সুস্থ বিবেকের বিদ্রোহ by উইলিয়াম বি মাইলাম
মন্দের জয়ের জন্য শুধু যা প্রয়োজন তা হলো ভাল মানুষের নীরব ভূমিকা। কথাটি এডমান্ড বার্কের মুখনিঃসৃত বলে বহুল প্রচলিত হলেও তিনি আদৌ এমন কিছু বলেছেন তেমন সম্ভাবনা কম। তবে চরম সত্য হলো, এ শব্দগুলো গত ৩২৫ বছরের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানকে ঘিরে রেখেছে।
এ সময়ের মধ্যে, কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে উত্থান হয়েছে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থার। মানব ইতিহাসের বেশির ভাগ সময়ই প্রচলিত ছিল কর্তৃত্ববাদী শাসন। ১৬৮৮ সালে ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ রাজনৈতিক রূপান্তরের সূত্রপাত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাজা ও দেশের কর্তৃত্বের ওপর ওই বছর সংসদীয় সীমারেখা দেয়ার অবধারিত কারণ ছিল ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা। সমাজের অভিজাতরাই ছিলেন তার রূপকার। কিন্তু বৃহৎ কিছুর সূত্রপাত হয় ক্ষুদ্র। ক্ষমতার ওপর অভিজাতদের শক্ত হাতকে নড়বড়ে করার জন্য আর তাদের ক্ষমতাকে ভাগাভাগি করার জন্য শতকের পর শতক ধরে নানা দেশের ভাল মানুষরা শাসক দলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তাদের সফলতার সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো সার্বিকভাবে সমগ্র সমাজের স্বার্থ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বমূলক ভূমিকা পালন করেছে। অন্য কথায়, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা অভিজাত সমপ্রদায়ের প্রতিনিধিই নয়, অন্তর্ভুক্ত থেকেছেন সমাজের অন্য অংশের প্রতিনিধিরা। যারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় মতপ্রকাশের দাবি করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সামাজিক ঐক্যবদ্ধতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। ১৬৮৮ সালের পর রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ঘটনা অনেকটা নিয়মিত হয়ে যায়। বার্ক ১৭৬৫-১৭৮৩ সালের মার্কিন অভ্যুত্থানকে পছন্দ করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ পরিশেষে অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক এক সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পক্ষান্তরে, তিনি ফরাসি অভ্যুত্থান পছন্দ করেননি। একভাবে বা অন্যভাবে সেখানে কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত ছিল। এটাই হয়তো তার অপছন্দের কারণ। প্রায় ৮০ বছর শোষণমূলক শাসনব্যবস্থা থাকার পর ফ্রান্সে অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বার্কের লেখায় বুদ্ধিবৃত্তিক নানা বিসদৃশের আধিক্য থাকলেও আমি মোটামুটি নিশ্চিত, তিনি বিংশ শতাব্দীর তথাকথিত অভ্যুত্থানকে তিরষ্কার করতেন। ১৯১৭ সালের রাশিয়ান অভ্যুত্থান এবং ২০ ও ৩০-এর দশকে নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট অভ্যুত্থানগুলো ধীরে ধীরে ঘটেছিল পর্দার অন্তরালে। এসব অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে সংখ্যালঘুরা। সেটা কখনও নির্বাচনের পর হয়েছে, কখনও বা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাচীন শাসনব্যবস্থার পতনের পর। আর জনপ্রিয় সমর্থনের অভাবে তারা তাদের অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছে বক্তৃতাবাজি, দমননীতি, ভাবাদর্শিক অনুশাসন এবং বিকৃত ইতিহাস দিয়ে। প্রায়ই এ প্রক্রিয়ায় বলির পাঁঠা হয়েছে নির্দিষ্ট কোন গ্রুপ। তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে তারা প্রায়ই গণহত্যা পরিচালনা করতো। গণতন্ত্র নিয়ে বার্কের দ্ব্যর্থকতা সত্ত্বেও তার রাজনৈতিক লেখার মধ্যে অন্তর্নিহিত একটি ধারা বিদ্যমান- সব অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে তিনি সর্বাধিক বিপজ্জনক যে দিকটি লক্ষ্য করেছেন, সেটা হলো বেপরোয়া ক্ষমতার অধিকারী কর্তৃত্ববাদী, দমনমূলক কোন সরকার উত্থানের আশঙ্কা। ১৭৭০ সালে বার্কের একটি গবেষণামূলক আলোচনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল, ‘আমাদের বর্তমান অসন্তোষের কারণগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা’ (থটস অন দ্য কজেস অব আওয়ার প্রেজেন্ট ডিসকনটেন্ট)। এতে তিনি রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতার বিষয়ে শক্ত সীমারেখা নির্দিষ্ট করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন এবং সরকারের ক্ষমতা অপব্যবহার প্রতিহত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, যখন অসাধু ব্যক্তিরা একত্রিত হয়, তখন সততাপরায়ণ ব্যক্তিদের মধ্যেও ঐক্য গড়ে ওঠা উচিত। তা না হলে তারা সবাই একের পর এক ঝরে পড়বে, যা হবে অবজ্ঞার এক সংগ্রামে করুণার অযোগ্য ত্যাগ। এ শতাব্দীতে বিপ্লব ঘটেছে প্রধানত ইসলামি দুনিয়ায়। এসব বিষয়ে বার্ক-এর অনুভূতি কেমন হতো তা বলা কঠিন। তবে আমাকে এটা আহত করে, নিচু স্তর থেকে উঠে আসা এসব মানুষকে প্রথমেই তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। যখন গণজাগরণ শুরুর বিষয়টিকে দৃশ্যত কিছু সুসংগঠিত, আদর্শপুষ্ট গ্রুপ নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্টা করে তখন নিশ্চিতভাবে তাকে উদ্বিগ্ন হতে হয়। পাশাপাশি দেখা দেয় অভিজাত শ্রেণীর কিছু থারমিডোরিয়ান প্রতিক্রিয়া। (সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফরাসি বিপ্লবে এ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল)। সুসংগঠিত গ্রুপগুলো প্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে রয়েছে।
পর্দার আড়ালে বিপ্লব ঘটানোর বিষয়ে তিনি অধিক উদ্বিগ্ন হতেন- এটা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এ ক্যাটিগরিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে নিকৃষ্ট পর্যায়ে। দৃঢ়ভাবে বলা যায়, এটি একটি নিখুঁত কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। একদলীয় একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে একদলীয় রাষ্ট্র। প্রধান বিরোধী দল একই সঙ্গে বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতায় বিশৃঙ্খল। তাদের বিশৃঙ্খল করতে ভূমিকা রেখেছে বিরোধী দল, ভিন্নমতাবলম্বী ও বলির পাঁঠা হওয়া ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের দমন-পীড়ন। সুশীল সমাজ বিভক্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত। সংঘাতের মধ্য দিয়ে জন্ম হওয়া এ দেশটির ইতিহাস নতুন করে লিপিবদ্ধ করেছে সরকার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। অবশ্যই এটা একটি বার্কিয়ান পরিস্থিতি। সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি একজনের পর একজন ঝরে পড়তে না চান, তাদের অবশ্যই একত্রিত খারাপ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিদের থামাতে একত্রিত, সংগঠিত হতে হবে। ইসলামিক বিশ্বে একসময় রাজনীতি ও সামাজিকতাকে আধুনিকায়ন করার জন্য ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু সেই বাংলাদেশ এখন দুর্নীতি, বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ে কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্রের তালিকায় যোগ হবে। এমন কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্রের তালিকায় স্থান পাওয়া দেশ অনেক। যদি সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ অলস থাকেন তাহলে বাস্তবিকই আধুনিকায়ন হারিয়ে যেতে থাকবে।
উইলিয়াম বি মাইলাম বাংলাদেশ, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি ওয়াশিংটনে উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার-এর সিনিয়র পলিসি স্কলার। তিনি ক্যারিয়ারের দিক থেকে একজন কূটনীতিক। ২০০১ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে তিনি অবসরে যান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে। ফের ১১ই সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানে পুনর্গঠনে তার ডাক পড়ে। তিনি লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
পর্দার আড়ালে বিপ্লব ঘটানোর বিষয়ে তিনি অধিক উদ্বিগ্ন হতেন- এটা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এ ক্যাটিগরিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে নিকৃষ্ট পর্যায়ে। দৃঢ়ভাবে বলা যায়, এটি একটি নিখুঁত কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। একদলীয় একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে একদলীয় রাষ্ট্র। প্রধান বিরোধী দল একই সঙ্গে বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতায় বিশৃঙ্খল। তাদের বিশৃঙ্খল করতে ভূমিকা রেখেছে বিরোধী দল, ভিন্নমতাবলম্বী ও বলির পাঁঠা হওয়া ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের দমন-পীড়ন। সুশীল সমাজ বিভক্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত। সংঘাতের মধ্য দিয়ে জন্ম হওয়া এ দেশটির ইতিহাস নতুন করে লিপিবদ্ধ করেছে সরকার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। অবশ্যই এটা একটি বার্কিয়ান পরিস্থিতি। সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি একজনের পর একজন ঝরে পড়তে না চান, তাদের অবশ্যই একত্রিত খারাপ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিদের থামাতে একত্রিত, সংগঠিত হতে হবে। ইসলামিক বিশ্বে একসময় রাজনীতি ও সামাজিকতাকে আধুনিকায়ন করার জন্য ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু সেই বাংলাদেশ এখন দুর্নীতি, বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ে কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্রের তালিকায় যোগ হবে। এমন কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্রের তালিকায় স্থান পাওয়া দেশ অনেক। যদি সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ অলস থাকেন তাহলে বাস্তবিকই আধুনিকায়ন হারিয়ে যেতে থাকবে।
উইলিয়াম বি মাইলাম বাংলাদেশ, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি ওয়াশিংটনে উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার-এর সিনিয়র পলিসি স্কলার। তিনি ক্যারিয়ারের দিক থেকে একজন কূটনীতিক। ২০০১ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে তিনি অবসরে যান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে। ফের ১১ই সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানে পুনর্গঠনে তার ডাক পড়ে। তিনি লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
(নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাকিস্তানি সংস্করণ দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে প্রকাশিত উইলিয়াম বি মাইলামের লেখা ‘দ্য গুড ওয়ানস রিভোলটেড’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ। গতকাল এটি প্রকাশিত হয়।)
No comments