড়ে দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন প্রবৃদ্ধির যে হার ছিল, তার থেকে যথেষ্ট কম প্রবৃদ্ধি হবে—এমন এক নতুন বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। অর্থনীতিবিদদের কর্মকাণ্ডের শোচনীয় রেকর্ড—যা কিনা ২০০৮ সালের সংকটের প্রাক্কালে ফুটে উঠেছিল—তিন বছরের পূর্বাভাস সত্ত্বেও এমন আস্থা বোধ করা উচিত হবে না যে, কেউ বলতে পারেন ভবিষ্যতের দশকগুলোতে কী ঘটবে। কিন্তু এটা পরিষ্কার বলেই মনে হয়: সরকারের নীতিগুলো পরিবর্তন করা না হলে আমরা সুদীর্ঘ সময় ধরে নৈরাশ্যব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যেই থেকে যাব।
বাজারের এমন শক্তি আছে যে তা নিজেই নিজেকে শুধরে নিতে পারে। কিন্তু আমি ওপরে যে অন্তর্নিহিত মৌলিক সমস্যাগুলোর কথা বললাম, সেগুলো খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। অনেক সমস্যার ইতিমধ্যে আরও অবনতি ঘটে গেছে। অসমতার ফলে চাহিদা দুর্বল হয়ে যায়; অসমতার বিস্তার ঘটলে চাহিদা আরও বেশি দুর্বল হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ দেশে অর্থনৈতিক সংকটের ফলে অসমতা শুধুই বেড়েছে।
উত্তর ইউরোপে বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনকি চীনেরও কিছুটা বেড়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাজারগুলোর অবস্থা কখনোই এত ভালো হয়নি যে সেগুলো আপনা থেকেই কাঠামোগত রূপান্তর দ্রুত অর্জন করতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কৃষি থেকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিকে যাত্রা কখনোই মসৃণ হয়নি। উল্টো বরং এই রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সামাজিক স্থানচ্যুতি ও মহা মন্দা ঘটেছে।
এবারও ভিন্ন কিছু ঘটছে না; বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা আরও খারাপ হতে পারে। যেসব খাতে প্রবৃদ্ধি ঘটা উচিত, যেগুলোতে নাগরিকদের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে, সেগুলো হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সেবা খাত। এই সেবা খাতগুলো ঐতিহ্যগতভাবে অর্থ বরাদ্দ পেয়ে এসেছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে এবং তা যুক্তিসংগত কারণেই। কিন্তু সরকার এসব খাতে রূপান্তরকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত করছে।
অর্থনীতিতে পশ্চাদপসরণ বা মন্দনের থেকে রুগ্ণতা বা ব্যাধি বরং ভালো। কিন্তু আমরা এখন যেসব সমস্যার মুখোমুখি, সেগুলো অর্থনীতির অনিবার্য, অমোঘ নিয়মকানুনের ফল নয়। ভূমিকম্প বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর সঙ্গে আমরা যেভাবে খাপ খাইয়ে চলি, এই সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রেও আমাদের তা-ই করা উচিত। এগুলো মোকাবিলা করা অতীতের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার মতোও নয়; যদিও নিশ্চিত করে বলতে গেলে, গত তিন দশকজুড়ে যে নয়া-উদারপন্থী নীতিগুলো প্রাধান্য চলে এসেছে, আজকের অবস্থার জন্য সেগুলোর দায় বিরাট।
আমাদের চলমান সমস্যাগুলো ভুল নীতিমালার ফল। বিকল্প আছে। কিন্তু যেসব অভিজাত লোকের আয় বেড়ে চলেছে, যারা আবার শেয়ারমার্কেটে ফুলেফেঁপে উঠছে, তাদের আত্মতুষ্টির মধ্যে আমরা সেই বিকল্পগুলো খুঁজে পাব না। শুধু যা ঘটবে তা হলো, জীবনযাত্রার আরও নিম্নমানের সঙ্গে স্থায়ীভাবে খাপ খাইয়ে নিতে হবে কিছু মানুষকে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই কিছু মানুষই হলো অধিকাংশ মানুষ।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারে ভূষিত মার্কিন অর্থনীতিবিদ; যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক।
No comments