বিশেষ সাক্ষাৎকার- আফগানিস্তানে তালেবানের প্রভাব আর নেই: নাজেস আফরোজ by মশিউল আলম ও এ কে এম জাকারিয়া
নাজেস আফরোজের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের
বর্ধমান শহরে, ১৯৫৮ সালে। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৯৭৯ সালে
রসায়নশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর এক বছর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন।
১৯৮১ সালে কলকাতার দৈনিক আজকাল পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন।
১৯৯৮
সালে বিবিসি বাংলা বিভাগে প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন। ২০০১ সালে বিবিসি
ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে কাজ শুরু করেন প্রযোজক হিসেবে। ২০০৬ সালে বিবিসি
ওয়ার্ল্ডের সাউথ এশিয়া ব্যুরোর এক্সিকিউটিভ এডিটর হন। ২০১১-১২-তে তিনি
এডিটর ইন্টারন্যাশনাল অপারেশন্স-এর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে চাকরি
ছেড়ে দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। নাজেস আফরোজ একজন আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ।
প্রথম আলো আপনি তো দীর্ঘ সময় ধরে আফগানিস্তানে যাওয়া-আসা করেছেন এবং সাংবাদিক হিসেবে সে দেশের খোঁজখবর রাখেন। দেশটির অবস্থা এখন কেমন?
নাজেস আফরোজ ২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর আফগানিস্তানের যে চেহারা ছিল, এখন তার সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাত।
প্রথম আলো ভালো না খারাপ?
নাজেস আফরোজ অনেক ভালো। ২০০২ সালে গোটা কাবুল শহরের যে ভগ্নদশা ছিল, আজকে সেই জায়গাগুলো ঘুরেফিরে দেখলে শহরটাকে চেনাই যায় না। জমির দাম, বাড়িভাড়া অনেক বেড়েছে। অবশ্য এর একটা কারণ, অনেক আন্তর্জাতিক এনজিও সেখানে কাজ করছে, প্রচুর বিদেশি লোক থাকে। এসব কারণে একটা ফলস ইকোনমি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেটাকে যদি বাদও দিই, তবু কাবুলের অনেক উন্নতি হয়েছে। শুধু কাবুল নয়, আমি হেরাত, মাজারে শরিফ, জালালাবাদ, কান্দাহার—যেখানেই গেছি, সবখানেই অনেক উন্নতি চোখে পড়েছে।
কাবুল শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে একটা ছোট্ট গঞ্জমতো আছে চারিকার নামে। চারিকার মানে চৌরাস্তা, চারটি প্রধান সড়ক সেখানে মিলিত হয়েছে। ২০০৩ সালে সেই চারিকারে দেখেছিলাম খুব দীন দশা, দু-চারটি দোকানপাট ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। প্রায় ১০ বছর বাদে আমি আবার সেই চারিকারে গেলাম। দেখলাম, গমগম করছে প্রাণবন্ত একটা শহর। বোঝা গেল যে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য দেখতে পাবেন। চাষবাস হচ্ছে।
প্রথম আলো নিরাপত্তা পরিস্থিতি কেমন?
নাজেস আফরোজ নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, এ কারণে যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় আক্রমণ হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সেটার প্রতিফলন একদমই চোখে পড়ে না। কারণ, তালেবান ও অন্যান্য বিদ্রোহী, জঙ্গিগোষ্ঠী আক্রমণ চালায় সরকারি লোকজন ও স্থাপনার ওপর এবং বিদেশিদের ওপর। সাধারণ মানুষ তাদের আক্রমণের শিকার হয় না। সেই কারণে নিরাপত্তার উদ্বেগটা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে দৃশ্যমান নয়।
প্রথম আলো কিন্তু আমরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আফগানিস্তানের যে চিত্র পাই, সেটা তো একেবারেই উল্টো।
নাজেস আফরোজ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের হয়ে কাজ করতে যাঁরা আফগানিস্তানে যান, তাঁদের বেশির ভাগই ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ। গায়ের রঙেই তাঁদের আলাদা করে চেনা যায়। তাঁদের যাতায়াতের ওপর অনেক বিধিনিষেধ থাকে, তাঁদের প্রতিষ্ঠানই সেটা তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থে করে। আমি নিজেও বিবিসিতে কাজ করার সময় সেটা দেখেছি। তাঁরা যদি রাস্তাঘাটে না বেরোন, গ্রামগঞ্জে না যান, তাহলে প্রকৃত চিত্রটা পাবেন কী করে? সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় যে নিরাপত্তাহীনতার প্রভাব পড়ছে না, সেটা তো তাঁদের দেখতে হবে। বছর দেড়েক আগে আমি আমার আফগান বন্ধু-সহকর্মীর বাড়িতে গিয়ে থেকেছি—মাজারে শরিফে। সেখান থেকে একটা ছোট্ট ভাঙা গাড়িতে করে বাল্ক শহর পর্যন্ত গেছি, সেখানে রাস্তার মধ্যে ছবি তুলেছি। আমার সহকর্মীরা গাড়িতে করে মাজারে শরিফ চলে যায়, ১২ ঘণ্টা লাগে। অবশ্য কান্দাহারের সড়কটা নিরাপদ নয়; এ রকম আরও কিছু রাস্তা আছে, যেগুলো নিরাপদ নয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আফগানিস্তান নিয়ে যাঁরা লেখেন, তাঁদের সিংহভাগই পশ্চিমা; সেখানে তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার শঙ্কাটা খুব বেশি। সেই শঙ্কা তাঁদের লেখালেখিতে প্রতিফলিত হয়।
প্রথম আলো আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সেনাবাহিনী এ বছর চলে গেলে দেশটিতে আবার তালেবান ফিরে আসতে পারে বলে উদ্বেগের খবর আমরা পাই। আপনার কী মনে হয়?
নাজেস আফরোজ তিন ধরনের সম্ভাবনা আছে। একটা হচ্ছে, এই সরকারের পতন ঘটবে, তালেবান ক্ষমতা নিয়ে নেবে। দুই নম্বর হচ্ছে, আলোচনা হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিন নম্বর হচ্ছে, একটা মাঝামাঝি অবস্থা থাকবে। অর্থাৎ, একটা সরকার থাকবে এবং মাঝারি থেকে নিম্ন মাত্রায় বিদ্রোহ চলতে থাকবে। আমার ধারণা, এই শেষের সম্ভাবনাটাই বেশি।
প্রথম আলো সে অবস্থায় বাইরের শক্তিগুলোর ভূমিকা কেমন হতে পারে? বিশেষত পাকিস্তানের?
নাজেস আফরোজ আফগানরা মনে করে, পাকিস্তানের ভূমিকা নেতিবাচক; তাদের কাছে পাকিস্তানের প্রভাব, তাদের উপস্থিতি কাম্য নয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অভিজাত পর্যন্ত, গোত্রনির্বিশেষে আফগানিস্তানের সব মানুষ এটা মনে করে। আর পাকিস্তান যে আফগানিস্তানে প্রভাব রাখতে চায়, সেটা খুব পরিষ্কার। পাকিস্তান খোলাখুলি সেটা বলেছেও। পাকিস্তানের আশঙ্কা হচ্ছে, আফগানিস্তানে ভারতীয় প্রভাব খুব বেশি। ভারত খুব বুদ্ধি করে সেখানে প্রভাব বাড়িয়েছে। ভারত আফগানিস্তানের পঞ্চম বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় দাতাদেশ। ভারত আফগানিস্তানকে দুই বিলিয়ন ডলার দিয়েছে; রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল বানিয়েছে, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বানিয়ে দিচ্ছে, চিশত শহরের কাছে একটা বড় হাইড্রোইলেকট্রিক বাঁধ তৈরি করছে। আফগান পার্লামেন্টের নতুন ভবন তৈরির পুরো ব্যয় দিয়েছে ভারতীয় সরকার। এখন আফগান সরকার ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চাইছে। এটা পাকিস্তানকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। আর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করে তার সেনাবাহিনী, যার অনেক বড় বড় অফিসার একাত্তর সালকে ভুলতে পারেননি। এমনিতেই পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্তে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা আছে, কাশ্মীর নিয়ে তারা কিছু করতে পারেনি। এর ওপর আফগানিস্তানে যদি ভারতের প্রভাব বাড়ে এবং সামরিক সহযোগিতাও যুক্ত হয়—এটা নিয়ে তারা ভীষণ উদ্বিগ্ন।
প্রথম আলো আমেরিকার ভূমিকাও তো নেতিবাচক হতে পারে। কারণ, আমরা দেখেছি, আফগান সরকারকে এড়িয়ে তারা তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
নাজেস আফরোজ আমার ধারণা, আমেরিকানরা খুব ভেবেচিন্তে তালেবানের সঙ্গে কথা বলেছে, তা নয়। আফগানিস্তান বা ইরাকের যুদ্ধ আমেরিকার জনগণের কাছে ভীষণ অজনপ্রিয় হয়ে গেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো অত সেনা মারা না গেলেও গত ১২ বছরে চার-পাঁচ হাজার সেনা মারা গেছে, আট-দশ হাজার আহত হয়েছে, প্রচুর টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর মধ্যে ২০০৮ সাল থেকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। ফলে, এ প্রশ্ন আমেরিকার ভেতরেই উঠছে যে আমরা ওখানে কী করছি? আবার সব ছেড়েছুড়ে চলেও যেতে পারছে না, কারণ তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে আফগানিস্তানে তারা একটা স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে দিয়ে যাবে। সে জন্য তারা সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনা করে একটা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সম্প্রতি তারা কাতারে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমেরিকানরা আশা করেছিল, তালেবান অন্তত তিনটি জিনিস করবে: আফগানিস্তানে যে সংবিধান তৈরি করা হয়েছে, সেটি মেনে নেবে, হামিদ কারজাইয়ের সরকারকে স্বীকৃতি দেবে এবং তালেবান বলবে যে আফগানিস্তানের ভূমিতে তারা কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে জায়গা দেবে না। কিন্তু তালেবান এই তিনটির কোনোটিতেই রাজি হয়নি। সে জন্য আমেরিকার সঙ্গে তালেবানের আলোচনা ভেঙে গেছে।
প্রথম আলো সামাজিক দিক থেকে আফগানিস্তানে গত ১০-১২ বছরে আপনি কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করেছেন?
নাজেস আফরোজ পরিবর্তন হচ্ছে খুব ধীরে। কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছে। যারা লেখাপড়া করছে, তাদের মধ্যে নতুন ভাবনাচিন্তা আছে। প্রায় ৫০ লাখ আফগান বহু বছর শরণার্থী হিসেবে অন্যান্য দেশে বাস করেছে, তারা এখন ফিরে আসছে। কিছু নতুন ভাবনা তারাও নিয়ে আসছে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ হাজার ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে, তাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ মেয়ে। হেরাত খুবই ছোট শহর, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মেয়ে। আফগানিস্তানে আট-দশটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে বেশ কয়েকটা। কাবুল শহরে কারদান ইউনিভার্সিটি নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ১০ হাজার ছাত্রছাত্রী। তাদের অনেকে পেশাজীবী; সারা দিন কাজ করে, রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করে। ফলে, সামাজিক দিক থেকেও পরিবর্তন আসছে।
প্রথম আলো সমাজে, সাধারণ মানুষের মধ্যে তালেবানের প্রভাব কেমন?
নাজেস আফরোজ ১৯৯৪ সালের দিকে তালেবান যখন আসে, যখন জনগণ তাদের সমর্থন করেছিল। কিন্তু আজকে তাদের প্রতি সমর্থন ১ শতাংশও নেই। যেসব জায়গা তারা এখনো নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলোতে তাদের অস্ত্র হচ্ছে ভীতি। ১৯৯৪ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান জনসাধারণের ওপর যে অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে, সেটা মানুষের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। এ কারণে একটা আতঙ্ক এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু তালেবানের প্রভাব তেমন নেই। মানুষের মন থেকে ভীতিটা কেটে গেলে তালেবানের মিথ ভেঙে যাবে। গণতন্ত্র ও ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা তৈরি হলে তালেবানের ভীতিটা দূর হবে। গজনি শহর ও উত্তরের কয়েকটা জায়গায় স্থানীয় জনগণ তালেবানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে; মেরে বের করে দিয়েছে। আফগানিস্তানের লোকসংখ্যা তিন কোটি, এর ১ শতাংশও যদি তালেবানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তালেবানের কিছু করার থাকবে না।
প্রথম আলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
নাজেস আফরোজ ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম ও এ কে এম জাকারিয়া
No comments